স্বাধীন খসরু

স্বাধীন খসরু

স্বাধীন খসরুর গদ্য ‘বাংলাদেশে ১৭ দিন ও ধমনী কাঁপানো মৃত্যু সংবাদ’

প্রকাশিত : মার্চ ০২, ২০২৫

বেসরকারি একটা বিজ্ঞাপনের কাজ নিয়ে ২০২৪ এর নভেম্বর মাস থেকে একটা বিজ্ঞাপন এজেন্সির সাথে কথা হচ্ছে। কোনোভাবেই আমি ওই মুহুর্তে দেশে যেতে চাচ্ছিলাম না। যত না করছি তত বিভিন্ন মাধ্যমে, বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ফোন আসছে। এজেন্সি থেকে শুরু করে সবার একই চেষ্টা আমাকে রাজি করানো। সাথে নানান রকমের আকর্ষণীয় কথা। এরপর শুরু আমার দুই অগ্রজ সহশিল্পী ডা. এজাজ ও ফারুক আহমেদের কথোপকথন, আমাকে রাজি করানো।

প্রথমে তারিখ দেয়া হলো ২০২৫ এর ৫ জানুয়ারির। এরপর ১০ জানুয়ারি। আমি কোনোভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। সাথে দেশ-বিদেশে আমার পরিচিত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই মানা করছে দেশে না যেতে। এদিকে সবার মানা করাতে আমার নিজের মধ্যে এক ধরনের জেদ কাজ করতে শুরু করলো। ভাবতে শুরু করলাম, আমি আমার নিজের দেশে যাব, সবাই মানা করছে কেন? আমি তো ক্রিমিনাল নই। রাজনৈতিক অস্থিরতা বা পরিস্থিতির জন্য যারা রাজনীতি করে, তারা দায়ী। আমি দলীয় রাজনীতি করি না বা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যও নই। কোনো দলের সুবিধাপ্রাপ্ত কিংবা সুবিধাভোগীও নই। তাহলে এর দায়ভারও আমার নয়।

কারো সাথে এ বিষয়ে আর কোনো কথা না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, আমি দেশে যাব, কাজটা করবো। এরপর থেকে কেউ জিজ্ঞেস করলে বা কারো সাথে কথা হলে আমি নিজেই বলি, না, দেশে যাচ্ছি না বা এই মুহূর্তে যাওয়া ঠিক হবে না। শুভাকাঙ্ক্ষীদের সবারই সম্মতি পাওয়া যায় নির্দ্বিধায়। তারিখ ঠিক করা হলো, ২০ জানুয়ারি। তেমন কাউকে বলিনি বা জানাইনি তারিখটি। এরপর থেকে দিন গুণতে থাকি আর প্রতিদিন ভাবি, কালকেই টিকেট বুকিং দিয়ে দেব। কিন্তু দেয়া আর হয় না।

এর মধ্যে কয়েকদিন ধরে দেশ থেকে ফোন আসছে না। আমিও নিজ থেকে আর ফোন করছি না। আমি মোটামুটি দ্বিধায় আছি, এদিকে সম্মতি জানিয়েছি। কিন্তু এজেন্সি থেকে ফোন না আসার কারণ বুঝতে পারছি না। নাকি প্রজেক্ট বাতিল! হঠাৎ ম্যাসেজ আসলো শুধু, ‘ভাই’। ম্যাসেজ পাওয়ার পর ওই দিন ফোন করা হয়নি। ধরে নিলাম, প্রজেক্ট বাতিল। কিন্তু ওই মুহুর্তে না শোনার জন্য আমি তৈরি নই। পরের দিন যথারীতি ফোন আসলো এজেন্সি থেকে। জানানো হলো, তারিখ পেছানো হবে। আবার নতুন করে তারিখ ঠিক করা হবে, এক সপ্তাহের মধ্যে। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস না করে ধরে নিলাম, কাজটি আর হচ্ছে না।

