স্বকৃত নোমানের প্রবন্ধ ‘উপন্যাস প্রসঙ্গে’

প্রকাশিত : জুন ২৩, ২০২০

আচ্ছা, মানুষের জন্য উপন্যাসের কী প্রয়োজন? উপন্যাস কী কাজে লাগে? এ-কথা সবার জানা যে, উপন্যাস একটা শিল্প বা সাহিত্যকর্ম। কবিতা-সংগীত-নৃত্য-নাট্যচিত্র যেমন। মানুষের জন্য কি শিল্পের প্রয়োজন আছে? কেউ বলতে পারেন, না, মানুষের জন্য শিল্পের কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষ পৃথিবীতে আসবে, খাবে, টয়লেট করবে, সঙ্গম করবে, সন্তানাদির জন্ম দেবে, ঘুমাবে, কিছু ব্যাংক-ব্যালেন্স রেখে একদিন মরে যাবে। ব্যাস, হয়ে গেল। শিল্প-সাহিত্য দিয়ে কী করবে মানুষ? শিল্প-সাহিত্য না হলেও মানবজীবন চলে যাবে।

এক্ষেত্রে আমার দ্বিমত আছে। আচ্ছা, আপনি কখনো এমন প্রান্তর দেখেছেন যেখানে কোনো ফসল ফলে না, বছরের পর বছর যেটি বিরান পড়ে থাকে? যদি দেখে থাকেন, তাহলে বলুন, ফসল সেখানে কেন ফলে না? কারণ অনুসন্ধান করলে জানতে পারবেন, ওই প্রান্তর আসলে শুষ্ক, সেখানে জলের অভাব। জল সৃষ্টি করে রস। সেই রস থেকেই ফসলাদি উৎপন্ন হয়। রস-কষহীন শুষ্ক মাটিতে ফসল ফলে না। শিল্পকলার কাজটা এখানেই। শিল্প মানুষের জীবনকে রসে পরিপূর্ণ করে তোলে। পৃথিবীর নানা জাতির আদিম অধিবাসীরা এ রসেরই সন্ধান করেছিল। তারা সৃষ্টি করেছিল নানা গল্প, কাহিনি, সংগীত, চিত্রকলা। করেছিল তাদের জীবনকে রসে ভরিয়ে তোলার জন্য। রুশ কথাশিল্পী ম্যাক্সিম গোর্কি যেমন বলেছেন, ‘ভলগা নদী তীরস্থ উরাল প্রান্তরের এবং সাইবেরিয়ায় বিভিন্ন জাতির অধিবাসীরা এই প্রশ্নের উত্তর জুগিয়েছে। বিগত দিনে এদের অনেকেরই অক্ষরজ্ঞান ছিল না। তবু আমাদের যুগের বহু শতাব্দী আগে এরা জঙ্গলের প্রত্যন্ত প্রদেশে জলাভূমির মধ্যে, প্রাচ্যের শুষ্ক অনুর্বর ভূখ-ে এবং তুন্দ্রা অঞ্জলে বহু গান, গল্প, বীরগাথা এবং ঈশ্বরের সম্পর্কে উপকথার সৃষ্টি করে নিজেদের নীরস জীবনকে সমৃদ্ধ এবং সুন্দর করেছিল। এগুলিকে আমরা ‘ধর্মীয় কীর্তিগাথা’ বলে থাকি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এদের স্থান শিল্পকলার জগতে।’

একইভাবে বাংলার ইতিহাস অনুসন্ধান করলেও দেখা যাবে, যখন গল্প-উপন্যাস বই আকারে আসেনি তখনো কিন্তু দাদা-দাদি তাদের নাতি-নাতনিকে কিস্‌সা শুনিয়েছে। যখন কবিতা আসেনি তখন শ্লোক বানিয়ে বাঙাল মানুষ মুখে মুখে প্রচার করেছে। মা তার ছেলেকে অলৌকিক সত্তার কথা বলে ঘুম পাড়িয়েছে। থিয়েটার আসার আগেও কিন্তু মানুষ যাত্রাপালা করেছে। বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে বিমূর্ত সত্তার উপাসনা করছে। এসব কেন করেছে? কারণ একটাই, তাদের নীরস জীবনকে রসে ভরিয়ে তোলা। মানুষ নীরস হয়ে বাঁচতে পারে না, তার রসের প্রয়োজন হয়। শিল্পকলা মানবজীবনে এই রস সঞ্চার করে। গল্প-উপন্যাস-নাটক-কবিতা তথা শিল্প-সাহিত্যের কাজ এটাই―মানুষের নীরস জীবনকে রসে ভরিয়ে তোলা। একইসঙ্গে শিল্প-সাহিত্য মানুষের চেতনাকে জাগিয়ে তোলে, মানুষকে মানবিকতায়, প্রাণবিকতায় উজ্জ্বীবিত করে। টাকাকড়ি খরচ করেও চেতনার এই উজ্জ্বীবন সম্ভব হয় না।

