স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের নাটক ও নাট্যচর্চা নিয়ে গর্ব

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৯, ২০২২

সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ পরবর্তী নাট্য আন্দোলনই এখানকার নাট্য রচনা ও প্রযোজনায় সচেতন রাজনৈতিক ধারার প্রবর্তন করেছে, যদিও তা সকল দল বা প্রযোজনার ক্ষেত্রে সমানভাবে ঘটেনি। দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তা কখনই সত্যিকারের নাটকও হয়ে উঠতে পারেনি। বিশ শতক পর্যন্ত স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে যা দেখা গেছে তাহলো এই প্রচেষ্টা বা আন্দোলন কখনো স্থির থাকেনি। বারবার ধারা পাল্টেছে, বক্তব্য পাল্টেছে। দিকবিদিক ছটাছুটি করেছে। নাটক শুরু হয়েছিল নিয়মিত প্রদশর্নী করার উদ্দেশ্য নিয়ে এবং পুরানো নাট্যরীতির বিরুদ্ধতা করে। কিছু পরে নাটককে তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার কথা বলেছে। দশ বছরের মাথায় অনেক তাকে শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ার করে তুলতে চেয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শেষে এসে শ্রেণীসংগ্রাম বাদ দিয়ে তারা নাটককে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষে গড়ে তুলতে চেয়েছে। কিছুদিন পর পুনরায় নতুন শ্লোগান তুলেছে নাটক করবে শেকড় সন্ধানে। পাশাপশি আবার নাটককে করে তুলতে চেয়েছে পেশাদার; জীবন জীবিকার উপায়। সত্যিকারভাবে প্রকৃত নাট্যচর্চার চেয়ে এসব শ্লোগানই ছিল নাট্য আন্দোলনের প্রধান দিক। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানকে ঘিরেই চলছিল এসব। সস্তা শেকড়ের সন্ধান করতে গিয়ে তারা প্রসেনিয়ামের বিরোধিতা করেছে প্রসিনিয়ামের মধ্যে আটকে থেকেই। সকলেই সেখানে সত্যিকারভাবে কী চেয়েছিল এখন হয়তো স্মরণ করতেও পারবেন না।

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ১৯৯৮ সালে এক নাট্যোৎসবের আয়োজন করে এবং সে উৎসবে মোট সাতান্নটি নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। যার মধ্যে ১৯টি নাটকের বিষয়বস্তু রচিত হয়েছল মুক্তিযুদ্ধ, ফতোয়াবাজি, রাজাকারদের উত্থান ও সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি নিয়ে। নাটকগুলো হচ্ছে থিয়েটার প্রযোজিত আবদুল্লাহ আল-মামুনের ‘মেহেরজান আর একবার’, ঢাকা নান্দনিক প্রযোজিত টুলু হাবীবের গল্প অবলম্বনে সৈয়দ মহিদুর রহমানের নাট্যরূপ ‘ঘা’, ঢাকার সময় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী প্রযোজিত ও মান্নান হীরা রচিত ‘ভাগের মানুষ’, চট্টগ্রামের তির্যক নাট্যগোষ্ঠী প্রযোজিত ও শেখর সমাদ্দার রচিত ‘তীর্থযাত্রা’, নারায়ণগঞ্জ থিয়েটার প্রযোজিত ও কুতুবউদ্দিন আহমেদ রচিত ‘ঘর থেকে ঘরে’, ঢাকার থিয়েটার সেন্টার প্রযোজিত ও মাসুম রেজা রচিত ‘শামুক বাস’, ঢাকার পদাতিক নাট্য সংসদ প্রযোজিত ও গোলাম সারোয়ার রচিত ‘ক্ষেতমজুর খইমুদ্দিন’, ঢাকার থিয়েটার আর্ট প্রযোজিত ও আজিজুস সামাদ রচিত ‘বৃত্ত’, চট্টগ্রামের অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায় প্রযোজিত ও শান্তনু কায়সার রচিত ‘সাজন মেঘ’, হবিগঞ্জের জীবন সংকেত নাট্যগোষ্ঠী প্রযোজিত ও হুমায়ুন আহমেদ রচিত ‘১৯৭১’, ঢাকা সুবচন নাট্য সংসদ প্রযোজিত ও মামুনুর রশীদ রচিত ‘রাষ্ট্র বনাম’, সংলাপ গ্রুপ থিয়েটার প্রযোজিত ও রফিকুল আলম রচিত ‘মানব সুরৎ’, ঢাকা থিয়েটার মঞ্চ প্রযোজিত