হিমুদের আত্মহত্যার দায় সংগঠন এড়াতে পারে না

হাসান আজারকাত

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৬, ২০১৯

হিমুর আত্মহত্যার ঘটনার পর ফেসবুক হোমপেজ স্ক্রল করছি আর নানান জনের নানান মতামত বসে বসে দেখছি। রানা প্লাজায় হিমুর বীরত্ব নিয়ে বাণিজ্য করতে দেখছি। যেই ছাত্র সংগঠন বিগত দুই বছর হিমুর দিকে ফিরেও তাকায় নাই সেই ছাত্র সংগঠন হিমুকে নিজেদের লোক হিসেবে দাবি করে এখন পোস্ট দিচ্ছে, শোকবার্তা জানাচ্ছে। অথচ এই হিমু কাকতালীয়ভাবে যদি রানা প্লাজা দিবসেই গায়ে আগুন না দিয়ে কোনো রোগে বা ড্রাগ এবিউসে মারা যেত তাহলে সংগঠনের এতটা মায়াকান্না দেখা যেত না এবং সেটা আমি পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হয়েই বলছি। আরেকটা কথা হলো, হিমু যে রানা প্লাজার ট্রমার কারণেই আত্মহত্যা করেছে বলে অনেকে দাবি করছে, নিউজে ছেপেছে সেটা পুরোপুরিভাবেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মৃত্যুর আগে তার কোনো ফেসবুক স্ট্যাটাসে রানা প্লাজা বিষয়ক কোনো কিছুরই উল্লেখ নেই। যারা রানা প্লাজাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে তারা কি নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই এমনটা করছে? নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার বা দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

সংগঠনের কর্মীরা যখন রানা প্লাজার ট্রমায় ভুগছিল তখন সংগঠন থেকে কি ধরনের সাহায্য করা হয়েছিল ট্রমা কাটানোর জন্য? কোনো কাউন্সিলিংয়ের বন্দোবস্ত করেছিল কি? সংগঠনের কর্মীরা যেন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়, অন্তত নিজের খরচ নিজেরা চালাতে পারে, সেক্ষেত্রে সংগঠন কখনো কোনো ভূমিকাই পালন করে নাই। হিমুর মতো বোকারা না খেয়ে না দেয়ে রাতভর পোস্টার-চিকা ও দিনভর মিছিল-মিটিং করে বেড়িয়েছে। থাকার জন্য ক্রিসেন্ট রোডের একটা অফিসে শোয়ার জায়গা দিয়েছে শুধু। নানান সময়ে এই বড়ভাই, সেই বড়ভাই, আমাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে তাদের খাবার খরচ চালাতে হতো।

ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতার আচরণের সাথে লেজকাটা শেয়ালের গল্পের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আরে পড়াশুনা করে কি হবে; চাকরি-বাকরি করে কি পুঁজিপতিদের দাস হবা; জীবনের খুবই মূল্যবান সময় এখন ব্যয় করছো, এই সময়টা আর ফিরে পাবা না... ইত্যাদি মগজে ঢুকিয়ে অনেক কর্মীর সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এই সংগঠন ও তাদের নেতাগুলা নষ্ট করে দেয়। ছেলেপেলে একটু জ্ঞানী হলে ছাত্র সংগঠনের নেতাদের তা হজম হয় না। বেশি বুঝো তুমি, ওইসব তত্ত্ব কোনো কাজে আসে না। সমাজ পরিবর্তন করতে হলে সংগঠনের আদর্শ ধারণ করাটাই খুব জরুরি। আর সুযোগ পাইলেই, আরে তূর্য্য! ও সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লব কি বুঝে! তূর্য্য তো মার্ক্স-এঙ্গেলস-মাও-চের তত্ত্ব আউড়ানো ‘প্রকৃত বিপ্লবী’! আর রূপম! ও তো মাওয়ের রেড ডায়েরি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, পুরাই এনার্কিস্ট! ওরা যে চর্চা করতে চায় ওসব করে লাভ নেই। কারণ সংকটের সমাধান, গণতান্ত্রিক সংবিধান!

সংগঠনের সাথে কোনো কর্মীর মতবিরোধ থাকলে ও প্রশ্ন তুললে উত্তরের পরিবর্তে কর্মীটির নামের পাশে আদর্শ ধারণ করতে পারে না, নেতাদের মানে না ইত্যাদি বিশেষণ যুক্ত হয়। অথচ নেতারা তখন দেখে না এই কর্মীটিই একসময় সারারাত পোস্টার মেরে দিনের বেলা আধপেটা খেয়ে মিছিল করতো। আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার, কমিটি কেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এক সহযোদ্ধার বিরুদ্ধে অপর সহযোদ্ধাকে দাঁড় করিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা। যার ফলে একসময় হিমুরা যাদের সাথে রানাপ্লাজায় উদ্ধার কাজ করতো তারাই দেখা গেল কমিটিগত প্রতিপক্ষ হয়ে গেল।

আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আমি ছাত্র সংগঠনে থাকাকালীন কোনো ছাত্র নেতা বা কর্মীকে হিমুর রানাপ্লাজায় উদ্ধারকাজের বীরত্বগাথা বলতে শুনি নাই, তার প্রাপ্য সম্মান তারে পাইতে দেখি নাই। রাতে হিমুদের সাথে থাকা হলে হিমুদের মুখেই তাদের বীরত্বের কথা শুনতাম, তাদের আক্ষেপ শুনতাম, সংগঠনকেন্দ্রিক হতাশা শুনতাম। `হাজার প্রাণের চিৎকার` বইটিতে তাদের কথা উল্লেখ করায় তারা কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পেয়েছিল। আমিও ২০১৫ এর বইমেলায় বইটাকে একটু বেশিই প্রমোট করার চেষ্টা চালিয়েছিলাম।

এরপর ছাত্র সংগঠন ছেড়ে দেয়ার পর বাইরে থেকে নেতাদের লেজকাটা শিয়ালের পরিবর্তে মাগী তোমার রূপ শেষ এইবার তুমি খোদা হাফেজ টাইপ দালালদের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া গেল। প্রচুর ডেডিকেশন থাকার পরও অবহেলার শিকার হয়ে সংগঠন ছাড়ার পর কোনো খোঁজ তো দূরে থাক, কর্মীদেরকে তাদের পোস্টে লাইক কমেন্ট করাও বারণ করা হলো। এরাই আবার মরার পর নিজেদের লোক বলে বাণিজ্য করবে। সংগঠন ছাড়ার পর ২০১৬ সালে স্টলে বই দেখতে গেলে রাজশাহীর এক নেতা মানুষজনের সামনে আমাকে বলল, এই সরো, এইখানে কি! এখানে ভিড় কইরো নাতো!

বইমেলায় সিনক্রিয়েট না করে আমি মেলা থাকে বের হয়ে ফোন দিয়ে বললাম, খা*কির পোলা, মেলা শেষ কইরা টিএসসির চায়ের দোকানে আয়, ভিড় তোর পু*কি দিয়া ভরমু। অবশ্য পরে নেতাটিকে সেসময় না পাওয়ার দরুণ সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রথম পাবলিক স্ট্যাটাস দিই এবং সেই নেতাটি ভুল বুঝতে পারে ও ক্ষমাপ্রার্থনা করে এবং আমিও অকথ্য ভাষার জন্য দুঃখপ্রকাশ করি। সংগঠন ছাড়ার পরবর্তী অনেক উদাহরণের মধ্যে মাত্র একটি দিলাম। একটা মানুষ রাজনীতি করতে এসে সংগঠনের এসব কার্যকলাপে কেন হতাশ হবে না। হিমুর মত হতাশ অনেকেই এই সংগঠনের আশেপাশে আছে। এদের সাথে যতই মতানৈক্য ও দূরত্ব থাকুক না কেন এদের পরিচর্যা করা ও খোঁজখবর নেয়াটা উচিৎ বলে আমি মনে করি। আমি বা বন্ধু রুপম শেয়ানা হওয়ায় হয়তো হতাশ হওয়ার পরও তা ওভারকাম করতে সক্ষম হয়েছি, কিন্ত অনেকেই আছেন যারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে।

সংগঠনের সব মানুষই যে লেজকাটা শিয়াল বা দালাল তা বলছি না। অনেক ভালো মানুষও আছেন যারা হিমুদের বিভিন্ন প্রয়োজনে বিনা প্রশ্নে হেল্প করেছেন। আমার কোন সমস্যা নিয়ে পোস্ট দিলে ইনবক্সে জানতে চেয়েছেন কি সমস্যা, অনেকসময় পার্সোনাল ব্যাপারে ভাল সাজেশনও দিয়েছেন, স্বার্থ ছাড়াই আপন করে নিয়েছেন। তাদের প্রতি সবসময়ই কৃতজ্ঞতা থাকবে। তবে ওইসব লেজকাটা শিয়াল বা মাগীর দালাল টাইপ লোকজনের ব্যাপারে মূল সংগঠনের নেতৃত্ব যদি সাবধান না হয় তাহলে সংগঠনের অস্তিত্বে খুব অচিরেই টান পড়বে, তখন সিপিবি-বাসদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে চলা ছাড়া কোন গতি থাকবে না।

যেসব ছোট ভাইবোন এ ধরনের সংগঠনে ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, সবার আগে পরিবার, এরপর পড়াশুনা এবং ক্যারিয়ার এবং তারপরে রাজনীতি। নিজেদের পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক থাকলে ও অর্থনৈতিক সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে পারলে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকসহ সব হতাশা খুব সহজেই ওভারকাম করা সম্ভব। রাজনীতির চর্চা থেকে বিরত হবার জন্য বলছি না, চর্চাটা জরুরি। তবে এটাই যেন প্রথম প্রায়োরিটি না হয়। নাহলে হিমুদের স্থলে নিজেদের আবিষ্কার করার সম্ভাবনা খুবই প্রবল।