হাদিউল ইসলামের গল্প ‘মুক্তি’
প্রকাশিত : জুন ০৭, ২০২১
টলতে টলতে ছেলেটি দরোজায় গিয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর সমস্ত বয়স হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত-অবসন্ন, সে এসেছে এইখানে। গায়ে ধুলোবালি আর নিজেরই রক্তের ধারা বেয়ে নামছে মাটিতে। ছেলেটি দাঁড়িয়েই থাকে।
আত্মীয় বাড়িতে যাওয়ার সময় অনেকেই তো হাতে মিষ্টির হাঁড়ি ঝুলিয়ে নিয়ে যায়। ছেলেটি দরোজায় দাঁড়িয়ে। এক হাতে নিজের কর্তিত মাথা চুল ধরে ঝুলিয়ে রাখা, অপর হাতে বুক ফেঁড়ে বের করে আনা হৃৎপিণ্ড ঝুলতে থাকে মিষ্টির হাঁড়ির মতোই। কড়া নাড়ার মতো তৃতীয় কোনো হাত না থাকায় সে দাঁড়িয়েই থাকে। অনন্তকাল। তার বুক বেয়ে, পা বেয়ে রক্তের ধারা চতুর্দিকে ছড়াতে থাকে। ছেলেটি স্থানু অথচ কাঁপতেই থাকে। যেন যেকোনো মুহূর্তে হাঁটু ভেঙে ধপাস, পড়ে যাবে।
কত রাতদিন, ঝড়বৃষ্টি গেছে এইভাবে। কোথাও কোথাও রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। কোথাও বা পোকা করছে কিলবিল। রক্তের ধারা ঠিক কতদূর নেমেছে তা কেউ অনুমান করতে পারে না। পাখিদের চোখের জল এখানে মিশেছে কতকটা, খসে পড়েছে বেশ কিছু পালকও। এরই মধ্যে একটি চারা গজিয়েছে এইখানে, তবে ঠিক চেনা যাচ্ছে না এটি ফুল না ফলের না আগাছার। ছেলেটি কাঁপছে। যেন বাতাস তাকে দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ঝাউয়ের মতো সে দুলতে থাকে।
মেয়েটির সঙ্গে তার হৃদয় আর মস্তিষ্কের সম্পর্ক ছিল খুব গাঢ়, অথচ মেয়েটি বুঝতে পারেনি বা বোঝার চেষ্টা করেনি কিম্বা বুঝেও না বোঝার ভান করে আছে তার বেড়ে ওঠার সম্পূর্ণ বয়স কিম্বা পৃথিবীর বয়সও হতে পারে। উপরের সম্পর্কের চেয়ে তার মানসিক সম্পর্কটা বেড়েছিল জ্যামিতিক হারেই। সুতরাং ছেলেটি হিসেব করে নির্ণয় করতে পারে না কতদিন কিম্বা কত শতাব্দী আগে মেয়েটি তাকে বা তার মাথা আর হৃৎপিণ্ডটাকে দখল করে নিয়েছে। সে দখল করেছে এটি যেমন ছেলেটি বুঝতে পারে ঠিক তেমনি বুঝতে পারে তার অবস্থানটা বড় বেশি অবহেলার। সুতরাং ভালোবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন মিছে ভালোবাসা।
ছেলেটি বহুদিন এইভাবে কাটিয়েছে। মেয়েটিকে নিয়ে নানামতো ভেবেছে, ভেবে ভেবে পুলকিত হয়েছে, তাকে পাওয়ার জন্য মাইল মাইল লম্বাও হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই যখন সে ব্যাপারটিকে নিয়ে চিন্তা করেছে তখনই অনিশ্চয়তার কুয়াশায় হারাতে হারাতে নিজেকে একা এবং ক্ষীণকায় দেখেছে। সে নিজেকে একা এবং ক্ষীণকায় দেখে। মাথা ঝিম ধরে যায়। তার ভয় করে, বুঝি বাল্বের মতো ফিউজ হয়ে যায় মাথাটা। বুকে ব্যথা অনুভব করে ক্রমশ ওজন বেড়েই চলছে সেখানে, একটি পাথর... দুটি পাথর... তিনটি পাথর... অজস্র পাথর।
