হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর

সৈয়দ মুনির হোসেন

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯

মোবাইলের রিংটোন শুনে উপল টেবিলে রাখা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে, অপরিচিত নম্বর। অনিচ্ছা নিয়ে ইয়েস বাটনে ক্লিক করতেই ওই প্রান্ত থেকে মেয়েলি গলার খিলখিল হাসির শব্দে উপল চমকায়। হাসতে হাসতেই মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে, শুনলাম আপনি নাকি হেপ্পি ছ্যাঁকা খাইছেন!

শুনে উপলের গা-জ্বালা দিয়ে উঠলো এবং সাথে সাথে বুঝতে পারলো, এইটা সিঁথির কণ্ঠ। উপল গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয়, তুমি কি এসব কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছ, না অন্য কিছু বলবা?
না, আমার পরীক্ষা শেষ। আগামী শুক্রবার বিকেলে ঢাকায় আসবো, মানে আপনাদের বাসায়। এক সপ্তাহ থাকবো, আপনার কোনও অসুবিধা হবে না তো?
তোমার যত দিন ইচ্ছা ততদিন থাকো তোমার ফুপুর বাসায়, চাইলে সারাজীবন থাকো। উপল রাগতস্বরে উত্তর দেয়।
সত্যি, সারাজীবন থাকতে দিবেন? সিঁথি হঠাৎ গভীর ভরাট কণ্ঠে জানতে চায়।
উপল হচকচিয়ে গিয়ে বলে, তার মানে?
তার মানে আপনি গাণ্ডু। সিঁথি আবার হাসতে হাসতে বলে। আর শুনেন, বেশি আপগ্রেড মেয়ের প্রেমে পড়লে এই অবস্থা হয়। বলেই সিঁথি ফোন কেটে দেয়।
উপল চিৎকার করে বলে, ওটা কোনও প্রেম ছিল না। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনও উত্তর আসে না। উপল ভাবে, মেয়েটি অল্পবয়সেই অনেক রহস্যময়ী।

দুই মাস আগের সব ঘটনাগুলো ফ্লাশব্যাকের মতো উপলের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কী শঠতার সাথেই না রাফিয়া তার সাময়িক নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য ওকে ব্যবহার করেছিল। চাতুর্যময় ঠকানোর খেলাটা উপল যখন ধরতে পারলো তখন উপল অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। উপল ভাবে, কেন যে রাফিয়ার পাতা ফাঁদে পা বাড়িয়েছিল! আসলে রাফিয়া তার নিজের আর অনিকের দোদুল্যমান সম্পর্কের অনিশ্চিত পরিণতির কথা চিন্তাভাবনা করেই উপলকে বেছে নিয়েছিল দ্বিতীয় অপশন হিসাবে। উপল আর এসব নিয়ে ভাবতে চায় না, এই হতাশা যাতে ওকে আর না গ্রাস করে, সে ব্যাপারে উপল এখন সচেতন।

সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে উপল বুকশেলফ থেকে একটা বই বের করে। বইয়ের পাতা উল্টোতেই একখণ্ড কাগজ মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে। উপল সেটি তুলে ধরতেই চোখে পড়ে, কি এক বিচিত্র ভাষাতে লেখা একটি বাক্য; vqpm j mpwf zpv, লেখাটা সিঁথির।

উপল দুই দিন ধরে ভাবে, কি লিখেছিল সিঁথি। উপল হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ভাবে, এর অর্থ সে কি কোনোদিনই বের করতে পারবে না। উপল ইংরেজি বর্ণমালা বের করে গভীর মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে থাকে, এবং সহসাই সিঁথির হেয়ালির উত্তর পেয়ে যায়। সিঁথি যে শব্দ আসলে লিখতে চায় ঠিক তার পরের শব্দ ব্যবহার করে বাক্যটি লিখেছে। সে আসলে লিখতে চেয়েছে, উপল আই লাভ ইউ। সত্যটা বার করে উপল অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, কী এক অনাবিল আনন্দে ওর মনটা ভরে যাচ্ছে। উপল নিজে লজ্জিত হয় এই ভেবে যে, সিঁথি মাত্র এইচএসসি দিল আর উপলের এখন ত্রিশ চলছে। প্রায় এক যুগের ব্যবধান, সে হয়তো অতি আবেগের জন্য এটা লিখেছে। কিন্তু উপলের লজ্জা লাগে নিজেকে আবেগে ভাসতে দেখে।

পরদিন উপল অফিসে গিয়ে উসখুস করতে থাকে। সিঁথির সাথে কথা বলার জন্য ওর মন আকুল হয়ে ওঠে এক অজানা কারণে। উপল ভাবে, সিঁথিদের বাসায় তো ফোন বা মোবাইল কোনোটাই নাই। উপল ওর ল্যান্ডলাইন থেকে সিঁথিদের পাশের বাসায় ফোন করে বলে, আমি ঢাকা থেকে বলছি, সিঁথিকে ডেকে দেয়া যাবে? উপল অপেক্ষা করে, কয়েক মিনিট পর ওপ্রান্ত থেকে সিঁথির গলা শুনতে পায়, উপল চমকায়। উপল বলতে চায় যে, আমি তোমার লেখা পেয়েছি আর আমি জানি যে, তুমি আমাকে ভালোবাস, কিন্তু আমি সেটা তোমার মুখ থেকে শুনার জন্য অপেক্ষা করে আছি। উপলের গলা দিয়ে স্বর বের হতে পারে না, কিছু বলতে না পেরে সে ফোন রেখে দেয়।