আর্নস্ট ফিশার তাঁর ‘দি নেসেসিটি অব আর্টে’ যেমন বলেন, ‘...মানুষ, যে কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ হয়ে উঠল, যে প্রকৃতিকে রূপান্তর ও বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে প্রাণিজগৎ থেকে বেরিয়ে এলো, সে এভাবেই হয়ে উঠল এক জাদুকর, সামাজিক বাস্তবতার স্রষ্টা-মানুষ, সে সর্বদা মহান জাদুকর হয়েই থাকবে, সে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে আগুন বহনকারী সর্বকালের প্রমিথিউস, সে সর্বকালের ওরফিউস, যে সঙ্গীতের মোহিনী মায়ায় প্রকৃতিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে জয় করে চলে। মানবতার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত শিল্পের মৃত্যু নেই।’ প্রশ্ন হতে পারে, এই একুশ শতকে জ্ঞান-বিজ্ঞান যেভাবে উৎকর্ষের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তাতে মানবীয় উন্নতি একদিন চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। এই পৃথিবীতে মানুষ শাস্ত্রপ্রোক্ত স্বর্গকে নামিয়ে আনবে, এনে অনন্ত সুখকে আলিঙ্গন করবে, সব রকমের স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাবে মানুষের, চাওয়া-পাওয়া বলতে আর কিছু থাকবে না তখন। শিল্প তখন কী উপকারে আসবে মানুষের? এই প্রশ্নের উত্তরটাও ‘দি নেসেসিটি অব আর্ট’ থেকে দেয়া যাক, ‘...মানুষের অগ্রযাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটবে না কখনো, মানুষের অগ্রযাত্রা অন্তহীন বিকাশের পথে অব্যাহত থাকবে। সে যা হতে পারবে সবসময় তার চেয়ে বেশি কিছু হতে চাইবে, নিজের প্রকৃতিগত সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে সর্বদা বিদ্রোহ করবে, নিজেকে ছাড়িয়ে উঠবার জন্য সদা সচেষ্ট থাকবে এবং অমরত্ব লাভের সংগ্রামে লিপ্ত থাকবে সদা সর্বদা। মানুষের সবজান্তা, সর্বশক্তিমান ও সর্বব্যাপী হওয়ার ইচ্ছাটা যদি কখনো উধাও হয়ে যায়, তবে সে আর মানুষ থাকবে না। অতএব প্রকৃতির সম্ভাব্য সকল রহস্য ও সুবিধা উদ্ঘাটন ও কাজে লাগানোর জন্য মানুষের সর্বদা বিজ্ঞানের প্রয়োজন হবে। আবার তার সর্বদা শিল্পের প্রয়োজন থাকবে শুধু নিজের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধের জন্য নয়, বাস্তবতার যে অঞ্চল সে কেবল কল্পনায় জানে, যা এখনো তার করায়ত্ব নয়, সেখানে স্বাচ্ছন্দ্য লাভের জন্য শিল্পের আবশ্যকতা থাকবে।’

