অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার
অপাঙ্ক্তেয়
আকাশ মামুনপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৮
রাতের নীরবতা ভেঙে একটানা গোঙানির আওয়াজ বাইরের অসহ্য রকম অন্ধকারকে একটা আকার দিতে চেষ্টা করছে। ভিতরে আলো বলতে হলদে সোডিয়াম বাতির টিমটিম জ্বলতে থাকা। মেঘাচ্ছন্ন রাতে ভরাপূর্ণিমাকে মেঘ গ্রাস করলে যেমন জ্যোৎসনা ম্লান হয়ে যায়, তেমনি বড় হলরুমের অন্ধকার সোড়িয়াম বাতিকে জাপটে ধরে ম্লান করে দিয়েছে। তবুও নিজস্ব আভাটুকু নিয়ে জেগে আছে। কিন্তু জেগে থাকতে পারছে না গোঙানিটা। নিস্তেজ হতে হতে দূরে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে যেন। দুরন্ত ট্রেনের হুইসেল দূরে যেতে যেতে যেমন মিলিয়ে যায়, তেমনি ধীরলয়ে মিলিয়ে গেল গোঙানিটা।
মুখে পানির ঝাপটা পেয়ে চোখ মিটমিট করতে করতে চোখের পাতা খুলতেই অকস্মাৎ একটা ধাক্কা খেল। দুর্বল শরীর আর ততোধিক দুর্বল মনে নিয়ে চোখ খুলতে গিয়ে আলোর ধাক্কায় চোখের চারপাশে বলিরেখা ফুটে চোখ কুচকে গেল। কয়েক বারের চেষ্টায় আধোবোজা চোখে যা ভেসে উঠলো তাতে চোখ খোলার আগ্রহটাই মরে গেল। কপালে ভাঁজ নিয়ে বলি রেখা ভেসে উঠা, আগ্রাসী চোখ আর মুখে বেমানান উদ্দেশ্যপ্রবণ কাঠিন্য নিয়ে নিঃশ্বাস দূরত্বে ঝুঁকে আছে লোকটা। চট করে চোখ বুজে এলো। প্রাণপণে চোখ খুলতে চাওয়ার মানষিক চেষ্টাটা ঠিক যেভাবে জেগে উঠেছিল সেভাবেই দমে গেল। ঝিঁম মেরে পড়ে রইলো সেহেরা বেগম।
এই অভিজ্ঞতা যে প্রথম, তা নয়। তবে নিপীড়নের তীব্রতার অভিজ্ঞতাটা একেবারেই প্রথম। মাদকদ্রব্য পাচারের অভিযোগে আগেও বারতিনেক গ্রেফতার হয়েছে সেহেরা বেগম। প্রতিবারই লিডারের লোক এসে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে। এবারই প্রথম নয় দিন হতে চললো গ্রেফতার হয়ে হাজতে আছে। দুর্ভাগ্য লিডার নিজেও গ্রেফতার হয়ে আইনের আশ্রয়ে আছেন। আদালত লিডারের জামিন না মঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। এই দুর্দশা যে কবে কাটবে বা আদৌ কাটবে কীনা, সহসাই বলা যাচ্ছে না। হয়তো জেলেই কেটে যাবে বাকি জীবন। কেউ খোঁজ নিতেও আসবে না। অবশ্য খোঁজ নেয়ার বিশেষ কেউ নেইও। যারা আগে খোঁজ নিতো তারা স্বার্থের কারণে, পাচার চক্রের স্বার্থে। এখন তারাও হয়তো অনিশ্চয়তায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ সেহেরার মতোই হয়তো জেলহাজতে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
