হাসান মোস্তাফিজের গল্প ‘হারামজাদার চোখ’
প্রকাশিত : অক্টোবর ২০, ২০১৯
যশোরের এক অজানা মফস্বল। মফস্বলটার একটা বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে কিছু জঙ্গল আছে। জঙ্গলে মাঝে মাঝে পিকনিকের আসর বসে। সেই জঙ্গলেই একদিন এক পিকনিক পার্টি একটা লাশ খুঁজে পেল। ২০-২৫ বছর বয়সের যুবকের লাশ। যুবককে যে হত্যা করা হয়েছে, তা দেখেই বোঝা যায়। বুকের মাঝখানে এক বিরাট ক্ষত। সেখান থেকে চুইয়ে পড়া রক্ত কিছু কাঁঠাল গাছের গোড়ায় জমে আছে। লাশটার সবচেয়ে কুৎসিত ব্যাপার হলো, অক্ষিকোটর থেকে চোখ তুলে পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। মুখটায় কেউ যেন ছুরি দিয়ে কুপিয়েছে।
লাশ আবিষ্কার হবার সাথে সাথেই মফস্বলটা কেমন পরিচিত হতে শুরু করলো। পুলিশও নড়ে উঠেছে। তারা এসে দ্রুত লোকজন সরিয়ে ফেললো। এক রোগা অসুস্থ অফিসার সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিলো। আশপাশে সাংবাদিকদের অভাব দেখা গেল না। এই লাশ আবিষ্কারের মাধ্যমে লোকজনের আরেক সুপ্ত প্রতিভা ফুটে উঠতে দেখা গেল। সেটা হলো, গল্প বলার প্রতিভা। সবাই যেন আস্তে আস্তে মিনি গল্পকার হয়ে গেল। যে যার মতো ইন্টারভিউ দিচ্ছে। পিকনিক পার্টি বললো, তারা শেয়াল দেখে লাশ শনাক্ত করেছে।
এক ফকির বললো, সে ভিক্ষার টাকা গোনার সময় দুই টাকার নোটে হঠাৎ করে লাশটার ছবি ভেসে উঠতে দেখতে পায়। তবে সব ক্রেডিট পেল মফস্বলের কিছু রাজনৈতিক কর্মী। কারণ যে খুন হয়েছে সে মফস্বলের কেউ না। মফস্বলের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এসব কর্মীর অবদান অনেক। ঠিক হলো, আগামী শুক্রবার জুম্মার পর আনন্দ মিছিল বের হবে। অভ্যর্থনা দেয়া হবে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতিকে।
ঢাকার পুলিশের ফরেনসিক দল যেদিন লাশটির ডিএনএ স্যাম্পল নিয়ে চলে গেল সেদিনই যেন মফস্বলটার সব পাবলিসিটি আবার ডুব মারলো। ওদিকে লাশটায় পচন ধরা শুরু হয়েছে। কিন্তু কেউই এর দাফন করতে রাজি না। কে জানে, হয়তো এক মাদক পাচারকারীর লাশ। টাকা নিয়ে বা ড্রাগ নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় খুন হয়েছে। লাশটার চোখগুলো তখনো পাশে পড়ে ছিল। একদিন দেখা গেল, দুটি চোখের মধ্যে একটি নেই। আশপাশে খুঁজে তারপর দেখা গেল, এক বিড়াল মজা করে সেই চোখটা খাচ্ছে। যে এটা খুঁজে বের করলো, সে আর এসব নিয়ে কিছু করলো না। করে কী হবে, বিড়ালেরও তো ক্ষিধা লাগে।
তবে এভাবে একটা লাশ পড়ে থাকা এক কিশোরের কেন জানি সহ্য হলো না। হোক যার লাশ, সেই যুবক একজন খারাপ লোক, কিন্তু এখন তো সে মৃত। তাকে দাফন করা একটা দায়িত্ব। সেই কিশোর থানায় যেতেই সেখানকার ওসি তার সাথে যথেষ্ট খারাপ ব্যবহার করলো। এক কলেজ পড়ুয়া কিশোর পড়ালেখা বাদ দিয়ে এক মার্ডার কেসের লাশের দাফনের দায়িত্ব নিয়ে পড়েছে। শেষে কিশোরটা যখন বললো যে, পুলিশই তাহলে দায়িত্ব নিক দাফন কাজের, তখন ওসি পুড়ে যাওয়া জিহ্বার মতো আঁতকে উঠলো। বাংলাদেশে প্রতিদিন মোট ৭০ জন মানুষ খুন হয়। এইসব মানুষের দাফন কাজ করার দায়িত্ব পুলিশের নয়।
শেষে সেই কিশোরটির বন্ধুরা ঠিক করলো, চাঁদা তুলে সব জোগাড় করবে। কিন্তু অনেক কষ্ট করে টাকা জোগাড় করেও শেষে সেই টাকায় ইমাম পাওয়া গেল না। ইমামের রেট অনেক। তাছাড়া লাশটার চোখ দেখে এক মসজিদের ইমাম বললো, ওই চোখগুলো হলো হারামজাদার চোখ। হারামজাদাদের জানাজা আমি পড়াই না। ওদিকে লাশ দ্রুত পচে যাচ্ছে। লাশের আশপাশে নেড়ি কুকুরের ডাক শোনা যায়। কিশোরটা মনে মনে কষ্ট পায় যে, সে লাশটা তাড়াতাড়ি দাফন করতে পারছে না।
যেদিন লাশটার একটা হাত চুরি হয়ে গেল সেদিনই ফরেনসিক টিম ডিএনএ রিপোর্ট দিলো। লাশটা কোনো মাদক পাচারকারী কিংবা খুনীর নয়। লাশটা ঢাকার এক বিখ্যাত ভার্সিটির এক ছাত্রের। সেই ছাত্র হাভার্ডে পড়ার জন্য স্কলারশিপ পেয়েছে। যে হত্যা করেছে, ধরা পড়েছে। হত্যা করার কারণ, ছেলেটা এক শিক্ষকের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলো। সেটা ধামাচাপা দিতেই এই কাজ। এখন লাশটা দাফন করার জন্য লোকের অভাব হচ্ছে না। সবাই হুট করে দায়িত্ববান হয়ে উঠলো। লাশটার বাবা-মাকে দ্রুত খুঁজে আনা হলো। থানার ওসিও এখন দাফন কাজে অংশ নিতে চায়। ইমামেরও এখন অভাব হলো না। কেউই টাকা নেবে না, বিনামূল্যে জানাজা পড়াবে। কিন্তু মফস্বলের রাজনৈতিক পার্টির সভাপতি ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি নিজে জানাযা পড়াবেন। এককালে তিনি মাদরাসার ছাত্র ছিলেন।
কিন্তু কিশোরটার সেদিকে কোনো আগ্রহই ছিল না। সে জঙ্গলে সেই সকাল থেকে ঘুরছে। কারণ লাশটার দ্বিতীয় চোখটাও হারিয়ে গেছে।