হার্ট অ্যাটাক
প্রসূন দাশগুপ্তপ্রকাশিত : আগস্ট ০৮, ২০১৮
বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন সীতানাথ, অথচ আজ এই পঞ্চাশোর্ধ্ব সীতানাথ মল্লিকের ভাগ্যে কোনো সীতা, গীতা বা অন্য যে কোনো নারীর নাথ হয়ে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এজন্য অবশ্য তিনিই প্রধানত দায়ী। কারণ বিয়ের নাম শুনলেই তার মনে এক অজানা আতঙ্ক দানা বেঁধে ওঠে। এর প্রধান কারণ, তিনি মনে করেন, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে পরে তার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, উনার ধারণা হয়েছিল যে, তিনি যে অর্থ উপার্জন করেন তাতে করে কোনো সংসার চলা সত্যিই দুঃসাধ্য। যদিও তার অনেক বন্ধুরাই তার চেয়ে কম রোজগার করেও সংসার করছিলেন এবং সুন্দরভাবেই তাদের সংসার পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু সীতানাথ বাবুর সেই সাহস আগেও ছিল না, আজও নেই। এই দেখুন, এতক্ষণ এত কথা বললাম, অথচ উনি অর্থ উপার্জনের জন্য কি পেশায় নিযুক্ত সেটাই বলা হলো না। সীতানাথ বাবু পেশায় একজন জীবন বীমা কোম্পানির দালাল। আসলে এই বৃত্তিতে আসাটা অনেকটা হঠাৎই হয়েছিল।
সে বহু বছর আগের কথা। যখন সীতানাথ বাবু দশম শ্রেণির ছাত্র সেই সময় তার বাবা হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার সময় না দিয়েই মারা গেলেন। সংসারে তখন তার মাকে বাদ দিয়ে আরও তিনজন সদস্য বর্তমান। সীতানাথের এক বছরের বড় দিদি পারুল, তার বিধবা পিসি মা ননীবালা আর তার ছয় বছরের পুত্র সন্তান সন্টু। একপ্রকার বাধ্য হয়েই পাশের বাড়ির রমাকান্ত বাবুর হাত ধরে এই লাইনে প্রবেশ করলেন সীতানাথ। সাথে অবশ্য নাইট স্কুলে পড়াশোনাটাও চালিয়ে যেতে লাগলেন। বলে রাখা ভালো, তার বাবা বিশেষ কিছুই রেখে যেতে পারেননি তাদের জন্য। তিনি ছিলেন একজন সৎ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। রোজকার স্কুলের পরিশ্রমের পর তিনি সন্ধ্যেবেলাটা কোচিং ক্লাসেই কাটিয়ে দিতেন, যাতে করে সংসারে দু’পয়সা বাড়তি আয় করতে পারেন। এত করেও যে টাকা তিনি রোজগার করতেন তার প্রায় সবটাই চলে যেত সংসারের জোয়াল টানতে। তাই তার না ছিল কিছু সেভিংস আর না ছিল কোনো বীমা। তাই বাবা মারা যাবার পর সেই কষ্টের দিন গুলোতে রোজগার বলতে ছিল পিসীমার স্বামীর অফিসের সামান্য পেনশন। কারণ পিসেমশাই ছিলেন পোস্ট অফিসের পিয়ন। মায়ের সেলাইয়ের পয়সা আর তার নিজের রোজগার। এভাবেই চলছিল দিনগুলো।
এরপর দু’বছর কেটে গেল কোন দিক দিয়ে, সীতানাথ নিজেও তা জানেন না। ততদিনে তিনি নিজের পেশায় বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। রোজগারও খারাপ হচ্ছিল না। এরই মধ্যে দিদির বিয়ের চেষ্টা শুরু করে দিয়েছেন তার মা ও পিসিমা।
