me too এবং বাংলাদেশ

লাবণী মণ্ডল

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৮, ২০১৮

me too আন্দোলনটা বাংলাদেশের মতো চরম পুরুষতান্ত্রিক, ভোগতান্ত্রিক, পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে এগুতে পারবে না- এটা আগেও বুঝেছিলাম। এর পেছনে কারণ রয়েছেও বটে! আন্দোলন শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যে প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হতে হয়েছে, যে প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন আরও হতে হবে তা নিয়ে দু’চার কথা লেখার প্রয়োজনবোধ করছি। 


১. এত দিন কেন মেয়েটি/মেয়েরা মুখ খোলে নি?
২. এখন বিদেশে গিয়ে, নিজের ফেসভ্যালুর জন্যই এসব করছে!
৩. এ আন্দোলনের শ্রেণীচরিত্র কি?
৪. এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কি ‘নারীমুক্তি’ আসবে, এই নারীরা ‘নারীদের’ অন্য আন্দোলনে যুক্ত হবে কী?
৫. এ আন্দোলনের খবর কি শ্রমিক, কৃষক নারীরা জানে?
৬. এই আন্দোলনটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় কী? 
৭. এই আন্দোলন কারো এজেন্ডা হয়ে কাজ করছে না কী?
৮. আপনি তো বামপন্থী মতাদর্শের, আপনার মত কী? 
৯. এই আন্দোলনটার কোনো মানেই হয় না- এটা তো পুরুষদের জীবনেও ঘটে! 
১০. ফালতু একটা আন্দোলন নিয়ে আপনারাও লিখছেন কেন? যে আন্দোলনের শ্রেণীচরিত্র একেবারেই এলিট শ্রেণীর! 

 

এরকম বহু প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। প্রশ্নগুলো শুনে হতবাক বা অবাক হইনি। বরং প্রশ্ন গুলোর সম্মুখীন হওয়া উচিত ছিল। যারা প্রশ্ন গুলো তুলেছে তাদেরকে বোঝাটাও জরুরি ছিল। যারা প্রশ্ন তুলেছে তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়! প্রগতিশীল, বামপন্থী পুরুষের সংখ্যাও কম নয়। সব গুলোর প্রশ্নের উত্তর আমার যতটুকু বোধশক্তি আছে ততটুকুই দিয়েই দেওয়ার চেষ্টা করছি।

 

 

‘এতদিন কেন মেয়েরা মুখ খোলেনি’- এতদিন মেয়েরা মুখ খোলেনি কথাটা সত্য নয়। মেয়েরা নিজেদের মতো করে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সব চেয়ে কাছের মানুষটির কাছে মুখ খুলেছে, বলেছেও। কিন্তু, এটাকে গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করাতে পারে নি। প্রথম জীবনে যে ঘটনাগুলো ঘটে সে ঘটনাগুলোর কথা মা, দাদীদের বলেও কোনো লাভ হয় না, আড়াল করার চেষ্টা চলে। মেয়েটিকেই সাবধান হওয়ার জন্য বলা হয়। এরপরের তথাকথিত ফেমাস ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যে ঘটনাগুলো সেগুলো বলার জন্য যে পরিমাণ সাহস থাকা দরকার, যে পরিমাণ সার্পোট থাকা দরকার তা নারীরা পায় না। তাদের ভয় থাকে। নিজেদের মান-সম্মান, আত্মসম্মানবোধ নিয়েও চিন্তা করে। তথাকথিত সামাজিক মূল্যবোধও কাজ করে। এটা দোষের কিছু নেই, এটা এখন প্রকাশ করতে পারবে না বলেও কোনো কথা নেই। যখন মেয়েরা সুযোগ পাবে, যখন মনে করবে বলা উচিত তখনই বলবে এটাই স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেওয়া উচিত। যারা মানতে পারছে না বা যারা এর পিছনে সন্দেহবাতিক মনোভাবের প্রকাশ ঘটাচ্ছে তাদের অতীত ইতিহাসে কোনো কালিমা আছে যার ভয়ে ঘুমও হারাম হচ্ছে কিছুটা। লক্ষ লক্ষও নারী এখনও বলতে পারছে না। যেমন: আমিও এখন অব্দি কোনো কথা বলতে পারছি না। তবে জীবনে কোনো একদিন বলবো না ব্যাপারটা তাও নয়! সাবধান থাকবেন কিন্তু প্লিজ! হে, মেয়েরা মুখ খোলো, যার যার অবস্থান থেকে মুখ খোলো। এই আন্দোলনটা এগিয়ে যাক। এটাকে ভিন্ন দিকে মোড় ঘুরিয়ে, বিপ্লবী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে আন্দোলনটাকে বানচাল করে দেওয়ার যে অপচেষ্টা তার বিরুদ্ধে আমাদের কলম চলুক আপাতত। 