ও কৃষণ চন্দরের গল্প অবলম্বনে মাসুম আজিজ রচিত ‘কাঠের গড়া’, বরিশালের খেয়ালী থিয়েটার গোষ্ঠীর প্রযোজিত ও মিন্টু বসু রচিত ‘গৌরব গাঁথা’, কুষ্টিয়ার অনন্যা‘৭৯ নাট্যদল প্রযোজিত ও সুনীল কুমার রচিত ‘আশ্রয়’, রংপুর থিয়েটার প্রযোজিত ও শেখ আকরাম আলী রচিত ‘এখনো যুদ্ধ’, চট্টগ্রামের অঙ্গন থিয়েটার প্রযোজিত ও সনজিব বড়ুয়া রচিত ‘পাথর প্রতিমা’ ইত্যাদি। বাংলাদেশে সেসময়ে সেই ১৯টির বাইরে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে বহু নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখা যায়। যার মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের অরিন্দম প্রযোজিত সৈয়দ শামসুল হকের ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, থিয়েটার প্রযোজিত অবদুল্লাহ আল-মামুনের ‘দ্যাশের মানুষ’, থিয়েটার আর্ট রিপারটরী প্রযোজিত আজিজুস সামাদের বিদেশি গল্প অবলম্বনে রচিত ‘কীর্তিনাশা’, ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত নাসির উদ্দীন ইউসুফের ‘একাত্তরের পালা’, সময় সাংকৃতিক গোষ্ঠী ও পাবনা ড্রামা সার্কল প্রযোজিত মান্নান হীরার ‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’, চট্টগ্রাম থিয়েটার প্রযোজিত দীপক চৌধুরীর ‘আবার যুদ্ধ’, খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটার প্রযোজিত মিন্টু বসু রচিত ‘ঘাতক চারদিকে’ ও ‘ঐ মহামানব আসে’ এ রকম বহু নাম বলা যাবে ।

নাটকগুলির কথা বলা হলো কেন? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা নাটকগুলি কি সত্যি আর কখনো মঞ্চস্থ হবার সম্ভাবনা আছে? গ্রীক নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে দুই-আড়াই হাজার বছর ধরে, শেক্সপিয়ারের নাটক চারশো বছর ধরে। ইবসেন, বালজাক, শিলার, আর্থার মিলার, গলসওয়ার্দি, চেকভ, ব্রেশট প্রমুখের নাটক সারা দুনিয়ায় বর্তমানেও মহাসমারোহে মঞ্চস্থ হয়। বাংলাদেশের উল্লিখিত নাটকগুলির কি সামান্য সম্ভাবনা রয়েছে যে, নিজের দেশেই আবার মঞ্চস্থ হবে? বাংলাদেশের নাট্যচর্চা বা নাট্য আন্দোলন নিয়ে তাহলে এত গর্ব বা আদিখ্যেতা কীসের? যাদের নাটক দু-দশ বছর পর আর মঞ্চস্থ হবে না, কী নিয়ে তাঁদের নাট্যচর্চার অহঙ্কার? নাটকগুলির কি বাংলা ভাষার ইতিহাসে কোনো সাহিত্য মূল্য আছে? নাটকগুলি কি প্রকাশকরা ভবিষ্যতে আবার নাটক হিসেবে মুদ্রণ করবে? নাটকগুলির প্রশংসা করে কি ভবিষ্যতে সভা সেমিনার হবে? যদি তাই না হয়, তাহলে কোন রচনাগুলিকে মুক্তিযুদ্ধের নাটক বলা হচ্ছে? মুক্তিযুদ্ধের উৎসব নাম দিয়ে কী মানের নাটক প্রদর্শিত হয়েছে? সবটা কি এখন প্রশ্ন হিসেবে সামনে আসার কথা নয়? নাটকের বিচার হবে তো সময়ের বিচারে, ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিত এবং শিল্প-সাহিত্যের মানদণ্ডে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলদেশের রচিত নাটক কেন দর্শক পায় না? ভিন্ন দিকে শেক্সপিয়ার, ইবসেন, ব্রেশট প্রমুখের নাটক মঞ্চস্থ হয়েই চলেছে। প্রশ্নটার মুখোমুখী কি একবার দাঁড়াবেন বাংলদেশের গর্বিত নাট্যবোদ্ধারা? বিশ্বের নাট্যচর্চার ইতিহাসে তারা কী অবদান রেখে যাচ্ছে যার জন্য বাকিদের আনন্দিত হতে হবে? কিছু নিয়ে হৈ চৈ করার আগে নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করা দরকার। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের নাটক নিয়ে প্রশ্নটা সর্বদা সামনে থাকা দরকার লড়াইটা কেন হয়েছিল?