একদিন কাজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎ দেখতে পেলেন, তাদের বাড়ির দরজার সামনে বেশ ভিড়। সীতানাথ ভিড় ঠেলে ঘরের ভিতর ঢুকলেন। দেখতে পেলেন, তার মা ও পিসিমা পাগলের মতো কাঁদছেন আর প্রলাপ বকছেন। দেয়ালের এক পাশে ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সন্টু। ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ সামনের ঘর পেরিয়ে ভিতরের প্যাসেজটাতে ছুটে গেলেন। ঘরের চৌকাঠ পেরোনোর আগেই দেখতে পেলেন দিদিকে। সকালের সেই শাড়িটা তখনও তার গায়ে রয়েছে। কিন্তু সীতানাথ বুঝতে পারলেন না, কেন তার দিদি ওরকমভাবে চিৎ হয়ে প্যাসেজটাতে শুয়ে রয়েছেন। কাছে গিয়ে দিদি বলে অনেকবার ডাকার পরেও কোনো সাড়া মিলল না। পাড়ার ক্লাবের বয়োজ্যেষ্ঠ অসিত বাবু তার কাছে এগিয়ে এসে পেছন থেকে দুই কাঁধে হাত দিয়ে আস্তে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন যে, পারুল অর্থাৎ কিনা তার দিদি আর বেঁচে নেই। সীতানাথ আস্তে আস্তে ঘুরে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলেন শুধু। এরপর আশপাশের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলেন হঠাৎই হার্ট অ্যাটাক করে মৃত্যু হয়েছে পারুলের। সীতানাথ তার সামনে রাখা চেয়ারটাতে ধপ্ করে বসে পড়লেন। আর সকলের উদ্দেশে বারবার বলতে থাকলেন, এটা কী করে সম্ভব! তার দিদির তো কখনো কোনো হৃদয়জনিত সমস্যা ছিল না। যাই হোক, ডাক্তার ঠিক সময় এসে ডেথ্ সার্টিফিকেট দিয়ে গেলেন আর কারণ দর্শালেন, সেই হার্ট অ্যাটাক।
এরই মধ্যে আরও একটা বছর দেখতে দেখতে কেটে গেল। সীতানাথ লক্ষ্য করলেন, দিদির মৃত্যুকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি মা। এই মানসিক কষ্টের কারণে তার মায়ের ইদানীং খাওয়া-দাওয়াও কমে গেছে অনেকটা। সেই কারণেই তিনি দিন-দিন দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলেন। ডাক্তার এসে বললেন, শরীরে পুষ্টির অভাব। তাই নিয়ম করে ইনজেকশন নিতে হবে। সাথে ভালোমন্দ খাওয়া দাওয়া করতে হবে আর পারলে চেঞ্জের নিয়ে গেলে আরো ভাল ফল দেবে। সীতানাথ ডাক্তারের কথা অনুযায়ী সব ব্যবস্থা করে ফেললেন এবং শেষপর্যন্ত মাকেও রাজি করালেন চেঞ্জে যাবার জন্য।
একদিন যথাসময়ে মা ও ছেলে দেওঘর যাওয়ার ট্রেনে উঠে বসলেন। কলকাতার বাড়িতে রয়ে গেলেন শুধু পিসিমা আর তার ছেলে। যদিও পিসিমার প্রবল ইচ্ছা ছিল তাদের সাথে বেড়াতে যাওয়ার, কিন্তু উপায় ছিল না। কারণ তখন সবেমাত্র সন্টুর ফাইনাল এক্সাম শুরু হয়েছে। দেওঘরে প্রথম তিনদিন নির্বিঘ্নেই কাটলো। চতুর্থ দিন তাদের দুজনের দুপুরের খাওয়ার পর সীতানাথের মা ক্লান্ত বোধ করায় হোটেলের বারান্দা থেকে উঠে এসে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ যেতেই সীতানাথ বাবুর মা শরীরে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। তিনি অস্ফুটে সীতানাথকে ডেকে বললেন যে, তার বুকে হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যথা করছে। সীতানাথ সঙ্গে সঙ্গে এক গ্লাস জল নিয়ে মাকে সাবধানে উঠে বসিয়ে অল্প অল্প করে খাওয়ালেন। এরপর তাকে আবার শুইয়ে দিয়ে উদভ্রান্তের মতো ডাক্তারের খোঁজে ছুটলেন। মিনিট পনের পর হোটেলের ম্যানেজারের সাথে একজন ডাক্তারকে ধরে এনে হোটেলের ঘরে ঢুকলেন। সীতানাথ এবার মাকে ডাকলেন আস্তে করে, মা, দেখো ডাক্তারবাবু এসেছেন। কিন্তু তার মা কোনো সাড়া দিলেন না। ডাক্তার তার মাকে পরীক্ষা করে জানালেন, তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন। সীতানাথ ডুকরে কেঁদে উঠলেন। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন বিছানার সামনে আর মাথাটা বিছানায় ঠেকিয়ে কাঁদতে থাকলেন অঝোরে। হোটেলের ম্যানেজার তখন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। এরই মধ্যে ডাক্তার লিখে ফেললেন, ডেথ সার্টিফিকেট। মৃত্যুর কারণ দর্শালেন সেই হার্ট অ্যাটাক। এরপর সীতানাথ মায়ের দেহ দেওঘরে পুড়িয়ে কাছা নিয়ে ফিরে এলেন কলকাতায়।
এরপর প্রায় দেড় বছর কেটে গেছে। সন্টু এখন দশ বছরের বালক এবং ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। পিসিমারও তখন বয়স প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। আসলে পিসিমার কপাল থেকে বাঁজা নামটা ঘুচতে সে প্রায় বেশ কয়েকটা বছর লেগেছিল আর তাই তার নিজের সন্তানের সাথে বয়সের পার্থক্যটা একটু বেশিই। পিসিমা প্রায় রোজই সীতানাথকে একটা বিয়ে করে ঘরে বউ নিয়ে আসার কথা বলেন। কিন্তু সীতানাথের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে প্রতিদিনই তার পিসিমার এই প্রস্তাব কায়দা করে এড়িয়ে যান। এরই মধ্যে পিসিমার মাথার যন্ত্রণাটা দিন দিন বেড়েই চলেছিল। ডাক্তার এটাকে সাইনাসের সমস্যা বললেন। অগত্যা পিসিকে অধিকাংশ দিনই পেইনকিলার খেয়ে এ ব্যথার থেকে মুক্তি পেতে হতো।
এরকমই এক সময় এক রবিবার সীতানাথ বাড়িতে রয়েছেন, যা কিনা উনি সচরাচর থাকেন না। তিনি নিজের ঘরে বসে মন দিয়ে একটা উপন্যাস পড়ছিলেন। ঠিক এমন সময় তার পিসিমা তার ঘরে এসে বললেন, তার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা করছে আর তার কেনা সবকটা পেইনকিলারই শেষ হয়ে গেছে। সীতানাথ বই থেকে চোখ সরিয়ে পিসিমার দিকে তাকালেন এবং বুঝলেন, পিসিমা সত্যিই বড় কষ্ট পাচ্ছেন। অগত্যা গায়ে জামা গলিয়ে ওষুধের দোকানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। হঠাৎ কী মনে হওয়ায় বিছানার পাশে রাখা টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং ড্রয়ারটা টেনে একটা পেইন কিলারের স্ট্রিপ বার করে পিসির হাতে দিলেন। আর পিসিকে এও বললেন যে, এই ওষুধটা তিনি কিছুদিন আগেই কিনেছিলেন তার নিজের জন্য। ওষুধটা একটু কড়া বলে ফল খুব শিগগিরই পাবেন। পিসিমা তার হাত থেকে ওষুধটা নিয়ে তার নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। দুপুরবেলা পিসিমা আর খেতে এলেন না। কারণ তিনি তখন ওষুধ খেয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সীতানাথ ও তার ভাই সন্টু তাই আর তাকে বিরক্ত না করে নিজেরাই দুপুরের খাবার খেয়ে নিলেন। এরপর সীতানাথ যথারীতি তার ঘরের বিছানার