হুমায়ূন আহমেদ, কিছু জানা কিছু অজানা
কাজী জহিরুল ইসলামপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৫, ২০২৪
জহির, আপনি আমাকে হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সেদিন কিছু বলিনি এজন্য যে, আমি প্রস্তুতির জন্য সময় নিচ্ছিলাম। ওর সঙ্গে আমার এত স্মৃতি, এত ঘটনা, গুছিয়ে বলার জন্য একটু চিন্তা করে নেওয়ার দরকার ছিল।
এভাবেই কবি আতাহার খানের সঙ্গে আজকের আলাপ শুরু হয়।
আপনি জানেন বোধ হয়, হুমায়ূনের প্রথম চাকরি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে যোগ দেন, ওখান থেকেই বৃত্তি নিয়ে আমেরিকায় যান পিএইচডি করতে। ফিরে এসে ওরা বাসা ভাড়া নেন শ্যামলীর এক নাম্বার রোডে। আমিও থাকতাম শ্যামলীতেই৷ দুই নাম্বার রোডে। শ্যামলীর দুই নাম্বার রোডে মেজর ডালিমদের একটি বাড়ি ছিল, আমরা সেই বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলাম। তখন থেকেই হুমায়ূনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা ঘনিষ্ঠ হয়। মাঝে মধ্যে হুমায়ূন আমাদের বাসায় আসতেন রঙিন টিভিতে ওর লেখা নাটক দেখতে, ওদের বাসায় তখন শাদাকালো টিভি ছিল। ও যখন একা আসতেন আমার শ্যালক আহমেদ ফারুক, আমি ও হুমায়ূন মিলে মদ্যপান করতাম। কিন্তু ওর স্ত্রী গুলতেকিন ও বাচ্চাদের নিয়ে যেদিন আসতেন সেদিন আর সুরাপান হতো না।
তো হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন আপনার পাড়ার বন্ধু?
হয়ে উঠেছিলেন তাই, যেহেতু একই পাড়ায় থাকতাম। তবে বন্ধুত্বটা লেখকসূত্রেই। ওর প্রথম বই তো বের হয় সেই ৭২ সালেই, আহমদ ছফা খেটেখুটে বইটা বের করে দেন। ছফা ভাই আহমদ শরীফকে দিয়ে একটা ভূমিকাও লিখিয়ে আনেন। বইটার বেশ ঘটা করে একটা প্রকাশনা উৎসবেরও আয়োজন করেন ছফা ভাই, আমি সেই অনুষ্ঠানে ছিলাম। আহমদ শরীফও ছিলেন।
প্রথম বই `নন্দিত নরকে` প্রকাশের মধ্য দিয়েই তো হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয় লেখক হয়ে ওঠেন?
হ্যাঁ, এটা ঠিক। এই বইটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা প্রচুর কেনে এবং মুখে মুখে ওরাই হুমায়ূনের নাম ছড়িয়ে দেয়। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকেই ও প্রচারটা পায় বেশি।
নন্দিত নরকে তো তিনি ছাত্র থাকাকালেই লিখেছিলেন?
হ্যাঁ, ওইটাও, শঙ্খনীল কারাগার। এই দুটো বইই ছাত্রাবস্থায় লেখেন। আমেরিকায় যাওয়ার আগে সম্ভবত আর কোনো বই লেখেনি।
আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাটা কখন হয়?
আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পরেই। শ্যামলীতে পাশাপাশি থাকার কারণেই বলতে পারেন। একদিন হুমায়ূন আমাকে বলেন, আতাহার, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি করে তো হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি, সংসার চালাতে পারছি না।
তখন আমি ওকে বলি, আপনি এক কাজ করেন, রোববার পত্রিকায় লেখেন, আমি ভালো একটা বিলের ব্যবস্থা করে দিতে পারবো।
একদিন ও রোববার পত্রিকার অফিসে, ইত্তেফাক ভবনে, আসেন। আমি ওকে দাবাড়ু নিয়াজ মোরশেদের ওপর একটা কভার স্টোরি করার অ্যাসাইনমেন্ট দেই। নিয়াজ মোরশেদ তখন মাত্র একুশ বছর বয়সে গ্রান্ড মাস্টার খেতাবে ভূষিত হন। হুমায়ূন প্রায় দশ পৃষ্ঠার একটা কভার স্টোরি লিখে নিয়ে আসেন। দাবার মত এমন কম জনপ্রিয় একটি বিষয়কে ও এত সুন্দর করে উপস্থাপন করেন, পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল সেই স্টোরির ওপর। আমরা সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকার সেই সংখ্যাটি দশ হাজার কপি বেশি ছাপি, শুধু হুমায়ূনের লেখার কারণেই সেটা সম্ভব হয়েছিল।
এরপর আরও লিখেছিলেন রোববারে?