মানুষের মূল লড়াইটা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বাঁচার লড়াই। মুক্তির লড়াই। সেটা কখনও ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের চেহারা ধরে আসে, কখনো ভারতের স্বাধীনতা হিসেবে, কখনও পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলন হিসাবে, কখনো পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমালোচনা হিসেবে, কখনও মুক্তিযুদ্ধ হিসাবে। যুদ্ধটা সেখানে প্রধান নয়, মানুষের মুক্তিটাই প্রধান। মুক্তিযুদ্ধের সার্থকতা সেখানে শুধু যুদ্ধে বিজয়ের ভিতরে নয়, জনগণের সত্যিকারের মুক্তিলাভের মধ্যে। সংগ্রামটা বা যুদ্ধটা সেখানে উপলক্ষ্য, মুক্তিটাই লক্ষ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিচার হবে সেই প্রেক্ষিত থেকে। যে-মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই সেই মানুষের মুক্তি ঘটেছে কি না? জনগণ তাদের কাঙ্ক্ষিত সুখ, সমৃদ্ধ জীবন লাভ করেছে কি না? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাটকে সে প্রসঙ্গটাই প্রাধান্য পাবার কথা। কিছু মানুষ ক্ষমতা পেয়েছে, পদক পেয়েছে, বড় বড় ব্যবসা পেয়েছে, গাড়িবাড়ির মালিক হয়েছে, রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে বসে ইফতার খাচ্ছে বলেই, মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়ে যায়নি। বৃহত্তর জনগণের অবস্থাটা কি সেটাই প্রধান বিবেচ্য। সকলেই তারা মন খুলে কথা বলার মতো বাক-স্বাধীনতা পেয়েছ কি না, খাদ্য-বাসস্থান, চিকিৎসা আর শিক্ষালাভের অধিকার পেয়েছে কি না; সেটাই হচ্ছে বিচার্য। কিন্তু বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগণের জীবন আর রাজধানী ঢাকা শহরের কিছু মানুষের জীবন যাপনে আকাশ পাতাল পার্থক্য। পাকিস্তানের তেইশ বছরের শাসন থেকে তাহলে এখনকার সময়টা আলাদা কোথায়?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করার জন্য যাঁরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, তাঁদের পঁচাশি ভাগ ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষ। শ্রমিক-কৃষক, কামার-কুমার। গত পঞ্চাশ বছরে তাঁদের ভাগ্যে কী পরিবর্তন এসেছে? স্বাধীনতার জন্য জানপ্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করে তাঁরা কি পেয়েছেন? কিন্তু নাটকের সঙ্গে যুক্ত নাট্যব্যক্তিত্বদের অনেকের জীবন স্বাধীনতার আগে কেমন ছিল আর স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বা পরিসংখ্যান বলছে, সরাসরি যুদ্ধ করেছেন এমন ভদ্রলোক মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল পনেরো শতাংশ। শিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারে কাজ করেছেন, কিংবা যুদ্ধেরমাঠে হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা অনেক যুদ্ধে যাবার জন্য প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করতে করতে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। বাকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকরা কেউ কলকাতায় ঘুরেফিরে কাটিয়েছেন, দিল্লিতে গিয়ে কেউ স্কলারশিপ নিয়ে ভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বহু শিক্ষিত ভদ্রলোকরা পাকবাহিনীর অধীনে বাংলাদেশের বহু প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সকলেরি তাঁদের ভাগ্য পাল্টেছে। ভাগ্য পাল্টায়নি সেই পঁচাশি শতাংশ নিরক্ষর বা নিম্নবর্গের মুক্তিযোদ্ধাদের। ভাগ্য পাল্টায়নি সেইসব বিরাট সংখ্যক কৃষক-শ্রমিকদের, যুদ্ধের সময়ে যাঁরা চাষাবাদ করে বাংলাদেশের মানুষকে খাইয়ে পরিয়ে রেখেছিলেন। যাঁদের পরিশ্রমের কারণে যুদ্ধের পরের বছর দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়নি।