উপর শুয়ে উপন্যাস পড়ায় মন দিলেন। আর সন্টু কিছুক্ষণ পরেই বাড়ির পাশের মাঠটায় বন্ধুদের সাথে খেলতে চলে গেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল আর সন্টু ও মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে এলো। একটু পর সন্টু সীতা রামের ঘরে এসে বলল, দেখো না দাদাভাই, মা ঘুম থেকে উঠছে না কিছুতেই। কতবার ডাকছি। সীতানাথ বললেন, আরে পিসির শরীরটা ভালো নেই। তাই বোধহয় ঘুমোচ্ছে। তুই হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বস। আমি না হয় তোর জন্য জলখাবার এনে দিচ্ছি। এই শুনে সন্টু বাধ্য ছেলের মতো আবার ভেতরের ঘরে চলে গেল।
এরপর রাত তখন ন’টা হবে। সীতানাথ সবেমাত্র উপন্যাসটা পড়া শেষ করেছেন। ঘর থেকে বেরিয়ে সীতানাথ পিসির ঘরে ঢুকলেন আর দেখলেন খাটের একপাশে সন্টু তার পড়া মুখস্ত করে চলেছে আর একপাশে পিসি তখনো ঘুমিয়ে আছেন। সীতানাথ পিসিকে ডাকতে লাগলেন। অনেক ডাকাডাকির পরও যখন দেখলেন পিসিমা উঠছেন না, তখন সীতানাথ পিসির কপালে হাত রাখলেন। চমকে উঠলেন সীতানাথ। পিসির গা তখন বরফের মতো ঠাণ্ডা। তৎক্ষণাৎ তিনি সন্টুকে বাড়িতে রেখে ডাক্তার ডাকতে ছুটলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাড়ার ডাক্তার হরিপদকে সাথে নিয়ে বাড়িতে এসে পৌঁছলেন। হরিপদ ডাক্তার পিসিকে পরীক্ষা করে মৃত বলে ঘোষণা করলেন এবং মৃত্যুর কারণ হিসেবে ঘুমের মধ্যে আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক বলে দর্শালেন।
এরপর বহু বছর কেটে গেছে। সন্টু এখন পূর্ণবয়স্ক এক যুবক। সে আর এক মাসের মধ্যেই ডাক্তার হয়ে চেন্নাই থেকে কলকাতায় ফিরবে। এদিকে সীতানাথ ও কলকাতায় তাদের পৈত্রিক বাড়িটা এক প্রোমোটারের সাহায্যে ভেঙে ফ্ল্যাট বাড়ি করে নিয়েছেন। আর প্রোমোটারের কাছ থেকে তিনটি ফ্ল্যাটও পেয়েছেন। এরমধ্যে দুটো ফ্ল্যাট ভাড়ায় দিয়েছেন, আরেকটিতে তিনি নিজেই বসবাস করছেন। এই ভাড়ার টাকা আর জীবন বীমার প্রিমিয়ামের টাকায় তার এখন দিব্যি চলে যায়। আজকাল আর তেমন বাড়ির বাইরে যান না তিনি। নেহাত দরকার না পড়লে বাড়িতেই থাকেন। সাথি থাকে বিশ্বস্ত চাকর সদাশিব। তারও বয়স প্রায় পঞ্চান্ন তো হবেই।
সীতানাথ এখন এক নতুন নেশায় আসক্ত হয়েছেন। তার বহু বছরের বন্ধু, তাদের গলির ঠিক অপরপারে রায়দের বাড়ির বড় ছেলে অনাদি বাবুর সাথে দাবা খেলা। এই খেলায় এখন তার আর পাঁচটা নিত্যকাজেরই অঙ্গ। আর সেই জন্যেই তিনি রোজ বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনাদি বাবুর বৈঠকখানায় হাজিরা দিতে যান। দুই মধ্যবয়স্ক বন্ধুর মধ্যে খেলা চলে প্রায় তিন-চার ঘণ্টা। আর এই খেলার মাঝেই কত পুরোনো স্মৃতিচারণ হয় তাদের মধ্যে। রায় বাবু যদিও বিবাহিত এবং তার তুই উপযুক্ত ছেলে এখন তাদের পারিবারিক ব্যবসা সিকিউরিটি গার্ড সাপ্লাইয়ের কাজে যুক্ত। অনাদি বাবু নিজে ছিলেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্তা। তবে সদ্য শারীরিক কারণে