হ্যাঁ, নিয়মিতই ওকে দিয়ে আমি সাহিত্য বিষয়ক স্টোরি করাতাম আর বিশেষ সংখ্যাগুলোতে ওর গল্প, উপন্যাস ছাপতাম। এরপর বিচিত্রার সঙ্গে ওর যোগাযোগ হয়, ওখানেও গল্প-উপন্যাস লিখতে শুরু করে।
এই গল্পটা শুনে আমার খুব মজা লাগছে আতাহার ভাই। মজা এজন্য লাগছে যে, ঠিক একইভাবে আমাকে দিয়েও আপনি এই কাজগুলো করিয়েছিলেন। প্রথম দিন আপনার সঙ্গে সাপ্তাহিক পূর্ণিমা পত্রিকার অফিসে কথা হওয়ার পরেই আমাকে কী একটা যেন অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দিলেন, সম্ভবত কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের ছোট্ট ইন্টারভিউ করে একটা স্টোরি লিখতে বলেছিলেন। মান্নান ভাইও তখন ওখানেই ছিলেন, সন্ধ্যার পরে একটা জমজমাট আড্ডা হচ্ছিল, স্টার কাবাব থেকে আপনি নানরুটি আর কাবাব আনিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে এবং আপনার সেই স্টোরিটা পড়ে মান্নান ভাই আমাকে বলেছিলেন, আতাহার ছেলেটার হাত খুব ভালো, ওর যত্ন নেবেন। শুধু মান্নান ভাই কেন, আপনি একবার আমার বন্ধু পীযুষ বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে একটা ছোট্ট রিপোর্ট করেছিলেন। দূর থেকে ওকে দেখেই লিখেছিকেন। কোনো এক বহুতল দালানের সামনে ও উদাসভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই লেখা পড়ে পীযুষ আমাকে ফোন করে বলেন, আতাহার আপনার সাংবাদিক তো বিরাট দার্শনিক, শিল্পীর মনের কথাও পড়ে ফেলতে পারে।
আপনি তো রোববার ছেড়ে দিয়ে ১৯৭৯ সালের দিকে পূর্ণিমায় যোগ দেন, এতে কী আপনাদের বন্ধুত্বে একটুও ছেদ পড়ে?
ছেদ পড়ার কী কোনো কারণ আছে?
না মানে, পূর্ণিমা, মাওলানা মান্নানের কাগজে...
ওরা তো কেউ পূর্ণিমাকে মাওলানা মান্নানের কাগজ মনে করে আসতেন না, আসতেন মুক্তিযোদ্ধা আতাহার খানের কাছে।
তা ঠিক, এই একই যুক্তিতে আমিও পূর্ণিমার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম। আসলে আমি তো জানিই পূর্ণিমায়ও আপনি নিয়মিত ঈদ সংখ্যাগুলোতে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ছাপতেন। এটা সম্ভব হয়েছিল আপনার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কারাণেই। আতাহার খান না হয়ে অন্য কেউ লেখা চাইলে আমার ধারণা তিনি লেখা দিতেন না।
মাঝে-মধ্যে হুমায়ূন ফোন করে মধ্যরাতে চলে আসতেন আমার সঙ্গে আড্ডা দিতে। খবর পেয়ে অফিসের অনেকেই আসত। মাঝে মাঝে ভিড় বেড়ে যেত বলে আমার অফিসে বসতাম না, ওকে নিয়ে যেতাম ইনকিলাব ভবনে, সম্পাদক বাহাউদ্দীন সাহেবের রুমে। এক পর্যায়ে হুমায়ূনের রসঘন আড্ডায় মজে গেলেন বাহাউদ্দীন। আমাকে প্রায়ই বলতেন, আতাহার সাহেব, চলেন একদিন হুমায়ূন আহমেদের বাসায় যাই, আড্ডা দিয়ে আসি। বাহাউদ্দীন সাহেব ওর খুব ভক্ত হয়ে যায়। বেশ কয়েকবার আমি বাহাউদ্দীন সাহেবসহ আরো কয়েকজনকে ওর বাসায় নিয়ে যাই।
হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে তো সাপ্তাহিক রোববারে আপনি কভার স্টোরি করেন, সম্ভবত তাকে নিয়ে কোনো সাপ্তাহিকের সেটাই প্রথম কভার স্টোরি?
