সংগৃহিত
অ ও আ
পর্ব ২
মোহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ ফয়সলপ্রকাশিত : জুলাই ২০, ২০১৮
সময়ের চক্রাবর্তনের সমাপ্তি না ঘটলে হয়তো অনুভূত ব্যক্তির স্বাধীনতার পরাজয় ঘটতো না! পরাজয়ের গ্লানি যদি আত্মা গ্রহণ করতে পারতো, তবে হয়তো আত্মার মৃত্যুতে এতোটা শব্দহ্রাস হতো না। জীবন চাকার গাড়িতে পারতপক্ষে মৃত শব আর গলিত আত্মার বসবাস। কারণ, মৃত শব ও গলিত আত্মার বিবচ্ছেদে পরিচয়, আক্রোশের ঘ্রাণ আর সময়ের কালাবর্তনের কালিমা এখন শরণাপন্ন! ঘড়ির কাঁটায় রাত ২টা ছুঁই ছুঁই! বাইরের আগন্তুক ঝুম বৃষ্টি যখন গগনের বুক চিরে ধরণীতে এসে বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে পৃথিবীকে স্পর্শ করে, তখন শাশ্বত সময়ের জন্য প্রতিটি জীবকণা স্বস্তিকা অনুভব করে! আর, সে সাথে আজকের অম্যাবসা রাতের বৃষ্টি কেন জানি শুভ্রকে অক্সিজেনের অনুভব করাচ্ছে! গড়পততায় থাকা বেশ প্রস্থত বারান্দায় বসে মৃদু আওয়াজে রবীন্দ্রসংগীত শুনছিল শুভ্র। রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি নিজের বিন্দুমাত্র আগ্রহ না থাকলেও কাঁঠালপাতায় গড়া ঠোঁটের অধিকারিনী শুভ্রার বেশ পছন্দের। ঘর থেকে মৃদু আওয়াজে বেজে আসছিলো শুভ্রার অনেক প্রিয় একটি গান, “....আজি ঝড়ো ঝড়ো মুখরো বাদালো দিনে, জানি নে, জানি নে....” আর গানের প্রতিটি লয়-সুর-তাল শুভ্রকে সুরের মোহে প্রচ্ছন্ন করে তুলছে। সশব্দে বেজে উঠা এক বজ্রঝড় পুরো ধরণীকে জাগিয়ে দেওয়ার মুহূর্তে কোমল এক হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠে শুভ্র! অজানা এক সংকোচনে যেন দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকে কপল বেয়ে, ক্ষণিকের মাঝে শুভ্র যেন সেটিকে আলিঙ্গন করে স্নান করে নেয়! দ্বিতীয় বজ্রঝড়ের শব্দে চেতন ফিরে আসামাত্র শুভ্র সশব্দে বলে উঠে- “তুই?”
“হুম্মম, আমি! .....কেনো, আমি কি আসতে পারি না?” টিপটিপ চোখে বলে উঠলো মেয়েটি।
“অবশ্যই আসতে পারিস। এটা তোর ঘর, যেখানে খুশি তুই সেখানে আসা-যাওয়া করতে পারিস।”
“ঘুমাস নি কেন এখনো, শুভ্র?”
“ঘুম আসছে না কেন জানি! মাথাটা ঝিম ধরে আছে।”
“তোকে আমি কতবার না করেছি যে, ঘুমোনোর আগে সিগারেট না খাওয়ার জন্য!”
“আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি!”
“তাহলে এতো রাতে কি এখানো ওয়াজ-নসিহত শুনতে এসেছিস!....আশ্চর্য, কোনো একটা কথাও শুনিস না তুই আমার শুভ্র। মেডিকেল সাইন্স বারবার বলেছে, ঘুমোনোর আগে সিগারেট না খাওয়ার জন্য! কিন্তু, কে শুনে কার কথা?” ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলো মেয়েটি।
“দ্যাখ, আমাকে মেডিকেল সাইন্স পড়াতে আসিস না। ঢের জানি তোর মেডিকেল সাইন্সকে!” মেয়েটি শুভ্রকে টেনে রুমের ভিতর নিয়ে গেলো, হালকা নীল দেওয়া ডীম আলোটি এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশকে জন্ম দিচ্ছিলো। মেয়েটি শুভ্রের হাত ধরে টেনে নিয়ে সোফায় সামনে এনে বললো –
“বস নিচে!” বিনাবাক্য ব্যয়ে শুভ্র টাইলস ফ্লোরে বসে গেলে মেয়েটি ‘নবরত্ন তেল’ এর বোতল থেকে তেল হাতের তালুতে ঢেলে দু’হাত দিয়ে শুভ্রের ‘মাথা ম্যাসেজ’ করতে থাকে।
বিড়বিড় কন্ঠে শুভ্র বলে উঠে – “তুইও পারিস বটে! এই রাত-বিরাতে বিছানা থেকে এতো প্রখর একটা ঘুম ছেড়ে আমাকে সামলাতে গিয়ে দ্যাখ তোর কতো কিছু করতে হচ্ছে। .....কি দরকার ছিলো এতো কিছু করার?”
