হিন্দুত্ব নামক ধর্ম–সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উত্থান

সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশিত : জুলাই ১২, ২০২০

তুলনামূলকভাবে দেখলে দেখা যাবে, আজ যে হিন্দুত্ববাদের বিষবৃক্ষটি ফুলে–ফলে পল্লবিত হয়েছে, ব্রিটিশ সরকারই নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে তার বীজ মাটিতে বপন করেছিল। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ভারতীয় জনগণের একত্রিত বিদ্রোহী চেতনাকে ভাঙতে উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ শাসকরা নিয়ে এসেছিল, ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতি। মূলত এর ওপর ভিত্তি করেই ভারতবাসীর মননে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ঘনবিষ ঢুকিয়ে দেয় তারা। এরই মাধ্যমে ভারতীয় জনগণের ওপর তাদের শাসন, শোষণ ও লুণ্ঠনকে দীর্ঘায়িত করতে পেরেছিল। ১৮৭৫ সালে হান্টার সাহেবের লেখা ‘দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমান’ বই থেকে ব্রিটিশরা আমদানি করেছিল ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’।

ইতিপূর্বে যে বহু ধারা, উপধারায় বিভক্ত এমনকি পরস্পরবিরোধী যে হিন্দু মতবাদ, হিন্দু প্রথা, হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দু (সনাতন) ধর্ম প্রবাহমান ছিল, তাকে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা শাসকের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে একটি প্রাতিষ্ঠানিক জাতি হিসেবে তুলে ধরে সচেতনভাবে হিন্দু–মুসলমানের বিভেদের কাজটি এগিয়ে নিয়েছেন।

ব্রিটিশ লিখিত এই ইতিহাস বই থেকেই যুক্তি খুঁজে রাজনারায়ণ বসু ও নবগোপাল মিত্র হিন্দু ধর্মকে (রিলিজিয়ন) ভিত্তি করে হিন্দু জাতি (ন্যাশন) পুনরুত্থানবাদী চিন্তাধারা প্রচার করতে শুরু করেন। দু’জনই ছিলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দ্বারা উপকৃত মধ্যসত্বভোগী শ্রেণীর প্রতিনিধি। এবং ১৮৬৭ সালে ‘ন্যাশনাল সোসাইটি’ একটি নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তারা হিন্দু মেলার আয়োজন করতে লাগলেন। নবগোপাল মিত্র তার সম্পাদনায় প্রকাশিত ন্যাশানাল পেপার পত্রিকায় লিখলেন– “…the basis of national unity in India is the Hindu religion. Hindu nationality embraces all the Hindus of India irrespective their locality or language…”।

এই বক্তব্য তুলে ধরে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, “নবগোপাল মিত্র, হিন্দু মহাসভা ও জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের পঞ্চাশ বছর আগেই এই ভাবনাটির আমদানি করেছিলেন। আর সে সময় থেকেই সচেতন বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসচেতনভাবে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের গভীরে হিন্দু বীজটি গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছিল। বিভিন্ন ধারা, প্রথা, ভাষা ও জাতিতে বিভক্ত ‘হিন্দু ধর্ম’ এভাবে এক জাতিগত ভিত্তিতে বিবেচিত হওয়ার দিকে পা বাড়িয়েছিল।” পাশাপাশি বঙ্কিম সাহিত্য হিন্দু ধর্মীয় পুনরুত্থানবাদের সূচনার ওপর নির্ভর করে, হিন্দু জাতীয়তাবাদের স্বরূপ নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছিল। অন্যান্য কিছু ধর্মীয় পুনরুত্থানবাদীর কথা ও লেখাতেও ভারতীয় সংস্কৃতি, ভারতীয় প্রথার নামে জাতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা সঞ্চারের মাধ্যমে হিন্দু সংস্কৃতির প্রচার চালিয়ে হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের বিপুল আয়োজন দেখা যায়।

সমসাময়িককালেই ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি প্রথম আমদানি করেন চন্দ্রনাথ বসু। ১৮৭৫ সালে তৈরি হয় ‘আর্য সমাজ’। ১৮৮০ সালে তৈরি হয় ‘গো–রক্ষিনী সভা’। ১৮৮২ সালে লাহোরে তৈরি হয় ‘হিন্দু মহাসভা’। ১৯১৫ সালে এই হিন্দু–মহাসভার সঙ্গে একীভূত হয় পাঞ্জাবের ‘হিন্দু সভা’।

যেহেতু ভারতবর্ষ কোনোদিনই এক ভাষা, এক জাতি, এক ধর্মের দেশ ছিল না, তাই পরের দশকগুলোতে হিন্দুত্ববাদীরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে হিন্দুত্ববাদকেই নিউক্লিয়াস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা জোরকদমে চালাতে থাকে। বলা বাহুল্য, এর পিছনে তৎকালীন দেশীয় বৃহৎ সামন্তশ্রেণী, মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াশ্রেণী এবং সর্বোপরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রত্যক্ষ মদত ছিল।

উগ্র–হিন্দুত্ববাদের প্রাতিষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ
১৯১১ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র ধারায় বিশ্বাসী হলেও, সেলুলার জেলে দ্বীপান্তরে থাকাকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে মুচলেকা দিয়ে ১৯২০ সালে ছাড়া পান দামোদর বিনায়ক সাভারকর। ঠিক পরের বছরই, অর্থাৎ ১৯২১ সালে তিনি একটি বই প্রকাশ করেন – ‘হিন্দুত্ব : হু ইজ হিন্দু’। কারাবাস থেকে নিস্তার পাওয়ায় সাভারকর ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা ও কর্তব্য প্রমাণে দায়বদ্ধ ছিলেন। এমনকি তিনি ভারতীয় বিপ্লবীদের ব্রিটিশ বিরোধিতা থেকে সরিয়ে আনার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন। উপরোক্ত বইয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, “হিন্দু জাতির প্রতিনিধি তারাই, যারা এই দেশকে শুধু পিতৃভূমি বা মাতৃভূমি বা জন্মভুমি বলেই স্বীকার করে না, পাশাপাশি এ দেশকে তারা পুণ্যভূমি বা পবিত্রভূমি বলেও স্বীকার করেন।” অর্থাৎ ভারতবর্ষ শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেশ, বাকি সব বসবাসকারীরাই বহিরাগত। যারাই এদেশে সম্মানের সহিত বসবাস করতে চাইবেন, তাদের অবশ্যই ভারতবর্ষকে হিন্দু পূণ্যভূমি ও হিন্দুদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেই বাঁচতে হবে। এখান থেকেই জন্ম নেয় আরও সংকীর্ণ ধর্মভিত্তিক ঘৃণা, বিদ্বেষ ও জাতিগত হিংসা। উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ উপনিবেশের বিভাজন ও শাসনের রাজনৈতিক চক্রান্ত সফল হলো।

