অন্যেকে যেহেতু ছাড় দেব না, অন্যরা কেন আমাদের ছাড় দেবে
জগলুল আসাদপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০
আমাদের দরদী বুজুর্গগণ যে প্রযুক্তি বিষয়ে আমাদের সতর্ক করতেন, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতেন তা অকারণ নয়। প্রযুক্তির মোহ ও চাকচিক্য দৃষ্টি, বিবেচনা ও অন্তরকে ঝলসে দিতে পারে। ধরা যাক, একজন নারী। তিনি যখন ফটোগ্রাফির অধীন হবেন, ফেসবুকে প্রদর্শিত হবেন, তখন তার একটা মুহূর্তই রূপান্তরিত হবে প্রায় অনন্তে। তিনি প্রযুক্তি ও গ্রাফিক্সের কারিগরির দরুণ রূপান্তরিত হতে থাকবেন প্রদর্শনযোগ্য শিল্পবস্তুতে, যা তার ইচ্ছানিরপেক্ষভাবেই বহু অর্থ-উৎপাদক হয়ে উঠবে। যিনি গোচরে ছিলেন গুটিকয়েকের, তিনি এখন প্রত্যক্ষে এলেন লক্ষজনের। যা ছিল ব্যক্তিগত ও পরিবর্তনযোগ্য অভিব্যক্তি, তা হয়ে ওঠে পাবলিক ও অনড়-অপরিবর্তনীয়; যা ছিল আটপৌরে ও একার্থবোধক, তা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ও বহুঅর্থবোধক। ক্যামেরাবন্দি কোনো অবয়ব যখন প্রযুক্তির কারসাজিতে ‘ভাইরাল’ হয় ও উদ্গীরণ ঘটতে থাকে মতামতের এত এত লাভা ও লার্ভা, তখন আমরা ‘ফটোগ্রাফি’ ‘ফেসবুক’ ‘সংবাদ মাধ্যমের কারসাজি ও বাণিজ্যবাসনা’ এককথায় প্রযুক্তিকে ক্রিটিকের আওতায় আনতে ভুলে যাই। তখন ক্যামেরাম্যানের কাজকে দায়িত্ব পালন আর নান্দনিকতার কাঠামোয় বুঝতে চেষ্টা করি, ক্যামেরা ও তার চালকের ‘সীমা’কে প্রশ্ন করতে ভুলে যাই।
প্রযুক্তির দাজ্জালি ব্যবহারে যে যার মতো নিজ নিজ সত্য নির্মাণ করে। প্রযুক্তির গর্ভে যেন ‘সত্য’ লুকানো আর সেই ভাণ্ড থেকে উদঘাটন করছি আমরা নিজ নিজ সত্যের সংস্করণ। দেবেশ রায়ের এক গল্প আছে ‘মুখের দরদাম’ নামে। সেখানে এক নারী টিভিকর্মীকে গণধর্ষণের নিউজ সংগ্রহের কথা বলা হয়। তো, নারীটি সেখানে তার ক্যামেরাম্যান স্বামীকে নিয়ে যেতে চায়। স্বামী সঙ্গে যাবে কিন্তু কোনোভাবেই সে ক্যামেরা নেবে না। সে বলে, ‘ক্যামেরা দিয়ে নারীগুলোকে আরেকবার ধর্ষণ করাতে চাই না।’ যেহেতু প্রযুক্তি নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে, তাই সমস্যাটি চিনে রাখা উচিত।
ফেসবুক একটা বাজার ও বিচারসভা। বাজার যখন বিচারালয় হয়, তখন রায়ও ভিন্ন ভিন্ন হয়, কিন্তু ভিক্টিম থাকে একটাই। সে জানা অজানা নানা প্রান্ত থেকে বিচারের নানা তীরে বিদ্ধ হতে থাকে। প্রতিটি বিচারক আলাদা আলাদা তুলাদণ্ড দিয়ে ‘আসামী’কে মাপতে থাকে। বিচারকগণ মত্ত থাকেন নিজ নিজ বিচারকার্যে, আর আসামি সকল বিবাদমান বিচারের ভারে ন্যুব্জ ও ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। ‘আসামি’র প্রতি ন্যুনতম ইনসাফের ভাবনাও মনের কোণে আর উঁকি দেয় না। আর, আসামি যদি হয় নারী তবে বিচারের পৌরুষ শত ফুল হয়ে ফুটতে থাকে, প্রবলকে লক্ষ্য বানানোর চেয়ে `পেলব` লক্ষ্য সদাই আরামদায়ক!
