প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

অদ্ভুতুড়ে

সোহাইল রহমান

প্রকাশিত : আগস্ট ০৪, ২০১৯

বিয়ের সপ্তাহখানেক বাদেই আনিস বুঝতে পারলো, তার বউ বীথি নর্মাল নয়। অবশ্য এটা সে ধারণা করেছিল বিয়ের পরদিনই। ভালোবাসাবাসির আগে বীথি যখন বলল, ‘কনডম ইউজ করার দরকার নাই কোনো’, আনিস অবাক হয়েছিল।
তোমার কি সেফ পিরিয়ড চলতেছে?
না।
তাহলে? পিল খাবা? পিল খাওয়া ক্ষতিকর স্বাস্থ্যের জন্য।
পিলও খাব না।
তাহলে? প্রটেকশন না ইউজ করলে কনসিভ করে ফেলবা তো। এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেয়া ঠিক হবে না।
বীথি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলেছিল, আমি বলতেছি তো, কোনো সমস্যা হবে না। এত দ্রুত বাচ্চা আমিও নিবো না। তুমি কনডম রেখে দাও। আর কখনো এটা কিনে তোমার টাকা নষ্ট করা লাগবে না।
তখন বিস্তারিত আলোচনা করার মতো ধৈর্য বা পরিস্থিতি না থাকায় আনিস আর কথা বাড়ালো না। তবে খটকা একটা থাকলোই।

ছয় সাতদিন পর একদিন সন্ধ্যা থেকে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। বাসায় বাজার ছিল না কোনো। আনিস বীথিকে বললো খিচুড়ি রান্না করো। সাথে ডিম ভাজি। দোতলার ভাবির বাসা থেকে ডাল আর ডিম ধার করে আনো।
বীথি জানালো, ঘরে ডিম আছে। শুধু ডাউল আনলেই হবে।

ডিম খিচুড়ি পেট ভরে খাওয়ার পর বৃষ্টিভেজা রোমান্টিক রাতে আনিসের ইচ্ছা হলো প্রেম করার। কারেন্ট ছিল না। মোমবাতি জ্বালাতে জ্বালাতে আনিস বীথিকে জিজ্ঞেস করলো, আজও নো প্রটেকশন?
বীথি হাসলো, ইয়েস বেইবি।
আচ্ছা বলো তো, তোমার কি কোনো অপারেশন করা আছে? আমাদের কি কখনো বাচ্চা হবে না?
আরে বাবা এমন কিছুই না। আমি সুস্থ একদম।
তাহলে? আজ আমাকে খুলে বলতেই হবে। আমি কিছুই শুনবো না। বলো তুমি।

সেদিন রাতেই আনিস জানলো তার বউ অন্য মেয়েদের মতো না। বীথি আলাদা। সে আর সবার মতো বাচ্চা জন্ম দিতে পারবে না কখনোই। তার সমস্যা হলো, সে ডিম পাড়ে। এবং আনিস কিছুক্ষণ আগে যে ডিমভাজি খেয়েছে সেটা স্বয়ং তার বউয়ের পাড়া ডিম।

বমি পরিষ্কার করে মাথায় পানি দেয়ার পর আনিস সুস্থ হলো কিছুটা। সে যে শকের মধ্যে চলে গেছিল খবর শুনে, সেটা একটু কমেছে। ঘরে ডিম না থাকার পরও এত বড় ডিমভাজি কই থেকে আসলো এবং সেটার স্বাদ এরকম অদ্ভুত কেন, সে ঘটনা জানার পর বমি আটকে রাখা সম্ভব ছিল না আনিসের পক্ষে।

আলমারির মধ্যে লুকানো দুটা ডিম বের করে দেখালো বীথি। অনেক বড় সাইজ একেকটার। একসাথে তিনটা মুরগির ডিমের সমান। ডিমের রঙও আলাদা। নেভি ব্লু কালারের ওপর হালকা লাল ছোপ ছোপ। বীথি শান্ত গলায় বললো, আনিস, তুমি চাইলে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে পারো।

