হারারির জনপ্রিয়তার কারণ কী

কামরুল আহসান

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৮

প্রতি বছর সন্ত্রাসী হামলায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে মারা যাচ্ছে পঞ্চাশজন, আমেরিকায় মারা যাচ্ছে দশজন, চীনে মারা যাচ্ছে সাতজন— সারা বিশ্বে মোট মারা যাচ্ছে পঁচিশ হাজার মানুষ (ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া এবং সিরিয়ায়)।

এর বিপরীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ইউরোপে মানুষ মারা যাচ্ছে ৮০ হাজার, আমেরিকায় ৪০ হাজার, চীনে দু’লাখ ৭০ হাজার, আর সারা বিশ্বে সব মিলিয়ে ১. ২৫ মিলিয়ন। ডায়াবেটিস বা অতিমাত্রার শর্করার কারণে সারাবিশ্বের বার্ষিক মৃত্যুর হার ৩. ৫ মিলিয়ন, বায়ুদূষণের কারণে মারা যাচ্ছে প্রতি বছর সাত সাত মিলিয়ন মানুষ।

তাহলে আপনি কেন এসবের চেয়ে সন্ত্রাসী হামলাকে ভয় পাচ্ছেন? সরকারগুলোও কেন সন্ত্রাসী হামলার ভয় দেখিয়ে টিকে থাকছে? এই হচ্ছে হারারির জরিপ। তার স্যাপিয়েন্স, হোমো ডিয়াস থেকে শুরু করে সর্বশেষ বই 21 Lessons for 21 Century ঘুরেফিরে এসব কথাই বলছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, পারমাণবিক যুদ্ধ এসবের ওপরই তিনি জোর দিচ্ছেন। এসব ভবিষ্যত পৃথিবীর মানুষের জন্য আতংক নিয়ে আসছে। এসব খুব নতুন কথা নয়। এসব নিয়ে বহুকথা হয়েছে। গত অর্ধশতাব্দী ধরেই এসব নিয়ে ব্যাপক কথাবার্তা হচ্ছে। পারমাণবিক যুদ্ধের বিপক্ষে বারট্রান্ড রাসেল ব্যাপক কাজ করে গেছেন। শুধু লিখেই না, স্বশরীরে, বক্তৃতায়, আন্দোলনে, যুদ্ধ-বিরোধী প্রচারণা তার চেয়ে বেশি গত শতাব্দীতে আর কোনো দার্শনিক করেননি।

হারারির লেখায় দার্শনিকতা নাই, নতুন কোনো পথ নিদের্শনা নাই, আছে শুধু জরিপ, সম্পাদনা। তার আকর্ষণীয় বলার ভঙিতে একটা জিনিস যে কোনো বিষয়ই অল্পতেই ব্যাপকতা ধারণ করে। বহু কিছু আসে একসঙ্গে। কয়েকবার ঢাকা, বাংলাদেশের প্রসঙ্গও এলো। পৃথিবীর আনাচে কানাচে তিনি চোখ বোলান। এর অবশ্য একটা বিপদ আছে, গভীরতার চেয়ে তা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে বেশি।

রোড অ্যাক্সিডেন্ট ও রোগেশোকে মরা আর সন্ত্রাসী হামলায় মরা এক কথা না। একজন মানুষ যদি কোনো মতবাদের কারণে একজন মানুষও হত্যা করে, সেটাও একটা ভয়াবহ ব্যাপার, হাজার মানুষ রোগে মরার চেয়ে। কারণ একটা প্রকৃতির হাতে, আরেকটা মানুষের হাতে, মানুষের বিশ্বাস এতে টলে যায়। এ নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। সেসব আমি এখন বলবো না। আমি অন্য একটা প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য এত কথা লিখছি।

হারারি 21 Lessons for 21 Centuryর এক জায়গায়, তৃতীয় অধ্যায়ের টেরোরিজম চাপ্টারে লিখেছেন, প্রতি বছর বাসে, রেস্টুরেন্টে ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসীদের হামলায় ৪৫১ জন ইসরায়েলি মারা যাচ্ছে। কিন্তু, ইসরায়েলিদের হাতে কতজন ফিলিস্তিনি মারা যাচ্ছে সেটা তিনি উল্লেখ করেননি। আমি নেট ঘেটে দেখলাম তার সংখ্যা কোনো কোনো বছর আশি নব্বই গুণ বেশি। ২০০০ সালের পর ইসরায়েলিরা মেরেছে ৯,৭৩৩ জন ফিলিস্তিনি, আর ফিলিস্তিনিরা মেরেছে ১, ২৫৩ জন ইসরায়েলি।

প্রতি বছরই ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের নৃশংসতা বাড়ছে। ২০১৫ সালের পর কমপক্ষে ৫৫৪ জন ফিলিস্তিনি মারা গেছে ইসরায়েলিদের হাতে, আর ফিলিস্তিনিরা মেরেছে ৫৭ জন। ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করেছে, জোর করে বাড়িঘর ছিনিয়ে নিচ্ছে, যখন ফিলিস্তিনিরা তার প্রতিবাদ করছে তাদেরকে সন্ত্রাসী নাম দেয়া হচ্ছে, এসবের কোনোকিছুই হারারির লেখায় উল্লেখ নেই। তিনি একজন ইহুদি। ইসরায়েলের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। সারা বিশ্বে তার এই তিনটা বই যে এত জনপ্রিয় হয়ে গেল, মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রি হচ্ছে, বিল গেটস পর্যন্ত তার লেখা পড়ে রিভিউ লিখছেন, কেন!