সংগৃহিত
হারেমখানা
মোরশেদ হাসানপ্রকাশিত : এপ্রিল ০৭, ২০১৮
ইতিহাসে হারেমখানা খুবই পরিচিত। হারেমখানা বললেই মুঘল সম্রাটদের কথা আসে। হারেমখানা তুরস্কের সম্রাটদেরও ছিল। তুর্কি সুলতানরা তাঁদের অন্দরমহলকে হারেম বললেও শব্দটি কিন্তু তুর্কি নয়। শব্দটি আরবি। মক্কা ও মদিনার চারপাশ ঘিরে অনেকখানি জায়গা ছিল হারাম অর্থাৎ নিষিদ্ধ এলাকা। এ এলাকার রীতিনীতি একটু ভিন্ন। সে অর্থে হারেম অর্থ শুধু নিষিদ্ধই নয়; পবিত্রও বটে। পারস্যে বলা হত অন্দরম, ভারতবর্ষে বলা হত অন্তঃপুর। অবশ্য জানানা বা জেনানাখানাও বলতেন অনেকে। পারসিক জান শব্দের অর্থ মহিলা। শুধু ভারতবর্ষই নয়, ইরানি-তুরানি, মিশরীয়, ইউরোপীয় নীলনয়না অপরূপ সব সুন্দরীদের সমাবেশ ছিল হারেমে।
এখন রোহিঙ্গাদের মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সেই ঘটনার ঐতিহাসিক আবর্তেও রয়ে গেছে সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহ সুজার কাহিনি। আওরঙ্গজেব সিংহাসনে বসেই ভাইদের কতল করার পরিকল্পনা নেন। যাঁরা আশ্চর্য হচ্ছেন তাঁদের বলব বিস্মিত হওয়ার কিছুই নেই। বিস্ময় যা লুকানো তা আছে সেই সিংহাসনটিতেই। এই সিংহাসনটিতে আসীন হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিটি বৈধ অবৈধ সবরকম প্রচেষ্টাই চালান। সেখানে মা-বাবা, ভাই-বোন সব সম্পর্ক নিমিষেই অসার হয়ে যায়।
অথচ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। সিংহাসনে বসার প্রক্রিয়াটি যেমন নিষ্ঠুর; সিংহাসন থেকে বিদায় নেওয়ার ইতিহাসটি সময়ের আবর্তে আরও বেশি নিষ্ঠুর। শাহ সুজার ঘটনাটি খুব সংক্ষেপে শেষ করি। লেখালেখির কোনোরূপ ইচ্ছাই নেই। জোর করে কি বোর্ডে মনের আক্ষেপ দূর করার জন্য ঠাস ঠাস বাড়ি দিচ্ছি। যাই কিছু লেখা বেরিয়ে আসুক আমার কিছু যায় আসে না।
দিল্লীর সিংহাসনে আওরঙ্গজেবের সব ভাইদেরই বসার ইচ্ছা। এ এমনই অমোঘ আকর্ষণ, যে আকর্ষণে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পতঙ্গ অগ্নিশিখায় ঝাঁপ দেয় । শাহ সুজাও তা-ই চেয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব ভাইকে হাতের মুঠোয় পেলে নিশ্চিত হত্যা করবেন। ১৬৬০ সাল। শাহ সুজা পালালেন আরাকান রাজ্যে। আরাকান রাজ চন্দ্র ধু শর্মা তাঁকে আশ্রয় দিলেন। শাহ সুজার সঙ্গে ছিল তাঁর পরিবার এবং অনুগত সৈন্য ও হেরেমখানা। আরাকান এখন রাখাইন রাজ্য; রাজা ধারণাও করেননি মুঘলদের সম্পদ কী বিপুল সম্ভারের হতে পারে। তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আরও চোখ ধাঁধিয়ে গেল শাহ সুজার অপরূপা কন্যা আমেনাকে দেখে। এ তো রূপ নয় যেন জ্বলন্ত অগ্নিশিখা।
চন্দ্র ধু শর্মা রাজকন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। শাহ সুজা মুঘল সম্রাটের সন্তান। তিনি আরাকান রাজের দুঃসাহসের বহর দেখে বিস্মিত ও স্তম্ভিত হলেন। প্রস্তাব প্রত্যাখিত হল। শাহ সুজা আরাকান রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা ও তাঁকে অপসারিত করতে চাইলেন। আরাকান রাজ প্রস্তুত ছিলেন। শাহ সুজা নাফ নদীর দিকে পালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হল। সুজার পরিবার হল বন্দি। তখন আরাকানে প্রচুর মুসলমান বসবাস করতেন। তাঁরা সেদিন শাহ সুজাকে বিজয়ী হতে সহায়তা করলে আজ হয়তো রোহিঙ্গাদের ভাগ্য অন্যভাবে লিখিত হতে পারত। সে অন্য কাহিনি।
