সংগৃহীত

সংগৃহীত

অপত্যের সাধ

সংহিতা দেব

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৫, ২০১৯

সোহম -- ছাড়ো আমাকে ছাড়ো!  যাব আমি!  যাবই!  আরো জোরে দৌড়াবো। তুমি আমাকে ছাড়ো!!  ধরতেই পারবে না এত জোরে ছুটবো এইবার দেখো... 
 
আবির -- পড়ে যাবে বাবা। এমন করতে নেই। আগের দিন কত ব্যথা পেলে। আমি কি তোমায় ধরতে পারি এত স্পিডে ছুটলে? আমার কি আর তোমার মত শক্তি আছে?  
 
সোহম-- তাহলে দড়ি আনো তুমিও। মাম্মা আমাকে বেঁধে রাখতো ধরতে পারলে। আমি আর যেতে পারতামই না। এবার আমার আরো শক্তি হয়ে গেছে আমি দড়ি ছেড়ে চলেই যাব দেখবে কেমন। বেঁধে রাখো আমাকে পাপা। জলদি কর।
 
আবিরের চোখে জল চলে আসে। বুকে জড়িয়ে চেপে ধরে বলে," না বাবা আমি কি তোমায় ব্যথা দিতে পারি? আচ্ছা তুমি ছুটো যত খুশি ছুটো। এখন খুব রোদ। আজ চল আমরা বাড়ি যাই। একটা নতুন ক্যারাম বোর্ড এনেছি না? ওটা তো খারাপ হয়ে যাবে বাবা না খেললে !  চল যাই আমরা বাড়ি। 
 
 
প্রায় ক`দিন অন্তর অন্তর এই খেলা। মানসিক বিকাশ সঠিক হলে সোহম এখন অনিক,  ঋক, ঋজুদের মত ক্লাস নাইন এর হান্ডসাম হাঙ্ক হতো। ঈশ্বর চাননি তাই আজ ও ক্লাস থ্রি তে অটিজ স্কুলে। তবু তো আবিরের একমাত্র সঙ্গী আজ সোহমই। না হলে এই শুন্য জীবন,  অফিসের ফাইল আর এক পাহাড় বেদনা দায়ী স্মৃতির চাপে হয়তো আত্মহননের পথই বেছে নিতো ও।
 
 
হায়ার সেকেন্ডারির পর ইঞ্জিনিয়ারিং এর জন্যই চেন্নাই যেতে হয়েছিল ওকে। জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়াতে তো হবে। সেই প্ল্যানেই এগিয়েছিল প্রথম থেকে। মনে ক্ষীণ স্বপ্ন জাগতো সৌমিকে আজীবনের সাথী হিসেবে পাওয়ার। বছর সাতেকের বড় সৌমীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাও পাপ ও জানত। কিন্তু দিন দিন সৌমির আচরণ ওর ভাবনাকে গুলিয়ে দিচ্ছিল। একটা ১৮ বছরের ছেলে কখনোই বিয়ে, সংসার, সন্তানের স্বপ্ন দেখে না। এইসব কাজ পুতুল খেলার বয়স থেকে মেয়েদেরই জাগে। ক্লাস টেনের পর ইংলিশ টাকে আরেকটু জোরদার করতেই ছোটকাকুর বন্ধুর মেয়ে সৌমিকে বাড়িতে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। দিব্যি পড়াশুনো এগোচ্ছিল। মাঝে মাঝে সৌমীদের বাড়িতেও আবির যেত পড়তে। যখন সৌমীর মা বাবা থাকত না বাড়ি ফাঁকা রেখে এলে পেট গুলোকে দেখার কেউ নেই বলে সৌমী আবির কেই ডেকে নিত। দুজনের মধ্যে টিচার - ছাত্রের ভাব ছাড়াও বন্ধুত্ব ছিল ভালোই। বয়স অনুযায়ী আবির ডেভেলপ চেহারার বরাবরই। ছফুট ছুঁই ছুঁই, তীক্ষ্ম চেহেরার সুন্দর পুরুষ। ছোট থেকে বাবার চাপে ভোরে ওঠা, ফুটবল পেটানো, নিয়মিত সুইমিং সুস্বাস্থ্যের মালিক  গড়ে দিয়েছিল ওকে। সেদিন হঠাৎ আকাশ ভেঙ্গে মেঘ এল, একটু পর থেকেই বৃষ্টি চরম। রাত হয়ে এসেছিল। আবিরের বাবা অফিস থেকে ফিরে আবিরকে বাড়ি নিয়ে যায় যেদিন আবির সৌমিদের বাড়ি পড়তে আসে। সেদিন রাত দশটা অবধি অফিস থেকেই ফিরতে পারেনি। সৌমির মা বার বার বলেন রাত টুকু থেকে যেতে বাবাকে কেন কষ্ট দেবে এই ঝড়জলে। আবিরের মাও রাজি হয়। ভীষণ এক অস্বস্তিতে পড়ছিল আবির। এর মধ্যেই কয়েকবার সৌমির পারফিউমের গন্ধ পেয়েছে, আচমকা কয়েকবার শরীরে টাচ হয়েছিল অসাবধানতা বশত। রাতে থাকার কথায় বার বার মন টা উতলা হচ্ছিল সতেরো বছরের উঠতি কিশোরের মতই। তবু থাকতে বাধ্য হয়। 
 