১৯২৫ সালে হেডগেওয়াড়ের চেতনা ও নেতৃত্বে মহারাষ্ট্রে জন্ম নেয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)। সেই সঙ্গে ভারতের মাটিতে পেশোয়া রাজ্যের গেরুয়া পতাকাকে সামনে এনে জন্ম নেয় গৈরিক মনুস্মৃতিনির্ভর মৌলবাদী রাজনীতির। জন্মলগ্ন থেকেই তাদের ঘোষিত লক্ষ্য– ‘হিন্দুদের জন্যই হিন্দুস্তান’। সাভারকর স্লোগান তুললেন– ‘রাজনীতির হিন্দুত্বকরণ ও হিন্দুত্বের সামরিকীকরণ’। সংঘ পরিবার ঘোষণা করলো– ‘হিন্দু জাতির সংস্কৃতিই এ দেশের জাতীয় সংস্কৃতি’। শুরু হলো হিন্দু সংকীর্ণ ও উগ্র–জাতীয়তাবাদের প্রচার ও ধর্মান্তকরণের খেলা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংগঠিত প্ররোচনায় ছড়িয়ে পড়লো রক্তক্ষয়ী হিন্দু–মুসলিম দাঙ্গা। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম ও রাজনীতি থেকে হেডগেওয়াড় আরএসএস কর্মীদের মুক্ত রাখলেন। এভাবে মূলত সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আরএসএস।

ইতালিতে ফ্যাসিবাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা ও ভারতে উগ্র–হিন্দুত্ববাদের উত্থান
প্রাচীন রোমের রাজশক্তির প্রতীক ছিল ‘ফ্যাসিস’। ১৯১৯ সালে এই ‘ফ্যাসিস’ বা দড়িবাঁধা কাষ্ঠদণ্ডকে গৌরবময় প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে ‘ফ্যাসিস্ট পার্টি’ গঠন করেন বেনিতো মুসোলিনি। তাদের মতাদর্শ ছিল রাষ্ট্রবাদ। তাদের মতে, “রাষ্ট্রই সকল শক্তির আধার, রাষ্ট্রের বাইরে কিছুই নেই এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও কিছু নেই।” ১৯২৬ সালের মধ্যেই বিরোধী দল ও কমিউনিস্টদের ওপর ভয়াবহ দমন–পীড়নের শেষে একেবারে গ্রাম থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত এই ফ্যাসিস্ট দলের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়। মেহনতি জনগণের মনে এই ধারণা প্রচার করা হয়– “রাষ্ট্রের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ব্যক্তি, ব্যক্তির অধিকারের জন্য রাষ্ট্র নয়।” এভাবে ইতালিতে মুসোলিনি হয়ে উঠলেন এক ফ্যাসিস্ট একনায়ক।

আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে ইতালির এই ফ্যাসিস্ট দল ও মুসোলিনির সম্পর্ক ছিল ভ্রাতৃপ্রতিম। ভারতীয় রাজনীতি বিষয়ক ইতালীয় গবেষক মারিয়া কাসোলারি, স্বয়ংসেবক বি এস মুঞ্জের ডায়েরিগুলো পড়ে মন্তব্য করেছেন, “ইতালীয় ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দ, মুসোলিনিও যার অন্তর্গত এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংযোগের অস্তিত্ব থেকে বোঝা যায় যে, ফ্যাসিবাদের মতাদর্শ ও কার্যকলাপ সম্বন্ধে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কেবলমাত্র বিমূর্ত কৌতূহল ছিল না। তার থেকে বেশি কিছুই ছিল। … ফ্যাসিবাদ তাদের কাছে আবির্ভূত হয়েছিল রক্ষণশীল বিপ্লবের একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে।”

১৯৩১ সালে বি এস মুঞ্জে ইতালি যান ও মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সংগঠনগুলোর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। মুসোলিনিও তাকে ভারতবর্ষে ইতালির মতো জাতীয়তাবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষী অতীত ঐতিহ্যবাদী সংগঠন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন এবং সফলতা কামনা করেন। এরপর ইতালির ফ্যাসিস্ট তরুণদের একটি দল আরএসএসের মধ্যে উগ্র–জাতীয়তাবাদ কিভাবে জন্ম দিতে হবে, তার প্রচার চালাতে আসে। বেশ কিছু জায়গায় আরএসএসের পক্ষ থেকে গোপন ও প্রকাশ্য সভার আয়োজন করা হয়। ১৯৪০ সালে মুসোলিনির লেখা ‘ডকট্রিন অব ফ্যাসিজম’ বইটি অনুবাদ করে ‘লোখান্ডি মোর্চা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন কাশীনাথ দামলে। এই পত্রিকাতেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় আন্তোনিও পাগ্লিয়ারোর ‘ফ্যাসিজম অ্যাগেইনস্ট কমিউনিজম’। ইতালির ফ্যাসিস্ট সংগঠন কালো জামা পরা আয়রন গার্ডসের অনুকরণে ভারতে সংগঠন গড়ে তোলেন দামলে। এই কাজের জন্য ইতালির কনসাল জেনারেল তার প্রশংসা করেছিলেন।

জার্মানিতে হিটলারের ক্ষমতায় আরোহণ ও ভারতে উগ্র–হিন্দুত্ববাদের প্রভাব বিস্তার
১৯২৫ সালে জার্মানিতে প্রকাশিত হয় অ্যাডলফ হিটলারের লেখা বই, ‘মাইন ক্যাম্ফ’ বা ‘আমার সংগ্রাম’। এই বইয়ে নাৎসি দলের মতাদর্শ, ভাবধারা ও কর্মসূচী বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। ১৯৩৪ সালে নিজেকে ফ্যুয়েরার ঘোষণা করে জার্মান রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন হিটলার। ক্ষমতা দখলের পরই বিরোধী দল, সোশ্যালিস্ট ও কমিউনিস্টদের ওপর শুরু হয় ভয়ানক দমন–পীড়ন, গ্রেফতার ও গুপ্তহত্যা। শুরু হয় ভয়ঙ্কর ইহুদি বিদ্বেষ। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমস্ত অ–জার্মান ও ইহুদিদের বিতাড়ন করা হয়। ইহুদিদের সঙ্গে জার্মানদের বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয় ও সমস্ত চাকরি থেকে ইহুদিদের বরখাস্ত করা হয়।

সমস্ত শ্রমিক সংগঠন ভেঙে দিয়ে শ্রমিক কর্মচারীদের নাৎসি প্রভাবাধীন একটি সংগঠনের ছত্রছায়ায় আনা হয়। জার্মানিতে লক আউট ও ধর্মঘট নিষিদ্ধ করা হয়। লক্ষ্য হিসেবে স্থির হয়, জার্মানির অতীত গৌরব পুনরুদ্ধার করে সমগ্র বিশ্বে জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

শীগগিরই হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা এই ফ্যাসিস্ট নাৎসি দল ও হিটলারকে তাদের গুরু বলে গ্রহণ করে নেয়। হিটলার প্রচার করতেন যে, জার্মানরাই একমাত্র আর্য জাতি এবং একমাত্র তাদের শরীরেই নর্ডিক রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। নাৎসিদের এসব ‘পবিত্র’ ভাবনা ও উগ্র জাতি বিদ্বেষী নীতি ভারতের ‘ধর্মপ্রাণ’ হিন্দুত্ববাদীদের ইন্দো–জার্মান আর্য পরম্পরায় ভাবতে অধিক সুবিধা করে দিয়েছিল। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত ‘উই আর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’ নামক বইয়ে সংঘ–সচিব গোলওয়ালকর ইতালি ও জার্মানিকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে বললেন, “এসব প্রাচীন রাষ্ট্রগুলো কিভাবে তাদের সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান করেছে, তা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। নিজেদের রাষ্ট্র কাঠামোয় কোনো পৃথক উপাদানকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি তারা। দেশের বৃহত্তম জনসংখ্যা বা রাষ্ট্রীয় জাতির মধ্যে একাত্ম হতে হয়েছে বহিরাগত অধিবাসীদের। গ্রহণ করতে হয়েছে তাদের সংস্কৃতি ও ভাষা, অংশীদার হতে হয়েছে তাদের আশা–আকাঙ্ক্ষার, নিজেদের পৃথক অস্তিত্বের কথা সম্পূর্ণভাবে ভুলতে হয়েছে, ভুলতে হয়েছে তাদের বিদেশি উৎসের কথা। তা না হলে নিছক বহিরাগত হিসেবেই থাকতে হবে তাদের, রাষ্ট্রের (পড়ুন হিন্দু) সমস্ত বিধি নিয়ম মেনে চলতে হবে, রাষ্ট্রের (পড়ুন হিন্দু) অধীনস্থ হয়ে থাকতে হবে, কোনো বিশেষ সুরক্ষা তারা পাবে না, কোনো সুবিধা বা অধিকারের তো প্রশ্নই ওঠে না। বহিরাগতদের জন্য মাত্র দুটি পথই খোলা আছে– হয় রাষ্ট্রীয় (পড়ুন – হিন্দু*) জাতির সাথে মিশে যেতে হবে এবং তাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করতে হবে, অথবা রাষ্ট্রীয় জাতি যতদিন চাইবে, ততদিন তাদের করুণার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা এবং রাষ্ট্রীয় জাতি যখনই চাইবে, তখনই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া। সংখ্যালঘু সমস্যার বিষয়ে এটিই একমাত্র যুক্তিনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গী। এটিই একমাত্র যৌক্তিক ও সঠিক সমাধান। নিজেদের রাষ্ট্র কাঠামোয় রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র সৃষ্টির মতো ক্যানসার রোগ তুল্য বিপদ থেকে নিজ–জাতিকে নিরাপদ রাখার এটাই একমাত্র উপায়।” উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের হি‘ন্দু ধর্ম’ পুনরুত্থানবাদ থেকে এভাবেই জন্ম নেয় ঘৃণা বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতায় ভরা সংকীর্ণ উগ্র–হিন্দু জাতীয়তাবাদ।

হিটলারের ইহুদিবিরোধী অভিযানকে সমর্থন করে ১৯৩৮ সালে ভারতে মুসলিমদের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে গোলওয়ালকর বলেন, “কোনো ভূখণ্ডে বসবাসকারী সংখ্যাগুরুদের নিয়েই দেশ গড়ে ওঠে। জার্মানিতে ইহুদিরা কি করছে? তারা জার্মানিতে সংখ্যালঘু বলে তাদের জার্মানি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।” ১৯৪০ সালে ইতালি ও জার্মানির ফ্যাসিবাদী মতাদর্শকে শিরোধার্য করে গোলওয়ালকর এক বক্তৃতায় বলেন, “এক নিশান, এক প্রধান ও এক মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই এই মহান দেশের প্রতিটি কোণায় হিন্দুত্বের শিখা প্রজ্বলিত করে চলেছে আরএসএস।”

ভারতীয় সংবিধানে লিখিতভাবে রাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা স্বীকৃত (যদিও কার্যক্ষেত্রে তার প্রয়োগ ছিল না বা নেই বললেই চলে)। ১৯৬১ সালে গোলওয়ালকর এক বিবৃতিতে বলেন, “বর্তমানের যুক্তরাষ্ট্রীয় ধাঁচের সরকার শুধু যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের জন্ম দেয় তা–ই নয়, তাকে পরিপুষ্টও করে তোলে। একদিক থেকে দেখলে এটি এক জাতির ধারণাকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে এবং তাকে ধ্বংস করে। একে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে। সংবিধান শুদ্ধ করতে হবে এবং একীভূত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।” আরএসএসের ইশতেহার ‘বাঞ্চ অফ থটস’ এ একই কথা আরও বিস্তারিতভাবে লেখা আছে।

উগ্র–জাতীয়তাবাদীদের মতাদর্শগত ও প্রয়োগগত মিল
ইতালির মতোই ফ্যাসিবাদী ভাবধারার প্রসারে ভারতের হিন্দু–জাতীয়তাবাদীরা শিক্ষাক্ষেত্রকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। ১৯৪৬ সালে সংঘ–সচিব গোলওয়ালকরের নেতৃত্বে তৈরি করা হয় ‘গীতা মডেল স্কুল’। ১৯৪৮ সালে এই স্কুলগুলোকে নিষিদ্ধ করে সরকার। ১৯৫১ সালে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল জন সংঘের প্রথম সম্মেলনেই বলা হয়, ভারতীয় সংস্কৃতিকে (আসলে হিন্দু) প্রতিফলিত করে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা, এক সংযোগকারী ভাষা প্রসার ঘটানোই তাদের মূল কর্মসূচী। ১৯৫২ সালে নানাজি দেশমুখের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সরস্বতী শিশু মন্দির’।

অনুগত নাগরিক ও অন্ধ–সমর্থক জোটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে আরএসএস দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে তোলে, ‘বিদ্যাভারতী অখিল ভারতীয় শিক্ষা সংস্থান’। সারাদেশে প্রায় ৫২ হাজার এ রকম স্কুল–কলেজ রয়েছে ও প্রায় ৯৬ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে বিদ্যাভারতী প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। প্রতিটি রাজ্যে বিভিন্ন নামে সমাজ–রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ২০১৮ সালে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর প্রণোদনায় আরএসএসের অধীনস্ত শিক্ষকদের ফ্রন্টাল গ্রুপ এবিআরএসএমের মাধ্যমে সম্পূর্ণ শিক্ষার দায়িত্বই চলে যাচ্ছে উগ্র–হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর হাতে। তাদের মূল লক্ষ্যই হলো– সাংস্কৃতিক (একমাত্র হিন্দু) জাতীয়তাবাদের মতাদর্শ শিক্ষাক্ষেত্রে ও সমাজে প্রচার করা। ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রবাসী হিন্দু–আমেরিকানদের মদদে দেশের প্রান্তিক, অনুন্নত ৯৬ হাজার গ্রামে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নিয়ন্ত্রণে চলছে এক লাখ এক হাজার ৪১৭টি একল বিদ্যালয়। যেখানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২৭ লাখ ৫২ হাজারেরও বেশি। আমেরিকাতেও তাদের শাখা রয়েছে।

ইতিহাসের গেরুয়াকরণেরও প্রয়াস চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা। আরএসএসের মোহন বৈদ্য বলেছেন, “ভারতীয় ইতিহাসের আসল রঙ হলো গেরুয়া। আমাদের ইতিহাস পুনর্লিখন করতে হবে।” এভাবে হিন্দুরা ভারতভূমির সন্তান এবং রামায়ণকে ইতিহাস হিসেবে তুলে ধরার অপচেষ্টা চলছে। নতুন করে ইতিহাস লেখার জন্য তৈরি হয়েছে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে কমিটি।

২০১৪ সালে বিদ্যাভারতী প্রজেক্টের অন্যতম মাথা দিননাথ বাত্রা এক সাংস্কৃতিক ভারতের ধারণা দিয়েছেন। অখণ্ড বৃহত্তর ভারতের কথা বলেছেন। বাত্রার তৈরি ওই মানচিত্রে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, কাশ্মীর, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কাসহ বৃহত্তর ভারতের ধারণা তৈরি করা হচ্ছে। বাত্রা বলেছেন, “ভারতের বিভাজন অপ্রাকৃতিক একে পুনরায় জুড়তে হবে।” ১৪ আগস্টকে ‘অখণ্ড ভারত স্মৃতি দিবস’ পালন করা হচ্ছে বিদ্যাভারতী পরিচালিত স্কুলগুলোতে। অতীত ঐতিহ্যের নামে এভাবে শিশুদের মনে বিকৃত, বিদ্বেষপূর্ণ শিক্ষার প্রসার চলছে।

আমেরিকাতেও রয়েছে সংঘের ‘হিন্দু স্টুডেন্ট কাউন্সিল’ নামক শিক্ষা শাখা। রয়েছে ‘হিন্দু ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকা’ নামে কলেজ। প্রবাসী ভারতীয়দের কাছে ফান্ড নিয়ে এভাবেই তারা ইতিহাস, ধর্ম, বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণার নামে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী চিন্তা–ভাবনা ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন। দেশের নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে তাদের মিথ্যে দিয়ে ভরা অবৈজ্ঞানিক ‘শিক্ষায়’ কূপমণ্ডূকে পরিণত করছে, যার ফলাফল দেশবাসী এখন দেখতে পাচ্ছেন।

ফ্যাসিবাদের সাংগঠনিক মিল
হিটলারের নাৎসি দলের মতোই আরএসএস–বিজেপির বিভিন্ন নামে প্রকাশ্য ও গোপন আনরেজিস্টার্ড সংগঠন রয়েছে। স্বয়ংসেবক কথাটির অর্থ স্বেচ্ছাসেবক। ১৯৬৩ সালে নেহরুর আমন্ত্রণে সাধারণতন্ত্র দিবসে তিন হাজার স্বয়ংসেবক ভারতীয় বাহিনীর সাথে প্যারেডে অংশগ্রহণ করে। এখন তাদের সংখ্যা কোটির কাছাকাছি। হিটলারের স্টর্ম ট্রুপার্স, শ্যুটস স্তাফেলন ও ব্ল্যাক শার্টের মতোই যুবক বাহিনী, নারী বাহিনী (সেবিকা সমিতি) ও ছাত্রদের, শ্রমিকদের সংগঠন রয়েছে সংঘের। বজরঙ দল, সন্তান দল প্রভৃতি সংগঠনও আরএসএসের মতাদর্শেই বিশ্বাসী। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, মেরঠে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বলেছেন, “এবার সমস্ত হিন্দুদের জেগে ওঠা উচিত, তাদের একত্রিত হওয়া উচিত, এটাই দেশের চাওয়া।” ওই সভায় তিনি হিটলারের ‘লাস্ট সলিউশন’ এর অনুকরণে ‘শেষ সমাধান’ এর ডাক দিয়েছেন। মনে পড়ে যায়, এই ডাকের পরই হিটলার ৯০ শতাংশ ইহুদিকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দমবন্ধ করে হত্যা করেছিল। তবে কি এমন কিছুই হতে চলেছে আগামীর ভারতবর্ষে?

উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে স্বামী নরসীমা রাওয়ের নেতৃত্বে ‘হিন্দু–স্বভিমান সংঘ’ কিশোর–যুবকদের শারীরিক কসরত ও লাঠি চালনা ও অত্যাধুনিক অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছে। হরিয়ানায় প্রায় দুই হাজার জনের হিন্দুত্ববাদী সশস্ত্র বাহিনী মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করেছে ও অত্যাচার চালিয়েছে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে মুজফফরনগরে প্রায় ৬০ জন সংখ্যালঘুকে হত্যা করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কথিত ‘লাভ জিহাদের’ কথা বলে দুর্গা–বাহিনীকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। নারীদের নাবালিকা অবস্থায় বিবাহের পরামর্শ দিচ্ছে এসব সংগঠন। ৫ জানুয়ারি ২০২০, ‘হিন্দু রক্ষা দল’ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রড ও হকি স্টিক নিয়ে কাপড়ে মুখ ঢেকে হামলা চালিয়েছে। এই ঘটনায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

আরএসএসের ২৬টি সংগঠনকে দিল্লিতে জমি দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার। বালাকোটের ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাশ্মীরি ও মুসলিমদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা। রক্তাক্ত হয়েছেন ছাত্রীরা।

হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক উত্থান ও জনগণের ওপর আক্রমণ
১৯৪৩–১৯৪৬ হিন্দু মহাসভার সদস্য ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ১৯৪৭ সালে তিনি নেহরু মন্ত্রিসভার গুরুত্মপূর্ণ মন্ত্রী হন। কিন্তু ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে শরণার্থী প্রশ্নে স্বাক্ষরিত ‘দিল্লি চুক্তি’ ও সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ প্রশ্নে বিরোধ হওয়ায় তিনি কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। ১৯৫১ সালে গোলওয়ালকরের পরামর্শ ক্রমে তথাকথিত সাংস্কৃতিক সংগঠন আরএসএসের প্রত্যক্ষ মদদে শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে তৈরি হয় রাজনৈতিক দল ‘ভারতীয় জন সংঘ’।প্রথম লোকসভা নির্বাচনে তারা ৯৪টি আসনে প্রার্থী দিয়ে মাত্র ৩টি আসন পেয়েছিল। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা–সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে। জরুরি অবস্থায় চলতে থাকা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশের সর্বত্র যে আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল তা থেকে জন্ম হয় কংগ্রেস বিরোধী জনতা পার্টির। জয়প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন ওই পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান। ভারতীয় জন সংঘ, ভারতীয় লোক দল ও কংগ্রেসের ইন্দিরা বিরোধী অংশ মিলে জনতা পার্টি তৈরি হয়। ১৯৮০ সালে নবগঠিত জনতা পার্টির চরণ সিং সরকারের পতন হলে ভারতীয় জন সংঘের নেতারা (অবশ্যই আরএসএস সদস্য) মিলে ৬ এপ্রিল গঠন করেন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কোনো গুরুত্ব না পেয়ে আরএসএসের পরিকল্পনা মতো বিজেপি নেতারা শুরু করেন রাম–জন্মভূমি প্রতি–আন্দোলন (কাউন্টার মুভমেন্ট)। হিন্দুত্ববাদীদের প্রত্যক্ষ মদদে ১৯৮০ সালে মুরাদাবাদ এবং ১৯৮৫ সালে আহমেদাবাদে দাঙ্গা হয়। ১৯৮৯ সালে বিহারের ভাগলপুরে রাম–শিলা সংগ্রহের সময় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুসলিম বিদ্বেষী স্লোগানকে কেন্দ্র করে একতরফা উস্কানিতে দাঙ্গা তৈরি হয়। ওই ঘটনায় ৯০০ মুসলিম ও ১০০ হিন্দু নিহত হন। ১৯৯০ সালের ২৫ নভেম্বর সোমনাথ মন্দির থেকে লালকৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে শুরু হয় রাম রথ যাত্রা। আদভানির নেতৃত্বে রথ যাত্রা প্রারম্ভের আগে ও পরে আহমেদাবাদে এপ্রিলে ৩০ জন ও অক্টোবরে ৪০ জন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ প্রাণ হারান। এ ছাড়াও যেখান দিয়েই এই রথ যায় সেখানেই অশান্তি ও মারদাঙ্গা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। এই রথ যাত্রার উদ্দেশ্যও এমনটাই ছিল। এ সময় ভি পি সিংয়ের নেতৃত্বাধীন সরকারকে বিজেপি বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল। তাই আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নিষ্ক্রিয় থেকে হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজদের পক্ষে কাজ করছিল।

৬ ডিসেম্বর ১৯৯২, সারা দেশের হিন্দুত্ববাদীদের একত্রিত করে তারা ধ্বংস করে অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ। এই ঘটনায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা কংগ্রেস সরকার ও প্রশাসনের পরোক্ষে মদদ দেওয়ার বিষয়টিকেই জোরালভাবেই সমর্থন করে। এরপর আরএসএসকে নিষিদ্ধ করে তৎকালীন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার। ১৯৯৬ সালে প্রথম কেন্দ্র সরকারের ক্ষমতায় আসে বিজেপি। এরপর ১৯৯৮ ও পরে ১৯৯৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসে তারা। ১৯৯৮ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ি সরকার পোখরানে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করে উগ্র–জাতীয়তাবাদী দম্ভ নির্মাণে কিছুটা সফল হয়। ১৯৯৯ সালে ঘটে কার্গিল যুদ্ধ। যা দিয়ে ‘পাকিস্তানবিরোধী’ সম্প্রসারণবাদী ইমেজ তৈরি করে ২০০৩ পর্যন্ত কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হয় বিজেপি সরকার।এই সরকারই জনবিরোধী নাগরিকত্ব বিল ২০০৩ পাশ করে ও ‘অনুপ্রবেশকারী’ শব্দটি নাগরিকত্ব আইনে অন্তর্ভুক্ত করে। অন্যদিকে, ২০০২ সালে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রত্যক্ষ মদদে ঘটে গুজরাট গণহত্যা। প্রায় দুই হাজার সংখ্যালঘু মানুষকে হিন্দুত্ববাদী ধর্মোন্মাদরা একতরফাভাবে হত্যা করে। অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করা হয়। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ওই গণহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়ার ফলস্বরূপ লাগাতার গুজরাটের ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হন মোদি।

২০১৪ সালে ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে মোদি সরকার। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গো–রক্ষার নামে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের হামলায় শতাধিক দলিত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে হত্যা এবং নিগ্রহ করা হয়েছে। ২০০৯–২০১৪ পর্বের তুলনায় যা ১০,৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ছত্তিশগড়ের সাবেক বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংসহ হিন্দুত্ববাদী নেতারা, কেউ খাদ্য তালিকায় গো–মাংস রাখলে তাকে হত্যা করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যুক্তিবাদী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে হিন্দুত্ববাদীরা। এর মধ্যে এম এম কালবুরগি, নরেন্দ্র দাভলকার, গোবিন্দ পানসারে এবং সাংবাদিক সমাজকর্মী গৌরী লঙ্কেশের হত্যাকাণ্ড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

২০১৭ সালে উত্তর–প্রদেশের হিন্দুত্ববাদবিরোধী দলিত সংগঠন ‘ভিম আর্মি’র নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ রাবণকে ‘মাওবাদী’ তকমা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে মহারাষ্ট্রের ভিমা কোরেগাঁও গ্রামে উচ্চবর্ণীয় মারাঠাদের মদদে দলিতদের ওপর হামলার ঘটনায় প্রতিবাদী নয় বুদ্ধিজীবীকে ‘মাওবাদী’ তকমা দিয়ে ইউএপিএ ধারায় গ্রেফতার করা হয় বা বে–আইনিভাবে আটক রাখা হয়। গ্রেফতার হন সিভিল রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট আনন্দ তেলতুম্বড়ে, দিল্লির গৌতম নউলাখা, মুম্বাইয়ের ভারনন গঞ্জালভেজ, অরুণ ফেরেরা, ফরিদাবাদ থেকে সুধা ভরদ্বাজ, রাঁচির স্ট্যান স্বামী, হায়দ্রাবাদের ভারভারা রাও, সোমা সেন এবং রোনা উইলসন। ২০১৯ সালের আগস্টে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের শতবর্ষ স্মরণ সভায় উপস্থিত হতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন ড. বায়েন ও তার এক সহযোদ্ধা।

হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদ
১৯৪৮ সালে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদের প্রথম স্বীকার হন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদীরা নানান কার্যকলাপে যুক্ত থেকেছে। ১৯৯২–৯৩ সালে মুম্বাইয়ে একতরফা সংখ্যালঘু হত্যা ও লুটপাট চালায় আরএসএস ও বজরঙ দল। ওই বছরই আদভানির নেতৃত্বে রাম রথ যাত্রা বের করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়ায় বিজেপি–আরএসএস। ১৯৯৯ সালে হিন্দুতববাদী সন্ত্রাসবাদীরা হত্যা করে গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেন ও তার দুই শিশুপুত্রকে। ২০০১ সালে উড়িষ্যা রাজ্য বিধানসভায় আক্রমণ চালায় বজরঙ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও দুর্গা বাহিনী। ২০০২ সালে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্ররোচনায় সংঘটিত হয় গুজরাট গণহত্যা। এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় সরকারি হিসাবেই নিহত হন অন্তত এক হাজার ৪০ জন মানুষ।নিহতদের মধ্যে ৭৯০ জনই মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হন এবং ২২৩ জনের কোনো খোঁজই মেলেনি। ২০০৭ সালের ১১ অক্টোবর রাজস্থানের আজমিরে ঐতিহাসিক স্থান মইনুদ্দিন চিশতির দরগায় বোমা হামলা চালায় আরএসএস। এ ঘটনায় সুনীল যোশী ও ভবেশ প্যাটেল নামে দুই সন্ত্রাসবাদী এখনো কারাগারে রয়েছেন। ২০০৭ সালে হামলা চালানো হয় সমঝোতা এক্সপ্রেসে। এ দুটি মামলায়ই অভিযুক্ত ছিলেন প্রাক্তন আরএসএস সদস্য স্বামী অসীমানন্দ। ২০০৬ সালে ঘটে যাওয়া নাসিকের কাছে মালেগাঁও সিরিয়াল বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় ‘অভিনব ভারত’ নামের একটি উগ্র–হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। ওই ঘটনায় যুক্ত সন্ত্রাসবাদী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর বর্তমানে মোদি সরকারের একজন গুরুত্মপূর্ণ সাংসদ! ২০০৮ সালে কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালোরে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, চার্চ ও তাদের পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা চালায় বজরঙ দল ও শ্রীরাম সেনা নামের দুটি সংগঠন। ২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পশ্চিম ভারতের গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে বোমা বিস্ফোরণে মারা যান ১০ জন মানুষ। এ সময় পুলিশ আরও ১৭টি বোমা নিষ্ক্রিয় করে। বোমা বিস্ফোরণ হয় মালেগাঁও ও মোদাসা শহরে। ২০১৮ সালের ১৮ মে হায়দ্রাবাদের অদূরেই মক্ষা মসজিদে পাইপ বোমা বিস্ফোরণে ১৬ জন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে পরিকল্পিত সংখ্যালঘু হত্যা ও লুটপাট চালায় আরএসএস ও বজরঙ দলের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী বাহিনী। অন্তত ৫২ জন ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় দেশের স্বরাষ্ট্র দফতরের সরাসরি মদদ ছিল।

কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরাচারী–ফ্যাসিবাদী ধরনের শাসন
১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশভাগ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি ভারতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত করে। তৎকালীন মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি ও সামন্তশ্রেণীর স্বার্থকে সামনে রেখে ভারতে দেশ গঠনের নামে শুরু হয় দেশের বিভিন্ন জাতি–উপজাতি ও মেহনতি শ্রেণীর ওপর নিপীড়ন ও দমনের আরেক খেলা। একদিকে ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’, বিবিধের মাঝে মিলনের বুলি আউড়ে স্বাধীনতাকামী অঞ্চলগুলোকে ভারত রাষ্ট্রে বেঁধে ফেলা হয়। অন্যদিকে, এ সময় থেকেই কোথাও কম কোথাও বেশি মাত্রায় স্বৈরাচারী–ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করে ‘হিন্দি–হিন্দু–হিন্দুস্তান’ গঠনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। সরকারে থেকে কংগ্রেস শ্রমিক–কৃষকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামী জঙ্গি আন্দোলনকে বন্দুকের নলের সামনে গুড়িয়ে দিতে থাকে। এভাবে সর্বদাই কংগ্রেস মহান ভারতের স্বপ্ন ফেরি করে সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন শিবিরের লুণ্ঠনক্ষেত্র হিসেবে ভারতকে তুলে ধরে। জরুরি অবস্থাকালীন সময়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। হাজার হাজার সংগ্রামী প্রগতিশীল মানুষকে গ্রেফতার করা হয়, হত্যা করা হয়। সাতের দশকে কমিউনিস্ট বিপ্লবী আন্দোলনকে প্রকাশ্য গণহত্যার মাধ্যমে দমন করে কংগ্রেস দেশের মানুষকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। এমনকি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করার নামে গণআন্দোলন, জাতিসত্তার আন্দোলন ও বিপ্লবী আন্দোলনকে দমন করতে গড়ে তোলে আধা–সামরিক বাহিনী সিআরপিএফ। যা কোনো গণতান্ত্রিক কাঠামোয় থাকার কথা নয়।

১৯৮৪ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহে পৃথক খলিস্থানের দাবি তোলা শিখ–জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকারীদের স্বর্ণ মন্দিরে ঢুকে হত্যা করে ভারতীয় সেনা। এই ঘটনার পিছনে ছিল ইন্দিরা গান্ধীর প্রত্যক্ষ আদেশ। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিশোধ স্বরূপ দেহরক্ষীর গুলিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিহত হলে সারা পঞ্জাব ও দেশ জুড়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক শিখ নিধনযজ্ঞ। এই একতরফা হত্যাকাণ্ডে কংগ্রেস হিন্দুত্ববাদী শক্তিকেই ব্যবহার করেছিল। মাত্র কয়েকদিনে সারা দেশে সরকারি ভাষ্যমতে তিন হাজার ৩৫০ জন এবং বেসরকারি তথ্যমতে অন্তত ১০ হাজার শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষকে হত্যা করা হয়। এ সময় আরএসএসকেও ব্যবহার করেছিল কংগ্রেস নেতারা। শ্রীনিবাসপুরী থানায় ১৪ জন আরএসএস নেতার বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছিল। আরএসএস বলেছিল, “হিন্দুদের ন্যায়োচিত আক্রোশ, শিখরা মুখ বুজে মেনে নিন।”

ইন্দিরার নেতৃত্বে কংগ্রেসের এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দ্বারা উৎসাহিত হয়ে ১৯৮৬ সালে রাজিব গান্ধী রাম মন্দিরের ইস্যুটি ব্যবহার করে, হিন্দু ভোট ব্যাংক নিজের দখলে নিতে বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেন। বলাই বাহুল্য, এর মধ্য দিয়ে তিনি হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদীদের লক্ষ্য পূরণের সুযোগ করে দেন। ১৯৮৯ সালের ১০ নভেম্বর রাজিব গান্ধী সরকার রাম মন্দির স্থাপনের জন্য শিলান্যাসের অনুমতি মঞ্জুর করে। সে বছরই ধর্মীয় বিভাজনকে হাতিয়ার করে রামরাজ্য স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি অযোধ্যা থেকেই নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে কংগ্রেসও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির তাস নির্লজ্জভাবেই সময় সুযোগ অনুসারে খেলেছে।

এভাবে এই ক্ষমতা ধরে রাখতে কংগ্রেস, এক হাতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের এবং অন্য হাতে হিন্দুত্ববাদীদের নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করেছে। পাশাপাশি প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশীয় সামন্ত, সুদখোর মহাজন, দালাল বুর্জোয়া, মুৎসুদ্দি বৃহৎ পুঁজি এবং বিবিধ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সেবা করেছে। মুখে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বললেও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে উচ্চবর্ণীয়দের শাসন কায়েম রেখেছে। কার্যক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদীরাই ভারত রাষ্ট্রের ‘গুডবয়’ বলে প্রিভিলেজ পেয়েছে। ফলে মতাদর্শগতভাবে প্রত্যক্ষভাবে হিন্দু মৌলবাদের প্রচার না করলেও এক ধরনের হিন্দুপ্রধান স্বৈরাচারী ফ্যাসিজম তারাও এ দেশের মাটিতে অনুশীলন করেছে।

কাশ্মীরে গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্রমাগত বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকায়িত অঞ্চলে পরিণত করেছে কংগ্রেস। যা আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতিরই পরিচায়ক। গত বছর ৫ আগস্ট হিন্দুত্ববাদী বিজেপি যখন অনুচ্ছেদ ৩৭০ ও অনুচ্ছেদ ৩৫ বাতিল করে কাশ্মীরকে একটি সম্পূর্ণ পরাধীন অঞ্চলে পরিণত করছে, তখনও কার্যত মুখে কুলুপ এঁটেছিল কংগ্রেস। দেশের উত্তর–পূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলোতেও একই কায়দায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম রেখেছে কংগ্রেস ও বিজেপি সরকার। এমনকি দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জাতিসত্তার লড়াইগুলোকেও ভোটের অংকে বা বন্দুকের নলে সমাধান করতে চেয়েছে কংগ্রেস।

একুশ শতকের ভারতীয় ফ্যাসিবাদের মূল্যায়ন
ফ্যাসিবাদের শ্রেণী চরিত্র বোঝাতে গিয়ে জর্জি দিমিত্রভ বলেছেন, “ফ্যাসিজম হলো– লগ্নি পুঁজির (ফিন্যান্স ক্যাপিটাল) তরফের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী এবং সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী অংশের সন্ত্রাসবাদী একনায়কতন্ত্র।”

১৯৯১ সালের পর থেকেই গ্যাট চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মুদ্যা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও), বিশ্ব ব্যাংক প্রবর্তিত বিশ্বায়ন–নয়াউদারনীতিবাদ এ দেশের পঙ্গু অর্থনীতির ওপর প্রয়োগ করা শুরু করে কংগ্রেস। যার ফল হয়েছে মারাত্মক। ভারত রাষ্ট্র খুব দ্রুত এক অভুক্ত, কর্মহীন, অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের দেশে পরিণত হয়। দেশের এক বিরাট অঞ্চল জুড়ে অঘোষিত মহামারী চলছে। ২০০৮ সাল থেকে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে ভারতীয় অর্থনীতিও মন্দার কবলে পড়েছে। লগ্নি করা পুঁজি ব্যাংক ফিরে না পাওয়ায় পুঁজির ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়। স্বাভাবিকভাবেই এই শতকের শুরুতে জনগণ এক গভীর হতাশার মধ্যে পড়েছেন। ফলে এতদিন ধরে প্রচলিত নরম–গরম স্বৈরাচারী গণতন্ত্র বা পোশাক পরা ফ্যাসিবাদ দিয়ে জনগণকে বেঁধে রাখা যাচ্ছে না। তাই দেশি–বিদেশি লগ্নি পুঁজির স্বার্থে নগ্নভাবে ফ্যাসিবাদ কায়েম করে জনতার ওপর শোষণ চালাচ্ছে।

ভারতবর্ষের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো– বর্ণবাদী সামন্ত কাঠামোর ওপর পৈশাচিক সংকীর্ণ কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে পরিচালিত এক উগ্র–হিন্দুত্ববাদ। মনুস্মৃতি কথিত ব্রাহ্মণ্যবাদী অনুশাসন– যা আদিম গোষ্ঠী সমাজের দস্যুতাবৃত্তিরই নামান্তর– শ্রমিক, ঠিকা শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর, নিপীড়িত জাতি–উপজাতি ও সমাজের চিন্তাশীল অংশের ওপর বর্বর নির্যাতন চালানোর পদ্ধতি। সীমান্ত জুড়ে ভীতি প্রদর্শনের ও অন্যের দেশ দখলের রাজনীতি।

তবে এখনো পর্যন্ত ভারতে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির ব্যাপক গণভিত্তি নেই। আর বুর্জোয়া শিবিরের মধ্যেই এখনো অনৈক্য বেশ প্রকট। তাই আরএসএস–বিজেপি এখনো পার্লামেন্টকে অস্বীকার করে কিছু সিদ্ধান্ত নিলেও সংবিধান পরিবর্তন করে বিরোধী দলগুলিকে সসাসরি নিষিদ্ধ করার মতো কাজ তারা করছে না। তবে ভবিষ্যতেও করবে না, এমন কিছু ধরে নিলে এক ঐতিহাসিক ভুল হবে। তারা এখনই ট্রেড ইউনিয়ন ভেঙে দিচ্ছে না, বা দিতে পারছে না। উপরন্তু, বুর্জোয়া ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দলগুলোকে কিছু পরিমাণে আইনগত সুযোগ বজায় রাখতে দিচ্ছে। কিন্তু হিটলারের ইহুদি বিতাড়নের মতোই নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) কার্যকর করে হিন্দু–মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করে বিতাড়িত করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে। ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করে মানুষকে বন্দি করছে। এভাবে অধিকারহীন সস্তা মজুরে পরিণত করছে নিপীড়িত ভারতবাসীকেই।

ফ্যাসিবাদ ভারতবর্ষে ক্ষমতা দখল করতে পেরেছে এই কারণে যে, প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তি বেশ দুর্বল। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট বা সমাজ গণতন্ত্রী দলগুলো যে সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের অনুগত বুর্জোয়াদের সঙ্গে শ্রমিক ও কৃষকের সহযোগিতার সংশোধনবাদী লাইন নিয়ে চলছিল, তাতে ব্যাপক মেহনতি মানুষের সমর্থন তারা হারিয়েছে। গণবিরোধী বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড–সেজ) প্রকল্প, শ্রমিকবিরোধী আইন, কৃষককে নিঃস্বকারী কৃষিনীতি নয়াউদারনীতিক অর্থনীতির মডেল যখন কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদের প্ররোচনায় কার্যকর হচ্ছিল, তখন বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতাসীন সমাজ গণতন্ত্রীরাও জনগণের ওপর দমন–পীড়ন চালিয়েছিল।সিঙ্গুর–নন্দিগ্রামের ঘটনা মানুষ এতো সহজে ভুলে যাবে না।

আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো– ফ্যাসিবাদ শ্রমিকশ্রেণীকে ন্যায়সঙ্গত মজুরির, কৃষকের ঋণ মওকুফের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবক্ষেত্রে তারা শ্রমিককে কর্মচ্যুত করছে, কৃষককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিগত ৬ বছরে প্রায় ৭৫ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। ক্ষেতমজুর, দিনমজুররা একচেটিয়া পুঁজি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রযন্ত্রের পুরোপুরি দাসে পরিণত হয়েছেন। বেকার যুবকদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। সরকারি–বেসরকারি সমস্ত ক্ষেত্রেই তাদের নামমাত্র মজুরিতে বাধ্যতামূলক ক্রীতদাসের মতো শ্রম–শোষণ করা হচ্ছে। বাতিল করা হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর অর্জিত শ্রম আইন। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের শিক্ষা কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। শ্রমিকের বিমা তহবিল আজ আর সুরক্ষিত নয়। অফিস কর্মচারী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়িদের নিশ্চিত ‘আচ্ছে দিনের’ স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। এখন তারা বুঝতে পারছেন– এই আচ্ছে দিন আসলে একচেটিয়া পুঁজির– টাটা, বিড়লা, অম্বানি, আদানি, গোয়েঙ্কার। জনগণের জমানো ব্যাংক পুঁজির ওপর দাঁড়িয়ে যারা মুনাফাখোরী করছে, লুণ্ঠন চালাচ্ছে। কর্পোরেট পুঁজির অসহনীয় একনায়কত্ব কায়েম করা হয়েছে এবং দুর্নীতি ও কদাচারকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে।
জর্জি দিমিত্রভের ভাষায়, “ফ্যাসিবাদ জনসাধারণকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ, সব থেকে ভাড়াটিয়া মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তিদের গ্রাসে তুলে দেয়; কিন্তু জনসাধারণের দরবারে তারা হাজির হয় ‘স্বচ্ছ সরকার’ গড়ার দাবি নিয়ে।”

আমরা দেখতে পাচ্ছি– বিশ্বায়ন–পরবর্তী পরিস্থিতিতে ২০২০ সালে এসে সারা বিশ্বসহ আধা–উপনিবেশিক ভারত রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংকট অতি গভীরে। ভারতের ক্ষেত্রে এই সংকটের বোঝা পুরোপুরি মেহনতি মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে সাম্রাজ্যবাদের অনুগত মুৎসুদ্দি ধান্দাবাজ পুঁজিপতিরা। তারই গতি বাড়াতে নিপীড়িত, নির্যাতিত জাতি সমূহ এবং মেহনতি শ্রমজীবী ও দরিদ্র কৃষককে পায়ের তলায় রেখে তার রক্ত শুষতে ফ্যাসিবাদের আশ্রয় নিচ্ছে শাসকশ্রেণী। ব্যাংক থেকে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়নি শাসকশ্রেণী। সাম্রাজ্যবাদী শিবির চাইছে, নয়া–উপনিবেশিক শোষণ তীব্রতর করে ভারতের জল–জঙ্গল–জমি তথা খনিজ–বনজ সম্পদ ও ১৩০ কোটি মানুষের বাজার দখল করতে। দেশীয় কর্পোরেট হাউসগুলো তাদের এই কাজে শেয়ালি সহযোগিতা করছে। করোনাজনিত লকডাউন পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিবাদ আরও শক্ত শেকলে তামাম মেহনতি ভারতীয়কে বেঁধে ফেলতে উদ্ধত হয়েছে।

মুক্তির পথ মেহনতি জনসাধারণের যুক্তফ্রন্ট
এমন অবস্থায় যা করা যেতে পারে তা হলো– দেশি–বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী–পুঁজিবাদী লুণ্ঠন ও ফ্যাসিস্ট বর্বরতার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য ব্যাপক জনগণকে একত্রিত করা। নানা মতের শ্রমজীবী মানুষের সংগঠনের যুক্ত আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপকতম যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলা দরকার। সেই সঙ্গে দরকার শ্রমজীবী অংশের প্রতিটি মানুষের অধিকার ও সুবিধা রক্ষার জন্য ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তোলা। দেশি–বিদেশি কর্পোরেটদের লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে, বনবাসীদের অধিকার রক্ষায়, সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায়, দলিতদের অধিকার রক্ষায় এবং জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামগুলোর মধ্যে প্রকৃত ঐক্য গড়ে তোলা দরকার। কারণ ফ্যাসিবাদ তাদের সকলের উপরই আক্রমণ জারি রেখেছে। জর্জি দিমিত্রভ যেমনটা বলেছেন– “ফ্যাসিবাদ এক হিংস্র কিন্তু ক্ষণস্থায়ী শক্তি।” বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নতুন বিন্যাস ও ক্রমবর্ধমান বৈরি দ্বন্দ্ব, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাঠামোগত সংকট, আধা–উপনিবেশে বিভিন্ন নিপীড়িত জাতির অস্তিত্ব এবং সংকুচিত বাজার, যার ফলে শ্রেণী–দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধি খুব স্বাভাবিক। আর তাই বলা যায়, ফ্যাসিবাদের সাফল্যই শাসক বর্গের প্রতি জনসাধারণের মনে তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভের সঞ্চার করছে, করবে। এই অবস্থায় ফ্যাসিস্টরা ভয়ানক দমন–নিপীড়ন চালাবে, যা জনগণকে গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী চিন্তা চেতনায় দীক্ষিত হতে ইন্ধন হিসেবে কাজ করবে। তাছাড়া জনগণের সামনে কোনো রাস্তাই আজ আর খোলা নেই। ইতিহাসের শিক্ষাও এটাই– শ্রমিক–কৃষক–ক্ষেতমজুর–কর্মচারী–যুবক–শিক্ষার্থী তথা আপামর মেহনতি জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবী–সংগ্রামী ফ্রন্টই হিন্দুত্ববাদী চরম প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলে, ফ্যাসিবাদ এবং তার দোসর সাম্রাজ্যবাদকে কবর দেবে। লকডাউনে অসংগঠিত শ্রমিকের রক্তাক্ত পায়ে লং মার্চ অচিরেই পরিণত হবে বিপ্লবী লং মার্চে। হবেই।

লেখক: মার্ক্সবাদী লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট (পশ্চিমবঙ্গ)