নাদিরা আফগানিস্থানের এক গরীব পরিবারের মেয়ে। অসামান্য রূপসী। আফগান রাজদরবারে নাচ পরিবেশন করতেন। সম্রাট আকবর তখন প্রৌঢ়। তিনি তশরিফ রাখলেন আফগানিস্থানে। আফগান রাজা হলেন ধন্য। রাতের বেলায় বসে জলসা। সেই জলসায় নাদিরা তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী নিয়ে অনুপম ভঙ্গিতে নাচলেন। আকবর নর্তকীর নাচের প্রশংসা করলেন; রূপেরও। আকবরের মুগ্ধ, লুদ্ধ দৃষ্টি এড়াল না আফগান রাজের ধূর্ত চোখ। সম্রাট আকবর অবসর কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছেন দিল্লীতে। বিদায় বেলায় আফগান রাজার বিশাল উপঢৌকন সামগ্রীতে নর্তকী নাদিরাকে দেখে তিনি প্রীত হলেন।
প্রৌঢ় আকবরের বিকাল ও সন্ধ্যাগুলোর ক্লান্তির অপনোদন ঘটে নর্তকীর ঘুঙুরের অনুপম মিষ্টি ঝংকারে। বিশাল রাজত্ব পরিচালনায় তাঁর উৎসাহ উদ্দীপনায় ঘাটতি পড়ে না। তখন সে আর নাদিরা নয়; তার নাম আনারকলি। কিন্তু অপূর্ব দেহবল্লরীর আনারকলির সঙ্গে চারচোখের মিলন ঘটল আকবরেরই সন্তান শাহজাদা সেলিমের।
আকবরের চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে এলেই পায়ের ঘুঙুর খুলে নিঃশব্দে সতর্ক হরিণীর মতো মৃদুপায়ে সে নেমে আসতো রাজদরবারের বাগানে। তরুপল্লবে ঘেরা কুঞ্জে অপেক্ষার প্রহর গুনত শাহজাদা সেলিম। আকুল তৃষ্ণায় পরস্পর পরস্পরের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকত। সময় বিলীন হয়ে যেত ফুলের ভাঁজে; ভ্রমরের গুনগুন গুঞ্জনে। এক অমর প্রেম কাহিনির জন্ম হল ইতিহাসের মর্মর পাথরের মায়ায় শোভিত হতে।
আনারকলি-সেলিমের এই প্রেম অভিসার জানাজানি হতে সময় নিল না। আকবরের কান পর্যন্ত পৌঁছল। চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠল সম্রাটের; মুখের বিকৃত ভাঁজ অতি কষ্টে স্বাভাবিক হল। আকবর শীশমহলের কাঁচে চোখ রেখে নিজেই চাক্ষুষ করলেন ব্যভিচারিণী নর্তকীর আনন্দময় চোখ আর সেলিমের মুখের স্মিত হাসি। তিনি জানেন যৌবনের কাছে প্রৌঢ়ত্বের পরাজয়ের বেদনা কী অপরিসীম; কী অপরিমেয়; কী নিষ্ঠুর। কিন্তু এ বেদনার অস্তিত্ব তিনি রাখবেন না। নির্দেশ দিলেন আট দেওয়ালের নিরন্ধ্র সৌধ নির্মাণের।
আনারকলি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর শরীরের চারপাশ ঘিরে তৈরি হচ্ছে একের পর এক পাথরের দেওয়াল। মাথার ওপরের শেষ দেওয়ালটুকু তুলে দিতেই তারাভরা আকাশ ঢাকা পড়ে গেল। জীবন্ত সমাধিস্থ হল আনারকলি। শাহজাদা সেলিম প্রাসাদে দাঁড়িয়ে থেকে পাথরচোখে দেখলেন প্রিয়তমার শেষ বিদায়। তখন প্রাসাদের প্রতিটি কক্ষে জ্বলে উঠেছে রঙিন ঝাড়বাতি। প্রেমিক শাহজাদা সেলিম পরিণত হচ্ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের অবয়বে।
সম্রাট শাহজাহান এলেন আদরের দুহিতা জাহানারার কক্ষে। কক্ষে প্রবেশের মুহূর্তেই শুনলেন ভেতরের ফিসফাস। তিনি মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালেন। এরমধ্যেই জাহানারা দয়িতকে ঘরে রাখা বিশাল এক ডেকচিতে লুকিয়ে রাখলেন। সম্রাট অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কক্ষে প্রবেশ করলেন। স্নেহের সঙ্গে কন্যাকে সম্বোধন করলেন,
জাহানারা, এই ডেকচিতেই তবে পানি গরম করা হোক। তোমার স্নানের প্রয়োজন।
জাহানারার কাজলের ছায়ায় বিষ্ফারিত চোখের সামনেই খোজারা এসে ফুটন্ত পানি ঢালল বিশাল কড়াইতে। সময় স্তব্ধ হয়ে রইল। সম্রাটের আদেশ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হল।