 

 

‘এখন বিদেশে গিয়ে, নিজের ফেসভ্যালুর জন্যই এসব করছে!’ একেবারেই বিবেকবুদ্ধিহীন কথা। এ কথার কোনো ভ্যালু নেই। নিজের ফেসভ্যালুর জন্য এসব করতে হয়নারে- পুরুষ! ফেসভ্যালুর জন্য আর বহু পথ সমাজে আছে। প্রিয়তী, সেমন্তীরা আসলে যাদের প্রসঙ্গে মুখ খোলেছে তাদের প্রসঙ্গে এই বাংলাদেশে থেকে মুখ খোলাটা একটু অসম্ভবই ছিল। শুরুটা ওরা করে দেওয়ার পর যদিও বাংলাদেশের মেয়ে বন্ধুরা নির্ধ্বিদায় মুখ খুলেছে। সুতরাং, এটা ফেসভ্যালুর আন্দোলন নয়। এটা তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সাহসের সাথে বলে দেওয়া, ভবিষ্যৎ কন্যাশিশুদের সুন্দরের জন্য আগাম সতর্ক বাণীও বলা চলেও! যেমন: আমি আমার কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাববো। যারা এধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে, তারাও কোনো না কোনো নিপীড়ক। এ কথাটি স্পষ্টকরণ করার জন্য তাদের সন্দেহই যথেষ্ট। সাধু সাবধান! 

 

 

‘এ আন্দোলনের শ্রেণীচরিত্র কি?’ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। যারা এ প্রশ্ন তুলেছে তাদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা রেখেই বলছি এটা কোনো শ্রেণীসংগ্রামের আন্দোলন নয়, হ্যাঁ, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে কোনোকিছুই শ্রেণীচরিত্রের বাইরে নয়। এই আন্দোলনও এখন পর্যন্ত একটা শ্রেণীর মধ্যেই অবস্থান করছে। কিন্তু, এই শ্রেণীটাও কিন্তু নিপীড়নের শিকার- এটাকে আমলে নিতে হবে। নারী হওয়ার কারণে তাদের নিপীড়নের মাত্রা ভিন্ন হলেও, তারা নিপীড়নের শিকার হয়। অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন, পুরুষও তো হয়! সে প্রসঙ্গে পয়েন্ট আকারে পরে আসছি। এ আন্দোলনটার মধ্যদিয়েই সমাজ পরিবর্তন হয়ে যাবে, সমাজতন্ত্র এসে যাবে, সাম্যবাদ এসে যাবে তাও ভাবা উচিত হবে না। তবে, ‘হ্যাঁ’ এই আন্দোলনটা একটাকে শ্রেণীকেই সার্পোট দিচ্ছে। এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে না- কোনো নারী শ্রমিক বা কৃষক নারী। তার মানে এই আন্দোলনের কোনো ভ্যালু নেই। এই আন্দোলনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই ব্যাপারটাকে এভাবে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। এই আন্দোলনের মধ্যদিয়েই নারীরা ‘পুরুষতন্ত্রধারণকারী’ পুরুষদের চরিত্র কিছুটা উন্মোচক করুক না! আমাদের কি খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে? কিংবা আমাদের পুরুষ বন্ধুদের কি নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নাকি? আরে বাবা, জীবনে কোনো একদিন কোনো ঘটনা যদি ঘটিয়েই থাকেন, তার জন্য একটু অনুশোচনা করুন, নিজেকে শুধরান। সমস্যা নেই তো! পুরুষতন্ত্র মানুষের মজ্জাগত সমস্যা। এই সমস্যাটাকে জিইয়ে না রেখে শোধরানো সম্ভব। শোধরানোর প্রস্তুতি নিন। আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না প্লিজ। প্রয়োজনে পাশে থাকুন, নচেৎ দূরে থাকুন- চুপ থাকুন। উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে নিজের স্বজাতির প্রতি অন্ধপ্রীতি দেখিয়ে নিজেদের মুখোশটা আর উন্মোচন করার দরকার কি? আর যদি মনেই করেন দরকার আছে, তবে করুন! এতে আমাদের সুবিধা হয় বটে! নারীরা লিখে যাও, প্লিজ লিখে যাও।

