সতীনাথ ভাদুড়ী
স্মৃতির আয়নার সতীনাথ ভাদুড়ী
জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়প্রকাশিত : মার্চ ৩০, ২০২০
কথাসাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ীর আজ মৃত্যুদিন। ১৯৬৫ সালের ৩০ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম বিহারের পূর্ণিয়ার ভাট্টাবাজারে, ১৯০৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। পিতা ইন্দুভূষণের আদিবাড়ি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখি স্মৃতিচারণমূলক একটি রচনা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
জেলে গেলেই অনেকেই কিছু না কিছু লিখতে আরম্ভ করেন। নিয়মিত খাতা পেনসিল পাওয়া যেত। পাওয়া যেত হাতে অফুরন্ত সময়। সবাই কিছু না কিছু লিখতেন। ভাদুড়ীজীও লিখতেন। কিন্তু কি লিখেছিলেন সেটা জানা গেল যখন আমরা ‘টি’ সেলে গেলাম। ‘টি’ সেলে ঢুকেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, ভাদুড়ীজী কেন এই সেলের জন্য জেল-সুপারিটেনডেন্টের কাছে ‘ওজুর’ করেছিলেন। লেখাপড়ার জন্য এমন চমৎকার জায়গা এই জেলে আছে আমরা জানতাম না।
একদিন ওঁর ‘ডিগ্রি’তে বসে চা খাচ্ছিলাম। সেখানে একটা খাতা ছিল। হাতে নিয়ে পাতা খুলে দেখি— লেড পেনসিল দিয়ে লেখা। পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হল— এতো ডায়েরি। খাতা বন্ধ করে রেখে দেবার সময় বললাম, ডায়েরি বুঝি? প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উনি বললেন, কেন? ডায়েরি পড়তে নেই কারো বুঝি? আর বাকি সব কিছুই না বলে পড়া যায়। কি?
আমি অপ্রস্তুত এবং লজ্জিত হয়ে চলে আসছিলাম।
বললেন, চার পাতা যেখন পড়েই ফেলেছো বাকি পৃষ্ঠাগুলোও পড়ে নাও। নিয়ে যাও।
পরদিন ওঁর ডিগ্রিতে চা খেতে গেছি। চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, জানেন? রাত্রে বিলুর অধ্যায় পড়বার সময় আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে, কাল সকালেই আমার ফাঁসি হবে। শেষের ছত্রগুলো তো কি বলি, মানে... মানে... তখন উনি বইয়ের ‘আওরত কিত্তা’ অর্থাৎ বিলুর মা এর অধ্যায়ে ছিলেন। বললেন, থাক! আর মানে বোঝাতে হবে না। চা নোন্তা নোন্তা লাগছে না তো?
আমার চোখের পাতাগুলো ভিজে গিয়েছিল। কিছু বলতে পারছিলাম না। হিন্দী সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক ফনীশ্বর নাথ রেনু ‘ভাদুড়ীজী’র স্মৃতি কথায় যা লিখেছিলেন তার যথার্থতা ধরা পড়ে ‘জাগরী’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ পাবার পর। কিন্তু সেই হিসাবে সতীনাথ ভাদুড়ী এখনো আলেচনার বিষয় বস্তু হয়ে উঠতে পারেননি। কারন তাঁর নিজের কথায়, ‘আমাদের চিন্তাধারার, ethics-এর ভালমন্দ বিচারের সবচেয়ে মৌলিক Contradiction হলো যে, যে Values-গুলিকে আমরা নৈতিক দৃষ্টিতে উঁচু স্থান দিই সেগুলিকে দিয়ে Succesful man হওয়া যায় না সমাজে। সে গুলি যে লোকের আছে তারা সমাজে misfits। উদারতা, লোভহীনতা, সারল্য, সাধুতা, প্রাণখোলা ভাব, দিলদরিয়া হাসি-খুশির ভাব, ভাবালুতা, আদর্শবাদিতা, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি গুণগুলিকে আমরা উচ্চাসন দিই। অথচ এগুলো দিয়ে জীবনে সাফল্য লাভ করা যায় না। এদিকে জীবনে সাফল্যলাভকে সমাজ বড় মনে করে’।