না, প্রথমে বিচিত্রা তার ওপর কভার স্টোরি করে। আমরা, রোববারে, তার কিছুদিন পরেই করি।
বাহাউদ্দীন সাহেবকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের কোন বাসায় যেতেন?
সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে হুমায়ূন একটি এপার্টমেন্ট কিনেছিলেন। ওই বাসাটাতেই বাহাউদ্দীন সাহেবকে নিয়ে যেতাম। হুমায়ূন তখন তুমুল জনপ্রিয়। প্রকাশকেরা অগ্রীম টাকা নিয়ে ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে বসে থাকত।
তখন তো তার পাণ্ডুলিপি পাওয়ার জন্য প্রকাশকদের ঘাম ঝরাতে হতো। আপনাকে ধরত না প্রকাশকেরা পাণ্ডুলিপির বিষয়ে তদবিরের জন্য?
হ্যাঁ ধরত। সময়ের ফরিদ আহমেদ, অনন্যার মনিরুল হক, অবসরের আলমগীর, ওরা সবাই ধরত।
ওদের হয়ে অনুরোধ করেছিলেন?
না, আমি কখনোই এই বিষয়টাতে নিজেকে জড়াতাম না। ততদিনে হুমায়ুন হয়ে গেছে পেশাজীবী লেখক, এটা তার পেশা, ও কাকে কত টাকায় পাণ্ডুলিপি দেবেন, এটা ওর পছন্দ, এই বিষয়ে অনুরোধ করা অনুচিত মনে করেছি আমি। হঠাৎ হঠাৎ ফোন করে বলতেন, আতাহার অফিসে যাওয়ার পথে একটু হয়ে যাবেন তো।
আমি তো গোসল করে দুপুরের খাবার খেয়ে একটা/দেড়টার দিকে রওনা দিতাম। ওর বাসায় গিয়ে দেখতাম প্রকাশকেরা গোল হয়ে মেঝের কার্পেটের ওপর বসে আছে। হুমায়ূন বলতেন, আতাহার আমি তো একটা বড় রকমের ঝামেলায় পড়েছি।
ও খুব নাটকীয়ভাবে ছোটো ছোটো বিষয়কে উপস্থাপন করতেন। আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম ঝামেলাটা কী তা শোনার জন্য। ও বলতেন, এক প্রকাশক মুক্তাগাছা থেকে আমার জন্য মণ্ডা নিয়ে এসেছে, এত মণ্ডা কে খাবে? আপনি কিছু নিয়ে যান। আমাকে উদ্ধার করেন।
আমি বলি, হুমায়ূন, আমি তো এখন অফিসে যাচ্ছি।
অফিসেই নিয়ে যান, স্টাফদের দেবেন।
তাই করতাম। অফিসে নিয়ে যখন এই ঘটনা বলতাম, সবাই দ্বিগুণ উৎসাহে খেত এবং সেসব কথা নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়ত। হয়ত হুমায়ুন নিজেও এটাই চাইতেন যে চারদিকে ওর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ুক।
কোনোদিন গিয়ে দেখতাম এক প্রকাশক বগুড়ার দৈ নিয়ে এসেছে। আবার অন্যদিন আরেক প্রকাশক নিয়ে এসেছে এত্তগুলো পনিরের বল। কুমিল্লার রসমালাই নিয়ে এসেছে একজন, কেউ এনেছে রংপুরের রসমঞ্জুরি। যেখানকার যেটা বিখ্যাত প্রকাশকেরা ওকে খুশি করার জন্য সেটাই নিয়ে আসত। আমি প্রায়ই এইসব নিয়ে আমার অফিসের স্টাফদের খাওয়াতাম, মাঝে মাঝে বাসায়ও নিয়ে যেতাম।
আপনি যখন পূর্ণিমায়, আশির দশকে,নব্বুইয়ের দশকে, তখন তো তিনি খুবই ব্যস্ত, তখনও কি পূর্ণিমায় যেতেন আড্ডা দিতে?