তীব্র পানির ঝাপটায় গুঙিয়ে উঠল সেহেরা। হাত টেনে চেয়ারের পিছনে বাঁধা, কাত হওয়া ঘাড় ঝুঁকে উঠলো। হা হওয়া মুখে লালা ঝরছে। লাঠি দিয়ে থুতুনি উপরের দিকে তুলে শ্যোন দৃষ্টিতে চোখে চোখ রেখে কর্কশ গলায় তদন্ত কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলো, আসল পরিচয় বল। মুসলিম না অন্য ধর্মের? মাথা নিচু করেই সেহেরা উত্তর দিলো, অফিসার পুরুষ হলে প্রমাণ করতে পারতেন, আমি যা বলেছি তা সত্যি। চুলটা মুঠো করে ধরে খিস্তি দিয়ে অফিসার বলে উঠলো, মাগী বাঁচতে যদি চাস তবে আসল পরিচয় বল। নয়তো এমন মার খাবি সারা জীবন আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবি না। ঢোঁক গিলে প্রাণশক্তি সঞ্চার করে সেহেরা বললো, বলেছি তো, খাড়াংখালীর সেহেরা বেগম। বলেই, হাঁপাতে লাগলো। রক্ত মেখে রাঙা হওয়া ঠোঁটের কোণ বেয়ে লালা ঝরেই চলছে। এবার আরো তীব্রভাবে হেঁচকা টানে মাথাটা পিছনের দিকে টেনে নিয়ে অফিসার বলে উঠলো, ধোকা দিতে পারবি না মাগী। ১৫ বছর এই লাইনে আছি। তোকে দেখেই বুঝেছি রোহিঙ্গা। বল, কোথা দিয়ে ঢুকেছিস? কবে এসেছিস, কার হয়ে কাজ করিস? অফিসার বলেই চলছিল। শেষ হওয়ার আগেই আবার মূর্চ্ছা গেল সেহেরা।
ভিতরের অন্ধকার দেখে বোঝার উপায় নেই এখন দিন না রাত। ঘড়ির কাঁটা ছাড়া বলা সম্ভব নয়। তবে তিন দিনেই সেহেরা বুঝে গিয়েছে, কখন রাত, কখন সকাল আর কখন দুপুর। খাবার দিয়ে যাওয়া দেখে সেহেরা অনুমান করে নেয়। তবে এখন দিন না রাত সেটা বলা সম্ভব নয়। একই রকম অন্ধকার। নীরবতা। দীর্ঘ সময় ঘুমিয়েছে মনে হচ্ছে। হয়তো আরও একটু ঘুমিয়ে নিতো। শীতানুভবে হঠাৎ করেই জেগে গেছে। হাত দুটোকে দু উরুর মাঝখানে রেখে হাঁটু ভাঁজ করে বুকের কাছে নিয়ে এসে জড়োসড়ো হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। শেষবার মূর্চ্ছা যাওয়ার পর আর কিছু মনে করতে পারছে না সেহেরা। তবে এখন দুর্বল লাগলেও আদরমাখা শীতে একটু সতেজ লাগছে। বুকের কাছ অব্দি ভাঁজ হয়ে চলে আসা হাঁটু দুটি আরও একটু টেনে বুকের কাছে এনে হাত সমেত শরীরটাকে একটু মুচড়িয়ে নিতে গিয়ে দেখলো, সারা শরীর ব্যথা করছে। দাঁতে দাঁত চেপে কোনও রকমে বার দুয়েক ঢোঁক গিলে চোখ বুজে অনড় পড়ে রইলো সেহেরা। ক্ষুধাটা বেশ চড়ছে মনে হলো। ঠোঁটের কোণ ছিলে গিয়ে রক্তের দাগ শুকিয়ে জায়গাটা টনটন করছে। একটু টান পড়তেই কোত করে শব্দ করে উঠলো সেহেরা। আচমকা মনে পড়লো মূর্চ্ছা যাওয়ার আগে তদন্ত কর্মকর্তার কথা। আগের দিন তদন্ত কর্মকর্তা ক্রস ফায়ারে দেবে বলেছিল। সেহেরা পরোয়া করে না। এতবছর যে বেঁচে আছে এটাই আশ্চর্য। পরজনমে তার বিশ্বাস নেই। তবু মনে হচ্ছে যেন নতুন করে জন্ম নিয়েছে। আশা করেনি। আশা করার মতো পরিস্থিতিও ছিল না। বছর চব্বিশেক আগে বুচিডং এর কাছে মারমাখালী থেকে উখিয়ার উনচিপ্রাণ পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছিল সেহেরা। আসার সময় আরাকানের জাতিগত দাঙ্গায় স্বামী আর তিন বছরের সন্তানকে চোখের সামনে খুন হতে দেখেছে। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, কথা বলার ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটাই ছিল না। শোকে যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। সাত দিন পালিয়ে বেড়িয়ে উখিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢেকার সময় যেন সে সম্বিৎ ফিরে পায়। জীবন থেকে কিছু একটা যে হারিয়ে গিয়েছে, জীবন যে শূন্য হয়ে গিয়েছে, সেটা তখনই প্রথম অনুভব করতে পারে। নাফ নদীর পাড়ে ভাসতে দেখে এক শিশুর লাশ। উপুড় হয়ে পড়ে যেন এই পৃথিবীর নির্মতাতা থেকে মুখ লুকাতে চাইছে। এই লজ্জা, এই দায়ভার, মানবতা বিবর্জিত পৃথিবীর প্রতি। এই পৃথিবীর নির্মাতা দেখে অতিষ্ঠ হওয়ার চেয়ে মুখ লুকানোই বোধকরি ভালো মনে করেছে। লাল শার্ট আর নীল জিন্স প্যান্ট পরা শিশুটিকে মরে ভাসতে দেখে তার জীবনের শূন্যতা টের পেলো। ডুকরে কেঁদে উঠলো। কিন্তু সীমান্ত চালানকারীরা ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল। ধমক খেয়ে সে থেমে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু চোখ ভিজে যাচ্ছিল তবুও। পাঁচ হাজার কিয়াত দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। তার বাবা-মার খবর আজও জানে না, বেঁচে আছে না মরে গেছে। তাই মৃত্যু তার কাছে নতুন কোনও বীভৎসতার নাম নয়। কর্মকর্তা জানে না মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়েই বেঁচে আছে সেহেরা। মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে মুক্তি খুঁজবে বলেই অপেক্ষা করছে এই পৃথিবীর আলো বাতাসে। তাই ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সেহেরার কাছ থেকে তথ্য বের করা যাবে না।
বিষয়টা হয়তো কর্মকর্তা অনুমান করতে পেরেছিল। তাই নতুন টোপ দিয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা। টোপে কাজও হবে বলে মনে হচ্ছে। নিজের কাছেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে সেহেরা। নিজেকে এবার বুঝি আর ধরে রাখতে পারবে না। এই ভয় শুধু ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়ে টনটন করে ওঠা নয়। মূর্চ্ছা যাওয়া, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু। সেহেরা কার হয়ে মাদক চোরাচালানে অংশ নেয়, কোথা থেকে-কোন পথে মাদক আসে বিস্তারির সব তথ্য না দিলে ধর্ষণ করবে বলে হুমকি দিয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা। গণধর্ষণের পর ক্রস ফায়ারে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। এখানেই নিজের কাছে হেরে যাচ্ছে সেহেরা। দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। বুচিডং থেকে মংডু হয়ে পালিয়ে আশার সময় তার স্বামী-সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে। তখন কত আর বয়স হবে সেহেরার, বড়জোর ষোল কী সতের। তাকে ধরে নিয়ে যায় নাসাকা বাহিনী। তিন দিন আটকে রেখে উপর্যুপরি নির্মম ভাবে নির্যাতন করে। বারবার মূর্চ্ছা যাচ্ছিলো সে, কিন্তু তাকে নিস্তার দেয়া হয়নি। দল বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছিল তার ওপর। তিন দিন থাকার পর পালাতে পারে সেহেরা। ওদের জমানো টাকা নিয়ে পালিয়ে আসে। তারপর চার দিন ঘুরে বাংলাদেশে ঢুকতে পারে। সেই স্মৃতি মৃত্যু যন্ত্রণাকেও হার মানায়। দগদগে সে স্মৃতি আজও তাকে তাড়া করে। সেই দিনগুলোর ভয় এখনো সে কাটাতে পারেনি। তাইতো ভয়ে কুকড়ে যাচ্ছে। সকালের মিষ্টি শীতল পরশ নিমিষেই তার কাছে বিস্বাদ হয়ে উঠলো। এক অজানা অথচ অনুমিত আতঙ্কে নিজের মধ্যেই নিজে গুটাতে থাকলো।
আদালতে তোলা হয়েছিল সেহেরাকে। প্রিজন ভ্যান থেকে সকালে আদালত চত্বরে নামার সময় সেহেরা দেখেছে, প্রত্যেক আসামি-কয়েদির কোনও না কোনও আত্মীয় এসেছে। হেঁটে যেতে যেতে কথা বলার চেষ্টা করছে। প্রিয়জনদের উদ্বিগ্ন মুখে সে কি আকুতি, কী আবেগের তীব্রতা, অনুভূতির গভীরতা। কেবল তার জন্যই কেউ উদ্বিগ্ন মুখ নিয়ে ছুটে আসেনি, তার জন্য কারো অনুভূতি আহত নয়, আর্ত নয়, পীড়িত নয়। কেবল সে অপাঙ্তেই একজন অপরাধী, যার কোনও দেশ নেই, যার কোনও স্বজন নেই, যার অপরাধের কোনও ক্ষমা নেই, তার হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করারও কেউ নেই। আদালত তার যাবজ্জীবত কারাদণ্ড দ্যান। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, মাদক চোরাকারবারি, মানব পাচারকারী ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার হুমকির অপরাধ আমলে নিয়ে তাকে শাস্তি দেয়া হয়। কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে থাকার সময় যে লক্ষ্য করে, কী অমানসিক জীবন কাটাচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। খাদ্যাভাব, পথ্যাভাব, ওষুধের অভাবে অকালে জীবনাবসান দেখে তার ভিতর নড়ে ওঠে। গুমড়ে ওঠা মানবতা তার অপারগতা ও অসহায়ত্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। হঠাৎ করেই একদিন মাদক চোরাচালানের সাথে জড়ানোর প্রস্তাব আসে তার কাছে। ভাবার আর সময় নেয়নি সেদিন সেহেরা। হারানোর ভয় তার নেই, নিজেকে উজাড় করে দেবার ইচ্ছা শুধু সুযোগের অপেক্ষায়। সেহেরা পরে ভেবেছিল, এক দলের জীবন বাঁচাতে যে রাস্তায় যাচ্ছে সে রাস্তার বাঁকেই আরেক দলের জীবন ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যাবে। নিজেকে সেদিন সেহেরা বুঝিয়েছিল, চোখের সামনে যে মৃত্যু তার যন্ত্রণা ঢের বেশি। অগোচরে কত অঘটন আর মৃত্যুই তো প্রতিদিন লিপিবদ্ধ হচ্ছে। তার খবর কে রাখে! মনও সেদিন তার বুঝ মেনেছিল। অচিরেই সেহেরা কুতুপালং আর টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হলো। সেহেরার দেয়া টাকায় সীমিত আকারে শিবিরগুলোতে শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম আর স্বাস্থ্য সেবা দেয়া শুরু হলো। সেহেরা ততদিনে শিবির ছেড়ে শহরে এসে জীবন শুরু করেছিল। নাগরিকত্ব নিয়েছিল স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে। সব