 
২৪ বছরের সৌমি সবে মাস্টার্স শেষ করে হস্টেল ছেড়ে এসেছে। শান্তিনিকেতনে বেশ অনিয়মিত জীবন যাপন ছিল ওদের। হস্টেল জীবনে সিগারেট, মদ, সেক্স কোন কিছুর স্বাদ নিতেই বাকি রাখেনি। কিন্তু কোন সম্পর্কে সে ভাবে বাঁধেনি। কারণ ডক্টরেট, পোস্ট ডক্টরেট সব কিছুই ও সারবে, ইউনিভার্সিটির জব ওর টারর্গেড বছর দুয়েক কলেজ সারভিস কমিশন ট্রাই করবে। জি.আর.এফ পেয়ে গেলে পি এইচ ডির জন্য বাবার কাছে হাত পাততে হবে না। স্কুল সারভিসে তো বসবেই না ও, এত জলদি জবের লক্ষ্য নেই। পড়তে হবে আরো। এই ফাঁকে যে ক`দিন বাড়িতে আছে ক`টা টিউশনিতে হাত খরচ টুকুও আসবে আর চর্চা টাও থেকে যাবে। এই ভেবেই এগোচ্ছে। সে রাতে ডিনারের পর জানালার ধারে অঝোরে ঝরা বৃষ্টি দেখছিল আনমনে আবির। লজ্জা অস্বস্তিতে ছিল, এর আগে মা ছাড়া কোন অপরিচিতর বাড়িতে থাকেনি, বাথরুম ইউজ করেনি কি যে মুশকিলে পড়লো, মনে মনে এটাই ভাবছিল। তবুও সে ম্যামের প্রিয় পাত্র, ম্যাম নিশ্চয় বুঝতে পারবেন ও ফ্রি নেই -- এটুকুই আশা। কখন সৌমি পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি। দুপুর থেকে প্রায় লোড শেডিং, ইনভার্টার টারও চার্জ শেষ। গভীর অন্ধকার, বাইরে ঝড়ের দাপট, ঘরে মৃদু মোমবাতির আলোয় পিছন ফিরতেই সজোরে ধাক্কা লাগল সৌমির বুকের সাথে। দুহাতে শক্ত করে ধরেছিল সৌমি ওকে।  স্তম্ভিত আবির নড়া চড়া ভুলে গেছিল। আবিরকে ধরে বিছানায় বসিয়ে আচমকা সৌমি গলা জড়িয়ে  চুমু দেয়, আর বলে " বড় মিষ্টি আর পছন্দের তুই আমার"। আবিরের সারা শরীর হিম হয়ে গিয়েছিল। এর আগে কোন অপরিচিত মেয়ের এত ঘনিষ্ট হয়নি ও। বুঝতে পারলো না কি করা উচিত। হাত দুটোয় মুঠো করে ধরা সৌমির নাইট ড্রেসের প্রান্ত। সৌমির হাত উঠে আসে আবিরের দু গালে। প্রচূর চুমোয় ভরিয়ে দেয় আবিরকে। অবশ হয়ে আসে আবিরের শরীর অদ্ভুত এক ভালো লাগায়। সৌমির বুকের গভীর থেকে উন্মত্ত করা ফিরদৌসের গন্ধ আরো মাতোয়ারা করে দেয়। জানে না কতক্ষণ সৌমি ওর লিপ লক করে রেখেছিল, কিন্তু সেই চরম ভালো লাগার নির্বাক মুহূর্ত জীবনে এর আর আসে নি আগে। তারপর