স্বকৃত নোমানের গল্প ‘রবীন্দ্রনাথ’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৯

ভিডিও ক্লিপটি ফেসবুকে প্রথম আপলোড করে তরুণ সাংবাদিক মীর কামাল, বিষ্যুদবার রাত দশটায়, যেখানে প্রথিতযশা লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক মনজুর মোরেশদ বলছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন সাঁইর গান চুরি করেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, নজরুলের কবিতা চুরি করে তিনি নোবেল পেয়েছিলেন।’ ব্যাস, এটুকুই। তের সেকেন্ডের ছোট্ট ভিডিও ক্লিপ।

শুক্রবার ছুটির দিন বলে বিষ্যুদবার রাতে বেশিরভাগ ফেসবুকার একটিভ থাকে। রাত বারোটা নাগাদ ভিডিওটি ভিউ হয় প্রায় তিন হাজার, শেয়ার দুই শ আশি। শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনার সাইক্লোন। সকাল নগাদ ভিডিওটি হয়ে যায় ভাইরাল, ঝুলতে থাকে আইডির ওয়ালে ওয়ালে। আর সব ইস্যুকে চাপা দিয়ে এটিই হয়ে ওঠে প্রধান ইস্যু। সেইসব ধর্মান্ধ, যারা মনে করে রবীন্দ্রনাথ মুসলিম বিদ্বেষী, তারা সমর্থন করতে লাগল মনজুর মোরশেদের এই বক্তব্য। আর প্রগতিশীল কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী সবাই মুখর হয়ে উঠল মনজুর মোরশেদের নিন্দায়। করতে লাগল তার মুণ্ডুপাত। একজন প্রবীণ অধ্যাপক কেমন করে এসব মনকগড়া কথা বলেন! একজন নোবেল লরিয়েটকে কেমন করে এভাবে অপমান করেন! মনজুর মোরশেদ কিসের লেখক? তিনি রবীন্দ্রনাথের নখের ময়লার যোগ্য? কিসের জাতীয় অধ্যাপক? তিনি তো প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারের যোগ্যও নন। কীভাবে হলেন জাতীয় অধ্যাপক? কে বানাল? ক্ষমতাসীনদের পা চাটলেই জাতীয় অধ্যাপক হওয়া যায়? গেল, দেশটা রসাতলে গেল!

সকাল আটটার দিকে অনলাইন এক্টিভিস্ট মাহমুদ হাসান দিল একটি পোস্ট। লিখল, লালনের গান আর নজরুলের কবিতা চুরির মতো হাস্যকর অভিযোগ নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনকথা পড়েছি, প্রশান্তকুমার পালের রবিজীবনী পড়েছি। রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিলেন, এমন কোনো তথ্য এ দুটি বইয়ে পাইনি। কোনো রবীন্দ্রগবেষকের লেখায় এমন তথ্য পাইনি। মনজুর মোরশেদ এসব তথ্য কোথায় পেলেন? নিশ্চয়ই তার মনগড়া। তার উপর ভর করেছে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা। তার উপযুক্ত চিকিৎসা দরকার। তার এমন উদ্ভট বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাই।

কিছুক্ষণ পর একটি পোস্ট দিলেন একুশে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ওসমান মজুমদার। লিখলেন, আমি ভাবতেই পারছি না রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এমন মন্তব্য মনজুর মোরশেদ করতে পারেন! তাকে এতদিন পণ্ডিত বলে জানতাম। তলে তলে যে তিনি ঘোর রবীন্দ্রবিদ্বেষী, জানা ছিল না। ল্যাঞ্জা ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট টু হাইড। শেষ বয়সে এসে পাগলের প্রলাপ বকতে শুরু করেছেন। আশা করি তিনি জাতীয় অধ্যাপকের পদটি ত্যাগ করবেন। তিনি এই পদের যোগ্য নন।

কথাসাহিত্যিক জোহরা রওশন দিলেন একটি পোস্ট। ভিডিওটা শেয়ার নিয়ে তিনি লিখলেন, সকালে অধ্যাপক মনজুর মোরশেদের ভিডিও ক্লিপটি দেখলাম। কবি রায়হান আলীমের পোস্টটিও পড়লাম, যেখানে তিনি লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার নাকি তার ‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’ বইতে লিখেছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার আশুতোষ মুখার্জীর নেতৃত্বে সেই সময়কার ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করার জন্য আঠারো বার স্মারকলিপি দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। স্মারকলিপিতে এক নম্বরে নাকি রবীন্দ্রনাথের সাক্ষর ছিল। আমি ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের বইটির ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান’ এবং ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা’ অধ্যায় দুটি পড়লাম। এ দুটি অধ্যায়ে ঐ স্মারকলিপিতে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষর ছিল, এমন কোনো কথা রমেশচন্দ্র লেখেননি। রবীন্দ্র-বিদ্বেষী চক্রের এই অপপ্রচারে আমাদের অনেক জ্ঞানী-গুণী বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, এখনো হয়ে যাচ্ছেন, যেমন হয়েছেন মনজুর মোরশেদ ও রায়হান আলীম। ভবিষ্যতেও হয়ত আরো অনেকে হবেন। ইতিহাস ঘেঁটে দেখার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। ইতিহাসেরও যে একটা ভাষা আছে, তা বুঝে নেওয়ার মতো সময় আমাদের নেই। আমরা এখন বাতাস থেকে জ্ঞান কুড়াই। অন্যের মুখ থেকে শুনে জ্ঞানী হই। আমরা গুজবে গা ভাসাতে ভালোবাসি। ফেসবুকে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে লাইক, কমেন্ট আর শেয়ার কামাতে ভালোবাসি। রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করুন, কোনো সমস্যা নেই। রবীন্দ্রনাথ দেবতা নন, মাটির মানুষ। তিনি বহু উঁচু মানের শিল্প যেমন রচনা করেছেন, তেমনি নিচুমানের শিল্পও যে রচনা করেননি তা নয়। তাঁর শিল্পের সমালোচনা করা যেতেই পারে। কিন্তু তাঁর বিরোধিতা করার আগে, তার কাপড়টা খুলে ন্যাংটো করে দেওয়ার আগে, হে পতিত বুদ্ধিজীবীগণ, আপনাদের মনে রাখা উচিত, বিরোধিতা আর সমালোচনা এক জিনিস নয়। আরো মনে রাখা দরকার, আপনি কোথায় দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রবিরোধিতা করছেন। এমন এক ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে করছেন, যেখানকার বিপুল মানুষ রবীন্দ্রসংগীতকে আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। বাদ দিতে চায়। আপনার বিরোধিতা তারা লুফে নিচ্ছে, নিজেদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। মনজুর মোরশেদের মতো একজন পণ্ডিত বলেছেন, লালনের গান আর নজরুলের কবিতা চুরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কী ভয়াবহ মিথ্যাচার! আমরা আসলে কোথায় চলেছি! আর রবীন্দ্রনাথ যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেননি, এটা অনেক আগেই মীমাংসিত। বাংলাদেশ ও বাঙালি-বিরোধীরা যেসব তথ্য উল্লেখ করে সেসব তথ্য যৌক্তিকভাবে তথ্যসূত্রসহ বহু আগেই খণ্ডন করেছেন গবেষকরা। তবু নতুন করে কেন এই বিষয়ে বাক্যালাপ? এর কারণ কি এই যে, আমরা যত বড় পণ্ডিত হই না কেন, যতই আমরা নিজেদের বাঙালি বলে দাবি করি না কেন, আসলে আমাদের ভেতরে ঘুমিয়ে আছে একটি বীজ। সেই বীজটি হয় সাম্প্রদায়িকতার, নয় আত্মঘাতের।

দশটার দিকে একটি পোস্ট দিলেন সাংস্কৃতিক ঐক্যজোটের সভাপতি শাফায়েত আহমেদ মিলন। লিখলেন, রবীন্দ্রনাথকে বাঙালি থেকে পৃথক করলে বাঙালিরা সমান দুভাগে ভাগ হবে, যার একদিকে রবীন্দ্রনাথ, অন্যদিকে রবীন্দ্রহারা গোটা বাঙালি জাতি। বস্তুত আধুনিক বাংলা সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায়, তা দুজন সাহিত্য-পুরুষের যৌথ প্রযোজনায় একটি বিশাল অবয়বের মঞ্চনাটক। তারা হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সংস্কৃতি ও সাহিত্যকলায় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ছাড়া আমাদের আর কে আছে? আমাদের কোন সাংস্কৃতির অনুষ্ঠান শুরু আর শেষ হয় না রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ছাড়া। আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা, আদেশ-উপদেশ, গল্প-খোসগল্প, আনন্দ-বেদনা, উচ্ছ্বাস-উদ্যম, প্রেম-ভালবাসা সব কিছুই এ দুজন সাহিত্য, সংগীত আর সুরস্রষ্টার ছায়াতলে স্থিত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চক্রান্তও কম হয়নি। রবীন্দ্রবিদ্বেষী একটি গোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশা থেকেই তৎপর ছিল। তারা এই মনীষী সম্পর্কে নানা ধরনের বিরূপ সমালোচনা ও চরিত্র হননের প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। পাকিস্তান সরকার এই দেশে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করেছিল। নিষিদ্ধের পক্ষে সাক্ষর করেছিল মনজুর মোরশেদের মতো কিছু জ্ঞানপাপী বুদ্ধিজীবী। লাভ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা। তার রচিত গান গেয়ে যুদ্ধ করতে করতে শহিদ হয়েছেন লাখো বাঙালি। সেই মনীষী সম্পর্কে এমন বিভ্রান্তি ছড়ালেন মনজুর মোরশেদ, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি তার এমন উদ্ভট বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।