স্বাধীন দেশে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিলেন রাজধানী সহ বড় বড় শহরের শিক্ষিত মানুষরা, মুক্তিযুদ্ধে তাঁরা অংশ নিক আর না নিক; ভাগ্য তাঁদেরই বেশি খুলে গিয়েছিল। যাঁরা ছিলেন তরুণ, মেধাবী, অভিজাত এবং যুবক, যুদ্ধে না গিয়েও খুব সম্মানজনক আসন পেলেন তাঁরা। কারণ তাঁদের শ্রেণীটিই রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতো। হতদরিদ্র রাজাকাররা শাস্তি পেল, ভদ্রলোক রাজাকাররা পেল সম্মান। স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার পদক পর্যন্ত পেয়েছে তারা। কারণ তাঁদেরকে অপরাধী প্রমাণ করার সাহস অনেকের ছিল না তাদের পারিবারিক গুরুত্বের কারণে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিয়ে নয়মাস বিশ্ববিদ্যালয়ে  চকিরি করেছেন, পাকবাহিনী হুকুম মেনে চলেছেন, স্বাধীনদেশে তাঁরা হলেন বুদ্ধিজীবী। সমাজের মাখনরুটি খাওয়া লোকগুলি নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের সুফল ভোগ করলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে সামগ্রিকভাবে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি ছিল, কিছুই পেলেন না তাঁরা। কিন্তু তথাকথিত শিক্ষিত-সংস্কৃিতবানদের তা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না, নিজেরা হালুয়া রুটির ভাগ পাবার জন্য নানা পথ ধরলেন। নাটকে মুক্তিযুদ্ধ বেচাকেনা শুরু হলো নিজেদের আখের গোছাবার জন্য। কিন্তু স্বাধীনতা সম্পর্কে একটি সঠিক সত্যবাক্য উচ্চারণ করলেন না। যুদ্ধে না গিয়েও এঁরা অনেকে মুক্তিযুদ্ধের বড় প্রেমিক হয়ে দাঁড়ালেন।  যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাটকের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের, মুক্তিযুদ্ধের মূল আকাঙ্ক্ষার সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারেনি বলেই, নাটকগুলি আর টিকবে না। কালজয়ী হবার সামান্য সম্ভাবনা রইলো না।

ব্রিটিশ শক্তি ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর করে ১৯৪৭ সালের পনেরই আগস্ট, ভারতের স্বাধীনতা লাভের সেই দিন কলকাতা শহরে স্বাধীনতা উৎসব চলছিল। উৎসব পালনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছল কংগ্রেস দল। সেদিনই শিশির কুমার ভাদুড়ীর পরিচালনায় শ্রীরঙ্গম মঞ্চে ‘দুঃখীর ইমান’ নাটকটি দেখানো হয়। সেই নাটক মঞ্চায়নের আগে শিশির কুমার একটি বক্তব্য রেখেছিলেন। শিশির কুমার জানতেন প্রেক্ষাগৃহের বাইরে তখন জনতা ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে উল্লাস করছে। তা জেনেও তিনি বলেছিলেন, ‘এ স্বাধীনতা পূর্ণ স্বাধীনতা নয়। অস্ত্র এখনো মাউন্টব্যাটেনের হাতে।’ শিশির কুমারের এই বক্তৃতায় দর্শক সেদিন উল্লাস প্রকাশ না করলেও আপত্তি করেনি। ঠিক পরের বছর স্বাধীনতা দিবসে তিনি বললেন, ‘এ স্বাধীনতা  ভুয়া স্বাধীনতা’। মধ্যবিত্ত দশর্কদের ততোদিন স্বাধীনতা সম্পর্কে পূর্ণ মোহভঙ্গ হয়েছে। সেজন্য পরবর্তী স্বাধীনতা দিবসে তিনি নাটক মঞ্চায়নের আগে বলেন, ‘আজ দুঃখের দিন, স্বাধীনতা দিবস নয়। স্বাধীনতা কোথায়? দেশ বিভক্ত হয়েছে, এক বাঙালী, এক পাঞ্জাবী আজ দুই রাষ্ট্রে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণ লোকের খাদ্যের কথা বিচার করুন। দেশে আজ দুর্ভিক্ষের অবস্থা, রেশনের চালে পাথর খেয়ে খেয়ে রেশনের এলাকার লোকেরা পেটের রোগে মরণাপন্ন। ফলে দেশের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে। মানুষ যদি মানুষের মতন খেতে এবং বাস করতে না পারে কিসের স্বাধীনতা?’ শিশির কুমার মার্কসবাদী ছিলেন না। তিনি ছিলেন উদারনৈতিক মতবাদের প্রবক্তা। সেই তিনিও মানুষের দুঃখে স্বাধীনতা সম্পর্কে বারবার প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা শ্রমিক-কৃষক ও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ দেখেও স্বাধীনতার মাহাত্ম্য প্রচার করে গেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের কেন উত্থান ঘটলো সেটাই ছিল নাট্যকারদের মূল ক্ষোভ। নিজশ্রেণীর ভদ্রলোকদের লুটপাট নিয়ে কিছুই বললেন না।

স্বাধীন দেশে বিরাট জনগোষ্ঠী না খেয়ে আছে কেন, শ্রমিক-কৃষকের মুক্তি ঘটছে না কেন সে প্রশ্ন তাঁরা তোলেননি। শ্রমিক-কৃষকদের মুক্তির প্রশ্ন বাদ দিয়ে কোনো নাটকই ইতিহাসের দৃষ্টিতে রাজনৈতিক নাটক হতে পারে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নাটক সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার সম্পূর্ণ বাইরে ছিল। সকলের নানা কথার আস্ফালন ছিল, কিন্তু সমাজের প্রতি সত্যিকারের দায় ছিল না। নাট্যব্যক্তিত্বরা সম্পদ বানাতে ব্যস্ত ছিলেন কিন্তু মুখে ছিল মুক্তিযুদ্ধের সস্তা বাণী।  বুর্জোয়া একটি রাষ্ট্রে যারা বুর্জোয়াকে মূল শত্রু হিসাবে না দেখে, বাজার সংস্কৃতিকে আক্রমণ না করে, বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সমালোচনা না করে একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে; তাঁরা বৃহৎ জনগণের মুক্তিসংগ্রামেরই বিরোধিতা করে। বাজার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়বার সাহস বা মানসিকতা কোনোটাই তাঁদের ছিল না। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ভিতরে তাঁরা চেয়েছিলেন যেনতেন প্রকারে নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠা। মুখে রাম নাম, কিন্তু লক্ষ্যটা সকলকে পিছনে ফেলে নিজের উপরে উঠবার সিঁড়িটাকে কাজে লাগানো। ফলে পদক, পুরস্কার, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পিছনে সারাক্ষণ ছুটে বেড়ানো। কিন্তু নিজের দেশপ্রেমিক চেহারাটা ঠিক রাখতে সকল সময়ে মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে চলছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বা দালাল রাজাকার ও মৌলবাদ বিরোধিতার নাটক মঞ্চায়নের প্রশ্নে রাজশাহীর অনুশীলন নাট্যদলের মলয় ভৌমিক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের কথা নাটকে উল্লেখ থাকলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিফলিত হবে এমন ধারণা করার কোনো কারণ নেই। সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার শৈল্পিক প্রতিফলন নাটকে ঘটানো গেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তিনি আরো বলেন, ‘দর্শককে বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী করে তোলা এবং সুস্থ জীবনবোধ সম্পর্কে ধারণা দেয়া যদি নাটকের সাধারণ লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে নাটকে স্বৈরাচার ও মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন পৃথকভাবে করার প্রয়োজন পড়ে না। এ ধরনের পৃথকীকরণ নাটককে চটুল রাজনৈতিক শ্লোগানে পরিণত করে যা ইদানিং বাংলাদেশের অনেক নাটকে দেখা যাচ্ছে। দর্শকের চিন্তাশক্তি ও বিশ্লেষণী ক্ষমতাকে এসব নাটক এড়িয়ে যায়; প্রকারান্তরে যা স্বৈরাচার ও মৌলবাদকেই শক্তিশালী করতে পারে।’ খুব গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন মলয় ভৌমিক।  তিনি ১৯৯০ সালে দেয়া ঐ সাক্ষাৎকারে আরো উল্লেখ করেন, দুই দশক ধরে এদেশে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার পরও সাধারণ গ্রামীণ জনসমাজে এর প্রভাব উল্লেখ করার মতো নয়।

চট্টগ্রামের অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের কর্ণধার ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি শিশির দত্ত প্রশ্ন তোলেন, নাটকে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অবক্ষয়ের যে সকল কথা এসেছে সামাজিকভাবে তা কতোটুকু প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে? তিনি মনে করেন, এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টিকে দেখলে উৎসাহী হবার মতো তেমন কাজ খুব একটা চোখে পড়ে না। বেশি কাজ হয়নি বলেই দুই একটা যা হয়েছে তাকে অনেকেই খুব বড় করে দেখছে। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের যথাযথ চেতনা যেখানে সবখানে ভুলুণ্ঠিত সেখানে আমাদের নাটকেই কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংরক্ষিত হয়েছে বা হচ্ছে এমনটি ভাবা কি সঠিক হবে?’ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ ও স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রসঙ্গে মঞ্চায়িত নাটক সম্পর্কে উষ্মা প্রকাশ করেন নরসিংদীর সংকেত নাট্যগোষ্ঠীর তপন দাস। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম সুকৃতি হিসাবে গ্রুপ থিয়েটার চর্চাকে আখ্যায়িত করা যায় না। নাট্যকার, নাট্যকর্মী, নাট্যগোষ্ঠী ও নাটক অধিকাংশই ভুলপথ যাত্রী। তিনি আরো বলেন, নাটক যদি সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হয় তাহলে প্রথমে প্রশ্ন আসে আমাদের শত্রু-মিত্র কে? কাকে আমরা সেই হাতিয়ার বা নাটক দিয়ে আঘাত করবো। শুধু স্বৈরাচার বা মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে কি আমাদের চূড়ান্ত মুক্তি আসবে? তবুও কিছু কিছু নাট্যকার তাদের নাটকে স্বৈরাচার ও মৌলবাদ বিরোধী বক্তব্য তুলে ধরেছেন, তা নিজেকে জাহির করার স্থূল লক্ষ্যেই করে থাকেন।

মুক্তিযুদ্ধের এসব নাটক প্রসঙ্গে মামুনুর রশীদ এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়টি খুবই আপেক্ষিক এবং ব্যাপক। যদি মৌল আদর্শের কথা বলি তাহলে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বারবার লংঘিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক করলেই এই চেতনা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হবে এ কথা ভাবা যায় না। বরং বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটকগুলিতে একেবারেই উল্টো কিছু বিষয় চলে এসেছে। তিনি বলছেন, চেতনার বিষয়টি আরো গভীর এবং চেতনাকে যাঁরা ধারণ করবেন তাঁদের প্রশ্নটাও এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একথাও স্বীকার করেন, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে চিৎকার করাটা অদ্যাবধি একটা ফ্যাশনের অংশ।