“শোন, বেশি বক বক করিস না! চুপচাপ কথা না বলে বসে থাক আর আমাকে আমার কাজ করতে দে।”
দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে দিয়ে শুভ্র বলে উঠে, “.....তোদের মেয়েদের মন বুঝতে পারা যে কতটা কষ্টদায়ক এটা আমি আজও টের পাচ্ছি!” শুভ্রের কথার রেশ টেনে মেয়েটি সে মুহূর্তে জিজ্ঞেস করলো –
“মেয়েদের? আমার পর আর কয়টা মেয়েকে বুঝতে গিয়েছিস তুই, শুভ্র?” বলে হ্যাঁচকা টান দেয় শুভ্রের চুলগুলোতে।
“আহ! কি করছিস, লাগছে তো। ....ছাড় না, ব্যথা পাচ্ছি কিন্তু!”
“তোর কি মনে হয় আমি তোকে আদর করার জন্য দিচ্ছি?....বল, তুই ‘মেয়েদের’ কেন বললি? অনেক কিছু গোপন করছিস আমার কাছ থেকে, সত্য সত্য বল কি হয়েছে তোর? সপ্তাহখানিক ধরে তুই বেশ মনমরা থাকছিস, আমার দিকেও তোর কোনো নজর পড়ছে না। .....তুই কি কোনো অ্যাফেয়ার করছিস, শুভ্র?”
“দ্যাখ, যা তা বলিস না! মাথাটা এখনো ঝিম ধরে আছ, পারলে ‘ম্যাসেজ করে দে। নাহলে ঘুমোতে যা।” শুভ্রর অবয়ব অনেকটা গাঁয়ের শেষ ধারে নদীর পাড়ে সাদা কাশফুল গুলোর মতো! দেখে যেন মনে হবে, কে যেন এইমাত্র শুভ্রকে দুধের নদীতে স্নান করিয়ে এনেছে! কিন্তু, সেই শুভ্রর চেহারা এখন রক্তিম লাল দেখাচ্ছে! ঠিক যেমনটা হয় সূর্যস্নানের সময়! গোধূলি ছুঁই ছুঁই ক্ষণে সূর্য যখন গঙ্গার জলে স্নানে যায়, তখন যে রূপ বেয়ে পড়ে শুভ্রর চেহারায়ও সেই আভা দেখা দিচ্ছে!
“কিরে, ঘুমিয়ে পড়েছিস?”
“...হ..হু...ম্ম..রে, বড্ড আরাম পেয়েছিস তোর ‘ম্যাসেজে।’ থ্যাংক ইউ। বল, কি চাই তোর আমার কাছে? কি আবদার আছে?”
“....আমাকে থ্যাংক ইউ দিতে হবে না। আর, আমার চাওয়ার কিচ্ছু নেই। আমার শুধু তোকে চাই, এই বদলে যাওয়া শুভ্রকে নয়। পুরোনো শুভ্রকে চাই।”
“আরে মেয়ে, তুই বড্ড সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিস তো! এতোটা দুশ্চিন্তা করিস না, আমি তোর আছি, থাকবো।”
“শুভ্র, শুধু এটা বলবো যে ধোঁকা দিস না আমায়। কারণ, তুই জানিস আমি ওটাকে সহ্য করতে পারবো না! .....আর তখন, লাশ তখন শুধু একটা না, বেশ কয়েকটা পড়ে থাকবে।” মেয়েটি গম্ভীর কণ্ঠের কথাগুলো বেশ একটা আড়ম্বর পরিবেশের সৃষ্টি করে ফেলছিসো, বিছানায় যেতে যেতে মেয়েটি বললো –
“লাইট অফ করে দিস।”
তখনো বিগড়ে যাওয়া পরিস্থিতে অনাড়ম্বর করতে শুভ্র বললো - “দোলা, তুই জানিস আমি তোকে কতোটা ভালোবাসি। এভাবে বলিস না, প্লিজ।”
“শুভ্র, আমি তোর ঘরের বউ। এটা মনে রাখিস শুধু। .....ঘুমিয়ে পড়।”
(চলবে)