থেকে পড়ার সিডিউল বদলে দেয় সৌমি। শনি রবিবারটা বাদ দিয়ে ওয়ার্কিং ডে তেই বিকেলের দিকে আবিরদের বাড়ি যায় ও। আবিরের মা বাবা অফিস থেকে ফিরতে প্রায় রাত আটটা হয়। এর মধ্যে পড়িয়ে ফেলে সৌমি ওকে। নিয়মিত মিলিত হতে থাকে ওরা। শরীরের নেশায় পড়ে যায় আবির। সাথে ভালোবেসেও ফেলে সৌমিকে। পড়াশুনায় জোর দেয় আগের থেকে অনেক বেশি। ভালো রেজাল্ট ছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হওয়া মুস্কিল। জব ছাড়া সৌমির সাথে সম্পর্ক সমাজে প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব নয়। সেহেতুই জীবন থেকে খেলা ধুলা, আড্ডা, বন্ধু সমস্ত টাইম পাশ বাদ দিয়ে পড়াশুনায় মনোযোগী হয়ে ওঠে প্রবল ভাবে। আর সপ্তাহে দু তিন দিন সৌমি এসে ওকে সুখের সাগরে ভাসিয়ে দেওয়াটা অবিচ্ছেদ্য রাখে। এর পর হায়ারসেকেন্ডারি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং চেন্নাই এর হস্টেল জীবন। সারাক্ষণ সৌমিহীন অন্ধকার ওকে ঘিরে ধরে। একটু আধটু ফোন, টানা  দুবছরের এত গভীর মানসিক - শারীরিক সংযোগকে কি ভাবে মেটাতে পারে আর? শরীরের খিদে উন্মাদ করে দেয় এক এক রাতে। ফোন করে সৌমিকে। বাড়ি থেকে সেভাবে কথা বলতে পারে না সৌমি। কিছু চ্যাট, কিছু ছবি কত টুকুই বা অভাব মেটাতে পারে। তবুও ওকে জলদি চাকরি পেয়ে বিয়ে করতেই হবে সৌমিকে। এই ভাবেই দুবছর চলে। বছরে একবার পুজোর সময় কয়েক দিনের জন্য আসা। সকলের ছুটি ঐ সময়। না পাওয়ার খিদে মন মরা করে রাখতো আবিরকে সর্দাই। সৌমিও আজকাল এত ব্যস্ত কয়েক দিনে বার কয়েক ফোন ও অনেক ম্যাসেজের পর সারা মেলে। এই করে থার্ড ইয়ারের শেষ সেমিস্টারের সময় এসে যায়। প্রায় দিন পনেরো সৌমির কোন খবর পায়নি। উতলা মন ধীরে ধীরে দমে যাচ্ছিল ভিতর ভিতর। হঠাৎ কতগুলো ছবি পাঠায় সৌমি হোয়াটস আপে। বিয়ের সাজে এক ঝলকে চিনতে পারেনি প্রথমে। তারপর স্তব্ধ হয়ে যায় সেই বৃষ্টিরাতের প্রথম স্পর্শের মতই। এই দিন টাও অঝোরে বৃষ্টির রাতই ছিল। কে জানত অসময়ের বৃষ্টি বার বার নাড়া দিয়ে যায় আবিরের জীবন কে অগোছালো পথে? 
 