যেতেন মানে, মাসে অন্তত একবার আমার অফিসে যেতেনই। আবদূল মান্নান সৈয়দ, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ আখন্দ, আল মুজাহিদী এরাও মাঝে-মধ্যে উপস্থিত হতেন।
কী ধরণের গল্প হতো?
হাত-পা ছাড়া গল্প। গল্পের কোনো আগামাথা নেই। তবে ওর কথা শুনে আমরা সবাই খুব হাসতাম। প্রচুর জোকস বলতেন। হুমায়ূন জোকসগুলোও যুক্তি দিয়ে বলতেন। একদিন বলছেন, আতাহার, মেয়েলোকের বুদ্ধি সব সময় হাঁটুর নিচেই থাকে, কোমর অব্দি কখনোই উঠতে পারে না।
কথাটা কী প্রসঙ্গে বলেছিলেন এখন আর মনে নেই, হতে পারে আমাদের রাজনীতি প্রসঙ্গে বা অন্য কিছুও হতে পারে।
এটা তো খুব আপত্তিকর মন্তব্য।
হয়ত কোনো কারণে স্ত্রীর ওপর রেগে ছিলেন।
কী ধরণের জোকস বলতেন, কিছু কি মনে আছে?
সব তো আর মনে নেই। দেখি কিছু মনে করতে পারি কিনা। হ্যাঁ একটা মনে পাড়েছে। একদিন বলছেন, আতাহার আপনি তো সম্পাদক মানুষ, বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন, ব্যাকরণ খুব ভালো জানেন, বলেন তো কাঁঠাল কোন লিঙ্গ?
আমি বলি, ফলের আবার লিঙ্গ হয় নাকি?
হয়। কাঁঠাল হলো পুংলিঙ্গ। কারণ কাঁঠালের বিচি আছে।
আমরা তো হাসতে হাসতে মরে যাই।
আতাহার ভাই, বিচি তো সব ফলেরই আছে। সব ফলই তো তাহলে পুরুষ। অবশ্য আজকাল জেনেটিক্যালি মডিফাই করে বিচি ছাড়া ফল উৎপাদন করা হচ্ছে, সেগুলিকে আমরা স্ত্রী-ফল বলতে পারি। অবশ্য স্ত্রী ফল না বলে সেগুলোকে ট্রান্সজেন্ডার ফল বলাই বোধ হয় ভালো হবে, কী বলেন?
ফোনের অন্য পাশে আতাহার খান হাসেন।
শোনেন, হুমায়ূনের আরো একটি জোকস বলি, কথা হচ্ছিল দেশের আইন-কানুন নিয়ে। হঠাৎ হুমায়ূন বলে উঠলেন, বলেন তো আইন কোন লিঙ্গ?
আমরা চুপচাপ ভাবছি কিন্তু কেউ উত্তর দিতে পারছি না।
হুমায়ূন বলেন, পারলেন না? আইন হলো স্ত্রী লিঙ্গ, কারণ আইনের ফাঁক আছে।
আমরা তো এটা শুনে হাসতে হাসতে মরে যাই। পরে বোধ হয় কোনো বইয়েও কোনো চরিত্রের মুখ দিয়ে এটা বলিয়েছিলেন। হুমায়ূন যে-জোকসটাই বলতেন তার মধ্যেও একটা যুক্তি দিতেন। যুক্তি ও খুব পছন্দ করতেন। নিজে বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন এবং ব্যক্তি জীবনেও খুব বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ ছিলেন। যখন যেখানে থাকতেন চারপাশ মাতিয়ে রাখতেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই তার ভক্ত হয়ে যেত।
পূর্ণিমায় তো আপনি অনেকবারই হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছেন।
প্রতি বছর একুশের বইমেলার আগে হুমায়ূনের ওপর একটা কভার স্টোরি করতামই। অন্য লেখকেরা এটা নিয়ে ঈর্ষা করত। এবং আমাকে চাপ দিত আমি যেন তাদের ওপরও কভার স্টোরি করি।
কে কে চাপ দিত?
আল মাহমুদ দিত, ফজল শাহাবুদ্দীন দিত। একবার হাসনাত আবদুল হাই জাপান থেকে ঘুরে এসে ধরলেন তাকে নিয়ে যেন একটা কভার স্টোরি করি। চাপাচাপির কারণে করেছিলাম কিন্তু সেটা ফুল কভার স্টোরি ছিল না, অন্য বিষয়ের ওপরও একটা কভার স্টোরি ছিল, সঙ্গে ইনসেটে হাসনাত ভাইয়ের একটা ছবি দিয়ে শিরোনামটা দিয়েছিলাম।
এতে তিনি রাগ করেননি?