কিছু ভালই চলছিল। ধীরে ধীরে বার্মা সরকার শরণার্থীদের ফেরত নিচ্ছিলো। যদিও জাতিগত দাঙ্গা শেষ হয়নি তখনও, নিয়মিত বিরতিতে তা চলছিল। কিন্তু সেহেরা তার কাজ নিয়েই ছিল। তাছাড়া পিছুটান অনেক আগেই নোঙর ছাড়া নৌকার মতো ভেসে গিয়েছিল। তাই ফেরার আর টান অনুভব করেনি। প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়ে নিজের জায়গা করে নিচ্ছিলো। কিন্তু বিধি বাম। তাকে আশ্রয়দানকারী নিজেও আজ আইনের আওতায়। তাইতো সেহেরার ভিত দুর্বল হয়ে গেল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সাজানো জীবন বিধস্ত হয়ে গেল। সারা জীবন হয়তো জেলেই কেটে যাবে। কিন্তু তাতে সে মোটেই উদ্বিগ্ন নয়, পীড়িত নয়। যে জীবন সে কাটিয়েছে তার কাছে তা জেলেও যেমন, বাইরে তার চেয়ে সুখকর কিছু নয়। শুধু মন খারাপ হচ্ছে শিবিরের শরণার্থীদের কথা ভেবে। তাদের একটু হলেও একটা আশা আজ দপ করে নিভে গেল, একটা ঝড় মাথার উপর থেকে অচমকা ছাদ কেড়ে নিল। একটা ডানা ভেঙে গেল। ডানাভাঙা পাখির উড়ার ছন্দ যেমন থাকে না তেমনি নিজেদের জীবনের একটু ছন্দ পতন হলো দুটি শরণার্থী শিবিরে। এখন ঝড়-বৃষ্টির কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রকৃতির দয়ায় হাত জোড় করে বাঁচতে হবে শরণার্থীদের, শিশুদের স্কুলটাও বন্ধ হয়ে যাবে।
জীবনের প্রতি সেহেরার কোনও দায় নেই। যে দায় ছিল, যে টান ছিল তা মংডুতেই খুইয়ে এসেছে। এতদিন তাই ভেবেছে। অথচ আজ আদালত চত্বরের অচেনা জরাজীর্ণ, ধূলি-ধূসর কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ কেমন ভালো লাগছে। খুব আপন লাগছে। হয়তো কোনও দিন এমন পরিপূর্ণ মুক্ত আকাশ আর দেখা হবে না। আশেপাশে সবার পরিজনরা কেমন বিবর্ণ-বিমর্ষ মুখে বিদায় দিচ্ছে, নিচ্ছে। কেবল তাকেই বিদায় দেবার কেউ নেই, নেবারও না। কেউ তাকে মনে রাখবে না, না সময়-না পরিজন। নীরবে নিভৃতে বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু না, নিজেকে শাসাচ্ছে সেহেরা। দুর্বল হলে চলবে না। নিয়তির কাছে নতি স্বীকার নয়। তাই যদি হতো তবে মংডুতেই জীবন শেষ হয়ে যেত। শেষদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকবে সেহেরা, শেষ দৃশ্যের শেষ সংলাপ আওড়াতে চায় সে। ভাসতে ভাসতে যেখানেই যাক সেখানেই তাকে যুদ্ধ করতে হবে। নোঙর গাড়তে হবে। স্রোতের টানে ভাসবে কিন্তু হারিয়ে গেলে চলবে না। নিয়তির কাছে হার মানা নয়। ভেঙে পড়া, হার মানা তাকে মানায় না। একদিকে মনকে শাসাচ্ছে অন্যদিকে শরণার্থী শিবিরের শীর্ণ মুখগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠে মন খারাপ করে দিচ্ছে। ভেসে উঠছে মারমাখালীর দিনলিপি, স্বামী-সন্তানের মুখ। বুকের ভিতর আটকে থাকা বাতাস ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। অকারণেই ঝাপসা হয়ে আসে চোখ।