অ ও আ
পর্ব ১
মোহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ ফয়সলপ্রকাশিত : জুলাই ১১, ২০১৮
নিশ্চুপ প্রকৃতির কথাগুলো অন্য ধাঁচের এক শঠতায় আবৃত। অদ্ভুত রকমের এক মায়া যেন চক্রের মতো কুন্ডলি দিয়ে ঘিরে রেখেছে এখানে। কথাগুলো এলোমেলো নিশ্চুপতার রাজ্যে হারিয়ে যায়, যেন এক স্থবিরতা সাপের মতো কুন্ডলি পাকিয়ে বসে আছে। নিশ্চুপতার মাঝে কেমন জানি এক কান্নার শব্দ লুকিয়ে আছে, আর সে কান্না বড্ড বেদনাদায়ক!
রাজধানী ঢাকার আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি, উঁচু দালানের ইটগুলো থেকে মাঝে মাঝে রক্ত ঘাম করা শ্রমিকের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। ইট-পাথরের শহরে নিত্য নতুন সামগ্রী আবেগের রাস্তাকে পথভ্রষ্ট করে প্রতিনিয়ত, অজানা হাজারো শব্দবিলাস ভেসে বেড়াতে থাকে শহরের বাতাসে। ৭/এ এর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধানমন্ডি লেক তেমনি ভাবে সাক্ষী হাজারো অঙ্কুরিত-বিনষ্ট আবেগের, ভালোবাসার। লেকের পাড়ের প্রতি বৃক্ষ হাজারো সম্পর্কের সাক্ষী, আর সাক্ষী কিছু হারিয়ে যাওয়া মানুষের।
“....শুভ্র, আমি প্যাগনেন্ট!” পাশে বসে থাকা মেয়েটি সহসা বলে উঠলো।
“কি? তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস নাকি, শুভ্রা ? কি বলছিস আবোল তাবোল! মাথা কি পুরোটাই গেছে!” মেয়েটির পাশে বসে ছেলেটি বিমূর্ত কণ্ঠে বলে উঠলো।
“না শুভ্র, আমি সুস্থ মস্তিষ্কে বলছি।
.....দাঁড়িয়ে পড়েছিস কেন? বসে পড়, আমাদের কথা বলতে হবে!” ছোট্ট করে জবাব দিলো শুভ্রা।
শুভ্রার কাঠাঁল পাতার মতো ঠোঁটটা যেন আজ ভুতুড়ে শব্দ দিচ্ছে! ওর শুকনো হাসিটা কেমন করে জানি শুভ্রর কাঁচা হৃদয়কে টান দিয়ে ধরে! এতো বছরের পরিচয়, সম্পর্কে কখনো শুভ্রা এমনটা বলেনি। শুভ্র-শুভ্রা’র সম্পর্ক পিচ্চিকাল থেকে, নার্সারির ‘টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটল স্টার.....’ পড়তে পড়তে শুভ্র নীলাভ হৃদয়ের তারায় বসে গিয়েছিলো শুভ্রা। এতোদিনের পরিচয়ে কত কিছু না ঘটে গেলো; শুভ্রা বাবার মৃত্যু, ভালোবেসে সারাটি জীবনের অঙ্গীকারনামায় সই করা শুভ্রার মায়ের মৃত্যু! প্রতিটি সঙ্গতে শুভ্রার ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো শুভ্র, কখনো বিন্দুমাত্র সময়ের জন্য কোনোকিছু টলাতে পারে নি শুভ্রকে। কিন্তু, আজ শুভ্রের হৃদয়ে এক ঝড় উঠেছে, এ ঝড় যেন নিজেকে নিজের ভিতর জ্বালিয়ে ছাই করে দিবে। কিন্তু, কেন এমন.....
“শুভ্র, চুপ কেন তুই? আমার কিন্তু ভীষণ ভয় লাগছে...” শুভ্রার কথার টানে নিজের চিন্তা জগত থেকে বেরিয়ে আসে শুভ্র।
“শুভ্রা, তুই কি সত্যি বলছিস? দেখ, এখন কিন্তু একদম মজা নিবি না! আমার পা কিন্তু কাঁপছে...!”
“শুভ্র, আমি সিরিয়াস!
....আমি বাসায় টেস্ট করেছি!” মাথা নিচু করে বলে উঠলো শুভ্রা।
“বাসায় টেস্ট করেছিস মানে? কে কিনে দিয়েছে তোকে?....তুই এতোসব কিভাবে জানলি? আর এতো পণ্ডিতি করতে তোকে কে বলেছে?” চেঁচিয়ে বলে উঠলো শুভ্র।
“আশ্চর্য! তুই এভাবে চেঁচিয়ে কথা বলছিস কেন? লোকজন দেখছে কিন্তু আমাদের, শান্ত হয়ে বস!” বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ডান হাত টেনে বসালো শুভ্রকে।
“...স্যরি শুভ্রা! আসলে নিজের কন্ট্রোল করতে পারি নি।....আর, তুই তো আমার রাগ জানিস, তুই ছাড়া ওটাকে কেউ আয়ত্তেও আনতে পারে না!”