সতীনাথের জন্ম ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯০৭ সাল। স্থান ভাট্টাবাজার, পূর্ণিয়া। পূর্ণিয়া জেলার আয়তন তখন বৃহৎ। বাংলা বিহারের কৃত্রিম বিভাগ তখন কেউই চিন্তা করেনি। পুরানো গেজেটে দেখা যায়, সেই সময় এই অঞ্চলে দু-শোর বেশী নীলকর সাহেব পরিবার বসবাস করতো। কিন্তু এরই মাঝে বুদ্ধিজীবী বাঙালীরা এক সম্মানের স্থান পেয়েছিল স্থানীয় জন-জীবনে। ইংরেজ রাজত্বের সেই স্বর্ণযুগে পুর্ণিয়া কোর্ট উকিলদের স্বর্গ। প্রচুর পয়সা। সাহবদের কাছ থেকে সুনজর ও সম্মান পেতো বাঙালী বাবুরা। এই পরিবেশে কৃষ্ণনগর থেকে পূর্ণিয়ায় প্র্যাক্টিস এলেন করতে ইন্দুভূষণ ভাদুড়ী। ১৮৯৬ সাল। কৃষ্ণনগরের খাঁ ভাদুড়ী পরিবারের এক অংশ ছিটকে বেরিয়ে পড়লো বিহারের এই সুদূর অঞ্চলে।
ভাদুড়ী বংশ কৃষ্ণনগরের সম্ভ্রান্ত পরিবার ছিল। ইন্দুভূষণের পিতামহ সুধাময় খাঁ জমিজমা নিয়ে কৃষ্ণনগরে বেশ বর্ধিষ্ণু পরিবার ছিলেন। ইন্দুভূষণের জন্ম ১৮৬৯ সালে। মাতা মুক্তকেশী দেবী ছিলেন বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক রামতনু লাহিড়ী মহাশয়ের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্রসাদ লাহিড়ীর কন্যা। ইন্দুভূষণরা ছিলেন পাঁচ ভাই। তিনি নিজে ও অন্য দুই ভাই চন্দ্রভূষণ ও জ্যোতিভূষণ প্রসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করতেন। ইন্দুভূষণ নিজে কৃতী ছাত্র ছিলেন। ১৮৯০ সালে স্বর্ণপদক নিয়ে কেমেষ্ট্রিতে পাশ করেন। তিন ভাই একই কলেজে একই বিভাগে থাকায় বিভাগাধ্যক্ষের আপত্তি হয়। তখন ইন্দুভূষণ কলেজ ছেড় আইন পাঠ করেন। তারপর জীবিকান্বেষণে সুদূর পূর্ণিয়া। ১৮৯৬ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত।
ইন্দুভূষণ ও রাজবালার সন্তান সতীনাথ। তিন ভাই, চার বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। অগ্রজ ভূতনাথ ভাদুড়ীর ভাষায়, ‘আমাদের পারিবারিক শিক্ষা ও কৃষ্টিতে উৎসাহিত করেছিলেন আমাদের ঠাকুর্মা—রামতনু লাহিড়ীর ভ্রাতুষ্পুত্রী। কৃষ্ণনগরে ইংরাজী ধরণে শিক্ষার প্রচলন প্রথম দিকেই। আমাদের পারিবারিক moto ছিল—plain living and high thinking. এই পরিবেশে মানুষ সতীনাথ’।
সতীনাথের পিতা ছিলেন রাশভারী লোক। সতীনাথ তাঁর কাছ থেকে দূরত্ব রক্ষা করে চলতেন বরাবরই। সতীনাথের লেখাপড়ার যা-কিছু উৎসাহ প্রেরণা জোগাতেন তাঁর মা। মায়ের স্নেহেই সতীনাথের স্কুল জীবনের সুরু। পূর্ণিয়া জেলা স্কুল সেই সময় স্থানীয় সদর হাসপাতালের কাছেই ছিল। সতীনাথ ভর্তি হলেন স্কুলে। সেই সময় জেলা স্কুলের হেডমাষ্টার ছিলেন প্যারীমোহণ মুখোপাধ্যায়, খুলনা জেলার লোক। সতীনাথকে তিনি স্নেহ করতেন। আর ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত তুরন্তলাল ঝা। সতীনাথকে তিনি ‘ক্লাসকী রোশনী’ বলে ডাকতেন। সেই সময় সতীনাথের সহপাঠী ও সমসামযিক ছিলেন কৃপানাথ ভাদুড়ী, সুধীর চট্টোপাধ্যায় (নালুবাবু), তুলসী মুখোপাধ্যায়, সত্যচরণ গঙ্গোপাধ্যায়, কালিপদ মৈত্র, ফণিগোপাল সেন, প্রফুল্ল গঙ্গোপাধ্যায় প্রভৃতি।
স্কুলজীবনে সতীনাথ খুব একটা দুরন্ত ছিলেন না। তার জানার আগ্রহ ছিল অসীম। যতক্ষণ কোনো জিনিষ অজানা থাকত ততক্ষণ তার প্রতি আসক্তি। স্কুল জীবনে একবার বিজয় দশমীর দিন সিদ্ধি কি জিনিষ তা পরীক্ষা করার জন্য সতীনাথ অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে অল্প সিদ্ধি খান। নেশা কাটানোর জন্য সকলে কাঁঠাল পাতা চিবিয়ে নেয়, কিন্তু সতীনাথের জন্য ডাক্তার ডাকতে হয়। ফলে কয়েক দিন বাড়ীতে প্রায় বন্দী থাকতে হয়।
১৯২৪ সালে সতানাথ ডিভিশন্যাল স্কলারশিপ নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পাশ করার পর তিনি পাটনায় চলে আসেন পড়াশোনার জন্য। ১৯২৬ সালে পাটনা সায়েন্স কলেজ থেকে সতীনাথ আই. এস-সি. পাশ করেন দ্বিতীয় বিভাগে। পূর্ববর্তী ফলের তুলনায় এই পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ায় তিনি বিজ্ঞান থেকে কলা বিভাগে চলে আসেন। অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে বি.এ ক্লাসে ভর্তি হন। বি.এ পড়ার সময় পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামেডান হস্টেলে চলে আসেন। যশ্বস্বী লেখক অন্নদাশঙ্কর যে ঘরে থাকতেন সেই ঘরটি সতীনাথের জন্য বরাদ্দ হয়। ১৯২৮ সালে অর্থনীতিতে অনার্স সহ বি.এ পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এই সময় তার জীবনে দুটি অঘটন ঘটে। ডায়াবিটিসে তাঁর মা মারা যান ৪ এপ্রিল ১৯২৮ সাল। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই দিদি করুণাময়ী কলেরায় মারা যান। এই দুজনেই ছিলেন সতীনাথের অত্যন্ত প্রিয়। মায়ের মৃত্যুতে সতীনাথ অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন এবং সংসারের প্রতি বন্ধন যেন শিথিল হয়ে যায়। সতীনাথের জীবনে মায়ের এই অভাব বোধ পূরণ করেন দু-জন মহীয়সী মহিলা। এঁরা হলেন কুসুমকুমারী দেবী এবং দাক্ষায়নী দেবী। যথাক্রমে পূর্ণিয়ার খোকা ডাক্তার (অমর ভট্টাচার্য) ও ডাক্তার গোপাল ভট্টাচার্যের মা।
১৯৩০ সালে অর্থনীতি নিয়ে তিনি এম.এ পাশ করেন দ্বিতীয় বিভাগে। এম.এ পাশ করার পর পাটনা ল কলেজে বি.এল (আইন) পড়ার জন্য ভর্তি হন। ১৯৩১ সালে আইন পরীক্ষায় পাশ করেন। কলেজ জীবনে রাজনীতির সঙ্গে তাঁর কোন পরিচয় হয়নি এমন কি যোগাযোগও হয় নি। তবে এম. এন. রায়ের রচনা দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। পাটনা থেকে আইন পাশ করে সতীনাথ পূর্ণিয়ায় ফিরে আসেন। পিতার সহকর্মী হিসাবে ওকালতি ব্যবসা শুরু করেন। জুড়ি-ঘোড়ার গাড়ীতে পিতার সঙ্গে, কখনও বা সাইকেলে চেপে সতীনাথ কোর্টে যেতেন। বার লাইব্রেরীতে গিয়ে বইয়ের স্তূপে ডুবে থাকতেন। মক্কেল ধরা বুদ্ধি তাঁর হয় নি। আদর্শ বাদী মন এই সব ঘৃনা করতো। আইন সম্বন্ধে সতীনাথের জ্ঞানের গভীরতা ছিল যথেষ্ট। আইন শাস্ত্রের জটিল মার প্যাঁচ তিনি সহজেই বুঝতেন এবং তখনকার দুধর্ষ ব্যবহারজীবীরা—জ্যোতিষ ভট্টাচার্য, নিশিকান্ত সেন, শশি কোনার প্রভৃতি সতীনাথের কাছে অনেক জটিল তত্ত্ব জেনে নিতেন। তাঁর মেধা এত প্রখর ছিল যে জুনিয়র উকিল হওয়া সত্ত্বেও জেলা জজেরা ওঁকে ডেকে নানা রুলিং জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতেন। ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত তিনি আইন ব্যবসায় লিপ্ত থাকেন।
এই সময়কার সতীনাথের জীবনের একটা চিত্র পাওয়া যায় বন্ধু বিভুবিলাস ভৌমিককে লেখা সতীনাথের এক পত্র থেকে—‘তোমার দিন জলের মতো কেটে যাচ্চে শুনে হিংসে হচ্চে। নেহাৎ লোকের দিন কাটে বলেই আমার দিন কাটছে একথা বললে একটু অত্যুক্তি করা হয় তবে আমার কাটচে এই শতকরা ৮০ জন লোকের সাধারন বৈচিত্র্যহীন ভাবে যে রকম করে কাটে। Daily Routine বলচি,—৭টা থেকে ৯টা Good Boy আইন পাঠ। ৯টা থেকে বারোটা কেদার বাঁঢ়ুয্যে সাহিত্যিকের বাড়ি আড্ডা। খাওয়া দাওয়ার পর ছোট্ট একটা ঘণ্টা তিনেকের ঘুম। ঘুম থেকে উঠে চা পানের সঙ্গে খবরের কাগজ পাঠ। তারপর সান্ধ্য ভ্রমণ। তারপর ৯টা (রাত) পর্যন্ত বাজী রেখে Bridge খেলা—রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সাহিত্য চর্চা। নবশক্তি পড় না বোধহয়—ওতে আমার লেখা গোটা কয়েক Satire বেরিয়েছে। এখন দ্বিগুন উৎসাহে লিখচি। হ্যাঁ বলতে ভুলে গিয়েছি, এছাড়া একটু ড্রয়িং করচি। নমুনা পাঠালাম। এই হচ্চে বাঁধা Routine। এছাড়া বাহাদুরী আর বাহবা নেবার জন্য কতকগুলি Public Activity দেখাচ্চি। টুলের উপর দাঁড়িয়ে বর্ক্তৃতাও মেরেচি। একটা Public Trust Fund দেখবার জন্যে এখানকার লোকেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েচি। পূজোয় বলি তুলবার জন্য mass meeting আহ্বান করচি। বাড়ি এসে নিজেরই হাসি আসে। এই সব তুচ্ছ ব্যপারে মাথা ঘামানোর জন্য। জার্মান কিছুদিন শিখেছিলাম। সম্প্রতি বই গুলি যাঁর কাছ থেকে এনেছিলাম তাঁকে ফেরৎ দিয়েছি। এই তো গেল আমার কথা। জানতে চেয়েছিলে বলেই এত ফেনিয়ে বলতে সাহস করলাম। আর এর আগের চিঠিতে তোমার কথা কিছু জানতে পেরেচি। তার থেকে বেশী জানাটা চিঠিতে বিশেষ শিষ্টাচার সঙ্গত নয় ব’লে কৌতূহল নিবৃত্ত করলাম।
এই সময় রামশর্মা ভারতের সবজায়গায় বলি প্রথা তুলে দেবার জন্য আর্জি জনান এবং আন্দোলন করেন। তার ঢেউ পূর্ণিয়াতেও এসে পৌঁছায়। সতীনাথ এর নেতৃত্ব দেন। এছাড়া তিনি একটি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৩৫ সালে। নাম পূর্ণিয়া লাইব্রেরী। পরে সতীনাথের বাবার নামে লাইব্রেরীর নতুন নামকরণ হয়—ইন্দুভূষণ লাইব্রেরী। সতীনাথের সাহিত্য জীবনের সূত্রপাতও এই সময়। দাদামশাই কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এর মূলে। সম্ভবতঃ ১৯৩২ সালে প্রথম রচনা প্রকাশিত হয় বিচিত্রায়। আর কিছু লেখা নবশক্তিতে। নবশক্তিতে ৪ ভাদ্র ১৩৩৮ সাল ইংরাজী ১৯৩১ সাল ‘ইংলণ্ডে গান্ধীজি’ প্রবন্ধটি প্রকাশ হয়েছিল। বিচিত্রায় প্রথম গল্প ছাপা হয় ‘জামাইবাবু’ অগ্রহায়ণ ১৩৩৮ সাল।
কেদারনাথ বাবুর বাড়ীতে অনেক ম্যাগাজিন আসতো। সতীনাথ এবং তার অন্যান্য বন্ধু বান্ধবরা সেখানে যেতেন। সাহিত্য পাঠ সাহিত্য চর্চা ছিল এই আসরের মুখ্য বিষয়। সতীনাথের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ এই সময়েই। বৌদিদের কথায় জানাযায় তিনি ছিলেন আত্মনির্ভর, সংসার-উদাসীন, নিঃসঙ্গ, অন্তরমুখী মানুষ। অথচ বন্ধুদের সঙ্গে, ছোটদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। তবে ব্যাক্তি গত জীবনে কষ্টসহিষ্ণু আত্মনির্ভর মানুষ, পরের সেবায় উন্মুখ, কিন্তু নিজে অন্য কারোর সেবা কখনো নিতেন না। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ে পূর্ণিয়াতে। পূর্ণিয়া জেলা কংগ্রেস তৈরী হয় গোকুল কৃষ্ণ রায়ের নেতৃত্বে। সতীনাথ সক্রিয় ভাবে না হলেও বিক্ষিপ্ত ভাবে জড়িয়ে পড়েন।
একদিন বন্ধু সুধীর চট্টোপাধ্যায় ও আরও কয়েকজন স্থানীয় যুবককে সঙ্গে নিয়ে সতীনাথ ভাট্টা বাজারে মদের দোকানে পিকেটিং শুরু করলেন। দু-একদিন বাদে আবগারী বিভাগ থেকে লোকেরা আসে, পুলিশের সাহায্যে পিকেটিং ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা করেন, সকলে ভয়ে পালিয়ে যায় সতীনাথ একলা দাঁড়িয়ে তর্কে প্রবৃত্ত হন। আর একদিন দাদা মশাইয়ের নাতি গেনুকে (শ্রী ক্ষিতীশ চট্টোপাধ্যায়) নিয়ে একদল ছাত্রের সঙ্গে পূর্ণিয়া জেলা স্কুলে ইংরাজী শিক্ষা বন্ধ করার জন্য পিকেটিং শুরু করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সবাইকে বিস্মিত ও সচকিত করে সতীনাথ সর্বোদয় নেতা শ্রী বৈদ্যনাথ চৌধুরীর টিকাপট্টি আশ্রমে যোগদেন। পূর্ণিয়া শহর থেকে এই আশ্রমের দূরত্ব ছিল ২০/২৫ মাইল। অগ্রজ ভূতনাথ ভাদুড়ীর কথায়—‘বাবার টেলিগ্রাম পেয়ে আমি টিকাপট্টি আশ্রমে গিয়েছিলাম তাকে ফিরিয়ে আনতে। আমার সহযাত্রী ছিল সতুর অন্তরঙ্গ বন্ধু দ্বারিক সুর ও কমল দেও নারায়ণ সিনহা। সে আমাকে ফিরিয়ে দেয়’।
দাদামশাই (সাহিত্যিক কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়) ও তাঁর ডায়েরীর কয়েকটি পাতায় সতীনাথের কংগ্রেসে যোগদানের ব্যাপারে উল্লেখ আছে—
২৭.৯.৩৯: কালকে বললে—সতু টিকাপট্টি গিয়েছে— Law Practice ছেড়ে দিলে। কথাটা বিশ্বাস হয় নি। আজ শুনেছি সে সত্যই congress-এর কাজ করবে; তাই গিয়েছে। ওরূপ intellect-এর ছেলে, চাকরী কি court attend করতে উৎসাহ পায় না। তারা বরাবর বড় aspiration পোষণ করে, সাধারনে যা করে তাতে মন বসে না। কিন্তু congress circle-এই বা তার মন তুষ্ট থাকবে কি করে? সে হল একটি ক্ষুরধার intellect’-এর ছেলে, সত্যপ্রিয়, বিদ্যাপ্রিয় sincere, কিন্তু ও circle-এ যে প্রায়ই মূর্খ, মিথ্যাভাষীর সঙ্গে জুটবে। মনের মত দোসর বা বন্ধু পাবে না। কারো সঙ্গে বনবে না, কি করে কাটবে! সে নিশ্চয়ই একটা কিছু স্থির করে গিয়েছে। তা হলেও একজনও নিজের মত খাঁটি লোক না পেলে, ভাল লাগবে কেন; কাজ হবে কেন? ভগবান তাকে সাহায্য করুন, সে যেন মনের মত একমতের লোক পায়।
আমরা সংসারী। তাই তার বৃদ্ধ পিতার জন্য ভেবে কষ্ট পাচ্ছি। আর ২/১ বছর অপেক্ষা করে গেলেই ভাল হত। তাকে সত্যই ভালবাসি বলে তার কাজে সত্যি ব্যাথা পাচ্ছি,—যেন আমার নিজের নাতি চলে গিয়েছে। সে ভাল থাকুক তার উদ্দেশ্য সফল হউক।
৩০.৯.১৯৩৯ প্রিয় ভূতনাথের সঙ্গে খোকার দোকানে দেখা হল। সতীনাথকে দেখে এসে তার ভাবনা কমে গিয়েছে। সে ভালই আছে। প্রথম শুনে সত্যই বড় কষ্ট হয়েছিল—তার মনের মতো সঙ্গ পাবে না এই ভয়ে। এখন ভাবছি—যে সে সকল বিষয়ে যথেষ্টই বোঝে এবং শেষ পর্যন্ত ভেবে নিয়ে এ কাজ করেছে; adopt করে নেবার শক্তি নিশ্চয়ই রাখে। Risk না নিলে বড় কাজ হয় না।
কংগ্রেসের টিকাপট্টি আশ্রমে যেগদান করলেও সতীনাথ প্রায়ই ভাট্টাবাজারে নিজের বাড়ীতে দেখা-সাক্ষাৎ করতে আসতেন। সঙ্গে একটি কম্বল, মশারি আর ধুতি। রাজনীতির সক্রিয় জীবনের পরিধি সতীনাথের হয়ে পড়ে ব্যাপক। পুলিশের চোখ এড়াবার জন্য রাতে ট্রেনে ভ্রমণ করতেন, গভীর রাতে জল-কাদা ভেঙ্গে বিনা টর্চের আলোয় ১৫-২০ মাইল হেঁটে গিয়ে সভা সমিতি তৈরী করতেন। কাটিহার জুটমিলের ধর্মঘটে সতীনাথ ছিলেন শ্রমিকদের পাশে। সেই সময় বিহারের শ্রম কমিশনার ছিলেন সতীনাথের বন্ধু। তাঁর এবং সতীনাথের প্রচেষ্টায় ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়।
সতীনাথ তিনবার কারাবরণ করেন। প্রথম ১৯৪০ সালের জানুয়ারী মাসে। ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের জন্য। স্থানান্তরিত হন হাজারীবাগ জেলে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পূর্ণিয়া কংগ্রেসের সভাপতি অনাথকান্ত বসু, প্রাক্তন পার্লামেণ্ট সদস্য ফণিগোপাল সেন প্রভৃতি। ঐ জেলে সেই সময় ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, বিহারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, অনুগ্রহ নারায়ণ সিংহ প্রভৃতি। জয়প্রকাশ নারায়ন সতীনাথ স্বন্ধে বলেছেন,—
‘১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দলোনের পর জেল থেকে বেরিয়ে এসে ওঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। এরপর যখনই পূর্ণিয়া গেছি, সতীনাথের সঙ্গে অবশ্যই সাক্ষাত করতাম। সতীনাথ তখন পূর্ণিয়া জেলা কংগ্রসের কর্ণধার। ওঁর বিশাল প্রসাদ ছিল স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের কেন্দ্রস্থল। আমার সোসালিষ্ট পার্টি আগে কংগ্রসের অংশ ছিল। এইজন্য সতীনাথ সহজেই এই দলের সংস্পর্শে আসেন এবং যোগদান করেন। তাঁর সংবেদনশীল হৃদয় নিপীড়িত ও শোষিত জনগনের দুঃখে দ্রবীভূত হয়ে যেত। সমাজবাদের মধ্যে তিনি দরিদ্রের মুক্তির পথ দেখতে পান আর ফলে আমার সহকর্মী হয়ে চলে আসেন’।