আধুনিক উর্দু-হিন্দি কথাসাহিত্যের প্রতিভাবান লেখক মুন্সী প্রেমচন্দ ১৯৩৬ সালে লক্ষ্ণৌয়ে অনুষ্ঠিত প্রগতিশীল লেখক সংঘের প্রথম অধিবেশনের সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, ‘...পুরানো আমলে সমাজের লাগাম ছিল ধর্মের হাতে। মানুষের আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক সভ্যতার আধার ছিল ধর্মীয় নির্দেশ আর সে কাজ করতো ভয় অথবা প্রলোভন দিয়ে―পুণ্য-পাপের শাসন ছিল তার সাধনা। এখন সাহিত্য সে কাজ নিজের দায়িত্বে নিয়ে নিয়েছে, আর তার সাধনা হলো সৌন্দর্যপ্রীতি। সে মানুষের মধ্যে সৌন্দর্যপ্রীতি জাগানোর চেষ্টা করে। এমন কোনো মানুষ নেই যার মধ্যে সৌন্দর্যের অনুভূতি নেই। সাহিত্যিকের মধ্যে এই বৃত্তি যতটা জাগ্রত ও ক্রিয়াশীল হয় তার রচনা ততটাই প্রভাবশালী হয়ে থাকে। প্রকৃতি-নিরীক্ষণ আর নিজের অনুভূতির তীক্ষ্ণতার বদৌলতে তার সৌন্দর্যবোধে এত তীব্রতা আসে যে, যা কিছু অসুন্দর, অভব্য, মনুষ্যত্বরহিত সেসব তার জন্য অসহ্য হয়ে যায়। তার উপর সে শব্দ আর ভাবের সমস্ত শক্তি দিয়ে আক্রমণ করে। বলতে পারেন, সে মানবতা, দিব্যতা আর ভব্যতার বন্ধনে জড়িয়ে থাকে। যারা দলিত, পীড়িত, বঞ্চিত―হোক সে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, তার পক্ষ নেয়া এবং তার ওকালতি করা সাহিত্যিকের অবশ্য কর্তব্য। সমাজ তার আদালত। সেই আদালতের সামনে সে তার ফরিয়াদ পেশ করে, এর ন্যায়বৃত্তি আর সৌন্দর্যবৃত্তিকে জাগ্রত করে নিজের চেষ্টাকে সফল মনে করে।

কিন্তু সাধারণ উকিলের মতো সাহিত্যিক নিজের মক্কেলের তরফ থেকে উচিত-অনুচিত সকল রকমের দাবি পেশ করেন না, অতিরঞ্জনকে ব্যবহার করেন না, নিজে নিজেই কথা বানিয়ে তোলেন না। তিনি জানেন যে এইসব যুক্তির দ্বারা সমাজের আদালতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারবেন না। এই আদালতের হৃদয় পরিবর্তন তখনই সম্ভব যখন তিনি সত্য থেকে খানিকটাও বিমুখ না হন, নইলে আদালতের ধারণা তার ব্যাপারে নষ্ট হয়ে যাবে আর তার বিরুদ্ধে ফায়সালা শুনিয়ে দেবে। তিনি কাহিনি লেখেন, কিন্তু বাস্তবতা বিষয়ে খেয়াল রেখেই লেখেন; তিনি মূর্তি বানান কিন্তু এমন মূর্তি যাতে সজীবতা থাকে আর থাকে ভাবব্যঞ্জনাও―তিনি মানবপ্রকৃতিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে অবলোকন করেন, মনোবিজ্ঞানের অধ্যয়ন করেন আর এই চেষ্টা করেন যেন তার চরিত্রেরা সকল অবস্থায় আর সকল ক্ষেত্রে এমন আচরণ করে, যেমনটা করে রক্ত-মাংসের মানুষ। নিজের সহজ সহানুভূতি আর সৌন্দর্যপ্রীতির কারণে তিনি জীবনের সেই সূক্ষ্ম স্থান অব্দি পৌঁছান, যেখানে মানুষ নিজের মনুষ্যত্বের কারণে পৌঁছতে অসমর্থ হয়।