 


‘এ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে কি ‘নারীমুক্তি’ আসবে, এই নারীরা ‘নারীদের’ অন্য আন্দোলনে যুক্ত হবে কী?’ একটু ধীরগতিতে আগাতে হয়। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তাই তো বলে নাকি! এত তাড়াহুড়ার কি আছে? এই যে, নারীরা তাদের যৌননিপীড়কদের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে, তাদের বিচার দাবি করেছে, তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছে- একটা সময় পর্যন্ত আমরা এটাও তো ভাবতে পারি নি- তাই নয় কী! ঠিক, এখনই এই নারীরা আমাদের ‘নারীমুক্তি’ আন্দোলনে যুক্ত হবে না, সকল শ্রেণীপেশার মানুষের মুক্তির আন্দোলনে যুক্ত হবে না- এটা আমরা এখনই সীমারেখা টেনে দিতে পারি কি? আমাদের সংগ্রাম, সংগঠন, আন্দোলন, লড়াই বিকশিত হলে এরা আমাদের পাশে কেন দাঁড়াবে না, যুক্তিটা কি? এরা কি মুক্ত হতে চায় না, এরা কি পুরুষতন্ত্রের ভয়াল থাবায় আক্রান্ত না? এরা কি ভোগবাদের শিকার না? অবশ্যই! এগিয়ে আসবে! আমাদের কাজটা হোক এদেরকে সংগঠিত করার, এদেরকে পাশে টানার। সবাই মাঠে নেমে যাবে, সবাই শ্রেণীচ্যুত হয়ে যাবে- ব্যাপারটা তাও নয়! তবে এই সমাজের ভণ্ডদের বিরুদ্ধে মুখোশ খোলা জরুরি ছিল- নয় কী? রফিকুল, প্রণব সাহা, বিজু, মাহিদুল, সেলিম আল দীনদের মুখোশটা খোলা উচিত ছিল নয় কী? তাদেরকে চেনা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের জরুরি ছিল নয় কী? এই আন্দোলনের পাশে থাকুন। মেয়েরা মুখ খোলো প্লিজ। প্লিজ!

 

 
‘এ আন্দোলনের খবর কি নারী শ্রমিক, কৃষক নারীরা জানে?’ এই আন্দোলনের খবর এখনই নারী শ্রমিক-কৃষক নারী জানবে না। কেননা, তারা আমাদের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার মানুষ না! এরা সোশ্যাল মিডিয়ার অংশ না। কিন্তু, এই আন্দোলনটার প্রয়োজনীয়তা যখন নারী শ্রমিক, কৃষক শ্রমিকরা বুঝবে তখন তারাও বলবে। তাদের বলার ভঙ্গি, দৃষ্টিভঙ্গি যেরকম হবে তাও একটু বলছি- ‘ওরে আমার দাদা, আমার ফুফা, আমার ভাইয়ের বন্ধু আমার বুকে চাপ দিয়া ব্যথা দিছিল, আমার ঠোঁটে কামড় দিছিল, আমি কিছু কইতে পারি নাই, আপনারা কইছেন আপনাগরো ধন্যবাদ। আপনাগর পাশে আছি। গার্মেন্টস শ্রমিকরা বলবে, সুপারভাইজার, লাইনচিপ আমার বুকে চাপ দিয়া কইছিল- ক’জনের লগে শুই ছিলিরে, এত ঢিলা ক্যা, সুপারভাইজার লাঞ্চের সময় একটু স্টোররুমে আসিস, যাওয়ার পর জোর করে তার ঠোঁট আমার ঠোঁটে কামড় দিছিল।’ ইত্যাদি। তখন কি করবেন? আপনারা কি বুঝতে পারছেন না এই আন্দোলনটার প্রয়োজনীয়তা? এই আন্দোলনটা এগিয়ে যেতে পারে? এই গার্মেন্টস নারীরা বলতে পারে, কৃষক নারীরা বলতে পারে তাদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা। অবশ্যই পারে! বরং তারা আরও বেশি পারে, জাস্ট তাদেরকে উসকিয়ে দিয়ে, সংগঠিত করার কাজটা আপনার/আমার করতে হবে। সুতরাং নারীরা লিখে যাও, সাধু সাবধান!!