১৯৪১ সালে সতীনাথ পূর্ণিয়া জেলা কংগ্রেসের সেক্রেটারী হলেন। বৈদ্যনাথ চৌধুরী সভাপতি। ১৯৪২ সালের আগষ্ট আন্দোলনের সময় আবার করাবাস। প্রথমে রাখা হল পূর্ণিয়াতে, তারপর দল বেঁধে পূর্ণিয়া জেল ভাঙার চেষ্টা করার জন্য ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলে বদলি হন। এই সময় তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় হিন্দি সাহিত্যরে যশস্বী লেখক ফনীশ্বরনাথ রেণু’র। রেণু সতীনাথকে গুরুজী বলতেন। ‘জাগরী’ উপন্যাস এখানেই লেখা হয়। প্রথম পাঠক ফুলেশ্বরনাথ রেণু। ছাড়া পাবার পর ১৯৪৪ সালে তৃতীয় দফা করাবাস। প্রথম বার তাঁর বন্দী জীবন কাটে এক বছরের জন্য, দ্বিতীয়বার ছ’মাসের জন্য, তৃতীয়বার কারাবাসের সময়েই সতীনাথের পিতা, অগ্রজ ভূতনাথের কলকাতার গৃহে, ৭৪ বছর বয়সে, ১৯৪৪ সালের ২০ জানুয়ারী মারা যান।
সতীনাথের চরিত্রের ধাতটা ছিল অনেকটা তাঁর পিতা ইন্দুভূষণের মতো। জীবনে কোথাও কখনো তিনি আপোষ করেন নি। তাঁর দৃঢ়চেতা, আদর্শবাদী চরিত্রের জন্য পূর্ণিয়া ছাড়াও সমগ্র বিহারে তিনি ভাদুড়ীজী নামে সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারী মাসে কিষণগঞ্জে বিহার প্রাদেশিক কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলন হয়। ডঃ বীরেন ভট্টাচার্যের পরিচালনায় সফল হয় এই অনুষ্ঠান। ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, মৃদুলা সারাভাই, শ্রীকৃষ্ণ সিংহ এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। দেশের স্বাধীনতার পরও সতীনাথ জেলা কংগ্রেসের সেক্রেটারী ছিলেন। কিন্তু চোখের সামনে দুর্নীতি অন্যায় তাঁকে অনেকটা পার্টি বিমুখ করে তোলে। শেষে ১৯৪৮ সালে যখন পূর্ণিয়া জেলা কংগ্রেসের বিশাল জেলাভবন তৈরী হচ্ছিল তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। ত্যাগপত্র দিলেন। অফিস থেকে ফিরে আসছেন একজন পুরনো গ্রামীন কংগ্রেস কর্মী জিজ্ঞেস করল,—‘কেন ভাদুড়ীজী ? কংগ্রেস কেন ছেড়ে দিচ্ছেন’ ? সতীনাথ জবাব দিলেন,—‘কংগ্রেসের কাজ স্বাধীনতা লাভ করা ছিল। সে কাজ তো হাসিল হয়ে গেছে। এখন ‘রাজকাজ’ ছাড়া কোন কাজ নেই আর’।
সতীনাথের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের ব্যাপ্তি নয় বছর ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৪৮ সালে রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ভাবে সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। এরপর ১৭ বছর ১৯৬৫ পর্যন্ত তিনি সাহিত্য চর্চা করে গেছেন। ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশ পায় ‘জাগরী’। ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশ পায় ‘গনণায়ক’। ১৯৪৯ সালের আগষ্ট মাসে ‘চিত্রগুপ্তের ফাইল’। ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ প্রথম খণ্ড। ১৯৫১ সালের মে মাসে ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ দ্বিতীয় খণ্ড।
সতীনাথ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বনফুল খেই হারিয়ে ফেলেছেন।—সতীনাথের কথা কি বলব? একটি সলজ্জ, মিতবাক, বিনয়ী, বুদ্ধিদীপ্ত মুখ মনে পড়ছে।....মনে পড়ছে একবার যেন সে আমায় বলেছিল কানাইদা, আমি লখক নই, পাঠক। পড়ত খুব।....কিন্তু বিদ্যের ভুড়ভুড়ি কাটতে দেখিনি কখনও তাকে, সে পূর্ণকুম্ভ ছিল। তাই বক বক করত না।
এহেন সতীনাথ পাড়ি দিলেন ইওরোপে। ১৯৪৯ সালের ১৬ই আগষ্ট পি. এ্যান্ড ও কোম্পানীর ‘ম্যালোজা’ জাহাজে বোম্বাই থেকে রওনা হলেন সমুদ্র পথে। এডেন, মার্সেই বন্দর ছুঁয়ে সতীনাথ পৌঁছলেন লণ্ডনে। সেখানে দু’সপ্তাহ কাটিয়ে ফ্রান্সের রাজধানী পারীতে। সাতমাস একটানা রইলেন পারীতে। ফরাসী ভাষা ও সাহিত্য চর্চা করেন ১৯৫০-এর এপ্রিলে ঘুরে এলেন জার্মানি, অষ্ট্রিয়া, জুরিখ, ইটালি। শিখেছিলেন রুশ ভাষা। বাসনা সোভিযেত দেশ ভ্রমণ। কুড়ি বছর ধরে স্পপ্ন দেখেছেন সোভিয়েত ভ্রমণের। কিন্তু পারীর সোভিয়েতে দূতাবাস ভিসা দিলেন না। চুরমার হয়ে গেল তাঁর স্বপ্ন। পারীতে থাকতে সতীনাথের কাছে একটি টেলিগ্রাম পৌঁছল। কলকাতা থেকে তাঁর অগ্রজ এই টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন। প্রথমে একটু ভয় পেয়ে ছিলেন, পরে টেলিগ্রাম খুলে জানতে পারলেন ‘জাগরী’ উপন্যাসের জন্য তিনি প্রথম ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ পাচ্ছেন।
রাশিয়া বেড়ানো হল না। হাতের পয়সাও প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। বহু আকাঙ্ক্ষিত স্পেন যাওয়াও হল না। পারী থেকে ফিরে গেলেন লণ্ডনে ১৬ মে ১৯৫০ সাল। সাদামটন বন্দর থেকে দি অ্যাসড ও কোম্পানীর জাহাজে ২রা জুন রওনা হলেন ভারতের উদ্দেশে। এক বছর ইওরোপে কাটিয়ে দেশে ফিরে এলেন। এই ভ্রমণের ফল ‘সত্যি ভ্রমনকাহিনী’। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ পায় ১৩৫৭ বঙ্গাব্দের ১৭ই চৈত্র থেকে ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৪ শ্রাবণ পর্যন্ত সতেরোটি সংখ্যায়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
১৯৫১ সালের ২১ জুন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁকে পত্র দিয়ে জানান,— ‘আজকাল প্রতি শনিবার ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য আগ্রহান্বিত হয়ে থাকি—আপনার পারিস ভ্রমনের অভিজ্ঞতা ও ফরাসি জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির কথা পড়বার জন্য। আমি এবং আমার মতন অনেকে—মুক্তকণ্ঠে আপনার এই চমৎকার লেখার প্রশংসা করি। বাংলায় এ জিনিষ অত্যন্ত বিরল। আপনি দেখবার চোখ নিয়ে গিয়েছেন, ভাষাজ্ঞন, ইতিহাসজ্ঞান নিয়ে গিয়েছেন।....একটা সমগ্র বিদেশী সভ্যতার এ-রকম খুঁটিয়ে বর্ণনা আর বিশ্লেষন বাংলায় তো আর দেখিনি।....এখন আপনার লেখা পড়ছি, আর মনে হচ্ছে এ তো আপনি আমার কথাই বলছেন, আমার নিজের চোখে দেখা নিজের নানা অভিজ্ঞতা আপনি এমন গুছিয়ে বলছেন যে আপনাকে সাধুবাদ না দিয়ে পারিনা।....আপনার লেখার ঝাঁজ আছে। ঘৃনা বা উপেক্ষা নেই, অদ্ভুত সমীক্ষা শক্তির সঙ্গে অপূর্ব দরদের সংমিশ্রণ।
এই জন্য এ জিনিষ চিরকাল টিকবে। প্রথম যেদিন পারিসে বছর খানেকের জন্য বাস করতে এলুম, সেদিন ঐ অ্যানিরই বোন ‘ওলালা, মস্যো আঁদু’ করে পাঁজিঅঁতে অভ্যর্থনা করে, তার প্রতিধ্বনি আপনার লেখার মধ্য দিয়ে আসছে।....ফরাসী সভ্যতার এই যে Complet rendu বার করেছেন, এটা হয় ফরাসীতে নয় ইংরাজীতে বেরুনো চাই। ওদের মুখের সামনে আরশিটা ধরা দরকার আমাদের কারোর দ্বারা—আপনার বই ছাড়া আর কেউ এই আরশি ধরার কাজ এমনভাবে করেছেন কিনি জানি না’।
