হুমায়ূন সাধুর গল্প ‘রহস্যময়ীর সেমাই’
প্রকাশিত : অক্টোবর ২৫, ২০১৯
অভিনেতা, চিত্রনির্মাতা ও লেখক হুমায়ূন সাধু আর নেই। ব্রেইন স্ট্রোকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার দিনগত রাত দেড়টার দিকে তিনি মারা গেছেন। তার প্রতি আমাদের ভালোবাসা রইল। ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ছাড়পত্রে ‘রহস্যময়ীর সেমাই’ শিরোনামে একটি গল্প লেখেন। তার মৃত্যুতে শোকাবহ এই দিনে গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
তখন আমি আমেরিকান অ্যাম্বাসির অপজিটে থাকি। এক বড়ভাইয়ের কল্যাণে দোতলা ছাদের ওপর সুন্দর কিচেন, এটাচ বাথঅলা এক বিশাল রুম পাইয়া গেসি। উনি বাসা নিয়া পরে আর ওঠে নাই। অ্যাডভান্স দেয়া (পরে আমারে ডাবল দিতে হইসিলো) উইঠা পড়লাম। প্রথম মাসে কেয়ারটেকার আইলেন। আমারে বুঝাইলেন, দেখেন জাঙ্গাটা খুব রিস্কি। আমি কইলাম, কেমন? কইলেন, এ যেমন ধরেন গত মাসেই সামনের রোডে মার্ডার হইসে। এক্টু সাবধানে। আমি বললাম, আচ্ছা।
সে আবার বলল, নিচে টিচে যাইয়েন না যে।
আমি কইলাম, যাই না তো। টাইম কই?
কেয়ারটেকার বলল, ১০টার মধ্যে গেইট বন্ধ।
এইটা বেশি বেশি। তবু নতুন নতুন কিছু কইলাম না। পরে কমু।
এরপর যেখানেই থাকি, অনেক সময় না খেয়ে দৌড়াদোড়ি করে ১০টার মধ্যে আইসা পড়ি। বিশ্বাস অর্জন করাতে হবে। ছোট একটা রিচার্জেবল প্রজেক্টর ছিল, সাদা ওয়ালে মেরে মুভি দেখি। নাইলে গিটারটা নিয়া লাড়চাড়া করি। এভাবে টাইম কাট। নিচের লগে আমার কোনও লেনদেন নাই, গেইট দিয়া ঢুইকা সিঁড়ি দিয়া সোজা ঘরে। কোথায় কি হচ্ছে তাকাইও না। ঘরে থাকলে আওয়াজ শুনি, ওরা ছাদে উঠত। আমি দেখতামও না। জানলা দিয়া উঁকিঝুঁকি মারতো। আমি আমার মতো। একদিন জানালা দিয়াই একজনের লগে কথা হইসে, এই। সে নানান কিছু জানতে চাইছিল।
ময়মনসিংহ কেয়ারটেকার ভাই রাতে আবার আসলেন।
এই জাঙ্গা কুব খরাপ।
ওহ আচ্ছা।
ব্যাচেলর ভাড়া দেই না। উনি ফ্যামিলি বলে ভাড়া নিসে। পরে দেখি আপনে।
আমার চারপাশে ঢোল, তবলা, দোতারা... এসব দেখে লোকটা জিগেশ করল, আপনি গান বাজনা করেন?
এই আর কী!
আমিও করতাম বলে কেয়ারটেকার এবার শুরু করলেন আম্বিয়ার মা’র কিসসা। যাত্রা করতো, উনি পাট গাইতো। আমি ‘বাহ’ ‘বাহ’ করে গেলাম। যাওয়ার সময় কইলেন, জাঙ্গা খরাপ। নিচে টিচে যাইয়েন না যে।
মনে মনে কই, বেটা, আমি যাই? তারা আসে।
একদিন দেরি হয়া গেল। তাড়াহুড়া করে গেসি। খাঁড়ায় থাইকা, অনেকক্ষণ গেইট খট খট করি। কোনও লক্ষণ নাই। ধরা খাইলাম নাকি? বিকল্প ভাবতেসি। আমি আবার গাছগাছালি, বিল্ডিং, ওয়াল খুব বাইতে পারি। ‘বিসমিল্লাহ্’ বলে চড়ে বসলাম। রড, শিক বেয়ে গেইটের ওপর উঠে গেসি। ওয়ালে কাচ লাগানো, এটা দিয়া বা কোনওদিক দিয়্যা দোতলায় ওঠা যায়, পথ খুঁজতেসি। এরমধ্যে নিচে লাগসে কুকুর। এখন বিকল্প পথ বের করার বা নামার উপায়ও না। কুত্তার বাচ্চা সরতেসে না। আধাআধি জায়গায় লটকে আছি। এইসময় গেইট খোলার সাউন্ড। শিকের গুতা টুতা খেয়ে নামতে নামতে দেরি হবার এক্টা স্ট্রং স্টোরি ভাবতেসি। নাইমা দেখি গেইট খুলে খাড়ায় আছে এক মহিলা। কেয়ারটেকারের বউ। মিনমিন করতে করতে উপরে উঠছি। বাসায় ঢুকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