“হয়েছে, থাক!.....কে কিনে দিয়েছে, কিভাবে জানলাম এসব প্রশ্নের মানে কি শুভ্র?
....শুভ্র, প্লিজ তুই নরমাল হ!” উৎকন্ঠা ভরা কন্ঠে জবাব দিলো শুভ্রা।
“সিরিয়াসলি! তুই আমাকে নরমাল হতে বলছিস, কিভাবে আমি স্বাভাবিক হবো?” আবারো চেঁচিয়ে উঠলো শুভ্র।
“শুভ্র......” চোখগুলোকে বেশ বড় করে কোটর থেকে বেরিয়ে এনে আদেশের সুরে শুভ্রকে ডাক দিলো শুভ্রা, যেন আদেশ অমান্য করার কারণে বিধাতা রুষ্ট হয়ে অভিশাপ বর্ষে দিবেন।
“ওকে, ফাইন! আই এম স্যরি! চেঁচানোর জন্য দু:খিত!
....আমি মাফ চাচ্ছি, কিন্তু তুই তো জানিস আমি কোনোভাবে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি নি এমন সিচুয়েশনে!” ভাঙা কন্ঠস্বরে বলে উঠলো শুভ্র।
“শুভ্র, ইটস অকে। আমি রাগ করি নি। আমি তোকে জানি, চিনি এবং বুঝি! কিন্তু, আমার অবস্থানটাও তোকে বুঝতে হবে।
.....তুই আমাকে বল আমি কি করবো এখন?” শুষ্ক কণ্ঠে জবাব দিলো শুভ্রা।
“শুভ্রা, তুই একদম চিন্তা করিস না। আমি সবকিছু সামলে নিবো।
.....আচ্ছা, তুই কাকে কাকে বলেছিস? কেউ কি জানে?...কাউকে জানিয়েছিস?” কাঁচুমাচু হয়ে জিজ্ঞেস করলো শুভ্র।
“শুভ্র, তোর কিন্তু বুদ্ধি বেশ লোপ পাচ্ছে দিনে দিনে। আজব কথা বলছিস তুই! মনে হয় আমি মেট্রিকে জিপিএ-৫ পেয়েছি আর সেটা আমি পাড়ায়-মহল্লায় ঢোল পিটিয়ে পিটিয়ে জানাবো, তাই না?” কড়মড় কণ্ঠে জবাব দিলো শুভ্রা।
“না, আমার কিন্তু সেটা বুঝাইনি; তুই শুধু শুধু চিৎকার করছিস আমার সাথে....”
“ও, আচ্ছা...তাই বুঝি!
তুই কি বুঝতে পারছিস আমার সিচুয়েশন?
...শুভ্র, আমি প্যাগনেন্ট। আমি মা হতে.....” কথা শেষ করার আগে শুভ্রা মুখ চেপে ধরলো শুভ্র। তবুও ততক্ষণে বেশ কিছু চোখ এসে পড়েছে ওদের দিকে। শুভ্রার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর সহসা পরিবর্তন করে দিয়েছিলো পরিবেশকে, উৎসুক জনতার দৃষ্টি নন্দিত চোখগুলো মজা লুটে নেবার জন্য ক্ষণে ক্ষণে পলক ফেলে যাচ্ছিলো। কিন্তু, শুভ্র শুভ্রার মুখ চেপে ধরে টেনে বসিয়ে দেবার কারণে কিছু রক্তলোভী মানুষের চোখের খাবার ছিনিয়ে গেলো, নাক ছিঁটকে যে যার মতো কাজ করে যেতে লাগলো।
“শুভ্রা, কি করছিলি তুই? এভাবে চিৎকার করছিলি কেন? সিচুয়েশন কিন্তু আমাদের হাতের বাইরে এখনো যায় নি।
....অকে, আই এম স্যরি। আমি আমার প্রশ্ন উঠিয়ে নিচ্ছি!” শান্ত কণ্ঠে বললো শুভ্র।
“না শুভ্র, এবার আমি স্যরি। আমার মেজাজ হঠাৎ করে বিগড়ে গেলো; কেন গেলো, কিভাবে গেলো বুঝতে পারছি না রে...! কাউকে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না, তাই সাহস করে তোকে বলেছি।.....আমার খুব ভয় করছে, শুভ্র...!” বলতে বলতে কেঁদে ফেলে শুভ্রা, চোখ থেকে অনবরত টপটপ ফোঁটায় মুক্তার মতো ঝরঝরে অশ্রুকণা বেরিয়ে আসে থাকে।
শুভ্র শুভ্রার হাতটা টেনে নিজের পাশে বসালো, অশ্রুকণায় বাঁধ দিলো ওর আঙ্গুলের স্পর্শে! নিজের কাঁধটা বাড়িয়ে দিয়ে শুভ্রার হারিয়ে যাওয়া হাসির মুখটাকে অবলম্বন দিলো। সেসময়ে শুভ্র তাকিয়ে আছে ভবিষ্যৎ ক্ষণের দিকে, মাথাটা কেমন জানি ঝিম ধরে আসছে! মনে হচ্ছে দুনিয়াটাকে কে জানি উলটে দিলো সময়ের অতল গহ্বরের মাঝে....।
(চলবে)