ফেসবুকীয় বিচারসভায় একটি ছবি নিয়ে চার ধরনের বিচার লক্ষ্যযোগ্য:
১. ছেলের সাথে বোরকা পরিহিত মায়ের ক্রিকেট খেলা দেখে অনেকেই মাতৃত্বের এই সৌন্দর্যে মুগ্ধ। দৃশ্যের নির্মলতায় অনেকেই চোখ-জুড়ানো নিষ্পাপ আনন্দ লাভ করেছে।
২. অনেকে বোরকা পড়াকে সমাজের ইসলামাইজেশনের প্রতীক ভাবছে, বাঙালিত্বের পক্ষে হুমকি ঠাওরাচ্ছে। এই ‘দৃশ্য’কে অত্যন্ত নেতিবাচক গণ্য করে আশংকিত হচ্ছে।
৩. অনেকে ইসলামের সৌন্দর্যও দেখছে এখানে। মহিলা তার ছেলের সাথে খেলছেন, নন মাহরাম পুরুষের সাথে খেলছেন না। মোবাইল ও গেমসে ব্যস্ত না থেকে বাচ্চাকে সঙ্গ দিচ্ছেন, ছেলেকে হাফেজ বানিয়েছেন ইত্যাদি।
৪. অনেকে সাক্ষাৎকার পড়ে নারীকে পেশাগত ক্রিকেট নামক হারাম পেশায় ছেলেকে উৎসাহিত করার দৃষ্টিভঙ্গিতে তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন, ছেলেকে আলেম না বানিয়ে, খেলোয়ার বানাতে চাওয়ায় সাংস্কৃতিক দৈন্য দেখছেন, নারীটির ধর্মাচারে যথেষ্ট তাকওয়ার অভাব লক্ষ্য করছেন। নারীটি প্রকাশ্যে এভাবে ক্রিকেট খেলে দীনের অমর্যাদা করেছেন বলেও মত এসেছে।
এই প্রত্যেকটা রিডিংয়ে বাস্তবতা আছে, অতিরঞ্জন আছে, আশা আছে, ক্ষোভ আছে। ১ আর ৩; ২ আর ৪ নং পয়েন্টে মিলও পাবেন অনেকে! এই আপাত দ্বন্দ্বমূলক রিডিং আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির কিছু গভীর বিষয় উন্মোচন করে, যা নিয়ে বড় আলোচনা দরকার হবে।
নজরদারি এক মতাদর্শিক বাস্তবতা। তা রাষ্ট্র করে, মুমিন-আলিম করে, বাঙালি জাতীয়তাবাদীও করে। তাকওয়ার নজরদারি আছে, ভাষা পুলিশি আছে, আইনি নজরদারিও থাকবে। এক অর্থে কর্মগত দিক থেকে তারা প্রায় কেউ আলাদা নয়, লক্ষ্যে ভিন্নতা আছে অবশ্যই। নারীবাদী আর বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের বাদ দিলাম; বোরখা পরা নারীটির ছবি যেসব মুত্তাকীপ্রাণ পোস্ট দিচ্ছেন, তারা কি একটিবারও ভেবে দেখেছেন, ছবিটির একজন মালিক বা মূলমুখ আছেন, এরই মধ্যেই তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন, কারো চোখের আরামের জন্যে নিজের পোস্ট-লেখাকে এই ছবিটি দিয়ে আরো শোভিত ও দৃষ্টিসুখকর করে নিজের ইগোকে সন্তুষ্ট করার প্রচেষ্টা কতটা নীতিসিদ্ধ! এই ছবি ইউজ করে বয়ান দেয়াটাকে সকলেই মুখে মুখে বাহবা দিলেও বাস্তবতার তলে তলে ধসে পড়তে পারে কি কারো দীনি সৌন্দর্যের ইমেজ ও গ্রহণযোগ্যতা? পোস্টটা দ্বীনি উদ্দেশ্যের মোড়কে কতটা অন্য আশায় চয়িত সে মুহাসাবা করার জরুরতও আছে বৈকি আমাদের!
তাকওয়ার নজরদারি যারা করবেন তাদেরকে হতে হবে আরো তাকওয়াবান, সতর্ক। পান থেকে চুন খসলে তারাও কিন্তু লক্ষ্যবস্তু হবেন কঠোরতার, তারাও হবেন প্রশ্নবিদ্ধ আর তারা হনও তা। অন্যেকে যেহেতু আমরা ছাড় দিব না, অন্যরাও আমাদের ছাড় দিবে কেন? আমরা অপরের মধ্যে দ্বীনদারির কোনো ঝলককেও যদি প্রসংসা করতে না পারি, আমাদের দ্বীনদারির বয়ান তাদের হৃদয় কতটা স্পর্শ করবে, জানি না। প্রতিকূল সাংস্কৃতিক প্রতিবেশের মধ্যে হক কথাও দরদ ও রহমের সাথে উচ্চারিত না হলে তা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসবে আমাদেরই কাছে! আত্মসমালোচনাকে যেন ভুল না বুঝি!
তবুও কিছু মানুষকে হক কথা তিক্ত হলেও বলে যেতে হবে। প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে একটু নাড়াচাড়া দেয়াও গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতি। রাজনীতি মানে দৈনন্দিনতার মধ্যেই কোনো স্বপ্নের সঞ্চার আর সেই স্বপ্নকেই দৈনন্দিন করে তোলা— কে যেন বলেছিলেন!
লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক