হাওড়বাংলার লুপ্ত সংস্কৃতি: আগ লওয়া

আশরাফ রোকন

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৪, ২০২০

আবহমানকাল থেকে হাওড়বাংলার মানুষের জীবনে বৈশাখ এক সোনালি শস্যের মাস হিসেবে গণ্য। কেননা এ মাসেই কষ্টে ফলানো ধানফসল ঘরে তোলার মওশুম শুরু হয়। ফলে কৃষকের মনে খেলা করে এক নতুন শিহরণ, এক নতুন স্বপ্ন। আর তাই এ বৈশাখ মাসকে হাওড়াঞ্চলের মানুষেরা স্মরণ করে বরণ করে তাদের অন্তরের সমগ্র ভালোবাসায় নানা উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে। বৈশাখ মাসে ধানকাটা শুরুর এমনি একটি উৎসবের নাম `আগ লওয়া` অর্থাৎ পাকা ধান কাটার আনুষ্ঠানিকতা— যা আজ বিলুপ্ত। শৈশবের গাঁয়ে অনেকবার দেখেছি সে উৎসব। যার স্মৃতি এখনো বারবার মনে পড়ে।

সকালবেলায় দেখতাম, দাদি, মা, চাচি, ফুপুরা মিলে সারা বাড়িঘরআঙিনা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে গোবরে লেপন করে দিতেন উঠোন। ঘরে রান্না করা হতো ক্ষীর, খিচুরি। এ বাড়ি ও বাড়ির ছেলেমেয়েরা নতুন কাপড় পরে মেতে উঠতাম আনন্দে, ঠিক ঈদের দিনের মতো। মনে আছে, আমাদের বাড়ির সামনের হিজলতলায় বসে যেত মানুষের হাট। সেখানে মাল্লতের মুরুব্বিরা আসতেন। আগে নির্ধারিত ষাঁড় জবাই করা হতো। আর `আগ লওয়া`র জন্যে নির্ধারিত কৃষকপ্রতিনিধিরা আসতেন হাতে নতুন কাঁচি, দড়ি নিয়ে। তাদের সকলের পরনে নতুন লুঙি, মাথায় নতুন গামছা, গায়ে নতুন গেঞ্জি।

এক হাতে কাঁচি ও দড়ি, অন্য হাতে `এগড়া` ও `ডুগল` (এক ধরনের বনস্পতি লতা বা ঘাস) কয়েকটি ডাঁটা। ষাঁড় জবাই হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জবাই করা ষাঁড়ের রক্তে এক হাতে থাকা `এগড়া, ডুগল` ডাঁটা দুটি সামান্য ভিজিয়ে মাঠের যেখানে পাকা ধানক্ষেত সেদিকে ভোঁ দৌড় শুরু করতেন কৃষক প্রতিনিধিরা। প্রত্যেকে যার যার ক্ষেতে পৌঁছার পর `এগড়া ও ডুগল`র ডাঁটা দুটি ঈশানকোণে পুঁতে দিয়ে অন্য হাতে রাখা কাঁচি দিয়ে বিজোড় সংখ্যক পাকা কয়েকটি ধানের শীষ দড়িতে বেঁধে গামছা দিয়ে প্যাঁচিয়ে আবারও দৌড়ানো শুরু হতো যার যার বাড়ির দিকে।

বলা প্রয়োজন, ফেরার পথে একদল তামাশাকারীর সাথে দেখা হতো, যাদের উদ্দেশ্য হলো কৃষকপ্রতিনিধিকে নানান তামাশাচ্ছলে হাসানো, যাতে করে `আগ লওয়া` লোকটির দাঁত দেখা যায়। কথিত নিয়ম ছিল, হেসে ফেললে যার দাঁত দেখা যাবে তার `আগ লওয়া` হবে না। প্রসংগত, কৃষক পরিবারের বড় পুত্র হওয়ার সুবাদে আমাকেও `আগ লওয়া` কাজের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল বেশ কয়েকবার। মনে আছে, আমাকে হাসিয়ে দাঁত দেখার জন্যে পীড়াপীড়ি করেও কেউ কখনো সফল হতে পারেনি। দাদির কাছে হাসি চেপে রাখার কৌশল শিখে নিয়েছিলাম।

যা হোক, পাকা ধানের শীষ নিয়ে বাড়িতে এসে প্রথম যখন দাঁড়ানো হতো উল্ডিতলায় (বারান্দার নিচে, ঘরে উঠার সিঁড়িসংলগ্ন), ঠিক তখনই গৃহকর্ত্রী এসে `যাত্রাপানি` (আমপাতা, বরইপাতা, সোনারূপা ভেজানো পানি) ঢেলে দিতেন পায়ে, তারপর মাথায় ধানদূর্বা দিয়ে বরণ করে নিয়ে যেতেন গৃহের ভিতর। গৃহে গিয়ে ধানের গোলার উপরে কেটে আনা পাকা ধানের শীষগুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে দিলেই শেষ হতো `আগ লওয়া` পর্বের। এর পরে পাকা ধানক্ষেত কাটার ধুম পড়ে যেত সারা হাওড়ে।

সাধারণত বৈশাখ মাসের আগের দিনটিই অধিকাংশ সময় `আগ লওয়া` দিন হিসেবে নির্ধারিত থাকতো। সারাদিন মহানন্দে কাটতো। হাওড়বাংলার বৈশাখবরণের এমন অপূর্ব দৃশ্য এখন আর চোখেই পড়ে না। অন্য হাজার সংস্কৃতির মতোই আজ যা অতীতের মুগ্ধ স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

লেখক: কবি