 

 

‘এই আন্দোলনটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় কী?’ এই আন্দোলনটা মোটেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। কাউকে হেয় করা বা কারো পিছনে লেগে থাকাও নয়। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের দ্বারা এমন কাজ সম্ভব নয় বলে কি মনে করেন আপনারা? বিজুর খবর জানে না এরকম- কবি, সাহিত্যিক, লেখক, প্রকাশক কি এসমাজে আছে? প্রণবসাহর কথা আর কি বলবো- মিডিয়ার জগতের মানুষ। জাস্ট বুঝে নেন! রফিকুল পাওয়ারফুল পুরুষ। মাহিদুল আবৃত্তির আকৃষ্টতায় আকৃষ্ট করে নারীদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে- আহা! সেলিম আল দীন তার প্রসঙ্গে কোনো কথাই চলে না। জোর করে, নিজের বিশালত্ব প্রমাণ করতে চায় তখন তো তা কারো না কারো লেখনীতে উঠে আসবেই! সুতরাং, এ আন্দোলনটাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কেন হবে? কি লাভ এসমস্ত নারীদের? কি এমন স্বার্থ? আপনারা মাথায় একটু বিবেক রাখুন। নারী-পুরুষ উভয় অন্ধপ্রীতিধারণকারীদের বলছি। প্লিজ, আন্দোলনটাকে সহযোগিতা করুন। নারীরা মুখ খোলো। ফেমাসরা সাবধান। 

 

 

‘এই আন্দোলন কারো এজেন্ডা হয়ে কাজ করছে না কী?’ হ্যাঁ আন্দোলনটার মধ্যে এজেন্ডা আছে। তা হলো ‘নারীদের’ এজেন্ডা। নিজের এজেন্ডা। সকল যৌননিপীড়কের বিরুদ্ধে এজেন্ডা। এই এজেন্ডায় কারো যদি খুব ক্ষতি হয়, সে ক্ষতিটা হোক। আমরা চাই। এতে কারো যদি বিশাল ক্ষতি সাধিত হচ্ছে বলে, উলঙ্গ হয়ে দৌঁড় দেয়, দিক না! তাতে, যারা চরিত্র উন্মোচন করছে, তাদের কি? এরকম এজেন্ডাধারীদের সংখ্যা বাড়–ক। আপনিও লিখুন, নারীরা লিখুক। নারীরা মুখ খোলো প্লিজ!

 

 

‘আপনি তো বামপন্থী মতাদর্শের, আপনার মত কী?’ হ্যাঁ, আমি বামপন্থী মতাদর্শকে ধারণ করি। আমি কমিউনিজমে বিশ্বাস করি। সকল শ্রেণীপেশার মানুষের মুক্তি চাই। সেই মুক্তির জন্য এই সমাজটাকে পরিবর্তন করতে চাই। সমাজ পরিবর্তনের জন্য যতটুকু অবদান রাখা উচিত ততটুকু না পারলেও চেষ্টা করছি। হয়তো চিন্তার বিকৃতি না ঘটলে আজীবনই করবো। মার্ক্সবাদকে জীবনে ব্রত হিসেবেই গ্রহণ করেছি। কিন্তু, কথা হলো মার্ক্সবাদীরা কি এসব আন্দোলন নিয়ে কথা বলবে না, এদের পাশে দাঁড়াবে না, এদেরকে সমর্থন দিবে না, এদেরকে সহযোগিতা করবে না- কেন করবে না? কোথায়, কোন অভিধানে লেখা আছে? কোন দলিলপত্রে লেখা আছে? কেন, মার্ক্সবাদী ধারণকারী পুরুষরা কি আকাশ থেকে টুপ করে পড়েছে, মাটি ফেটে বের হয়েছে, নারীরা কি নির্যাতনের শিকার হয়নি? এই রাজনৈতিক নেতারা কি কোনো দিন কোনো নারীকে যৌনহয়রানি করে নি? কোনো পুরুষ কমরেড কি তার নারী কমরেডটিকে জোর করেনি? তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে স্পর্শ করেনি? তার গায়ে হাত দিয়ে নরম না শক্ত তা অনুভব করেনি? তুমি অনেক যত্মশীল বলে ঘাড়ে, মাথায়, ঠোঁটে হাত বোলায় নি- হাহাহাহাাহাহ! প্রশ্ন উঠছে আরও, রাজনীতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কখন মুখ খুলবে নারীরা? আমি চাই, মুখ খুলুক নারীরা। আমি জানি, বহু নারী এ সমস্ত নেতাদের প্রলোভনে পড়েছে, যখন বুঝতে পেরেছে তখন তো আর কিছু করার ছিল না। সুতরাং, আমি বামপন্থী মতাদর্শকে ধারণ করি বলেই, এ আন্দোলনটাকে আর দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি। এই আন্দোলনে আরও হাজার হাজার মুখোশধারীর মুখোশ উন্মোচন হোক, হাজার হাজার নারী মুখ খুলুক। হাজার হাজার যৌন নিপীড়ক প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে, কান ধরে উঠবস করুক। হাজার হাজার যৌননিপীড়ক চিন্তাধারণকারী শিক্ষা নিক। রাজনৈতিক নারীরাও মুখ খুলুক। তাদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা লিখুক। লিখুন প্লিজ। 