এই চারটি পোস্টে লাইকের পর লাইক, কমেন্টের পর কমেন্ট পড়তে লাগল এবং হতে লাগল শেয়ারের পর শেয়ার। কিছু কমেন্টের নমুনা :
মনজুর মোরশেদ পাকিস্তানের এজেন্ট। তাকে গ্রেপ্তার করা হোক।
লোকটা মুখোশধারী। তুখোড় বদমাশ।
মদ খেয়ে এমন মন্তব্য করেছে শালা।
তার ক্ষমা চাওয়া উচিত।
বুড়ো ভাম।
বয়স হয়েছে, তাই উল্টাপাল্টা বকছে।
সম্ভবত বার থেকে বেরিয়ে উল্টাপাল্টা বকেছেন।
আপনাদের এত জ¦লছে কেন? রবীন্দ্রনাথ কি আপনাদের বাপ?
তাকে চিড়িয়াখানায় নেওয়া হোক।
বয়সের দোষ, সব বয়সের দোষ।
চরম সত্য প্রকাশ করেছেন মোরশেদ স্যার। তাকে ধন্যবাদ।
নিন্দা।
বান্দর মোরশেদকে জুতাপেটা করা হোক।
সহমত।
একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে এভাবে গালি দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। তিনি ইতিহাসের সত্য উদঘাটন করেছেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা।
হোক প্রতিবাদ।
শালা গাঁজাখোর।
হে হে। সত্য কোনোদিন গোপন থাকে না। সত্য প্রকাশ করায় অনেকের গায়ে আগুন ধরে গেছে। মোরশেদ স্যারকে ধন্যবাদ।
সে তো এই বয়সেও মদ খায়। মদ খেয়ে মাথা ঠিক ছিল না হয়ত।
পাবনায় পাঠানো হোক।
লোকটা মনে হয় জঙ্গিগোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়েছে।
মনজুর মিয়াকে আইনের আওতায় আনা হোক।
জোতা মার বাইঞ্চোদের গালে।

একটি ইসলামি ছাত্র সংগঠনের নেতা আসাদুর রহমান দিল একটি পোস্ট। লিখল, সত্য প্রকাশ করায় শ্রদ্ধেয় মনজুর মোরশেদকে ধন্যবাদ জানাই। রবীন্দ্রনাথ পূর্ববাংলার বাঙালিদের মূর্খ বলেছিলেন। বলেছিলেন, এদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কী প্রয়োজন? রবিবাবু তো ঠিকই বলেছিলেন। বাঙালি তো আসলেই মূর্খ। যে জাতি নিজের মুখে পরের গান গায়, যে জাতির স্বাধীন দেশে পরদেশীর গান জাতীয় সংগীত হয়, সে জাতি মুর্খ নয় তো কী? এদেশে এত শিক্ষিত, এত কবি থাকতে ধার করা সংগীত গাইতে রামপ্রেমীদের আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত না লাগলেও একজন খাঁটি বাঙালি হিসেবে আমার আত্মমর্যাদাবোধে চরম আঘাত লাগে। অনেক রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন করেছি এই দেশ। আমাদের দেশে আমাদের কবির লেখা সংগীত চলবে এটাই তো যৌক্তিক। আমি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি জানাই।

ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে এই পোস্ট লাইক পড়ল আড়াই হাজার, কমেন্ট বারো শ এবং শেয়ার সাড়ে তিন শ। কিছু কমেন্টের নমুনা :
সহমত।
রবীন্দ্রনাথ পূর্ববাংলার বাঙালিদের মূর্খ বলেছিলেন, এই তথ্য আপনি কোথায় পেলেন?
ঠিক বলেছেন।
আমাদের যুবকদের সচেতন হতে হবে। ইন্ডিয়ার রবি-চবির গান আমাদের বয়কট করতে হবে।
আপনি সত্য কথা বলেন, এজন্য আপনাকে ভালো লাগে।
রাইট।
আপনি তো দেখছি আরেক আবাল। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির পর হলো কবে? তিনি তো বাঙালির রবি, বাঙালির সূর্য, বাঙালির আপনজন।
ভালো বলেছেন। ধন্যবাদ।
সুন্দর লেখা। শেয়ার করছি।
জাতীয় সংগীতের কোথাও কি বাংলাদেশ শব্দটি আছে? নাই। আছে বাংলা শব্দটি। বাংলা বলতে শুধু বাংলাদেশ বোঝায় না, গভীরভাবে চিন্তা করলে পশ্চিমবঙ্গ (ইন্ডিয়া) বুঝায়। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের কখনো ভাল চায়নি। এজন্যই এটাকে জাতীয় সংগীত থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানাই।
আপনি তো দেখছি আস্ত পাঁঠা। বসে বসে কাঁঠালপাতা চিবাতে থাকেন।
মনজুর মোরশেদ স্যারকে ধন্যবাদ।
অসাধারণ লিখেছেন। জাজাকাল্লাহ।
এই সেই রবীন্দ্রনাথ, যে ব্রিটিশদের দালাল ছিল। বাংলাদেশের প্রজাদের কাছ থেকে সে জোর করে খাজনা আদায় করত। তার চুরির তথ্য প্রকাশ করার জন্য মোরশেদ স্যারকে ধন্যবাদ। আমরা আছি তার পাশে।