 
তারপর শুধু কেরিয়ার নিয়ে ভেবেছে ও। আর পিছিয়ে থাকতে হয়নি। সৌমিকেও জিজ্ঞেস করেনি এই ভয়াবহ আঘাত দেওয়ার অধিকার কে দিয়েছিল ওকে। সাতটা বছরের বড় সৌমি হয়তো বাড়ির চাপেই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু সেটা তো কষ্টের হত যদি বাধ্যবাধকতায় পড়তে হয়। শেয়ার করতেই পারতো আবিরকে সেটা। হয়তো শরীরের খিদেই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল সৌমির, তাই ব্যবহৃত হয়েছিল আবির। আজ আবিরের আর বুঝতে অসুবিধে নেই যে শরীর সর্বস্য প্রেমই  ছিল সৌমির। যৌবনের শুরুতে এই আঘাতে প্রেম, ভালোবাসা, সম্পর্ক, নারী ইত্যাদি থেকে মন উবে গিয়েছিল আবিরের। শাপে বর হয়েছিল বরং, কেরিয়ারকে আর অবহেলার সুযোগ আসেনি। আজ সে সাক্সেস তাই। 
 
 
 
তবুও আজ ওর জীবনে সোহম আছে। কিন্তু তবু সোহম কাঁটা না ফুল বুঝতে পারে না কখনো কখনো। ভাবনার অতলে তলিয়ে যায় বছর ৪২ এর আবির। কত ভালো ভালো সম্বন্ধ আসত ওর। একজন প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিয়ার, সুন্দর, বিচক্ষণ, পারিবারিক সুখ্যাতি যার অটুট সেই হিরের টুকরো ছেলের কি সুপাত্রির অভাব হয়? তবু দয়ার মন আবিরের  গলিয়েছিল আরেক নারী। অফিসের পার্ট টাইম কর্মরতা ঝিনুক। প্রবাসে খুব কমসংখ্যক বাঙ্গালী। তাই ঝিনুকের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল ওর। বাড়ি থেকে বানিয়ে টিফিন আনত আবিরকে ভাগ করে দিত। নানা কথায় ধীরে ধীরে জেনেছিল চরম অর্থাভাবে দিন কাটত ঝিনুকদের একটা সময়। ভালোবাসার ভরসায় বেঁধে বিয়ের আস্বাসে দিনের পর দিন ঝিনুককে ভোগ করে গেছিল সিধু। গুজরাঠের বাসিন্দা ঝিনুকরা। ছোটবেলায় বাবার কর্মজীবনের জন্য কলকাতা ছেড়ে এসেছিল পাকাপাকি ভাবে। পাড়ার ছেলে সিধু নানা স্বপ্নে ডুবিয়েছিল ঝিনুককে। তারপর একদিন বশ করে ফেলে ওকে। ঠিক যেমন আবিরকে করেছিল সৌমি। ঝিনুকের জীবনের আদ্যপান্ত তাই ছুঁয়েছিল আবিরকে। সন্তানসম্ভবা ঝিনুককে বেকায়দায় ফেলে একদিন উধাও হয়ে গেল পাড়া থেকেই সিধুরা। চব্বিশ দিনের গর্ভ তখন ঝিনুকের। মাথায় বাজ ভেঙ্গে পরে ওর পরিবারের। স্ট্রোকের প্রথম আঘাতেই শয্যাশায়ী হয় ওর বাবা চিরতরে। ভাগ্যিস কমার্সের মেয়ে ছিল ও, এই অফিসেই একটা প্রজেক্টে চান্স পায়। খুব কম স্যালারি নয়। খাওয়া পরা টুকু জুটে যায় দুবেলার আর বাবার অসুধ, ফিজিও থেরাপির খরচ টাও। আটমাসের বেবিকে ক্যারি করে নিত্য অফিস করছে ঝিনুক। কেউ জানেনা অবিবাহিত ঝিনুকের মানসিক শক্তির কথা। সকলে জানে ঝিনুকের বর দুবাইতে কর্মরত। আবির আসল ঘটনা জেনেছিল থেকে ঝিনুকের প্রতি শ্রদ্ধায় ভরে উঠেছিল মন ওর। দায়িত্ব নিতে পিছুপা হয়নি ঝিনুকের সন্তানের। ঝিনুক কিছুতেই রাজি হয়নি আবিরকে ঠকাতে। কি দিতে পারবে ও?  কেনই বা আবিরের জীবনকে বাঁধবে, ঝিনুক প্রথমে ভেবেছিল। তারপর আবিরের মহানুভবতায় মেনে নেয় বাস্তবকে। সত্যিই তো বাপ হীন আনম্যারেড মেয়ের সন্তান বড় করা সহজ কথা নয়। একটা বাচ্চা বড় করা মানে কত ইনভেস্টমেন্ট। পাবে কোথায় ঝিনুক?  আবির ওকে রাজি করিয়ে নতুন কম্পানিতে জয়েন করে কলকাতায়। কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে আনে গর্ভবতী ঝিনুককে। নতুন পরিবেশে কেউ খোঁজ নেয় নি আর ঝিনুকের। দিব্যি জন্ম দেয় আবিরের বৌ অন্যের সন্তানের।  আবিরের পরিবার সবটা মেনে নেয় ঝিনুকের অসহায়তা আর ফুটফুটে সোহমের মুখ চেয়ে। বছর তিনেক তখন। আর দশটা স্বাভাবিক বাচ্চার মত কথা বলতে পারেনা সোহম। চোখের দৃষ্টিও স্বচ্ছ নয়। ডাক্তার জানায় "বাচ্চা তো অটিজ " সেদিন মনের ভিতর আবার এক ঝড় ওঠে আবিরের। আজ  ঝিনুকের জায়গায় সৌমি থাকলে সোহম তো এমনই হতে পারতো। নিজের ঔরস জাত সন্তান হলে তখন ঠিক কি ভাবে নিত আবির সোহম কে? সন্তান তো সন্তানই হয়। ঝিনুক ওর জীবনে না এলে এই অপত্য স্নেহ থেকে বঞ্চিতই থেকে যেত ও। তাই সব মন খারাপকে দূরে সরিয়ে বাচ্চার দিকে মন দেয় আবির। 
 