 

 

‘এই আন্দোলনটার কোনো মানেই হয় না- এটা তো পুরুষদের জীবনেও ঘটে!’ হ্যাঁ পুরুষদের জীবনেও এরকম ঘটে। তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই বা তাদেরটাকে গুরুত্ব না দেওয়ার সুযোগ নেই। তারাও লিখুক। কিন্তু, সবকিছুর মাপকাঠি দরকার। ১০০% এর মধ্যে কত পাসেন্ট পুরুষ আর কত পাসেন্ট নারী! পুরুষেরা একটা বয়সসীমা পর্যন্ত এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়, কিন্তু নারীরা মৃত্যুর আগদিন পর্যন্ত এই ধরনের ঘটনার শিকার হন। যেখানে বয়স কোনো ফ্যাক্ট নয়, যেখানে রূপ, সৌন্দর্য কোনো ফ্যাক্ট না- যেখানে ফ্যাক্ট শুধু তার শরীরটা নারীর শরীর। যে শরীরটাকে খেলিয়ে দেখা যায়, মেপে দেখা যায়, ছুঁয়ে দেখা যায়। যে শরীরের স্তনের ছোট, বড়, মাঝারি জায়েজ করা যায়, ঝুলে পড়া, ঢিলে হয়ে যাওয়া, টাইট থাকার চিন্তা করা যায়- যে নিতম্ব স্পর্শ করলে নিজের পুরুষাঙ্গ দণ্ডায়মান, যে বগলে হাত লাগালে কামড়িয়ে খেতে ইচ্ছে করা যায়- হ্যাঁ, নারীরা এটা বুঝে! যে শরীরকে এক মাত্র পুরুষরাই খেলে দেখতে পারে, এক মাত্র পুরুষদেরই অধিকার আছে। সে শরীরকে নিয়ে আবার লিখবে কেন নারীরা- এই তো প্রকাশ করতে চাচ্ছেন আপনারা? যে সমস্ত পুরুষরা বলছে, ‘আমার ফুফু, খালা, দাদী, নানী, মামা, ভাই আমাকে যৌন হয়রানি করছে’ তাদেরকে বলছি লিখুন না, দেখি কতজন পুরুষ লেখে। আপনারা যখন লিখছেন, তখন তো আর আমরা প্রমাণ চাচ্ছি না! কারণ, আমরা জানি সমাজে এগুলো ঘটে, অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু, আপনারা প্রমাণ চাচ্ছেন, আপনারা লিংক চাচ্ছেন, ভিডিও চাচ্ছেন। আপনাদের মস্তিষ্ক পচার গন্ধ আমরা পাই, আমরা জানি আপনাদের ‘পুরুষাঙ্গ’ যে সব সময় মাথায় উঠে থাকে। আপনারা নারীকে ভোগের বস্তু ছাড়া আর কিছু হিসেবে দেখতে চান না, পান না। আপনাদেরকে আমি ঘৃণা ছাড়া আর কিছু করতে পারছি না। এইসমস্ত পুরুষদের, জাস্ট এই ধরনের পুরুষদের ঘৃণার পরিমাণটা বাড়ুক। নারীরা লিখুক, লিখো প্লিজ।

 

 