পরের দিন ডা. এজাজ ভাইয়ের সাথে কথা হলো। বললেন, এটা আর হবে না। কারণ জানতে চাইলে বললেন, দুইবার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। আগের অভিজ্ঞতা থেকে দৃঢ়তার সাথে তিনি বললেন, কাজটি হবে না। বললাম, এক সপ্তাহ সময় চেয়েছে এবং নিশ্চিত করেছে, একটু অপেক্ষা করুন।

এক সপ্তাহ লাগেনি। চারদিন পরই ফোন আসলো নতুন আরেকজনের কাছ থেকে। পরিচয় পেলাম নুহাশের সহযোগী কাস্টিং ডাইরেক্টর গাজী রাতুল। কথা হলো বিকাশের মার্কেটিংয়ের রায়হান ভাইয়ের সাথে। জানতে পারলাম, আগের এজেন্সির পরিবর্তে এখন কাজটি করবে Long Story থেকে নুহাশ হুমায়ূন। শুনে অনুভূতিতে এক ধরনের আনন্দ যোগ হলো। বাবার তৈরি করা জনপ্রিয় ও জননন্দিত তিন চরিত্রকে নিয়ে ছেলে কাজ করবে। এর মধ্যে নুহাশ তার নিজস্ব স্বকীয়তায় তার কাজে সে অত্যন্ত সফল। অসংখ্য বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ ও ওটিটি প্লাটফর্মের জন্য ওয়েব সিরিজ করেছে। সে তার নিজের কাজের এক অনন্য ধারা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

উৎসাহ বেড়ে গেল অনেক গুণ। নুহাশের সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয় না। এরপর নুহাশ কাজ শুরু করার পর এখনো তার সাথে কাজ করা হয়নি। তবে সবসময় নুহাশ কী করছে, ফলো করার চেষ্টা করি, দেখি। তার যেসমস্ত কাজ আমি দেখেছি তাতে আমি তার একজন গুণমুগ্ধ দর্শক। সে তার নিজস্ব স্বকীয়তা ও ভঙ্গিমায় সচল।

শুটিংয়ের ও ফটোশুটের তারিখ ঠিক করা হলো। ৬ ফেব্রুয়ারি আমি উড়াল দিলাম আকাশপথে, পৌঁছলাম ৭ তারিখ। যথারীতি একটানা পাঁচদিন ৯ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি সফলভাবে শুটিং সম্পন্ন হলো মহা আনন্দ, উৎসাহ আর উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। শুটিং শেষ হয় ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় জয়দেবপুর ধীরাশ্রম ট্রেন স্টেশনে। শুটিং শেষে সবার গন্তব্য ঢাকা আর আমি চলে গেলাম নুহাশ পল্লীতে, কাউকে না জানিয়ে। অনেক দিন যাওয়া হয়নি, থাকা হয়নি।

নুহাশ পল্লীর সেই সব পুরোনো কর্মচারী ও ম্যানেজার বুলবুল ভাই আমাকে পেয়ে মনে হলো বুকে টেনে নিলেন। বাংলোর সেই আমার রুম আয়নাঘর খুলে দেয়া হলো। মহা আনন্দে থাকলাম চারদিন। মনে পড়লো অনেক স্মৃতি। চারদিন শুধু নুহাশ পল্লী নিজের মতো করে হাঁটাহাঁটি করলাম আর মোবাইল ফোনে ছোট ছোট ক্লিপ্স ধারণ করলাম।

১৭ ফেব্রুয়ারি গন্তব্য পরিবর্তন করে বুলবুল ভাইয়ের সাথে চলে গেলাম ঈশ্বরদী, পাকশি। দুইদিন থাকা হলো ওখানে, থাকলাম পাকশি ইকো রিসোর্টে। ১৯ তারিখ ভোরে চলে এলাম ঢাকায়। কারণ, ২০ তারিখ সারাদিন ফটোশুট আছে। ফটোশুট করতে গিয়ে জানতে পারলাম, ওইদিন দুপুর আড়াইটা থেকে বিকাশের যে পাঁচটি বিজ্ঞাপন করেছি, প্রথমটি চলবে T-sports সহ দেশের প্রথম সারির সবক’টি টিভি চ্যানেলে। T-sports চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশ বনাম ভারতের খেলা দিয়ে বিজ্ঞাপন শুরু।