 
ঝিনুক আজকাল দিন দিন অমনোযোগী আর কেমন একটা মায়া দয়া হীন হয়ে উঠছে আবির লক্ষ্য করছিল। সারাক্ষণ ফোন কলে ব্যস্ত। আবির অফিস থেকে ফিরলেই বেরিয়ে যায় সোহমকে আবিরের ঘাড়ে ফেলে। সারাদিন অফিসের কাজের পর এই দামাল বাচ্চার সমস্ত ভার নিতে নিতে হাঁপিয়ে উঠছিল আবির। ঝিনুক কে আগে বোঝাতে পারত, আজকাল বড় এগ্রেসিভ ঝিনুক। বয়সে অনেকটাই ছোট তাই ঝিনুকের প্রতি মায়াই হয় আবিরের। এত ঠকেছে মেয়েটা, শেষে ভগবানও এই ভাবে মেরেছে ওকে। থাক বন্ধুবান্ধব, সপিং  নিয়ে ব্যস্ত থাকে ভালো থাকে যখন তাই থাক। আবিরের তো কিছু কর্তব্য থেকেই যায় সোহমের প্রতি, বিশেষ করে যখন বিয়ের চাপ সে- ই দিয়েছিল আজ তো পেছাতে পারে না আর। সোহম বড় হচ্ছে যত তত বাঁধন ছাড়া হচ্ছে। দশ বছরের সোহম ভাব প্রকাশে বছর চারেকের আর অবাধ্যতায়, চঞ্চলতায় সব সাধারণ বাচ্চাকে ছাড়িয়ে যায়। ইদানিং পিয়ানো ক্লাসে ভর্তি করেছে ওকে।  স্কুলেও দিয়েছে। অটিজ স্কুলে আটকে রাখে বাচ্চাকে। নিত্য নালিশ বা গারজেন কল, টিচারের পরামর্শও চলতে থাকে। মিউজিক দিয়ে একমাত্র কিছুক্ষণ বসানো যায় ওকে -- একথা স্কুল কর্তৃপক্ষ জানানোর পর থেকে পিয়ানো ক্লাসে ভর্তি করেছে আবির ওকে। অদ্ভুত ভাবে মিউজিকে মন ওর। বেশ শান্ত হয়ে যায়। দিনের মধ্যে যখনই সুযোগ পায় আবির ওকে নানা যন্ত্রসঙ্গীত শোনায়। কিন্তু এইসব দায়িত্ব যেন অদ্ভুত ভাবে আবিরের। এইরকম বাচ্চাকে মা বাবা আন্তরিক না হলে, সমস্ত বাহ্যসুখ, স্বার্থপরতা না ত্যাগ করলে বড় করতে পারবে না ডক্টর প্রতি সিটিং এ বলেন। মা সময় দেয়  না ছেলেকে কোন ভাবেই আর ছুটির দিন গুলো ছাড়া। সারাদিন স্কুল, বিকেলের পর আয়া আর আবির মিলে হিমসিম খেতে খেতে বড় করছে সোহমকে। আজকাল ঘন ঘন ঝিনুক শোনায় ওর পক্ষে এই অসুস্থ ছেলে নিয়ে এই ভাবে লাইফ কাটানো সম্ভব হচ্ছে না। চেঞ্জ চাই ওর, বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যেতে চায়। আবিরের কর্মজগতের পরিধি বাড়ছে , ব্যস্ততা বাড়ছে আর এই ছেলেকে নিয়ে আউটিং যায়নি ওরা ক`বছর । লম্বায় চওড়ায় অতি ডেভেলপ সোহম। সামলানো মুস্কিল হয়, রেগে গেলে ভাঙচুর করে, হঠাৎ দৌড়াতে থাকে ফাঁকা রাস্তায় তাই সাহস পায় না আবির আর বাইরে যেতে। বহির্মুখী ঝিনুকের সাথেও মানসিক দূরত্ব আজ অনেক টাই। বার কয়েক একাই গেছে ঝিনুক ভারত ভ্রমণে। তাতে স্থিত হয়নি ওর মন। বরং দূরত্ব বেড়েছে পরিবারের সাথে। 
 