সুতরাং তার বোধ এবং হৃদয় যা মাথা এবং হৃৎপিণ্ড এ দুটি নিয়ে সে বিপদে পড়েছে। কেননা সে বোধের চিন্তন দিয়ে তাকে আগলে এনে হৃদয়ের আবেগী আসনে বসিয়েই ছিল। এই কাজে তার মাথা ও হৃৎপিণ্ড এত বেশি ডানপিটে আর পারদর্শী হয়ে উঠেছিল যে, ছেলেটি এসবের প্রতি কর্তৃত্বই হারিয়ে ফেলেছিল। সে মনেই করতো এগুলো তার শরীরের অবাধ্য যন্ত্রাংশ।
ছেলেটি কাঁপছিলই। হঠাৎ দরোজা খোলার শব্দে সে সচকিত হয়।
মা, আমার ফিরতে একটু দেরি হতে পারে, বলে মেয়েটি দরোজা খুলছিল। বেশ সাজগোজ করেছে মেয়েটি। দরোজা খুলতেই মাথাহীন, একহাতে ঝুলছে মাথা অপর হাতে হৃৎপিণ্ড। বুক বেয়ে, পা বেয়ে গড়াচ্ছে রক্ত— এরকম একটি মূর্তি চোখে পড়ে তার। সে দরোজার সিঁড়ি বেয়ে নিচে না নেমে বরং থমকে দাঁড়ায়। বিস্মিত হয়। চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে যায়। ভাবে, কে এই লোক? কার জন্য সে এত বেশি বিধ্বস্ত আর করুণ আর মেতেছে এই মর্মান্তিক খেলায়? চিনতে চেষ্টা করে। চিনেও ফেলে। ছেলেটির মাথা ঝুলছে এক হাতে। মাথাটা অনেকটা স্ট্যান্ড ফ্যানের মতো ডান-বাম ঘুরছে। চোখ দুটি বুঁজে আছে শ্রদ্ধায় না অভিমানে আনত বোঝা যাচ্ছে না। অন্য হাতে হৃৎপিণ্ড। বুকের ভেতর ভয়ঙ্কর এক গর্ত। উথলিয়ে রক্ত পড়ছে পা বেয়ে। গলার অংশটাও ভয়ঙ্কর। সেখান থেকে রক্ত পড়ছে বুক বেয়ে।
মেয়েটি কথা বলে না। স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। এইবার ছেলেটি অনন্তকাল অপেক্ষার পর সম্মুখে অগ্রসর হতে গিয়ে টের পায় তার নিজের রক্ত পা দুটি এমন শক্ত করে বেঁধে ফেলেছে যে প্রথমত ছাড়াতে তার কষ্টই হয়। ছেলেটি টলতে টলতে অগ্রসর হয়। তার এক হাতে নিজে মাথা, অপর হাতে হৃৎপিণ্ড। মেয়েটি স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। কথা বলে না। ছেলেটি আরেকটু অগ্রসর হয়। তার মাথা আর হৃৎপিণ্ডটি মেয়েটির পায়ের কাছে রাখে। মেয়েটির চোখে মুখে এইবার খুব দ্রুত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে সে চৌকাঠে হাত রাখে। মাথাটা বোধ হয় ঝিম ধরে, তাই নুয়ে ঠেস দিয়ে রাখে চৌকাঠে রাখা একটি হাতে। ছেলেটি কর্তিত গলার অংশটা দিয়ে খুব কষ্টে, কাঁপা কাঁপা, ভাঙা ভাঙা উচ্চারণ করে— এগুলো আমার অবাধ্য, এগুলো আমার নয়, এগুলো বহুদিন আগে, বহুদিন আগে তোমার, তোমার হয়ে গেছে, তোমার হয়ে গেছে, দিয়ে-দিয়ে গেলাম— দিয়ে গেলাম...
ছেলেটি পূণর্বার আগে যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানটায় দাঁড়ায়। বুকের গর্তে হাত ঢোকায়। কিন্তু পরক্ষণেই ফিরিয়ে আনে রক্তে ভেজা খালি হাত। একবার ঘাড়ের উপর হাত নেয়, মাথা না থাকায় হাতটা আটকায় না। ফিরে আসে। মেয়েটি স্থির দাঁড়িয়ে, তবে আনত। পায়ের কাছে রাখা মাথা আর হৃৎপিণ্ডটাকে দেখছে কি? ছেলেটিও স্থির হয় এবং পরক্ষণেই মাটি থেকে কিছুটা উপরে ওঠে। আরেকটু ওপরে। টপটপ করে পৃথিবীর বুকে রক্তের ফোঁটা পড়ে। মেয়েটির চোখ থেকে দু`চার ফোটা জল এতক্ষণে পড়ে কিনা, কে জানে! আরো উপরে, ছেলেটি আকাশে মিলিয়ে যায়...