সাংঘাতিক মনঃক্ষুন্ন হয়েছিলেন। শোনেন, হুমায়ূনের বিষয়টা ব্যবসায়িক। তাকে নিয়ে কভার স্টোরি করলে পত্রিকার কাটতি বাড়তো, ম্যানেজমেন্ট খুশি হত। অন্য কোনো লেখকের প্রতি তো পাঠকের এই পরিমাণ আগ্রহ ছিল না। হ্যাঁ, একথা ঠিক যে অনেকেই বড় লেখক কিন্তু পত্রিকার পাঠকের তো তাদের প্রতি সেই আগ্রহটা নেই। এই রিয়েলিটি আমি লেখকদের বোঝাতে পারতাম না। আজকাল শেখ মুজিবের একটা সংলাপ প্রায়ই ইউটিউবে শুনি, তুমি রিয়েলিটি মাইনে নাও। মুশকিল হলো এদেশের কেউই রিয়েলিটি মেনে নিতে চায় না। তার মেয়েও চায়নি। সকলেই শুধু পেতে চায়।
আমি যতদূর জানি অভিনেতা মাহফুজ আহমেদকে তার নাটকে নেবার জন্য আপনিই অনুরোধ করেন।
হ্যাঁ। আপনাকে বলি সেই ঘটনাটা। একদিন হুমায়ূন ফোন করে বলেন, আতাহার বাসায় আসেন।
আমি তখন অফিসে। কথাটা শুনে মাহফুজ বলে, আতাহার ভাই, আমিও আপনার সঙ্গে যেতে চাই। মাহফুজ তখন পূর্ণিমার স্টাফ রিপোর্টার।
আমি বলি, তুমি কেন যাবে?
ও বলে, আতাহার ভাই, আপনি হুমায়ূন স্যারকে অনুরোধ করবেন আমাকে যেন উনার "কোথাও কেউ নেই" নাটকে অভিনয় করার সুযোগ দেন।
তখন মাহফুজ অল্পস্বল্প নাটকে অভিনয় করা শুরু করেছে। ওকে নিয়ে রওনা দেই। আমরা বাসায় ঢুকি। হুমায়ূন আমাদের স্বাগত জানায়। আমি সোফায় বসি কিন্তু মাহফুজ দাঁড়িয়ে আছে। হুমায়ূন ওকে বসতে বলছেন কিন্তু ও তবুও দাঁড়িয়ে আছে।
আমি হুমায়ূনকে বলি, কি জন্য ডেকেছেন?
আতাহার, আমি টাকার সন্ধান পেয়ে গেছি। ৩/৪ দিন আগে আমাকে এক প্রকাশক নতুন একটা ভিসিআর দিয়ে গেছে, আরেক প্রকাশক একটা গাড়ি দিয়ে গেছে। অধিকাংশ প্রকাশক ৫ লাখ টাকা করে অগ্রীম দিয়ে যাচ্ছে বইয়ের জন্য। মনে হচ্ছে ওপরে ওঠার সিঁড়ি পেয়ে গেছি।
খুব নাটকীয়ভাবে বলছিলেন কথাগুলো। আমি মাহফুজকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে অনুরোধ করি, আপনার যে ধারাবাহিক নাটকটা টিভিতে যাচ্ছে সেটাতে ও অভিনয় করতে চায়।
হুমায়ূন মনে হলো এই প্রথম মাহফুজের দিকে ভালো করে তাকালেন। মাহফুজ তখন দুই হাত দিয়ে বারবার ওর চুল ব্রাশ করছিল। সম্ভবত খুব নার্ভাস ছিল। হুমায়ূন ওর এই আচরণে খুব খেপে যান। এই ছেলে, তুমি এটা করছ কেন? তোমাকে দিয়ে অভিনয় হবে না৷ বের হয়ে যাও।
ওকে ধমক দিয়ে রুম থেকে বের করে দেন। শুধু বের করেই দেননি, ওকে বের করে দিয়ে দরোজা বন্ধ করে দেন। আমি বলি, এটা কী করলেন?
বেশি হয়ে গেছে?