আনিস ভ্রু নাচালো, আমি কিছুই বুঝতে পারতেছি না। সিরিয়াসলি। তুমি আমাকে বুঝাও। একটা মানুষ কেন ডিম পাড়বে? তুমি কি মুরগীর বাচ্চা?
বীথি রাগলো এবার, দ্যাখো, মুরগীর বাচ্চা বলে অপমান করবা না। মুরগী ছাড়া আরো অনেক প্রাণীই ডিম দেয়।
সে নাহয় দিলো। কিন্তু তুমি তো মানুষ। তুমি কেন দিবা?
সেটা আমি জানি না। প্রকৃতি জানে সেটা। তবে আমার ভুল হয়েছে আমি বিয়ের আগে ব্যাপারটা তোমাকে জানাইনি। আসলে আমার সাহস ছিলো না। ডিম পাড়া একটা মেয়েকে এই সমাজ মেনে নিত না কখনোই। তবে পরে ভেবে দেখলাম, ব্যাপারটা গোপন রাখলে আসলে তোমাকে ঠকানো হবে। তাই বলে দিলাম। এখন তুমি যা খুশি করো। ডিসিশন তোমার হাতে।
আনিস কি বলবে ভেবে পেলো না। একটু ভেবে বললো, আমাদের কি কখনোই বাচ্চা হবে না?
বীথি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, কেন হবে না? ডিমে তা দিলে অবশ্যই হবে। একসাথে চাইলে অনেকগুলা বাচ্চাও হতে পারে। কিন্তু সেগুলা কিসের বাচ্চা হবে আমি ঠিক শিওর না। তবে যদি মানুষের বাচ্চা হয়ও তবুও কোনো ধরনের প্রেগনেন্সি, ক্লিনিক, অপারেশন ছাড়া তোমার বউয়ের একটা বাচ্চা এই সোসাইটি একসেপ্ট করবে না।
আচ্ছা আমাকে ভাবার সময় দাও। এটা ছাড়া সেসময় আর বলার মতো কিছু খুজে পেল না আনিস।

বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেছে। আনিস বীথিকে ছেড়ে দেয়নি। তাদের সংসার খুব ভালোই চলছে। বউ হিসাবে বীথি অসাধারণ। আনিসের ভীষণ কেয়ার নেয়। চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত জানে। জোছনা রাতে ছাদে বসে শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে মেয়েটার প্রেমে পড়ে আনিস। বারবার। রান্নার হাত খুবই ভালো বীথির। বিছানাতেও পারদর্শী। শুধু একটাই সমস্যা, সে ডিম পাড়ে। আনিস মেনেই নিয়েছে। পাড়লে পাড়ে, কী আর করা! রাতে প্রেম করার ইচ্ছা হলে পৃথিবীর সব পুরুষরা বিভিন্ন কথা বলে বউকে কনভিন্স করে। আনিসই একমাত্র ব্যক্তি যে রোমান্টিক গলায় বলে, ভীষণ ডিম খেতে ইচ্ছা করতেছে। হবে নাকি?

এটা সে মজা করেই বলে। বাস্তবে সেই রাতের পর থেকেই সবধরনের ডিম খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে আনিস। নিজের বাচ্চা কিভাবে খাওয়া সম্ভব! তবে আনিস না খেলেও ওর বন্ধুরা খায়। বন্ধুমহলে বীথি ভাবির ডিম রান্নার প্রশংসা কিংবদন্তি আকার ধারণ করেছে। এত সুস্বাদু ডিম নাকি কেউ কখনো খায়নি। অবশ্য তারা এটাকে মুরগীর ডিম ভেবেই খায়। অনেকের বউ এসে জিজ্ঞেস করে, ভাবি, আপনার ডিম রান্নার প্রশংসা শুনি। রেসিপি দেন না।
বীথি হাসে শুধু। বলে রেসিপি তো নাই। সবার মতোই রান্না করি। মেবি আমার ডিমটাই আলাদা।
হাসে তারাও।
এদিকে আনিসের বাবা-মা বাচ্চার জন্য ভীষণ চাপ দিচ্ছে। তারা নাতি-নাতনির মুখ দেখবেই। আনিস প্লেটে ডিম ভুনা উঠিয়ে দিতে দিতে বলে, `খেয়ে দেখেন আপনার নাতি-নাতনি, কেমন!
মানে? কি বলছো?
কিছু না। বাচ্চা হবে টাইম আসুক।
বিয়ের দুই বছর হয়ে গেলো, আর কবে টাইম আসবে? আমরা মরে গেলে?
আচ্ছা খাওয়ার সময় আমরা কথা না বলি এবিষয়ে।
হ্যাঁ, তুমি তো কথা ঘুরানোর ধান্দায় থাকবা। যাই হোক, ডিম রান্নাটা বরাবরের মতোই অসাধারণ হয়েছে। আরেকটা কথা, তোমরা তিনবেলা শুধু ডিম খাও নাকি? তোমার বাসায় আসলেই খালি ডিম দেখি।
বীথি মুচকি হাসে, কি করবো বলেন? ঘরভর্তি খালি ডিম। আপনার ছেলের এনার্জি বেশি তো।
এনার্জি বেশি বলতে?
ইয়ে মানে কিছু না। খালি ডিম কিনে। ডিমে এনার্জি বাড়ে তো, তাই।
আনিসের মা মুখ বাঁকান, বাচ্চা হওয়ার খোঁজ নাই, এত এনার্জি দিয়ে সে করবেটা কি!

