স্বপ্নপূরণের শাস্তি
সুলতানা পারভিনপ্রকাশিত : আগস্ট ১৪, ২০১৮
১৯৭১ সাল। চারদিকে যুদ্ধ। শহরে, গ্রামে— সবখানে।
আমার বয়স মাত্র চৌদ্দ। বাবা প্রায় তাড়াহুড়ো করেই বিয়ে দিলেন। কেন দিলেন, কার সাথে বিয়ে হলো, কী করব— কিছুই জানা ছিল না। শুধু জানা এতটুকুই ছিল, বিপদ! বড্ড বিপদ। কিন্তু যেখানে যাচ্ছি সেখানে যে বিপদ নেই, এই নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারে না।
মার্চের শেষ। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে চললাম শ্বশুরবাড়ি। সাথে মানুষজন বলতে আমার নতুন বর। যার হাতে আধো আলোর একটা হারিকেন। চোখমুখে ভয়। আমার সামনে দু’কদম আগে হাঁটছে মানুষটা।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কই যাইতেছি?
কথাটা শুনে মানুষটা হঠাৎই চমকে গেল। বলল, কথা বইলো না। তাড়াতাড়ি পা চালাও। সূর্য ওঠনের আগে বাড়ি পৌঁছাইতে হবে।
রাত থাকতেই শ্বশুরবাড়ি পৌঁছলাম। এত তাড়ার কী ছিল সেটা তখন না বুঝলেও পরে বুঝলাম। যে ভয়ে বাবা বিয়ে দিলেন তাড়াহুড়োয়, সেই ভয়েই স্বামী তার নতুন বৌকে পাঁচ ক্রোশ পথ একনাগাড়ে হাঁটিয়ে আনলেন। আমি পাড়াগাঁয়ের এক কৃষকের মেয়ে। এখন পরিচয়, আমি এক কৃষকের বউ। তাতে কোনো আপত্তি নেই। আমি এক গৃহস্থ বাড়ির বউ। গৃহস্থদের বউদের এত পরিচয় থাকতে হয় না। তাদের জন্মই হয় প্রথমে বাবার পরিচয়ে বড় হওয়ার জন্য, স্বামীর পরিচয়ে ঘর করার জন্য, আর সন্তানের পরিচয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার জন্য।
শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা, সবাইকে রান্না করে খাওয়ানো, কখনো শাকটা-কখনো পাটটা-কখনো মরিচ-চাল-ডাল— এসব নিয়েই আমার চলছিল জীবন। স্বামী ব্যস্ত মানুষ। খেয়েছি কীনা সেটা জানার সময়ও তার হতো না।
বিয়ের তিন বছর পর আমার কোলজুড়ে এলো ফুটফুটে এক ছেলে, আমার আবির। ওকে কোলে নিতেই আমার জীবনের মানেটাই বদলে গেল। ধীরে ধীরে আবির বড় হয়ে উঠল। আমারও আর জীবনের প্রতি কোনো ক্ষোভ রইল না। আমার সব বাসনা ছেলের মধ্যে দিয়ে পূরণ হতে লাগল। আবিরকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলার প্রতিনিয়ত যুদ্ধ ময়দানে নামতে হলো আমাকে। তার প্রতিটা স্বপ্ন হয়ে উঠল আমার স্বপ্ন।
বাবা-চাচাদের মতো আবির ক্ষেতে-খামারে কাজ করবে না, সে পড়বে। তার চোখে ভাসে আমার নাম না জানা হাজারো স্বপ্ন। আর আমি তার স্বপ্ন পূরণে মরিয়া হয়ে উঠি। আবির ধীরে ধীরে বড় হয়। মানুষের মতো মানুষ হয়। নিজের কাজটাতো করেই, আমার কাজটা করতেও সে কুণ্ঠাবোধ করে না। পাড়ার বৌ-চাচিরা তাকে কত ভালোবাসে! আর আমি সেটা দেখে গর্ব অনুভব করি।
ঘটনাটার আজ অনেক বছর পেরিয়েছে। কত বছর সেটা আজ আর আমি ঠাহর করতে পারি না। বয়স হয়েছে। মনের আয়নায় ঘটনাগুলো কীরকম ঝাপসা হয়ে গেছে। আবির আজ মস্ত অফিসার। বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে আজ সে শহরে থাকে। শহরে তার মস্ত প্রাসাদের মতো বাড়ি। আজ আমার আবির তার মাকে পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। পাবারই কথা। কোথায় সে এত বড় শিক্ষিত অফিসার, তার বউ নামকরা ডাক্তার। তার ছোট ছোট বাচ্চাগুলোও আজ ফটফট করে ইংরেজি বলে।
তারা এই বুড়ো পাড়াগাঁয়ের মূর্খ বুড়িটার কাছে কী অভদ্রতা আর বোকামি শিখবে? শহরে নাকি এমন মূর্খ বুড়ো-বুড়ির জন্য আলাদা করে ঘর করে দেয়া আছে। একদিন আমি সেই মানুষগুলোর কাছে গিয়ে জানতে চাইব, আপনারাও কি সন্তানের স্বপ্ন পূরণ করার শাস্তি ভোগ করছেন?