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও ঢাকা পদাতিক নাট্যদলের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কুদ্দুস এ ব্যাপারে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নাটকে প্রতিফলিত কি না এ বিষয় আলোচনার আগে বুঝতে হবে সত্যিকারভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? এই মৌলিক বিষয়টিকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই নিজ নিজ শ্রেণী ও দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করছে। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের চেতনাকে আত্মস্থ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারলেই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনা নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। তিনি বলছেন, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক শোষণ-নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থানের অধিকার আদায় বা শোষণমুক্ত সার্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার অধিকার ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই মূলতঃ মুক্তিযুদ্ধের মৌলচেতনা। তিনি ১৯৯০ সালে দেয়া ঐ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের নাটক সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন, ‘বর্তমানে নাটকের দল এবং নাটকের সংখ্যা অনেক হলেও সে তুলনায় বলিষ্ঠ বক্তব্য সম্পন্ন মঞ্চ নাটক আমরা কটা পেয়েছি? আসলে আমরা যদি রাজনৈতিকভাবে সচেতন না হই বা সত্যিকারের জনকল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থাকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হই তবে মুক্তিযুদ্ধের মৌলচেতনাকে পূর্ণাঙ্গভাবে মঞ্চে উপস্থাপন সম্ভব নয়। কারণ লক্ষ্য নির্ধারিত না থাকলে উদ্দেশ্যবিহীন কর্ম কখনো সুফল বয়ে আনে না।’

মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগীশ্রেণীর নাট্যকার ও নাট্যকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের নাটক নিয়ে হৈ চৈ করলেও তাঁরা যে সে ব্যাপারেও আন্তরিক ছিলেন না তারও প্রমাণ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের কথা ঘোষণায় বলা হলেও সে সময়ের দলগুলো যে সত্যিকারভাবে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে নাটক মঞ্চস্থ করছিল পরবর্তীতে তা ধরা পড়বে। মুক্তিযুদ্ধ শব্দটিকে তাঁরা যতো গালভারি বুলি হিসাবে ব্যবহার করেছেন, দেখা যাবে তাঁদের নিষ্ঠা সেভাবে প্রমাণিত হয়নি। মূলত নাটক মঞ্চায়নে তারা নানাভাবে দর্শকদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করেছে। সেজন্য সুযোগ পেলেই তারা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্যবিহীন হাসির নাটক মঞ্চস্থ করেছে, যা অনেক সময় রুচির দিক থেকেও ছিল নিম্নমানের। একইভাবে তারা রাজনৈতিক বক্তব্যবিহীন তথাকথিত লোকনাটক মঞ্চস্থ করার ব্যাপারেও ছিল সমানভাবে আগ্রহী, যে-সকল লোকনাটক কুসংস্কার ও ধর্মীয় প্রভাব দ্বারা ছিলো আচ্ছন্ন। নাট্যদলগুলোর চিন্তার স্ববিরোধিতা ধরা পড়ে তাদের লোকনাট্য মঞ্চায়নে। মুক্তিযুদ্ধের নাটকে যেখানে তারা কুসংস্কার ও ধর্মীয় অনুশাসনকে আঘাত করেছে, লোকনাটকে আবার তারা সেগুলিকেই প্রচার করেছে। বিশ শতকের পুরা নাট্যচর্চাই ছিল নানা স্ববিরোধিতা দিয়ে ভরা। কারণ নাট্যকলা নামক শিল্পটা যে কী সে সম্পর্কে কারোই স্পষ্ট ধারণা ছিল না বলেই মনে হয়। সম্ভবত তাঁদের সঠিকভাবে জানা ছিল না বিশ্ব নাটকের ইতিহাস।