 
‘ফালতু একটা আন্দোলন নিয়ে আপনারাও লিখছেন কেন? যে আন্দোলনের শ্রেণীচরিত্র একেবারেই এলিট শ্রেণীর!’ হু, ফালতু আন্দোলনই বটে! আপনারা সব পুরুষরা মিলে এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে একটা মানববন্ধন ডেকে দিতে পারেন, ঘেরাও কর্মসূচি দিতে পারেন। আর নিজেদের পুরুষাঙ্গকে একটু নিয়ন্ত্রণও করতে পারেন, হাহাাহাহাহাহহাহাহা! নিজেদের জিহ্বা, ঠোঁট, হাত একটু নিয়ন্ত্রণেও রাখতে পারেন। না হলে কিন্তু! সময় বেশি দূরে নয়! শিমুল মোস্তফা পর্যন্ত এসে ঠেকেছে, এবার এর পরিমাণ বাড়–ক। আর সেলিম আল দীনের জন্য যেসমস্ত নারী-পুরুষ কান্নাকাটি করছে তাদের জন্য মন খুলে হাসুন, প্লিজ কষ্ট না পেয়ে হাসুন। আর এদের অন্ধ্রপ্রীতি, গুরুপ্রীতি নিয়ে তামাশা করুন। এদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে না পারলেও ব্যক্তিগতভাবে বয়কট করুন। আপনার বন্ধু, আপনার নারীবাদী মনস্তত্বের বলে তাকে সার্পোট দিয়েন না প্লিজ। স্বকৃত নোমান, লীনা পারভীন, শিমুল ইউসুফদেরও চিনে রাখুন। এদের ‘গুরুপ্রীতি’টা বুঝুন প্লিজ। এদের গুরুদের যে ‘পুরুষাঙ্গ’ নেই এরা তো এটা প্রমাণেই লেগে গেলেন। এদের গুরুরা যে কত নারীর সাথে শুয়েছেন, কত নারীকে নিয়ে লং ড্রাইভে গিয়েছেন তা তো আর কেউ বলছে না- সেটা তাদের বা যারা গিয়েছে তাদের একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু, যখন কেউ কারো বিরুদ্ধে যৌননির্যাতনের অভিযোগ তুলে তখন সেটাকে আমলে না নেওয়া কোন ধরনের মানসিকতা? কেউ একাধিক সম্পর্ক করতেই পারে, আর কবি, সাহিত্যিক, মিডিয়াজগতের মানুষ জনের আবার একাধিক নারী না হলে চলে না, তাদের সাহিত্য বের হয় না, তাদের ক্রিয়েটিভিটি বের হয় না, তাদের শিল্পমান সুন্দর হয় না! কিন্তু, তাই বলে জোর করে ধরে নিয়ে, স্তন চাপ দিয়ে, যৌনাঙ্গে হাত দিয়ে, নিতম্বে চাপ দিয়ে কি বোঝাতে চায়? এটা স্রেফ বিকৃত মস্তিষ্কের প্রমাণ নয় কী? একে কেন আপনারা সার্পোট দিচ্ছেন? আপনাদের ঘরে সন্তান আছে বলেও জানলাম। নারী, পুরুষ যে সন্তানই হোক না কেন আপনার সন্তানটির ক্ষেত্রে আপনার মেসেজ কি?

 

 

যাই-হোক, এই লেখাটি যখন লিখছিলাম তখনই একটা ফোন কল এলো, অপরপ্রান্ত থেকে হ্যালে বলেই বলতে শুরু করলো, ‘লাবণী তুমি কি জানো সেলিম আল দীনের ব্যাপারটা’... বললাম, হু...! উনি তো বেশ অবাক হয়ে বলতেছিলেন, ‘এটা কি #me too’? আমি তাকে বললাম কেন নয়? উনি বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়েই বললেন, ‘ভালো লোকদের ফাঁসানোর জন্য এসব করছে একটা গোষ্ঠী!’ আমার হাসি পাচ্ছিল, আমি জাস্ট বললাম, আপনার সাথে আমি একমত না। আপনার গুরুপ্রীতি দেখে আমি অবাক। জাস্ট, চিনে রাখুন। একে আমি আগেও চিনি। এখনও চিনলাম। কিন্তু, এর বিরুদ্ধে কোনোদিন #me too অভিযোগ উঠবে না চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে। আর #me too` আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এরকম বহু পুরুষ, নারীর সম্মুখীন হবো আমরা। তবুও এগিয়ে যেতে হবে। এই আন্দোলনটাকে বানচাল করে দেওয়ার যে অপচেষ্টা তার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। নারী-পুরুষ-ট্রান্সজেন্ডার যেকেউ-ই এর বিরুদ্ধে মুখ খুলুক। আমরা পাশে আছি, পাশে থাকবো। হয়তো, কোনো একদিন, হয়তো কোনো একদিন- সত্যটা বলে দিবো। সময়ের ব্যাপার। একটু অপেক্ষা তো করতেই হয়। অনেক ভালোবাসাসহ পাশে আছি। সকল যৌননিপীড়কের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠুক, দৃঢ় হোক আলোচনা, জোরালো হোক।