১৯৫১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি পূর্ণিয়াতেই বাস করেছেন। মাঝে মাঝে অগ্রজ ভূতনাথের কলকাতার বাড়িতে এসেছেন আবার ফিরে গেছেন। তাঁর ভাললাগার ভালবাসার জায়গা ছিল পূর্ণিয়া। পূর্ণিয়ার ভাট্টাবাজারে বিশাল ভবনে তিনি একা থাকতেন। সঙ্গী বাবাজী নামে এক পাচক, পাহারা নামে এক কুকুর। ‘ঈর্ষা’ ছোটগল্পে গৃহভৃত্য কালাচাঁদ নাম নিয়ে ‘বাবাজী’র সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন,—‘পুরনো মোর গাড়ীর মালিক ভাবে যে আমি খুব গাড়ী চালাচ্ছি, কিন্তু আসল গাড়ীই তাঁকে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায় নিজের খেয়াল খুশি মত’। পুরনো চাকরও ঠিক তাই। আইনতঃ কালাচাঁদের সঙ্গে আমার প্রভু-ভৃত্যের সম্বন্ধ, কিন্তু কার্যতঃ সেই আমার আভিভাবক, গৃহিনী ও বন্ধু। ‘ঈর্ষা’ গল্পেই পাহারার বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে।—‘খাঁকি খাঁকি রং, পোড়া কালোমুখ, খাড়া কান, গুনো লেজ—একেবারে নির্ভেজাল পেডিগ্রি খাঁকি-কুকুর’। জন্তু জানোয়ারের মন নিয়ে এর আগে কখনও মাথা ঘামাই নি। এখন এতে রস পেতে আরম্ভ করি। অবিকল মানুষের মত! যত পাহারাকে দেখি অবাক হয়ে যাই।
সতীনাথের পূর্ণিয়া জীবন এইভাবেই কাটতো—কুকুর পরিচর্যা, সাহিত্য-চর্চা, আর সন্ধেবেলায় ডঃ অমর ভট্টাচার্যের দোকানে বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে ছোট আসর। কখনও কখনও স্থানীয় চিত্রবানী সিনেমা হলে সেকেণ্ড শো সিনেমা দেখা। আদর্শবাদী সতীনাথ অবিবাহিত জীবনেও এক আদর্শ। কিন্তু হার্টের উপর একটা টিউমার তাঁকে প্রায়ই কষ্ট দিতো। চিকিৎসা করিয়েছিলেন, কিন্তু খুব বেশী এ বিষয়ে এগুতে পারেন নি। অপারেশন ছাড়া উপায় ছিল না, অথচ কোন ডাক্তারই এর ঝুঁকি নিতে রাজী ছিলেন না। মাঝে মাঝে টিউমারটি বেড়ে গেলে খুব কষ্ট পেতেন। পাড়ার ছেলেরা জানতে পারলে রাত জেগে তাঁর সেবা-যত্ন করতে চলে আসতো। ১৯৬৫ সালের ২৬ মার্চ কলকাতায় অগ্রজ ভূতনাথ ভাদুড়ীকে তিনি চিঠি দেন। চিঠিটা পান ২৯ মার্চ। চিঠিটি ছিল এরকম,—‘কাল আপনার চিঠি পেলাম। জয়তীর এম-এ পাশের খবরে খুব খুশি হয়েছি। পড়াশোনায় নানারকম বাধা পড়েছিল ওর....এখন আমি কলকাতা যাচ্ছি না; দিনও ঠিক করতে পারছি না। আপনার শরীর কেমন আছে? আমি ভাল আছি। প্রণাম নেবেন, ছেলেমেয়েদের স্নেহাশীর্বাদ দেবেন’।—সতু।
১৯৬৫ সালের ৩০ মার্চ। সকালে লোকজনের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। প্রতিবেশী যুবক গনেশ ঘোষাল বাড়ির ছাদ থেকে দেখেছে সতুদা হাতে একটি বই নিয়ে উলটাতে উলটাতে বাগানের রাস্তা ধরে পায়চারী করছেন (বইটি ছিল ‘জাগরী’র ইংরাজী অনুবাদ ভিজিল)। পাচক বাবাজী বাবুর জন্য জলখাবার রেখে যথারীতি বাজারে গেছে, ফিরে এসে দেখে একি কাণ্ড! বাইরের লাইব্রেরী ঘরের বারান্দায় টেবিলে অর্ধভুক্ত জলখাবার পড়ে আছে। বাবু কোন কারণে হয়তো বাড়ীর ভেতরে এসেছিলেন; আর সেখানেই পাতকুঁয়োর পাশে পড়ে আছে তাঁর দেহ। বুকের টিউমারা ফেটে গেছে, মুখ থেকে অল্প অল্প রক্ত পড়ছে। বয়স ৫৯। চির বিদায়।
তাঁর এই মৃত্যুর ছবি মনে পড়লেই ‘রেণু’র কয়েকটা কথা মনে পড়ে যায়। সতীনাথ তখন ভাগলপুর জেলার বাসিন্দা। সতীনাখ লিখছেন ‘জাগরী’র প্রথম পাঠক সমালোচক ‘ফুলেশ্বর নাথ রেণু’—তাঁর কথায়, ‘চার মাস পরে নীলুর অধ্যায় অর্থাৎ অন্তিম অধ্যায় সমাপ্ত করার পরে ছুটে গিয়ে ওঁর পায়ে হাত দিতে দিতে বলেছিলাম,—আজকে আপনি বারণ করলেও কিছু শুনবো না।....পায়ের ধুলো দিন। ‘জাগরী’ কোনো পাত্র বা ঘটনার সম্বন্ধে কোনোদিন কোনোকথা ওঁকে জিজ্ঞেস করি নি, মাত্র একবার বলেছিলাম—বিলুও ব্লাড ষ্ট্যাণ্ড করতে পারত না’।
এর কোন জবাব না পেয়ে আর কিছু বলবার সাহস হল না। আসলে কিছুদিন আগেই পাউরুটি স্লাইস করার সময় ওঁর আঙ্গুল সামান্য একটু কেটে গিয়ে এক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে যায়। আর রক্ত দেখেই উনি হাতে কাটা স্লাইস নিয়েই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। হুঁশ হবার পরে বলেছিলেন,—‘ও কিছু নয়....আমি ব্লাড ষ্ট্যাণ্ড করতে পারি না’।