নিঃসন্দেহে শিল্পের উদ্দেশ্য সৌন্দর্যবোধের পুষ্টিসাধন এবং তা আমাদের আধ্যাত্মিক আনন্দের উপায়। কিন্তু এমন কোনো ব্যক্তিগত বা আধ্যাত্মিক আনন্দ নেই, যার মধ্যে উপযোগিতার বিষয় থাকে না। আনন্দ নিজে থেকেই এক উপযোগিতাপূর্ণ বিষয় আর উপযোগিতার দৃষ্টিকোণ থেকে একই বস্তু থেকে আমরা সুখও পাই দুঃখও পাই। আকাশে চেয়ে থাকা লালিমা নিঃসন্দেহে সুন্দর দৃশ্য, কিন্তু আষাঢ় মাসে যদি আকাশ এরকম লালিমায় ছেয়ে যায়, তবে তা আমাদেরকে প্রসন্নতা দিতে পারে না। ওই সময় তো আমরা আকাশে কালো কালো বাদল দেখেই আনন্দিত হই। ফুল দেখে আমাদের এজন্য আনন্দ হয় যে তা থেকে ফলের আশা জাগে। প্রকৃতির সঙ্গে নিজের জীবনের সুর মিলিয়ে চলতে আমাদের এই জন্য আধ্যাত্মিক সুখ মেলে যে তাতে আমাদের জীবন বিকশিত আর পুষ্ট হয়ে ওঠে। প্রকৃতির বিধান বৃদ্ধি এবং বিকাশ, আর যেসকল ভাব, অনুভূতি এবং বিবেচনা আমাদের আনন্দ দেয়, সেসব এই বৃদ্ধি আর বিকাশের সহায়ক। শিল্পী নিজের শিল্প দিয়ে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে পরিবেশকে বিকাশের উপযোগী করে তোলেন।’

লাতিন কথাশিল্পী মারিও বার্গাস্ য়োসা তাঁর নোবেল ভাষণে বলেছিলেন, ‘সাহিত্য মানুষের বৈচিত্র্যের মধ্যে ভ্রাতৃভাব সৃষ্টি করে এবং অজ্ঞানতা, ভাবধারা, ধর্ম, ভাষা কিংবা মূর্খতা দিয়ে নর-নারীর সামনে যে সীমান্ত তৈরি করে দেওয়া হয় তা ম্লান করে দেয়।...সাহিত্য জীবনের ভুয়া প্রতিবিম্ব, তা সত্ত্বেও সাহিত্যই জীবনকে ভালোভাবে বুঝতে, যে গোলকধাঁধায় আমাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও মৃত্যু তার সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করে। বাস্তবজীবন আমাদের ওপর যে হতাশা ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা আরোপ করে থাকে, সাহিত্যের কারণে আমরা আংশিকভাবে হলেও তার অর্থোদ্ধার করতে পারি; যে দুর্বোধ্যতা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর বিরাজ করছে, বিশেষ করে আমরা যারা নিশ্চয়তার চেয়ে সন্দেহই বেশি মাত্রায় সৃষ্টি করছি; দুর্জ্ঞেয়, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক নিয়তি, আত্মা, ইতিহাসের অচৈতন্য সম্পর্ক চেতনা, ইতস্তত যৌক্তিক জ্ঞান―এ ধরনের বিষয়ের সামনে আমরা যে হতবুদ্ধিতা প্রকাশ করছি―সাহিত্যই তার স্পষ্টীকরণ করতে পারে।’

শিল্প-সাহিত্যের উপযোগিতা বিষয়ে আরেকটু সহজভাবে বলি। সেদিন মধ্যরাতে একটা দুঃসংবাদ শুনে মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। ঘুম আসছিল না। বারবারই দুঃসংবাদটির কথা মাথার ভেতর ঘাই মারছিল। ঘুম উড়ছিল, ঘুরছিল, কিন্তু আমার চোখে বসছিল না। কী করা যায়? ঘুমাতে তো হবে। কোনো রাতে ঘুমাতে না পারলে বা ঘুম কম হলে পরের দিনটা ভালো যায় না। চোখে ঘুম নামানোর জন্য আমি ব্যবহার করলাম একটি বিশেষ পদ্ধতি। বহুদিন ধরে এই পদ্ধতিটা ব্যবহার করি। যদি কোনো কারণে ঘুম না আসে, চোখ বন্ধ করে আমি ঢুকে যাই রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াদ, ওডিসি, ডিভাইন কমেডিয়া, আনা-কারেনিনা, লা-মিজারেবল, পুতুলনাচের ইতিকথা বা খোয়াবনামা’র কাহিনির বৃত্তে। সেদিন আমি ঢুকে গেলাম মহাভারতের কাহিনিবৃত্তে।...শান্তনু গঙ্গাদেবীকে বিয়ে করছে...অষ্টম সন্তান দেবব্রতের জন্মের পর গঙ্গা অন্তর্হিত হচ্ছে...শান্তনু মৃগয়াহেতু বনে যাচ্ছে...নদীর ধারে ধীবরকন্যা পরমাসুন্দরী সত্যবতী বা মৎস্যগন্ধার দেখা পেলেন...চিত্রাঙ্গদা ও বিচিত্রবীর্য জন্মাচ্ছে...পাণ্ডব ও কৌরবদের জন্ম হচ্ছে... ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন পরীক্ষায় সমর্থ হয়ে দ্রৌপদীকে লাভ করছেন...পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরে ফিরে যাচ্ছেন...শকুনি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কপট পাশা খেলার আয়োজন করছে...দুর্যোধনের নির্দেশে দুঃশাসন অন্তঃপুর থেকে দ্রৌপদীকে কেশাকর্ষণ করে সভায় টেনে আনছে...সভায় উপস্থিত ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, পাণ্ডবরা ধর্মসংকটে পড়ে অবিচারের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করতে পারছেন না...পাণ্ডবরা বারো বছর বিভিন্ন বনে ভ্রমণ করছেন...অতঃপর যুদ্ধ শুরু হচ্ছে...সেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ...স্বজনদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে দেখে মহাবীর অর্জুন যুদ্ধ থেকে বিরত হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে অস্ত্রত্যাগ করছেন...শ্রীকৃষ্ণ তাকে অস্ত্রধারণের জন্য উপদেশ দিচ্ছেন...।

কাহিনিবৃত্তে ঘুরতে ঘুরতেই আমি চলে গেলাম স্বপ্নের রাজ্যে। সুসুপ্তিতে ডুবে গেলাম। জেগে উঠলাম পরদিন সকালে। তার মানে সাহিত্য আমার ঘুমের ওষুধ হিসেবে কাজ করেছে। সাহিত্য কি তবে মানবজীবনের কোনো ওষুধ? হয়ত তাই। পৃথিবীটা তো কুরুক্ষেত্র। মানুষ জন্মাচ্ছে, রোগ-শোকের সঙ্গে যুজছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। আমি এসব জন্ম দেখছি, এসব রোগ-শোক দেখছি, এসব মৃত্যু দেখছি। দেখতে দেখতে আমিও আক্রান্ত হচ্ছি মৃত্যুচিন্তায়। আমার মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ছে মৃত্যুচিন্তা নামক ভাইরাস। মানবমস্তিষ্ক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিস্ময়। পৃথিবীর যত বড় বড় আবিষ্কার, সব তো মানুষের মস্তিষ্ক থেকেই। প্রাণিকুলের মধ্যে মনুষ্যমস্তিষ্ক সবচেয়ে বেশি উর্বর, সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে রহস্যময়। মস্তিষ্ক ঠিক মানে আমার দেহ ঠিক। মস্তিষ্ক বেঠিক মানে আমার দেহ বেঠিক। মানুষের বয়স চল্লিশ, পঞ্চাশ বা ষাটের পর এই মস্তিষ্কে যে ভাইরাসটি ঢুকে পড়ে তার নাম মৃত্যুচিন্তা। মানুষ যদি জানতো কখনো তার মৃত্যু হবে না, তবে হয়ত সে তার আয়ুর দ্বিগুণ কাল বেঁচে থাকত। মৃত্যুচিন্তা এমনই এক ভাইরাস যা মৃত্যুর আগেই মানুষকে মেরে ফেলে, মানুষকে অকর্মণ্য করে তোলে, জীবনকে অর্থহীনতার দিকে ঠেলে দেয়।

মানবমস্তিষ্কে মৃত্যুচিন্তার এই আধিপত্যের কারণেই পৃথিবীতে টিকে আছে অধিকাংশ ধর্ম। এই ধর্মগুলো মানুষকে পরকালের লোভ দেখাচ্ছে। বলছে, মৃত্যু অনিবার্য, মৃত্যুর স্বাদ তোমাকে গ্রহণ করতেই হবে, পরকালে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে সুশোভিত গৃহ, মনোরম উদ্যান, দুধ ও মধুর নহর প্রভৃতি। এসব সান্ত্বনাবাণী শুনে সাধারণ মানুষ শান্তি পায়। মৃত্যুই যে শেষ নয়, তারপরও যে প্রাপ্তির ব্যাপার আছে, এই ভেবে তারা নিজেদের সান্ত্বনা দেয়। বিশেষ মানুষদের কাছে এসব সান্ত্বনা বাণীর কোনো মূল্য নেই। সে জানে, জীবন মানে এক কুরুক্ষেত্র। এই রণক্ষেত্রে মানুষেরা যুদ্ধ করতে আসে, যুদ্ধ করতে করতেই মারা যায়। সে জানে, যে প্রকৃতি থেকে তার উত্থান, মৃত্যুর পর সেই প্রকৃতিতেই তার বিলয়। সে আবার মাটি হয়ে যাবে, পানি হয়ে যাবে, গাছ হয়ে যাবে, ঘাস হয়ে যাবে। হয়ত আবার সে ফিরে আসবে। ফিরে আসবে জীবনানন্দের সেই শঙ্খচিল হয়ে, শালিক হয়ে, কিংবা ভোরের কাক হয়ে, হাঁস কিংবা লক্ষ্মীপেঁচা হয়ে। আসা নিয়ে তার ভাবনা নেই, যাওয়া নিয়েও তার ভাবনা নেই। সে জানে, মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীর পরকাল নেই, স্বর্গ-নরক নেই। কোনো প্রাণীর যদি পরকাল না থাকে, স্বর্গ-নরক না থাকে, মানুষের কেন থাকবে? আর সব সন্তানের মতো মানুষও এই প্রকৃতির সন্তান। সে আলাদা কিছু নয়। প্রকৃতির কাছে তার সব সন্তানই সমান। বিশেষ মানুষটি মনে করে, যা প্রকৃতির চিরায়ত বিধান, যা অনিবার্য, সেই মৃত্যুকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা কেন? দুঃশ্চিন্তা করে কি মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে? দুঃশ্চিন্তা করলে কি মৃত্যু তার কাছে দেরিতে আসবে? আসবে না। মৃত্যু তার ঠিক সময়ে হাজির হবেই।

সে যাই হোক, বলছি যে, মৃত্যুচিন্তা নামক এই ভাইরাসটিকে মুছে দিতে পারে সাহিত্য। যখনই আমার মাথায় ভাইরাসটি কাজ করতে শুরু করবে তখনই আমি বসে গেলাম জীবনানন্দের ধূসর পাণ্ডুলিপি বা মহাপৃথিবী বা বনলতা সেন নিয়ে, কিংবা এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ড বা শেলির ওজিম্যানডিয়াস নিয়ে, কিংবা ঢুকে পড়লাম রবীন্দ্রনাথের জগতে, নজরুলের জগতে, মানিকের জগতে, তারাশঙ্করের জগতে, গার্সিয়া মার্কেজ বা ভিক্টর হুগোর জগতে। অর্থাৎ আমার মস্তিষ্ককে ব্যস্ত করে ফেললাম অন্য একটি কাজে। আমার মনকে মৃত্যুচিন্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলাম সাহিত্যের জগতে, সুন্দরের জগতে, সারস্বতের জগতে। তার মানে সাহিত্য আমাকে এমন একটি জগৎ দিচ্ছে, যে জগতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই, আর কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ। পৃথিবীর রোগ-শোক-মৃত্যুচিন্তা সেখানে প্রবেশ করতে পারে না।

কিন্তু সবাই তো আমার মতো নয়। আমি সাহিত্য পড়তে পারি বলে এই সারস্বত জগতটা তৈরি করতে পেরেছি এবং অনায়াসে ঢুকে পড়তে পারি সেই জগতে। গ্রামের কৃষকটি তো এই জগতটি তৈরি করতে পারছে না। সাহিত্য দিয়ে তার কী কাজ? সে তো বই পড়ে না, সাহিত্য তো তার কোনো কাজেই লাগছে না। আসলেই কি লাগছে না? না লাগলে সে গান গায় কেন? জারি-সারি-ভাটিয়ালি-মুর্শেদির কী দরকার তার? সে যাত্রাপালার আয়োজন করে কেন? সে সিনেমা দেখে কেন? সে নাটক দেখে কেন? সে কেন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গল্পের আসর জমিয়ে তোলে? কেন সে তার পুত্র-কন্যা বা পৌত্র-পৌত্রিকে ঘুম পাড়ানোর সময় গায়, ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে/বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে?’ কেন সে পুত্র-কন্যার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গল্প শোনায়, এক যে ছিল রাজা, তার ছিল সাত পুত্র, এক পুত্র একদিন বাণিজ্যে গেল, এক মায়াবতীর প্রেম মজে গেল...সে তাকে বিয়ে করল, তাকে নিয়ে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে সে দেশে ফিরল।