রাত। চারদিকে সুনসান। তাড়াহুড়া করে আসার কারণে কিছু খাইয়াও আসি নাই, নিয়াও আসি নাই। ছাদে হাঁটতে হাঁটতে আকাশে চাঁদ-তারা দেখি। পুরান সিগারেট পাই। এটাই খাই। পুরা বাসা খুঁইজা ম্যাচ পাই নাই। উপায়ন্তর না পেয়ে ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে আস্তে আস্তে নিচে নামি। আগের ঘটনায় সাহসও বাড়সে। যদি আবার কোনও দরদীরে পাই! সিঁড়ি দিয়া নাইমা তারপর একটা বড় স্পেইসের মতো আছে। সেখানে দেখি এলাহি অবস্থা! দুনিয়ার মেয়ে। বাতাস খাইতেসে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। কাপড় চোপড়ও ঠিক নাই। তারাও হঠাৎ আমারে আশা করে নাই। এর লাইগা কেয়ারটেকার বারবার নিচে যাইতে না করে। আমি আইসা ডিরেক্ট অদের মুখামুখি। ওখানে কেয়ারটেকার বউও ছিল মেবি। কাঁপা কাঁপা গলায় ম্যাচ চাইলাম। একজন কইলো, ম্যাচ কেন? এবার কি কমু? কইলাম, কয়েল জ্বালামু। ম্যাচ আইনা দিলো। নিয়াই দৌড়।
পরদিন রাতে কেয়ারটেকারের বউ আসলো বাসায়। বসলো। বিত্তান্ত জানলো।। গল্পগুজব করতে আসছে। খুব আন্তরিক। কইলেন, খানাপিনার সমস্যা হইলে আমার ওখানে আইসো। চাইলে এখানেই দিয়া গেলাম। দেরি করে না আসার জন্য কইলো। ব্যাচেলর তো দেই না। বুঝো না। এই বিল্ডিং আর নিচের কোয়ার্টারে ভার্সিটির মাইয়ারা থাকে।
আইচ্ছা, এই কাহিনি। লেডিস হোস্টেল।
উনি কইতে থাকেন, পরশুদিন একজন আতকা বেহুঁশ হয়া গেল। তারে নিয়া সেকি দৌড়াদৌড়ি। কাল সবাই সেই গপ করতেসিলাম।
উনার ব্যাবহারে মুগ্ধ হয়া গেলাম। সেবার ঈদে কোনও কাজ কাম নাই। টাকাও নাই। আম্মা ফোন করলো, বাসায় যাব কীনা। ব্যাস্ততা দেখাইলাম, আম্মা, অনেক কাজ অনেক কাজ। আসতে পারবো না।
চানরাইতে বস ফোন দিলো, কি বর্দা, কণ্ডে? চান রাইতে আপনার চানমুখ না দেখলে হবে! (বসের স্টাইল যারা জানে) আইয়েন্না, গুরি গারি আই।
আমি, বস, আমি তো চট্টগ্রাম যাচ্ছি।
বাইরে তখন মহাযজ্ঞ চলতেসে। লাউড স্পিকারের গানের আওয়াজ রুমে বসে শুনি। কোনও জায়গা থেকে টাকার যোগান হয় নাই।। চট্টগ্রাম যাওয়া হচ্ছে না এটা কনফার্ম হবার পর রুমে ঢুকে দরজা-জানলা বন্ধ। গেইট লক সার্ভিস। সবাই জানুক আমি চট্টগ্রাম। দুইদিন পর বাইর হমু। সারারাত এটা ওটা ট্রাই করি, ঘুম আসে না।
সকালের দিকে ঘুমাই। হঠাত ৯টা/১০টার দিকে দরজায় নক। এ কি করে সম্ভব! এম্নিতে কেউ আসে না, ঈদের সময় তো কেউ নাই আসার। জামা-কাপর পরে আস্তে দরজা ফাঁক করলাম। একটা মেয়ে খাঁড়ানো। মনে প্রশ্ন। হাতে সেমাইর বাটি দেখাইলো। তারে ঢুকতে না দিয়া বাটি নিলাম। বাটি ফেরত দিসি কি দিই নাই মনে নাই, সে চলে গেসিলো। আমি আছি এটাই কেউ জানে না। তার ওপর সেমাই।
আমার বাসায় হয়তো সবাই সেমাই খাচ্ছে। আমিও। সেদিনের সেই রহস্যময়ীর সেমাই নোনাজলে ভরে গেসিলো!