হ্যাঁ, একটু বেশিই হয়ে গেছে।
শোনেন, ও কিন্তু যায় নাই। দরোজার ওপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে চান?
এরপর উঠে গিয়ে দরোজা খোলেন, এই ছেলে ভেতরে আসো।
আমি মাহফুজ প্রসঙ্গে ওকে আর কিছুই বলিনি। ঈদ সংখ্যার জন্য উপন্যাস চাইলাম। ও আমাকে বলে, বিভিন্ন কাগজ থেকে এসে উপন্যাসের জন্য অগ্রীম টাকা দিয়ে গেছে।
এরপর কোন কাগজ কত টাকা দিয়ে গেছে এইসব গল্প শোনালেন। মাহফুজকে কিন্তু তিনি নিলেন। হয়ত বের করে দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন, অভিনয়ের ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস ও। যদিও আমাকে বলেছিলেন, কোথাও কেউ নেই - নাটক তো অন-এয়ারে যেতে শুরু করেছে, এখন আমি ওকে কীভাবে নিব? পরে সম্ভবত ওর জন্য নতুন একটি চরিত্র তৈরি করেই ওকে নিয়েছিলেন।
মাহফুজের জন্য আমি নাট্যকার শহীদ আখন্দ, ইমদাদুল হক মিলন, নাজমুল আলম এদেরকে অনুরোধ করেছি, সবাই আমার কথা রেখেছেন। মাহফুজ প্রায়ই এসে আমাকে মশারির নিচ থেকে ডেকে তুলত, তারপর আমাকে নিয়ে এর-ওর বাড়িতে যেত তদবিরের জন্য।
মেহের আফরোজ শাওনের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের সম্পর্ক নিয়ে বোধ হয় আপনি পূর্ণিমায় একটি কভার স্টোরি করেছিলেন?
সেটা করতে গিয়েই তো ঝামেলাটা বাঁধে।
ঝামেলা?
হ্যাঁ, ঝামেলাই তো। একদিন বাহাউদ্দীন সাহেব আমাকে ডেকে বলেন, হুমায়ূনের নারীঘটিত বিষয় নিয়ে চারদিকে কথা হচ্ছে, এটা নিয়ে কভার স্টোরি করেন।
আমি বললাম, এটা আমার জন্য বিব্রতকর হবে। আপনি তো জানেনই ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এটা করলে আমাদের সম্পর্কটা চিরকালের মতো নষ্ট হয়ে যাবে। আপনি নিজেও তো ওকে পছন্দ করেন।
তা তো করিই, কিন্তু বিনোদন জগতের এত বড়ো একটি ঘটনা, দেশের সেরা বিনোদন সাপ্তাহিক এটা এড়িয়ে যাবে?
আমি বাহাউদ্দীন সাহেবকে বলি, আপনি যদি এই বিষয়ে আমাকে প্রেসার করেন তাহলে আমি চাকরি ছেড়ে দিতে পারি তবুও হুমায়ূনের বিরুদ্ধে কভার স্টোরি করতে পারবো না।
বাহাউদ্দীন সাহেব আমাকে পেশাদারিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। সাথে সাথে এ-ও বলেন, আতাহার সাহেব, আমার আব্বা এবং আমরা সবাই আপনাকে খুব ভালোবাসি এবং সম্মান করি কিন্তু দিনের শেষে পত্রিকাটির মালিক তো আমি। পাঠকের কাছে আমার একটা দায়বদ্ধতা আছে। আপনি আপনার অফিসে যান, বিষয়টা নিয়ে আরো ভাবেন। আপনি চাকরি ছেড়ে দেন এটা আমরা চাই না।
আমি আমার অফিসে ফিরে আসি। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি। ভাবি বন্ধুত্ব না পেশাদারিত্ব, কোনটা বড়ো? অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করি বিষয়টা নিয়ে হুমায়ূনের সঙ্গেই কথা বলি। ও আমার বন্ধু, বিষয়টা বুঝবে। মাহফুজকে দিয়ে হুমায়ূনকে খবর দিলাম। রাত বারোটার দিকে হুমায়ূন আমার অফিসে এলো। এলো মাহফুজকে সঙ্গে নিয়েই। আমি ওকে একটাই বিকল্প অপশনের কথা বললাম,
চাকরি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আমি আর কোনো বিকল্প কিছু দেখছি না।
আতাহার, আপনি যদি এই বিষয়ে কভার স্টোরি করেন তাহলে মেয়েটার আর বিয়ে হবে না।
