হৃদ্য আবদুহুর গল্প ‘পোড়া মবিল’

প্রকাশিত : জুলাই ০৮, ২০২৩

আবদুল কাদের সকালে বেরিয়েই লক্ষ্য করল, শহরটা অন্ধকারের এক রকম কালিমায় লেপে আছে। কই, তেমন ঘন মেঘ তো নেই। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়েছিল সকালে। কিন্তু তার জন্য তো এত অন্ধকারের প্রয়োজন পড়ে না। হঠাৎ তার প্রিয় কবি আবুল হাসানের একটা কবিতার ক’টা পঙক্তি মনে এলো,
যেখানেই যাই আমি সেখানেই রাত।
স্টেডিয়ামে খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরাঁয়
অসীমা যেখানে তার অত নীল চোখের ভিতর...

 

আরে, এত ফার্মগেটে সকাল ন’টা। রাত কেন হবে? অসীমা নামে কাউকে সে কখনো চেনেনি, জানেনি, ভেবেছে শুধু। নীল চোখ? তাও বা কোথায়! সে দাঁড়িয়ে আছে বাসের জন্য যেটা তাকে তার নৈমিত্তিক জীবনকে ধরে রাখবে, চাকরি করে সে বনানীর এক অফিসে। শরীর তার সোনামুড়িয়ে না দিলেও ভরপেট ভাত আর কেচকি মাছে পেটটা ভরিয়ে দেয়, সঙ্গে বউ জামিলার, একমাত্র সন্তান পাঁচ বছরের আশার। আশা করতে পয়সা লাগে না।

 

ব্যাপার কী আজ! সেইতো পান-বিড়ি-চায়ের কদম মিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে, তার মাসের শুরু শেষ বলে কিছু নেই, দিনেরটা দিনেই। আজ কাদেরের প্রায় মাসশেষে বেতন পাওয়ার দিন। আজ ফিরতি পথে সে মেয়েটার জন্য একটা রঙ পেন্সিলের সেট আর দুটো খাতা কিনবে, বউয়ের জন্য কিছু একটা, নিজের ছিঁড়েফাটা পাঞ্জাবিটাতে একটা ‘অদৃশ্য’ রিপু করবে। কিন্তু অফিস তো যেতে হবে আগে!

 

আবদুল কাদের বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে বিএ-এমএ পাশ করেছে ইতিহাসে। অংকে-ইংরেজিতে বরাবরই কাঁচা। সিভিল সার্ভিস ছিল সোনার হরিণ, রয়েও গেল তা। ঢাকায় এসে এক অফিসে ক্লার্কের চাকরিতেই জীবনের উচ্চাশা শেষ। তাতেও ভাত তো জুটলো, বউও। একটা বাচ্চাও এসে গেল কোত্থেকে যেন। পর্যটক, বৈমানিক ইত্যাদি অফিসের বালাম খাতায় এসে থিতু হলো। বেঁচে থাকতে পারাই জীবনের সব মনে হলো, জীবন যে একটাই। বিশ্বাসের অভ্যাস কখনো মাথায় চাপেনি, কিছু বই আর কবিতা তাতে বাধ সাধলো। চোখ বন্ধ করলে তখনো জীবন তার টেকনিকালার।

 

সে দশ বছর আগের কথা। এখন জীবন তার ছকে বাঁধা। কলম্বাস বা ভেসপুচি হওয়া তো আগেই শেষ, একবার কক্সবাজারও যাওয়া হয়নি। হ্যাঁ, আমরা কাদেরের সঙ্গে ছিলাম ফার্মগেটের ভিড়ে। বহুকষ্টে পাঁচজনে মিলে একটা সিএনজি ভাড়া করে বনানীর দিকে রওয়ানা হতে দেখলাম তাকে। ভাড়ার টাকায় জামার রিপু আর জামিলার জন্য কোনো কিছু ঝরে পড়েছে ততক্ষণে তবুও রক্ত বেচেও মেয়ের জন্য কিছু সে কিনবে, আমরা সেটা কেন যেন অনুধাবন করলাম। আমাদের সবার ছেলেমেয়ের নামই আসলে আশা। নিরাশা থেকে যায় অন্তরালে।

 

মহাখালীর কাছে এসেই আক্রমণ। এক গাদা গালাগালিসহ সিএনজিকে উল্টে দেওয়া হলো। কাদেরের সঙ্গের বাকি চারজন যারপরনাই ছুটে পালালো কিন্তু কাদের তখন কবিতা নিয়ে ভাবছিলো। মুখ তার পোড়া মোবিলে কারা যেন কালো করে দিলো। তার হাতব্যাগটাও খোয়া গেল, সেখানে কিছু কবিতা আর টাকা ছিল।

 

টাকার তো কোন বিকার নেই। কিন্তু কবিতাগুলো সে আর কখনোই ফেরত পাবে না। কবিতা লেখে মানুষ বিশেষ মুহূর্তে, বিশেষ চিন্তায়, তা ফিরে আসে না। আবদুল কাদের পোড়া মোবিলে, কালো মোবিলে কৃষ্ণকায় হয়ে হেসে দিলো। এই না কারণ তবে সকাল থেকে এই কৃষ্ণকায় আকাশ। কৃষ্ণকায় যে তার জীবনটাই।

 

সে হাসতে হাসতে হেঁটে চললো। সামনে মহাখালীর রেললাইন। সেখানে সেখানে ক্ষণে ক্ষণেই বিধ্বংসী ট্রেন আসে। হা হা হা... ওদিকেই হেঁটে চললো সে।