ভি. আর. এস. নিয়েছেন। সীতানাথ ও অনাদি সেই ছোট্ট বেলার বন্ধু। অনাদিরা বনেদি বড়লোক হওয়া সত্ত্বেও তাদের বন্ধুত্বে এই অর্থনৈতিক অসাম্য কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এবং তাদের পরিবার থেকেও কোনোরকম বাধা দান করা হয়নি। আসলে তখনকার সমাজ আজকের এই অন্তঃসারশূন্য সমাজে পরিণত হয়নি। তখনো বন্ধুত্বের বিচার পরিবার বা ব্যক্তি বিশেষের সামাজিক স্বীকৃতির উপর বিচার করা হতো না।
এরকমই একদিন বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় সীতারাম আর অনাদি দাবা খেলছেন। সেদিন অবশ্য বাড়ি ফাঁকা। অনাদির স্ত্রী গেছেন বাপের বাড়িতে আর ছেলেরা তখনো অফিসে। থাকবার মধ্যে বাসু, যে কীনা অনাদির বাড়ির ফাইফরমাশ খাটে সেদিনই গেছে দেশে তার মায়ের কাছে। আর বছর পনেরোর কাজের মেয়ে শম্পা যে কোথায় গেছে এত, ডেকেও সারা মিলল না তার। আসলে এই সময়টা অনাদির বাধ্যতামূলকভাবে এক কাপ চায়ের প্রয়োজন হয়। আর সেই জন্যই শম্পার খোঁজ পড়েছে। এরই মধ্যে খেলা বেশ জমে উঠেছে। অনাদি তার ঘোড়াকে আড়াই চাল চেলে হঠাৎই প্রশ্ন করলেন সীতারামকে, আচ্ছা সীতু, তোর বাবা, মা, দিদি আর পিসিমা এরা সবাই একই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল, কীরকম আশ্চর্য না? সীতানাথ তার বোড়ের চালটা এগুতে গিয়ে খানিকটা থতমত খেলেন। তারপর সামলে নিয়ে দু`ঘরের চালটা দিয়ে শুধু ‘হুম’ বললেন। অনাদি তখন আড়াআড়িভাবে তিন ঘর নৌকার চালটা দিতে দিতে আরো বললেন, এসব মৃত্যুগুলোই খুব কম সময়ই ঘটলো। সীতানাথের কপালে তখন বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। তিনি একগাল হেসে তার এগিয়ে রাখা ঘোড়াকে আড়াই চাল পিছনে নিয়ে এলেন। আর মুখে বললেন, হ্যাঁরে সবই নিয়তি। অনাদি বাবু তখন তার ডান হাতের তিনটে আঙুলের সাহায্যে তার মন্ত্রীকে তুলে মোক্ষম চালটা দিয়ে বললেন, আরে সীতানাথ কিস্তি সামলা এবার। আসলে কী জানিস সীতু, আমার মনে হয়, আর মনে হয়ই বা বলব কেন, আমি নিশ্চিত যে, এসব মৃত্যু ওয়াজ্ অল কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারস্। সীতানাথ যেন একটু চমকে উঠলেন আর তৎক্ষণাৎই নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তার মানে? অনাদি বললেন, মানে আর কিছু নয় সীতু। এদের প্রত্যেককে ঠাণ্ডা মাথায় প্ল্যান করে খুন করা হয়েছে। সীতানাথ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু খুনের মোটিভ? এর জবাবে অনাদি শুধু বললেন, আছে-আছে। আর ঠিক সময়েই তা প্রকাশ পাবে। সীতানাথ ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে অনাদির দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি? এরই মধ্যে শম্পা এসে চা দিয়ে গেছে আর সে যে পাশের মুদিখানা থেকে চিনি কিনতে গিয়ে বৃষ্টিতে আটকে গেছিলো সেটাও জানিয়ে গেছে। অনাদি সীতানাথের দিকে চেয়ে বলে উঠল, আরে আগে তোর চাটা শেষ কর, তারপর বলছি। নিমেষের মধ্যে সীতানাথ চায়ের পেয়ালা শেষ করলো আর তারপর কাপটা নামিয়ে