হারাবার বেদনাকে প্রাপ্তির মতো করে চেনা
তারেক মাহমুদপ্রকাশিত : মে ০৩, ২০২০
শুধু শব্দে শব্দে বিয়ে দিয়ে কবি হওয়া যায় নাকি? যিনি শব্দে শব্দে ডিভোর্স দেন, তিনিও কাব্যপৌরহিত্যই করেন। তিনিও কেন কবি নন? এক লেখককে কোনো এক পাঠক এইরূপ প্রশ্ন করেছিলেন, কবে কোথায় পড়েছিলাম মনে করতে পারছি না। তবে প্রশ্নটা এইরকম ছিল স্পষ্ট মনে আছে।
বাংলা সাহিত্যের কবিতা সেগমেন্টে ছন্দকরণ ও আলংকরিক পদ্যের ব্যবহারের পাশাপাশি এই ধরনের শব্দে শব্দে ডিভোর্স দেবার একটা প্রয়াসও আশাতীতভাবে বিদ্যমান রয়েছে। আমার এই বক্তব্যের সমর্থনে যে বইটিকে সঠিক দৃষ্টান্তস্বরূপ হাজির করা যেতে পারে, তা হলো নির্বাণ প্রকাশ কর্তৃক মার্চ ২০২০ এ প্রকাশিত কবি, সাংবাদিক ও সৃজনশীল লেখক সাঈদ জুবেরী ওরফে মোহাম্মদ সাঈদ জুবেরী চিশতীর ‘Some Texts Are Missing অথবা কিছু মায়া রহিয়া গেল’ বইটি।
বইটিকে ঠিক কবিতার বই বললে আক্ষরিক অর্থেই বইটির কনটেন্টসের সাথে অবিচার করা হবে। মূলত বইটি লেখার সময়কাল ২০১১ থেকে ২০১৭ এর আগস্ট-সেপ্টেম্বর এই দীর্ঘ ছয়-সাত বছর। এই দীর্ঘ সময়ের নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কাটাছেঁড়া, যাপিত জীবন, সময় ও সমসাময়িক বিশ্বকে উল্টে-পাল্টে দেখার দাগ স্পষ্টতই রয়েছে বইটির শরীরজুড়ে এবং দাগ থেকে সাফল্য ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত পাঠ নিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে পাঠকের হাতে এলো সাঈদ জুবেরীর ‘Some Texts Are Missing অথবা কিছু মায়া রহিয়া গেল’।
সম্ভবত লেখার সময়কাল বিবেচনায় বইটিতে বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে গল্প, জার্নাল, কবিতা, গদ্য ও সমান্তরাল ন্যারেটিভ বা বয়ান যা লেখকের আত্মজবানিতে চমৎকাররূপে উপস্থাপিত হয়েছে। বইটির নাম থেকে অমল পাঠকও সহজেই ঠাওরে নিতে পারবেন আশা করি এই বই পাঠান্তে তার হৃদয়ে যা কিছুই থাকুক না কেন, কিছু মায়া নিশ্চিত রয়ে যাবে সজীব ও তার নিজেরই অলক্ষ্যে, গুনগুন করে পাঠককে মনে করিয়ে দেবে তার অতীতের ব্যর্থ প্রহর যত কিংবা প্রায় উপশমিত কোনো ক্ষত যা উঁকি না দিলেই মাঝে মাঝে হৃদয়-পটে বরং মনে হতে থাকে মিষ্টি কোনো বেদনা হারাতে বসেছে বুঝি জীবন থেকে কিংবা সত্য-মিথ্যার বিভ্রান্তি থেকে উদ্ভূত অতি আবশ্যকীয় যে নরম আলো জীবনকে রাঙিয়ে দেয় না হামেশাই, কিন্তু হারাবার বেদনাকে প্রাপ্তির মতো করে চেনায় বারবার— পাঠকের অনুভবে সেই রহিত মায়া সেই উচ্ছনে যাওয়া আলোকধারা স্পর্শ করে যাবে বইটির পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা।
বইটির ভূমিকায় লেখক ‘সেই মায়া রহিয়া যাইবার’ কথা নিজ জবানিতে লিখেছেন এইভাবে— ‘মায়া সভ্যতার পতনের পরও, মানুষের বুকে-মাথায় আজও কোথাও মায়া রহিয়া গেল, Some Texts Are Missing...’ বইটি শুরু হয়েছে ‘অ্যালিস ইন দ্যা মাইনফিল্ড’ শিরোনামের একটি ছোট গল্প দিয়ে। সেই গল্পের প্রধান চরিত্র ছোট্ট মেয়ে অ্যালিসের অভিমান— তার দুষ্টু খরগোশের পেছনে ছুটতে ছুটতে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত একটা মাইনফিল্ডে ঢুকে যাবার টানটান উত্তেজনার ছায়াচিত্র দেখতে দেখতে এই ছায়াচিত্রে দর্শক ও তার চারিপাশের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের নানান চিত্রের সমাহারের মধ্য দিয়ে আপনাকে হাত ধরে পার করে নিয়ে লেখক ঢুকিয়ে দেবেন বইয়ের অভ্যন্তরে— আপনার মন অ্যালিসের অভিমানে সিক্ত হয়ে থাকবে— নাদান ও দুষ্টু খরগোশের উপর মৃদু রাগ নিয়ে আপনি পৃষ্ঠা উল্টিয়ে হাজির হবেন ‘দুনিয়া এক মহানোকি কারখানা’ শিরোনামে একখানা স্যাটায়ার কাব্যকলায়।
‘Some Texts Are Missing অথবা কিছু মায়া রহিয়া গেল’ বইটি একটা ভ্রমণের আনন্দ নিয়া আপনারে এগিয়ে নিতে থাকবে এর শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত— একবার এই ভ্রমণ শুরু করার পর বাদামঅলা চাঅলা কারোর চেঁচামেচি চিৎকার আর আপনারে কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে না। আপনি নিমগ্ন হয়ে থাকবেন লেখকের বিগত জীবনের নানান অভিজ্ঞতা ও তাদের বৈচিত্র্যের আবহে ও ঘোরে। আপনি তলিয়ে যেতে থাকবেন এই সমাজ-সংসার, বৈশ্বিক রাজনীতি, প্রেম-কাম ও দর্শন নিয়ে একের পর এক স্যাটায়ার ও সমসাময়িক জীবনধারার অন্যরকম চিত্রায়নে।
বইটির পঠন শেষ হলে আপনার বুকের মাঝে একপ্রকার মৃদু ও রহস্যময় স্পন্দন টের পেতে থাকবেন— মগজের কোথায় যেন নিঃসরিত হতে থাকবে সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের হরমোন— কোনও বিশেষজ্ঞের মতামত ছাড়া আপনি নিজেই এই বিশেষ প্রকার হরমোনের নামকরণ করতে পারবেন। আমি নিশ্চিত আপনি এই হরমোনের নাম দেবেন ‘মায়া’।
বইটি প্রকাশ করেছে নির্বাণ। প্রকাশক আবেদীন পুশকিন। প্রচ্ছদ করেছেন রনি আহম্মেদ। মূল্য ৬৫০ টাকা।