মানুষের কী জানতে বাকি আছে? এরই মধ্যে কয়েকটা কাগজে কথাটা বেরিয়ে গেছে।
সেগুলোকে মানুষ গুজব ভাবছে। আপনি যদি কভার স্টোরি করেন তাহলে আর ঠেকানো যাবে না। মেয়েটার এই সর্বনাশটা করবেন না।
কর্তৃপক্ষকে বোঝানো যাবে না। একটাই উপায় আছে, আমি চাকরিটা ছেড়ে দিতে পারি।
হুমায়ূন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। আমরা যখন এসব কথা বলছিলাম তখন মাহফুজকে দূরে সরিয়ে দিই, ও অন্য রুমে গিয়ে বসেছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হুমায়ূন বলেন, আপনি চাকরি ছেড়ে দিলেও ওরা স্টোরি করবেই। চাকরি ছাড়ার দরকার নেই, আপনি থেকেই কী করতে পারেন দেখেন।
শোনেন হুমায়ূন, মেয়েটার বিয়ে নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা কেন করছেন? আপনি নিজেও কী চান ওর অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে হোক? আমি জানি, আপনি তা চান না। বরং যাকে ভালোবাসেন সাহসের সঙ্গে তাকে আপন করে নেন, আপনিই শাওনকে বিয়ে করেন। আমি কিছু প্রশ্ন তৈরি করে দিচ্ছি, আপনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে উত্তরগুলো দিন। স্টোরির সঙ্গে ইন্টারভিউটা ছেপে দিব।
এরপর আমি কিছু প্রশ্ন লিখে মাহফুজকে দেই। মাহফুজ ওকে নিয়ে চলে যায়, ভোররাতের দিকে ইন্টারভিউটা নিয়ে আসে। এদিকে পূর্ণিমার অন্য রিপোর্টার আবুল কাশেম স্টোরিটা তৈরি করে ফেলে। কাশেম স্টোরিটা লেখার ক্ষেত্রে পুরো পেশাদারিত্বের পরিচয় দেয়, আমিও ওকে প্রভাবিত করিনি।
কভার স্টোরিটা তাহলে হুমায়ূন আহমেদের বিপক্ষেই ছিল?
পুরোপুরি। ওই সংখ্যাটা এত জনপ্রিয় হয়, আমাদের দ্বিতীয় সংস্করণ করতে হয়েছিল।
হুমায়ূন আহমেদ কোনো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল?
টেলিফোন করে খুব রাগ করলো। পরে আবার স্যরিও বলেছিল। এর কয়েক মাসের মধ্যেই শাওনকে বিয়ে করে ফেলে।
এরপর কি আপনাদের যোগাযোগ কমে গেল?
সম্পর্কে তো কিছুটা ভাটা পড়েই। শুধু হুমায়ূনের সাথে যে আমার সম্পর্কে ভাটা পড়ে তাই নয়, ইনকিলাব গ্রুপের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক আস্তে আস্তে খারাপ হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে আমি ওই হাউজ ছেড়েই দিই।
ছেড়ে দিয়ে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় যোগ দেন?
হ্যাঁ, অবশ্য অধিক বেতনেই যোগ দেই। সেইদিক থেকে আমার আর্থিক কোনো ক্ষতি হয়নি।
এরপরে আর যোগাযোগ করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে?
করেছিলাম। আমার দেশ-এ যোগ দেবার পরে একদিন ফোন করে বলি, হুমায়ূন, আমি কয়েকজনকে নূহাশ পল্লীতে পাঠাতে চাই, নূহাশ পল্লীর ওপর একটা ফিচার করাবো। ও শুধু জানতে চান,
কতজন যাবে?
আমি বলি, ৫/৬ জনকে পাঠাব।
হুমায়ূন ওই টিমের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন।
আর কখনো তার বাসায় যাননি?
গিয়েছিলাম। ওর দখিন হাওয়ায় গিয়েছিলাম কাশেমকে নিয়েই। হুমায়ূন খুবই শার্প। কাশেমকে দেখেই ওর সন্দেহ হয়, আমাকে জিজ্ঞেস করে, এটা কে?
ও, হুমায়ূন, ও হলো ইনকিলাবের একজন রিপোর্টার।
নাম কি?