আনিসের এখন মাঝে মাঝে নিজেকে ভাগ্যবানই মনে হয়। কয়জন ছেলের বউ এই জামানায় ডিম পাড়তে পারে? আচ্ছা ব্যাপারটা কয়জন হবে না, তার বউই তো পুরো দুনিয়ায় একমাত্র। বীথিই একমাত্র মেয়ে যে ডিম দেয়। তবে এতে আনিসের ক্রেডিটও কি কম? সে-ই তো ডিমগুলোর বাবা। নিজেকে মোরগ মনে হয় ওর। পুরুষদের ঐটাকে তো এমনিতেও ককই বলে, নাকি? হাহাহা, ওরটা আসলেই কক। নিজের মনেই ভীষণ হাসি পায় আনিসের। হাসতে হাসতে হঠাৎ করেই চিন্তাটা আসে মাথায়। মাথা ঘুরে ওঠে ওর। ওহ গড। এটা কি সত্যি!

মনে পড়ে বাসর রাতেই কনডম ইউজ না করার কথা বলেছিল বীথি। তার মানে বীথি জানতো সে ডিম পাড়ে? তার মানে কি দাঁড়ায়? আগেও পেড়েছিল? বীথি ভার্জিন ছিল না? শিট! আর কিছু ভাবতে পারে না আনিস। বীথি ওর সাথে এত বড় প্রতারণা করতে পারলো?

কথাটা শুনে বীথি হাসে। আরে গাধা তোমার চিন্তার কিছুই নাই। আমি অন্য কোনো ছেলের সাথে কিছু করিনি বিয়ের আগে।
তাহলে? কিভাবে জানলে যে, তুমি ডিম পাড়ো?
কারণ আমার আম্মু পাড়তো। আমার নানু পাড়তো। নানুর আম্মুও পাড়তো হয়তো।
তার মানে তো আমাদের বাচ্চা হওয়া সম্ভব। কিন্তু তুমি বলেছিলে তুমি জানোনা কিসের বাচ্চা হবে।
কারণ আমি চাইনি আরেকটা ডিম পাড়া মেয়ের জন্ম হোক।
ছেলেও তো হতে পারে?
কারোর তো হয়নি, আম্মু বা নানুর।
তার মানে যে তোমার হবে না তা তো না। আমি রিস্ক নিতে চাই। মেয়ে হয় হোক, আমার বাচ্চা লাগবেই।

এক বছরের জন্য জার্মানি বেড়াতে চলে গেল আনিস আর বীথি। সেখানেই ডিমে তা দেবে বীথি। দেশে ফিরবে বাচ্চা নিয়েই। বীথি জানিয়েছে, ডিমে তা দেয়ার এক মাসেই বাচ্চা হয়। কিন্তু সোসাইটি এক মাসের বাচ্চা মানবে না বলেই একবছরের জন্য বিদেশ যাওয়া।

মিউনিখের একটা গলির ছোট্ট একটা বাড়িতে নয়মাস যাওয়ার পর ডিমে তা দেয়া শুরু করলো বীথি। দুজনই ভীষণ চিন্তিত। কী যে হবে! কেউ জানে না কিছুই। আরেকটা ডিম পাড়া মেয়ের জন্ম দিয়ে তাকে মানসিক টর্চারের মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাতে বাধ্য করা কতটা ঠিক হবে? আনিসের মতো একটা বর সে কি পাবে? না পাওয়ার সম্ভাবনাই তো বেশি।

তবে একমাস পরে সব চিন্তা দূর হয়ে গেল আনিস আর বীথির। ফুটফুটে একটা ছেলে নিয়ে দেশে ফিরলো এই দম্পতি। বাবা-মাসহ সবাই খুব খুশি। ছেলের নাম রাখা হলো নাঈম। তলপেটে বেল্ট বেধে অপারেশন হইছে এরকম একটা অভিনয় করলো বীথি। দেখা গেল, ডিম পাড়া ছাড়াও তার অনেক গুণ। অভিনয়ে বেশ ভালো সে।

কিছুদিন পর আরেকটা বুদ্ধি বের করলো দুজন মিলে। জার্মানি এক বছর থাকাতে বেশ টাকাপয়সা খরচ হয়ে গেছে। এখন ভীষণ হাতটান চলতেছে আনিসের। তাই সে বাসায় রাজহাঁসের খামার করলো। এবং একদিন বলা শুরু করলো তার একটা রাজহাস অদ্ভুত ডিম দেয়। খেতে অসাধারণ। হু হু করে বাড়া শুরু করলো ডিমের কাটতি। বেশ ভালো ইনকাম আসতে লাগলো রাজহাসের ডিমের সাইজের ডাবল অদ্ভুত এই ডিম বিক্রি করে।

কয়েকদিন পর আনিসের আয় আরো বাড়লো। ডিমের পাশাপাশি খামার থেকে লিটার লিটার দুধ বিক্রি শুরু করলো সে। কারণ তার একমাত্র ছেলে নাঈম অন্যদের থেকে আলাদা। সে-ই পৃথিবীর একমাত্র ছেলে, যে প্রসাব করে না। দুধ দেয়!