২০ তারিখ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফটোশুট শেষে উঠলাম বন্ধু মেজর মংয়ের বাসায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। মং আমার জন্য বান্দরবান থেকে ঢাকা চলে এসেছে। মংয়ের বাসায় শেষ ৩ দিন ভালোই কাটছিল, সেখানে মেজর আসিফ ও আরেক বন্ধু, প্রিয় দাদা তপন মজুমদারের সাথে। হঠাৎ একটি মৃত্যু সংবাদ ধমনী কাঁপিয়ে দিলো।

ড. সৈয়দ শরিফুল ইসলাম, আমার বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু। লন্ডন কুইন মেরী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে PHD করে, রয়েল লন্ডন কুইন মেরী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। তারপর বাংলাদেশে গিয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ডীন অবস্থায় অবসর গ্রহণ করেন।  আমি লন্ডন থেকে যাওয়ার আগে ফোনে কথা হয়, দেশে পৌঁছে ফোন দেব। ঠিকই ৭ তারিখ ফোন করি। ধরেন শরিফ ভাইয়ের এক বন্ধু ফনি ভাই। জানতে পারি, শরিফ ভাই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন গ্রীন রোডে।

 ৮ তারিখ রাতে আমি ঢাকার বাইরে চলে যাই। কারণ, শুটিং আছে। প্রায় প্রতিদিনই ফোন করি ম্যাসেজ রাখি কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। ২০ তারিখ আমার ফটোশুট শেষে শরিফ ভাইয়ের নম্বরে ফোন করি, উত্তর পাইনি। ফোন করি ফনি ভাইকে। জানতে পারি, শরিফ ভাইকে ভর্তি করা হয়েছে এবার কেয়ার হাসপাতালে। শরীরের অবস্থা যা শুনলাম, শুনে হতবাক! তন্দ্রার মধ্যে আছে শরিফ ভাই। ফনি ভাই বললেন, যদি পারেন কালকে এসে দেখে যাবেন।

ফনি ভাইয়ের কথামতো পরের দিন চেষ্টা করলাম, কিন্তু হাসপাতালে এখন অনেক রেস্ট্রিকশন থাকায় ভেতরে যাওয়া সম্ভব হয়নি এবং ফনি ভাইকেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পরের দিন ভোরে ঘুম ভাঙার আগেই ফোনে ম্যাসেজ পেলাম অপরিচিত নাম্বার থেকে, শরিফ ভাই আর নেই!

সারা শরীর কেঁপে উঠলো। মনে হলো, আমি হয়তো তন্দ্রাতে আছি। এই অপরিচিত নাম্বার থেকে ভুল ম্যাসেজ আসছে। ঝিম মেরে বসে থাকলাম, দুই চোখে অশ্রু। কথা ছিল, দেশে পৌঁছেই ফোন দেব। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল থেকে অবসর নেয়ার পর কিশোরগঞ্জে খামার প্রকল্প করেছেন, ওখানে আছেন। আমার শুটিং শেষে ঢাকা এসে ওখানে নিয়ে যাবেন, ৩/৪ দিন ওখানে থাকবো।

খামারে যাওয়া হলো না। দেখা হলো না। চলে গেলেন চিরকালের জন্য না=ফেরার দেশে। ভালো থাকুন শরিফ ভাই। আত্মার শান্তি কামনা করি।

মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্র শরিফ ভাই। প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রাক্তন এলজিআরডি মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কনিষ্ঠ ভ্রাতা।

লেখক: অভিনেতা