 
 
মনে পরে সোহমের শেষ জন্ম দিনটা। ১৫ বছরের ছেলের ধুমধাম করে জন্মদিন করেছিল। রাতের দিকে পার্টি প্রায় শেষ। এক হ্যান্ডসাম পুরুষের সাথে আলাপ করায় ঝিনুক। নাম সিদ্ধার্থ সিন্ধে। প্রথমটায় ধরতে পারেনি আবির। ১৫ বছর আগের শোনা নাম। তবু ডাক নামটা বার কয়েক শুনেছে। অত কি মনে থাকে? আলাপ চারিতার শেষে ঝিনুক জানায়, "এই সেই সিধু, বাল্য প্রেম, সোহমের বায়োলজিকাল বাবা।" এই রকম ভাবে স্তব্ধ আগেও জীবনে একবার হয়েছিল ও সৌমির বিয়ের ছবি দেখে। আজও পায়ের তলার মাটি আবার  সরে যায় যেন। 
 
 
আবির -- তবে কি নিয়ে যেতে এসেছে ও সোহমকে? 
 
ঝিনুক -- না কেন নেবে? কে নেবে দায়িত্ব এই ছেলের ?
 
আবির -- হাজার হলেও রক্তের টান। 
 
ঝিনুক -- ছাড়ো তো ওই সব সিলি সেন্টিমেন্টাল টক। ( রিরক্তিভরা মুখে বল্লো) 
 
আবির -- কবে থেকে যোগাযোগ হল?  
 
ঝিনুক -- লাস্টবার মুম্বাইতে। এয়ার্পোটের সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে আছে। ফেসবুক থেকে খুঁজে পেয়েছি। সত্যতা যাচাই করতে গিয়েছিলাম মুম্বাই। তোমাকে বলিনি মানে বলা হয়ে ওঠেনি। আর বলবো কখন?  বাড়ি ঢুকলেই তো হাজারো বায়ানাক্কা ছেলের।
 
আবির -- অবোধ শিশুটাকে এই ভাবে ব্যাখ্যা করোনা ঝিনুক। 
 
ঝিনুক -- অতই যদি মায়া ছেলে নিয়ে থাকো মুক্তি দাও আমায়। এক ঘেঁয়ে  জীবন অসুস্থ করে তুললো দিন দিন।  তার উপর পাথরের মত তুমি যেন বিয়ে করে উদ্ধার করে তুলেছ। 
 
আবির -- এ সব কি বলছ?  চাও কি তুমি?  বাচ্চাটা কি ইচ্ছেকৃত করছে এমন? মা হয়ে কি মানসিকতা  তোমার এই সব? 
 