রেখে অনাদির দিকে প্রশ্নসূচক ভঙ্গিতে চেয়ে থাকল। অনাদি চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলে রেখে তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের বাক্সটা বার করে তার থেকে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে মুখ থেকে মুখে একটা তৃপ্তির ধোঁয়া ছাড়লেন। তৃপ্তিটা তার আজকে একটু বেশিই। এর কারণ বাড়িতে আজ স্ত্রী নেই তাই ধূমপানে বাধা দেয়ারও কেউ নেই। এবার তিনি তীক্ষ্ণ অথচ স্থির দৃষ্টিতে সীতানাথের দিকে তাকালেন সোজাসুজি। এই দৃষ্টির সামনে অনেক দাগি আসামিরও প্রাণ খাঁচা থেকে উড়ে যেত এক সময়। তিনি সেই দৃষ্টিতে সীতানাথের দিকে তাকিয়ে বলে চললেন, তোর দিদির আতঙ্ক ছিল আরশোলা। আরশোলা দেখলেই পারুলদি আতঙ্কিত হয়ে উঠত। একবার মনে পড়ে, ছোটবেলায় আরশোলা গায়ে বসতেই দিদি ভয়ের চোটে অজ্ঞান হয়ে যায়। সেই জন্য খুনি তার জ্যামিতির বাক্সে বেশ কয়েকটা জ্যান্ত আরশোলা পুরে রাখে। আর পারুলদি সেদিন বাক্সটা খুলতেই আরশোলার বেরিয়ে আসে তৎক্ষণাৎ। সেই আকস্মিকতা আর আতঙ্কে পারুলদি মারা যান। ডাক্তারের ডেথ্ সার্টিফিকেট আর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী মৃত্যু হার্ট অ্যাটাকের কারণেই হয়েছিল।
সীতানাথের দৃষ্টি তখন অনাদির চোখের থেকে সরে নিচে মেঝের ওপর নিবদ্ধ। অনাদি বলে চললেন, আর এরপর মাসিমার পালা। উনি তখন শরীরে পটাশিয়ামের অভাবের জন্য নিয়ম করে ইনজেকশন নিচ্ছেন। খুনি গোপন সূত্রে জানতে পারে যে, কোনো মানুষের শরীরে যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পটাশিয়াম ক্লোরাইড ইনজেকশন দেয়া হয় তাহলে সেই ব্যক্তির হার্ট ফেল করে মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেকাংশেই থেকে যায়। আর এই ওভারডোজের কারণে মৃত্যু হলেও পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে কোনো রকম অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায় না। আর ঠিক এ জন্যেই খুনি এই সহজ পদ্ধতিটা নিয়েছিল। কারণ পোস্টমর্টেমে যদি বেশি পরিমাণে পটাশিয়ামের অস্তিত্ব থাকে তবুও তাকে অস্বাভাবিক আখ্যা দেয়া যায় না। এর পেছনে খুবই সাধারণ অথচ তাৎপর্যপূর্ণ কারণ রয়েছে। হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই মানুষের হার্ট থেকে অধিক মাত্রায় পটাশিয়াম নিঃসারিত হয়। আর সেই জন্যই খুনি এবারও পার পেয়ে যায়।
সীতারামের দৃষ্টি তখন নিজের পায়ের পাতায় পায়ের বুড়ো আঙুলটা দিয়ে মেঝেতে আপন মনে দাগ কেটে চলেছেন। কপাল থেকে ঘামের বিন্দু ঝরে পড়ছে নিজের উপর। অনাদি এরই মধ্যে আবার বলা শুরু করলেন, এবার এলো পিসিমার টার্ন। খুনি এক্ষেত্রেও জানতো যে, পিসিমার হাই ব্লাড প্রেসার আর সেই সঙ্গে সাইনাসের যন্ত্রণা। অতঃপর সুযোগ বুঝে পিসিমাকে কড়া ডোজের পেইনকিলার প্রদান আর তাই হার্টফেল। সীতানাথ এ পর্যন্ত শোনার পর মাটির দিকে চেয়ে খুব শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, প্রমাণ?