তার মানে মানতেই হবে যে গ্রামের সেই কৃষকটিরও সাহিত্যের প্রয়োজন আছে। সে তার বাস্তব জগত থেকে বের হতে চায়। চলে যেতে চায় এক পরাবাস্তব জগতে, গল্পের জগতে; যে জগতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নেই, রোগ নেই, শোক নেই, মৃত্যু নেই। সে কারণেই তার গল্পের দরকার হয়। সেই গল্প হয়ত সে কোনো বইপুস্তকে পড়ে না। শোনে বাবা-মায়ের কাছ থেকে, দাদা-দাদি, নানা-নানি কিংবা ভাইবোনোর কাছ থেকে। তার সাহিত্য মুখে মুখে টিকে থাকে। যেমন বহু বহু দিন মুখে মুখে ঘুরেছে রামায়ণের কাহিনি, মহাভারতের কাহিনি, বেতাল পঞ্চবিংশতির কাহিনি, ঠাকুর মার ঝুলির কাহিনি, পূর্ববঙ্গ গীতিকার কাহিনি। সুতরাং সাহিত্যের প্রয়োজন তারও আছে। তাই সাহিত্য শুধু অবসরকালীন বিনোদন নয়, সাহিত্য মানবমস্তিষ্কের অন্যতম খোরাকও বটে।

উপন্যাস মানে তো একটা গল্প, একটা কাহিনি। একটু গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে পৃথিবীজুড়ে গল্পের শাসনই চলছে। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই গল্প আছে। প্রতিটি মানুষের জীবনই একেকটি উপন্যাস। ধর্মগ্রন্থগুলো পড়লে দেখা যাবে গল্পের কী বিপুল সমাহার! লৌকিক-অলৌকিক গল্প। বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতায় দেখবে কত শত গল্প। গ্রীক পুরাণেও তাই। ত্রিপিট-বাইবেল-কোরানেও তাই। জেলখানা ও ভেঙে যাওয়া জাহাজ, পৌলের প্রচার যাত্রা, পিতর ও কর্ণীলিয়, স্তিফান, একটি খোঁড়া লোক ও সাবধান বাণী, বাতাস ও আগুন, শেষ ভোজ ও বিশ্বাসঘাতকতা, গাধায় চড়ে রাজার যাত্রা, রাজা হেরোদের জন্মদিন―এরকম বিস্তর গল্প রয়েছে বাইবেলে। ইব্রাহিম, ইসমাইল, ইউসুফ, মুসা, ফেরাউন, জাকারিয়া, নূহ, সুলায়মান, জুলকারনাইন, খিজিরের কাহিনিসহ অসংখ্য কাহিনি বর্ণিত হয়েছে কোরানে। সুরা ইউসুফের তৃতীয় আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে পয়গম্বর, ওহির মাধ্যমে তোমার নিকট যে কোরান প্রেরণ করেছি তাতে উত্তম কাহিনি বর্ণনা করছি। এর পূর্বে অবশ্য তুমি সে সম্পর্কে অনবহিত ছিলে।’ খেয়াল করে দেখুন, এই আয়াতেও কিন্তু ‘কাহিনি’ শব্দটি উল্লেখ রয়েছে। ঈশ্বরকে কেউ দেখেনি। অথচ তাকে কেন্দ্র করে কাহিনিগুলো মানুষ বিশ্বাস করছে। মৃত্যুর পর কবরে কী হবে কেউ জানে না, অথচ কবরের অবস্থা নিয়ে কত কত গল্প তৈরি করেছে মানুষ! পরকাল কেউ দেখেনি, স্বর্গ-নরক দেখেনি, অথচ পরকাল ও স্বর্গ-নরকের কাহিনিগুলো মানুষ কী গভীরভাবে বিশ্বাস করছে! বুঝে দেখুন গল্প বা কাহিনি কত শক্তিশালী!

উপন্যাস মানে কেবল কাহিনি বর্ণনা নয়, গল্প বলা নয়। উপন্যাস একটি শিল্পকর্ম। এই শিল্পকর্ম তৈরির বিস্তর উপাদানের মধ্যে কাহিনি হচ্ছে একটি প্রধান উপাদান। উপন্যাস নামক এই সাহিত্য বা শিল্পকর্ম সম্পর্কে র‌্যালফ ফক্স বলেছেন, ‘উপন্যাস হলো আমাদের সভ্যতার এক মহান লোকশিল্প, মহাকাব্যের একমাত্র উত্তরসূরি।...উপন্যাস হলো মানুষের জীবনের গদ্য। উপন্যাস হলো মানুষকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করার এবং তাকে প্রকাশ করার প্রথম নান্দনিক প্রচেষ্টা।’ উপন্যাস প্রসঙ্গে ক্রিস্টফার কডওয়েল কী দারুণ বলেছেন, ‘উপন্যাস এবং ঐকতানের জগতে মানুষের ধ্যান-ধারণায় জেগে ওঠে এক পরিবর্তমান ও প্রসারমান বিশ্বের বহু মানুষের বিভিন্ন আবেগের সমৃদ্ধ এবং বিচিত্র গতিধারা।’ বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক ই.এম ফরস্টার বলেছেন, ‘উপন্যাস সাহিত্যের এমন একটি মাধ্যম যেখানে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার অবকাশ থাকে। এখানে লেখক প্রাণখুলে তার মতামত লিপিবদ্ধ করতে পারেন বা একেকটি চরিত্রকে প্রস্ফুটিত করতে পারেন সকল ধরনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে। উপন্যাসকে এক সুবিশাল ক্যানভাস হিসেবে ধরা যায়, লেখক তাঁর পরিকল্পনা-মাফিক একেকটি অধ্যায়কে জায়গা করে দেন সেখানে। স্থান-কালের যথার্থ উল্লেখ, বাস্তবতার প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি রাখা, মানুষের হৃদয়ের গভীর তলদেশ স্পর্শ করার ক্ষমতা ইত্যাদি দরকার একটি সার্থক উপন্যাসের জন্য।’

তুর্কি ঔপন্যাসিক ওরহান পামুক তাঁর ‘অকপট ও ভাবপ্রধান ঔপন্যাসিক’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘উপন্যাস আবশ্যিকভাবে দৃশ্যগত সাহিত্য কাহিনি। আমাদের দৃশ্যগত বুদ্ধিমত্তাকে সম্মোধন করেই উপন্যাস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের ওপর প্রভাব ফেলে, প্রভাব ফেলে আমাদের মনশ্চক্ষে সবকিছু দেখে শব্দকে মানসিক ছবিতে বদলে ফেলার ক্ষমতাকে সম্মোধন করে। আমরা সবাই জানি, অন্যসব সাহিত্যবর্গের বিপ্রতীপে, উপন্যাস সাধারণ জীবনের অভিজ্ঞতার, স্মৃতির ও আমাদের খেয়াল না-করা ইন্দ্রিয়জাত ধারণার ওপর নির্ভরশীল, বিশ্বকে আঁকা ছাড়া, উপন্যাস এমন এক ঋদ্ধতায় আমাদের ঘ্রাণ, শব্দ, স্বাদ ও স্পর্শের সাথে যুক্ত ইন্দ্রিয়লব্ধ অনুভূতিগুলি বর্ণনা করে যা অন্য কোনো সাহিত্য-আঙ্গিক করতে পারে না। উপন্যাসের সাধারণ নিসর্গচিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠে―কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলির দেখাকে ছাপিয়ে যায়―সেই বিশ্বের ধ্বনি, গন্ধ, স্বাদ ও স্পর্শের মুহূর্তগুলির সাথে। তবু আমাদের অনন্য ভঙ্গিতে প্রতিমুহূর্তে অনুভব করা জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার মধ্যে, দেখাই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। উপন্যাস লেখার অর্থ শব্দ দিয়ে অঙ্কন, আর উপন্যাস পাঠের অর্থ অন্য কারো শব্দের মাধ্যমে বিম্বকে প্রত্যক্ষ করা।’

লেখক: কথাসাহিত্যিক