 
এর আগে  কোন দিন এর রূঢ় হয়নি আবির। কি সহজেই মানুষ ভুলে যায় অতীত। এই বাচ্চার জন্ম দিতে কত লড়তে দেখেছিল আবির ওকে। মাতৃত্ব দেখেছিল অপার। ওর সেই লড়াইতেই সহযোদ্ধা হতে হাত বাড়িয়েছিল ও।  তখন আপ্লুত ঝিনুক, ঝিনুকের মা এই ভাষাই বলেছিল "উদ্ধার করছ তুমি মেয়েটাকে "। সেদিনও আবির উদ্ধার শব্দ টাকে অপছন্দ করেছিল। কে কাকে উদ্ধার করে আর, সবই নিয়তি। আজ অনেক দিন পর সৌমির মুখ ভেসে উঠল।  সৌমির শরীরের খিদে থেকেও তো উদ্ধারই করেছিল আবির প্রকৃত পক্ষে। কিন্তু তবু " উদ্ধার " শব্দ কে মনে এনে এদের কাউকেই অপমানিত করেনি ঘুণাক্ষরেও।
 
 
অবশেষে মধ্যরাতে জানিয়েছিল ঝিনুক, "সেদিন সিধুর দোষ ছিল না কোন।  বাড়ির লোক জোর করে নিয়ে যায় ওকে মুম্বাই। যোগাযোগ করার কোন উপায় রাখেনি। তাই আমায় জানাতে পারেনি। এত গুলো বছর আমি ওকে দূষে যে পাপ করেছি তার প্রায়োশ্চিত্য করতে চাই। আমি ফিরে যেতে চাই সিধুর কাছে ".... 
সেদিন ও সন্ধ্যে থেকে বিকট মেঘ করেছিল। তবে বৃষ্টি ঝরে নি এই মেঘে। গুমোট হয়েছিল আকাশ বাতাস পরিবেশ। 
আবির শুধু বলেছিল, " ছেলেটাকেও নেবে?" 
 
ঝিনুক জানায় অতি সাবলীল ভাবে " ওকে নিলে বোর্ডিং এ দিতে হবে।আমি পারবো না আর এই ভাবে বিষিয়ে দিতে লাইফ। " 
তারাতারি আবির   বলেছিল, "তবে আমার কাছেই থাক না হয়। বড় অসহায় বেবি, হস্টেলে দিলে কে বুঝবে ওর মন? " 
 
ঝিনুক -- দেন ওকে। তুমি গার্জেনসিপ মামলার ব্যবস্থা কর। আমি সই করে দেবো। একমাত্র গার্জেন তুমিই ওর হবে। আমি আর জড়াতে চাইনা। 
 
আবির -- বেশ তাই হবে। 
 
 
সেদিন থেকে নির্বাক প্রায় আবির। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়েছে সোহমকে অটিজ বানানোর জন্য। অন্তত সরলতায় মাখা এক মানুষ সোহম। স্বার্থপরতা নেই, সুবিধাবাদী নয়, বয়স আন্দাজে একটু ছেলে মানুষ খালি। সুস্থ শরীরের, তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার অনেক অনেক মানুষের থেকে উন্নত, সুন্দর ওর সোহম। হাঁপিয়ে পরে এক এক সময় ছেলের বায়ানাক্কায় ঠিকই, কিন্তু  অফিস, ছেলের স্কুল, ছেলের মিষ্টি অবুঝপনায় দিব্যি চলছে জীবন। আজ একবছর ঝিনুক নেই তাতে কিই বা আটকালো।  ছোট কাকুর কাছে শুনেছিল সৌমির সন্তানহীন বিবাহিত জীবনের ট্রাজেডির কথা। কিন্তু উত্তরে আর কোন শব্দ খুঁজে পায়নি আবির।
 
#রিমিসংহিতা