প্রমাণ আছে সীতু। প্রমাণ তোর ভাগ্নে, যে সেদিন দেখেছিল কে তার দিদির জ্যামিতি বাক্সে আরশোলা রেখেছিল। প্রমাণ দেবে কম্পাউন্ডার নিশিকান্ত। যে কীনা খুনিকে ওই পটাশিয়াম ক্লোরাইড ইনজেকশনটার ভালো ও মন্দ দুটো দিকই জানিয়েছিল। আর শিখিয়েছিল কীভাবে ইনজেকশন দিতে হয়। প্রমাণ দেবে পাড়ার ওষুধের দোকানের পানু মিত্তির, যে খুনির কাছে অত কড়া ডোজের পেইনকিলার বেচেছিল। এবং বারবার করে তিনি খুনিকে বলেছিলেন, এই পেইনকিলার কোনো ব্লাডপ্রেসারের রোগীকে না দিতে।
সীতানাথ এবার সব শুনে অবাক হয়ে বলে উঠলেন, কিন্তু তুই কি করে...?
আমি কী করে এতসব জানলাম, তাই তো? দেখ সীতু, তুই যেমন মানুষের জীবন বীমার ভিতরের সব তথ্যের খবর রাখিস আর তোর অভিজ্ঞতার ফসল হিসাবে অনেক কিছুই আঁচ করতে পারিস, ঠিক তেমনি আমিও মানুষের অন্ধকার দিকগুলো পড়তে পারি আর নিজ অভিজ্ঞতা আর শিক্ষার সাহায্যে আগে থেকেই অনেক কিছু আঁচ করতে পারি। ভুলে যাস না আমি তোর বন্ধু হওয়ার সাথে-সাথেই পুলিশের লোকও বটে। আমি এসব তথ্য বহু বছর আগেই নিজের চেষ্টায় খুঁজে বার করেছিলাম। যদিও তখন ডাক্তার আর পুলিশ পোস্টমর্টেম রিপোর্টের ভিত্তিতে এই মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক বলে স্বীকৃতি দিলেও আমার কাছে এগুলো স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। আর তাই অনেক কষ্ট করে একটা একটা প্রমাণ একত্রিত করতে পেরেছি। এই প্রমাণগুলোর ভিত্তিতে আমি খুব সহজেই এই কেস ওপেন করতে পারি আর কার সাথে এটাও বলে রাখি যে, পুলিশ কিন্তু কোনো রকম কসুরই করবে না সত্যিটাকে বার করার জন্য। তাই এত কাল আমি অপেক্ষা করেছি উপযুক্ত সময়ের জন্য। আর এখন সেই সময় উপস্থিত। আমি এবার জগৎ সভায় তার মুখোশ টেনে খুলবো।
সীতানাথ শেষবারের জন্য একটা শেষ চেষ্টা করলেন আর বলে উঠলেন, কিন্তু মোটিভ? অনাদি এবার আরও একটা সিগারেট জ্বালিয়ে শুরু করলেন, এসব খুনগুলোর পেছনে মোটিভ একটাই। আর তা হলো, জীবন বীমার ক্লেইমের টাকা আত্মসাৎ করা। খুনি এদের প্রত্যেকের নামেই আলাদা আলাদা বীমা করিয়েছিলেন আর নমিনি বা বৈধ অভিভাবক হিসাবে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সেই হেতু এই তিনজনের মৃত্যুর পর তাদের পলিসির টাকা তারই প্রাপ্য হয়েছিল। এপর্যন্ত বলেই অনাদি বাবু আবার শুরু করলেন, দেখো সীতানাথ, আমি খুব ভালো করেই বহু বছর আগে থেকেই জানি যে, এই সব ক‘টা খুন তুমিই করেছ। আর এও জেনেছি, বহুদিন ধরে তুমি তোমার এই মাল্টি পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা করাচ্ছ এক নামকরা সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে। আর তাই কয়েক বছর ধরে তুমি সুস্থ আছো। কিন্তু আমি জানতাম যে, যেদিন তোমার ভাই সন্টু কলকাতায় ফিরে আসবে তুমি তাকে খুব কায়দা করে এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে। আর ঠিক তাই আমি ঠিক করি, এই সময়টাই উপযুক্ত সময় তোমাকে চিরতরের জন্য থামানোর। আর সেই জন্যেই তোমাকে আমার অনুরোধ, তুমি কাল সকালেই লোকাল পুলিশ থানায় নিজেকে সারেন্ডার করবে। নচেৎ আমরা কড়া ব্যবস্থা নেব। এবার তুমি আসতে পারো।
সীতানাথ কথা না বাড়িয়ে আস্তে আস্তে সোফা থেকে উঠে ঘরের বাইরে চলে এলেন। রাস্তায় নেমে বাড়ির দিকে না গিয়ে বড় রাস্তার মোড়ের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। বৃষ্টিটা তখন টিপ টিপ করে পড়ছে। রাস্তা ভিজে আছে জলে। তিনি ধীরপায়ে রাস্তা পার হতে লাগলেন। এমন সময় হঠাৎ দেখলেন একটা লরি তার তীব্র হেডলাইট জ্বালিয়ে প্রায় চোখ ঝলসে দিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। সীতারাম একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। লরির ড্রাইভার ব্রেক কষার চেষ্টা করেও রাস্তায় জল থাকার জন্য সঠিক সময়ে গাড়ি থামাতে পারলো না। পরের দিনের কাগজটা হাতে নিয়ে বৈঠকখানায় এসে বসলেন অনাদি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজটা খুললেন। প্রথম পাতায় চোখে পড়লো, মধ্য কলকাতার এক ব্যক্তিকে একটা লরি রাত সারে দশটার সময় চাপা দিয়ে চলে গেছে। খবরটায় আরও লিখেছে যে, মৃত ব্যক্তির পকেট থেকে মানিব্যাগ উদ্ধার করে জানা গেছে, তার নাম সীতানাথ মল্লিক। অনাদি এই অবধি পড়ে চোখ বুঝলেন। তার ভাবনা অনেক মুছে যাওয়া স্মৃতিকে উস্কে দিতে লাগলো। মানুষ আজ বড় একা আর তাই সে ভীষণ রকম স্বার্থপর। মানুষ আজ প্রতিনিয়ত আস্থা হারাচ্ছে মানুষের কাছ থেকে। এই ভয়ানক ব্যাধির হাত থেকে কারোর রেহাই নেই।
এই নিয়ে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই নিজের অজান্তেই মুখ থেকে এক দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরোলো আর হঠাৎই মনে মনে বলে উঠলেন, সত্যি নিয়তি...