ওর নাম কাশেম।
ওর দিকে তাকিয়ে ভীষণ ক্ষেপে যান।
তুমিই তো আমার ওপর লিখেছিলে?
প্রশ্নটা করেই খুব জোরে একটা ধমক দেন ওকে। সেদিন শাওন বাসায় ছিল না। আলমগীর, মাজহার এবং আরো একজন প্রকাশককে খবর দিলেন। ওরা সবাই হুমায়ূনের কারণেই দখিন হাওয়াতে অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিল। এক বাড়িতেই থাকত, সারাক্ষণ হুমায়ূনকে ঘিরেই ওদের জগত ছিল। ওদেরকে ডেকে বললেন, নাশতার ব্যবস্থা করতে। ওরা ছুটে গিয়ে প্রচুর খাবার নিয়ে এলো এবং খাবার দিয়ে চলে গেল। আমরা খাওয়া দাওয়া করি। কিছুক্ষণ গল্প করে চলে আসি।
ওটাই কি শেষ দেখা?
না, আরো একবার দেখা হয়েছিল। ওর চলচ্চিত্রের একটা অফিস ছিল কাকরাইলে, ওখানে একবার গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি ওকে ঘিরে আছে অভিনয় শিল্পীরা। তিনি ওদের বলেন, আমার বন্ধু আসছে, চা বানাও।
অভিনয় শিল্পীরা সবাই ওকে স্যার স্যার করত এমন কী ওর চেয়েও বয়োজ্যেষ্ঠ অভিনেতা অধ্যাপক মোজাম্মেল হককেও দেখলাম হুমায়ূনকে স্যার বলে সম্বোধন করছিলেন।
সামনা-সামনি আর দেখা হয়নি?
না আর দেখা হয়নি, তবে টেলিফোনে কথা হত মাঝে মাঝে। ও, আরেকটি মজার গল্প বলতে ভুলে গেছি। আপনাকে তো বলেছি, ও খুব নাটকীয়ভাবে একেকটা ঘটনাকে উপস্থাপন করত। একবার ওর বাসায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আপনি তো জানেন, প্রতি বছর ঈদ সংখ্যার জন্য আমি পশ্চিম বঙ্গের লেখকদের কাছে যেতাম, নগদ টাকা দিয়ে ওদের কাছ থেকে উপন্যাস নিয়ে আসতাম। এইসব নিয়ে কথা বলছিলাম। যখন একই গল্পে সুনীল, শীর্ষেন্দু আর সমরেশ মজুমদারের কথা এলো, হঠাৎ ও বলে, ওঠেন।
আমি ভাবলাম মাহফুজের মতো আমাকেও অপমান করে বের করে দেবে নাকি? ওর `ওঠেন` শব্দটি শুনে আমি ভড়কে যাই। পরে বলেন, আসেন, আপনাকে একটি গোপন জিনিস দেখাই।
এ-কথা বলে অন্য একটি ঘরে নিয়ে গেল। সম্ভবত ওর লেখার ঘর। ওখানে একটা বড়ো ছবি। সেই ছবিতে সুইমিংপুলে অর্ধনগ্ন অবস্থায় হুমায়ূন আহমেদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং সমরেশ মজুমদার।
আপনাকে কোনো বই উৎসর্গ করেছিলেন?
আমার জানামতে না, আমার চোখে পড়েনি। তবে ওর সঙ্গে আমার যে বন্ধুত্ব তাতে বই উৎসর্গ করাটা খুব স্বাভাবিক ছিল তবে ওর এক উপন্যাসে আমাকে একটা চরিত্র করেছিল। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে পড়ার সময় যখন স্যাতস্যাতে মাঠ পেরিয়ে হেঁটে যেতাম মাঝে মাঝে চিকন সাপ পায়জামা কামড়ে ধরত, তখন ভয় পেয়ে পায়জামা ঝাড়া দিয়ে দৌড় দিতাম। এটা ওকে বলেছিলাম। ওর কোনো এক উপন্যাসে আতাহার নামের একটি চরিত্র নির্মাণ করেই এই দৃশ্যটি তৈরি করেন।
অনেক ধন্যবাদ আতাহার ভাই, বাংলা সাহিত্যের এই অসামান্য প্রতিভার সঙ্গে আপনার বন্ধুত্বের সুবাদে অনেক অজানা কথা জানতে পারলাম। আবার কথা হবে অন্য কোনো প্রসঙ্গে।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক