হিটলার এবং তার ইহুদি বিদ্বেষ
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ১৭, ২০১৯
যদি অ্যাডলফ হিটলার ক্ষমতায় না গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতেন, শিক্ষার্থীরা অনেক লাভবান হতেন। মানুষকে নতুন চিন্তা করার, নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাবার বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি ছিলে হিটলারের। পরবর্তীকালের নিষ্ঠুর বর্ণবিদ্বেষী এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী মানুষটা তৎকালীন সমাজের বহু কিছু চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন, যা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। তিনি সাম্রাজ্যবাদকে ঘৃণা করতে গিয়ে কিছুটা ভুলভাবে ইহুদিদের ঘৃণা করতে বসলেন। কারণ অস্ট্রিয়ার ক্ষমতার সর্বত্র বসে ছিল ইহুদিরা। যখন বাইরের শক্তি হাবসবুর্গ অস্ট্রিয়ার ক্ষমতায় বসে অস্ট্রিয়াকে একটা স্লাভ প্রদেশে পরিণত করতে চাইলো, হিটলার তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। তিনি লিখেছেন, ভিয়েনা পরদেশীয়দের মধুচক্র ছিল, বিশেষ করে চেকদের। ভিয়েনাতে তখন কেউ জাতীয়তাবাদী হতে সাহস করতো না পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবার ভয়ে। তিনি লিখেছেন, ভিয়েনাই আমাকে রুঢ় বাস্তব শিক্ষা ও সত্যের সন্ধান দেয়। হিটলার হয়ে ওঠেন জাতীয়তাবাদী।
হিটলার লিখেছেন, প্রথমে আমি ইহুদিদের ঘৃণা করতাম না। বরং তাদের আমি শুধু একটি ভিন্ন ধর্মের লোক ভাবতাম। যেসকল পত্রিকাগুলি তখন ইহুদিদের বিরুদ্ধে লিখতো সে পত্রিকাগুলি আমাকে আকর্ষণ করতো না। কিন্তু বড় বড় গণমাধ্যমগুলি ছিল আবার ইহুদিদের হাতে। সেখানে নানারকম মিথ্যা প্রচার চলতো। নানা ধরনের মিথ্যা খবর প্রচার করা হতো। সংবাদপত্রের ভেতরে যতে বেশি ঢুকতে থাকি তত সংবাদপত্রের সততা সম্পর্কে শ্রদ্ধা হারাই। নিজেরই আশ্চর্য লাগে, কী করে বহুকাল ধরে সংবাদপত্রের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে এসেছি। সংবাদপত্রে সত্যের চেয়ে মিথ্যাই বেশি পরিবেশিত হয়। দেখতে পাই সেখানে লেখকরা হলো ইহুদি। ক্রমে ক্রমে সংবাদপত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে। ঘটনাগুলির সদুত্তর খুঁজতে গিয়ে বুঝতে পারি, সবকিছুই ইহুদিদের দ্বারা সংগঠিত। বুঝতে পারি, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, সংবাদ মাধ্যম সবকিছু ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে। বিদেশি শক্তির পরাধীন অস্ট্রিয়ার নাগরিক হিসেবে এই ছিলে হিটলারের উপলব্ধি।
হিটলারের এ বক্তব্য সম্পূর্ণ সত্য ছিলে না, আবার একেবারে মিথ্যাও ছিলে না। অস্ট্রিয়ার অর্থনীতিকে যারা নিয়ন্ত্রণ করতো, তার বড় একটা অংশ ছিলে ইহুদি বণিকরা। কিন্তু তার মানে এ নয়, সকল ইহুদিরা শোষণ চালাতো বা ইহুদি মাত্রই খারাপ ছিল। কিন্তু আমরা যেমন ভাবি পাকিস্তানি মাত্রই খারাপ, হিটলার ভাবতেন ইহুদি মাত্রই ক্ষমাহীন অপরাধী। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শকে ধারণ করে মার্কসবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল বহু ইহুদি। হিটলার ইহুদিদের ঘৃণা করতে গিয়ে মার্কসবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে চলে গেলেন। হিটলার লিখেছেন, “এই সময়ে আমি জাতির অস্তিত্বের পক্ষে দুটো বিপদ উপলব্ধি করতে পারি। একটা মার্কসবাদ আরেকটা হলো ইহুদি ধর্মমত।”
হিটলারের এই ইহুদিদের সম্পর্কে চরম ঘৃণার কারণ কিন্তু পত্রিকার প্রচার। হিটলারের মতো বিশ্লেষণী মানুষকে কী করে প্রচার মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে, ইহুদি বিরোধী পত্রিকাগুলি তার প্রমাণ। তিনি লিখেছেন, “বলা অত্যন্ত কষ্টকর, প্রায় অসম্ভব যে কখন `ইহুদি` শব্দটা আমার মনে বিশেষ এক চিন্তাধারার উদয় করেছিলে। আমি ঠিক স্মরণে আনতে পারি না।” তিনি মনে করেন, ধর্ম হিসেবে ইহুদি ধর্মকে অপছন্দ করতে শুরু করেন চোদ্দ পনেরো বছর বয়সে। কিন্তু এ ছাড়া ইহুদিদের সম্পর্কে আর তার কোনো বিরূপ ধারণা ছিলে না। লিনৎস শহরে ইহুদিদের সংখ্যা কম ছিলে, দেখতে তাদের ইউরোপের আর পাঁচজনের মতোই লাগতো। তিনি তখন তাদের জার্মান বলেই ভাবতেন। কারণ হলো মানুষ হিসেবে তাদের বাইরের চেহারায় অন্য কোনো পার্থক্য খুঁজে পাননি। ভিয়েনায় মানুষের সংখ্যা বিশ লক্ষ কিন্তু ইহুদি ছিলে মাত্র দু’লক্ষ। তিনি মন্তব্য করেন, “ইহুদিদের সম্পর্কে তখনো আমার ধারণা যে, ওরা অন্যধর্মী সুতরাং মানবতার খাতিরে অন্যধর্মের বলে তাদের আক্রমণ করার বিপক্ষে ছিলাম। ইহুদিদের বিরুদ্ধে যে পত্রিকাগুলি ভিয়েনাতে প্রচলিত ছিলে, ইহুদি বিরুদ্ধ এ পত্রিকাগুলি মোটেও প্রথম শ্রেণির ছিলে না। মনে করতাম, ইহুদি বিরোধী প্রচার হচ্ছে ঈর্ষার ফল, যার মধ্যে সামান্য সৎ প্রচেষ্টা নেই। ওদের চড়া ইহুদি বিদ্বেষী সুর আমার সঙ্গে মিলতো না। কিন্তু পত্রিকার কথাগুলি আমাকে ভাবিয়ে তুলতো।”
হিটলার জীবনের শুরুতে ইহুদি বিদ্বেষী ছিলেন না বরং তাদের পক্ষেই ছিলেন। কিন্তু পত্রিকাগুলির ইহুদি বিদ্বেষ প্রচার হিটলারের উপর খুব ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলতে থাকে। সবক্ষেত্রেই তাই ঘটে। সবসময় ক্ষমতাবানদের প্রচারই মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ায়। সংবাদপত্রের বারবার প্রচারে হিটলারের মনে ইহুদিরা প্রথম একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ তারপর একদিন হিটলার ইহুদি বিদ্বেষী পত্রিকা কিনে ফেলেন। কিন্তু তা সেভাবে তার উপর প্রভাব ফেলতে পারে না, হিটলার তার পুরানো চিন্তায় ফিরে যান। তিনি ভাবেন, বেশির ভাগ মানুষ ইহুদি বিদ্বেষী বলে এরকম প্রচার চলছে। হিটলার তাহলে পরে ভয়াবহ, ইহুদি বিদ্বেষী হলেন কী করে? সকলে যেভাবে হয়, জাতীয়তাবাদী হতে গিয়ে। হিটলার যখন বিদেশি শক্তির হাত থেকে নিজের জাতির মুক্তি চাইলেন, তিনি তখন জাতীয়তাবাদী হতে গিয়ে ইহুদি বিদ্বেষী হয়ে গেলেন। কারণ অস্ট্রিয়ার অর্থনীতি তখন ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে বা সঠিকভাবে বলতে গেলে যারা অস্ট্রিয়ার অর্থনীতি, রাজনীতি ও গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তাদের বেশিরভাগ ছিলেন ইহুদি। ফলে ইতিহাসের এটা এক দ্বান্দ্বিক পরিণতি, বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে জাতীয়তাবাদীরা সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে। নিজ জাতির পক্ষে সংগ্রাম করতে গিয়ে শাসকদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নগুলিই সামনে চলে আসে। মানুষের পরিচয় তখন আর মানুষ থাকে না। মানুষরা হয়ে যায় জার্মান, ইহুদি, বাঙালি, বিহারী, হিন্দু, মুসলমান, পাকিস্তানী, ভারতীয়। ভিন্ন সম্প্রদায়কে ঘৃণা আর হত্যা করার সনদপত্র দিয়ে দেয় তা। মানুষের যে আর একটা পরিচয় মানুষ, সেটা ভুলতে বসে সবাই। ভিন্নভাবে অন্যের দেশ দখলের সময় এখন মানুষকে যে উপাধিটা দেয়া হয়, তাহলো ‘সন্ত্রাসী’, ‘জঙ্গি’ ইত্যাদি। দখলদারদের নিজের জনগণকে এটা বোঝাতে হয়, বিশ্বাস করাতে হয়, যে দেশ বা ভূখণ্ড দখল করবে তার মানুষগুলি সম্পর্কে। দখলদারদের গণমাধ্যম সে কাজটা করে সুন্দরভাবে। কখনো ‘আক্রমণকারী’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ এ সকল শব্দ ব্যবহার করা হয় ব্যাপারটাকে আরো মদদ জোগাতে। মূল কাজটা হলো, ব্যাপক প্রচার দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা। নিজের দাবিগুলিকে হালাল করে তোলা।