উপল অফিস থেকে মাত্র বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, আর তক্ষুণি মোবাইল বেজে উঠলো। অপরিচিত নম্বর, উপল কল রিসিভ করে। ও প্রান্ত থেকে সিঁথি বলে উঠে, কি ব্যাপার ফোন করে কথা বলেন না কেন?
কৈ না তো, আমি কল কখন করলাম! উপলের লজ্জিত জবাব।
দেখেন, আমি নিশ্চিত আপনি কল করেছেন, আমি আপনার নিঃশ্বাসের আওয়াজে বুঝতে পারি যে এটা আপনি। সিঁথির উৎসুক জবাব।

আজ সিঁথি আসবে, উপলের অফিসে কাজে মন বসে না। বিদেশি বায়িং হাউজে চাকরি করার সুবাদে শুক্রবারও অফিস করা লাগছে দেখে উপলের মেজাজ খিচিয়ে আছে। ও ঘড়ি দেখে, সাড়ে পাঁচটা বাজে, এখনো আরো ৩০ মিনিট। এতক্ষণে সিঁথি আর ওর ছোট ভাই নিশ্চয় চলে এসেছে। দ্রুত বাসায় ফিরে দেখে, সিঁথি ডাইনিংয়ে বসে আছে। ওকে দেখে চুলের বেণী দুলিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, আপনি তো দেখছি ঠিকঠাক আছেন, আমিতো ভেবেছিলাম দাড়ি রেখে দেবদাস হয়ে গেছেন।
উপল রেগে কিছু বলতে গিয়েও কিছু বলতে পারলো না ওর নিষ্পাপ চেহারার মিষ্টি হাসি দেখে।

উপল সবে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় সিঁথি আস্তে করে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে একরাশ মায়া ভরা চাহনিতে জিজ্ঞেস করলো, আপনার খুব কষ্ট হয়েছিল না, যখন উনি (রাফিয়া) চলে গিয়েছিল। আমি জানি, সত্যিকারের ভালবাসার কি কষ্ট!
উপল বলে, সেটা কোনও ভালবাসা ছিল না, ছিল মোহ আর হঠকারিতা।
সিঁথি কোন কথা না বলে ঘর হতে বের হবার সময় উপল কাগজের খণ্ডটা সিথির সামনে তুলে ধরে বলে, এটা তুমি লিখেছ?
সিঁথি এক দৃষ্টিতে উপলের চোখে চোখ রেখে গ্রীবা উঁচু করে বলে, হ্যাঁ আমি লিখেছি, তো?
উপল কোন জবাব দিতে পারে না। সিঁথি ঘর হতে বেরিয়ে যায়।

আজ দুপুরের বাসে সিঁথি পাবনা চলে যাবে। উপল আজ অফিসে যায়নি, সিঁথিদের বাসে তুলে দিয়ে অফিস যাবে। বেবিট্যাক্সি চলছে, একদিকে উপল, মাঝখানে সিঁথি আর একদিকে সিঁথির ছোট ভাই। বেবিট্যাক্সি মিরপুর ১০ নম্বর গোলচক্কর পার হতেই উপল সিঁথির ডান হাত নিজের দুই হাতের তালুর মাঝে শক্ত করে ধরে রাখল। সিঁথি উপলের দিকে না তাকিয়ে বললো, আমি জানতাম আপনি একদিন আমার কাছে ফিরে আসবেন, আর হ্যাঁ আমি আপনাকে খুব ভালবাসি।
উপলের গলা ধরে আসে, বুকের ভেতর কেমন যানি খচখচ করে, কিছু বলতে গিয়েও পারে না। বেবিট্যাক্সি বাস স্টান্ডে পৌঁছে গেছে, সিঁথি নামার সময় দুষ্টুমি ভরা স্বরে বলে, আবার বেশি ভালবাসলে ধরা খাওয়া লাগে।
উপল অবাক হয়ে ভাবে, আসলেই সে সিঁথিকে বুঝতে পারে না। তার মন বলতে চায়,
কেন তুমি এমন, কখনো রহস্যময়ী
কখনও মমতাময়ী, কখনও ছলনাময়ী
কখনো তুমি কবি, কখনও নর্তকী।

সিঁথিরা বাসে উঠে যায়। উপল অপেক্ষা করে আর ভাবে, এই বুঝি সিঁথি বাস থেকে নেমে এসে বলবে, গাণ্ডু, ভালোবেসে হাত ধরলে ছেড়ে দিতে হয় না, আরো শক্ত করে ধরে রাখতে হয়।

বেবিট্যাক্সি চালকের ডাকে উপল বাস্তবে ফিরে আসে, দেখে বাস চলতে শুরু করেছে। উপল পাগলের মতো বেবিট্যাক্সি থেকে লাফ দিয়ে নামে...