একটি ভিডিও ক্লিপকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে চলেছে, অধ্যাপক মনজুর মোরশেদ কিছুই জানেন না। কী করে জানবেন, তিনি তো দেশে নেই। বিষ্যুদবার রাতে বাঙালি কমিউনিটি আয়োজিত বইমেলায় যোগ দিতে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। ফেসবুক আইডি থাকলে দেখতে পেতেন। প্রযুক্তিতে তিনি অনভ্যস্ত। ফেসবুক সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গিও নেতিবাচক। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একথা সত্য যোগাযোগ অনেকটা সহজ করে দিয়েছে ফেসবুক। কিন্তু ফেসবুকের ভালো দিক যেমন আছে, তেমনি খারাপ দিকও বিস্তর। যেমন ধরুন, প্রত্যেক মানুষের নিজের কিছু বিষয় থাকে যেগুলো অন্যকে জানাতে চায় না। কিন্তু ফেসবুকিংয়ের কারণে আপনি না চাইলেও সেগুলো জানিয়ে দিচ্ছেন। জানিয়ে দিচ্ছেন আপনার মনের অজান্তে। ফেসবুকে অন্যের সাফল্য বা সুখবর দেখে জীবনকে ইতিবাচকভাবে নেওয়ার মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলেন অনেক। নিজের ছবি বা পোস্টে লাইক-কমেন্ট না পড়লে হতাশায় ভোগে। ফেসবুকের সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক হচ্ছে তাৎক্ষণিকতা। কোনো তথ্য যাচাই-বাছাই না করে অনেকে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করে বসে। এটা খুব খারাপ। এতে সামাজিক অস্থিরতা ও বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।

কট্টর মৌলবি-মাওলানারা, যারা সুযোগ পেলেই রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে, তাকে মালাউন, পৌত্তলিক, কাফের বলে গালি দেয়, এত বড় সুযোগ কি তারা হাতছাড়া করে? রাজধানীর বায়তুন নাজাত কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মাওলানা রুহুল আমিন কামালী জুমার খুতবার আগে মুসল্লিদের উদ্দেশে বললেন, দেখলেন তো সত্য কীভাবে প্রকাশ পায়? আপনারা ফেসবুকে দেখেননি কিছু? ওই যে অধ্যাপক মনজুর মোরশেদের ভিডিওটা? রামের গোষ্ঠী ভেবেছিল তাদের কবিগুরুর গোপন কথা গোপন রাখতে পারবে। শেষ পর্যন্ত পারল না। জাতীয় অধ্যাপক মনজুর মোরশেদ বিরাট পণ্ডিত, বিশিষ্ট লেখক। তিনি গবেষণা করে বের করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে লালনের গান চুরি করেছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা চুরি করে সে নোবেল পেয়েছিল। হা হা হা। সত্য কোনোদিন গোপন থাকে? থাকে না। সত্য এমন এক আগুন, যাকে ছাইচাপা দিয়ে রাখা যায় না। ঠিক কিনা বলেন? জোরে বলেন ঠিক কিনা? আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সম্মান দেন, যাকে ইচ্ছা বেইজ্জতি করেন। যেমন বেইজ্জতি করেছেন হিন্দুকবি রবীন্দ্রনাথকে। জোরে বলেন সুবহানাল্লাহ।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অধ্যাপক মনজুর মোরশেদের বক্তব্যের প্রতিবাদে বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করল প্রগতিশীল ছাত্রজোট। তাদের কর্মসূচিকে নৈতিক সমর্থন দিল সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট। বিকেল পাঁচটা থেকে দলে দলে আসতে শুরু করল ছাত্ররা। জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখল এগারোজন বক্তা। সবাই মজনুর মোরশেদকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানাল। সন্ধ্যায় বের হলো মশাল মিছিল। জাতীয় জাদুঘরের সামনে দাহ করা হলো মনজুর মোরশেদের কুশপুত্তলিকা।

বাংলাদেশ কবিতা সংসদ কি আর চুপ থাকতে পারে? মনজুর মোরশেদের বক্তব্যের প্রতিবাদে গণমাধ্যমে জ্যোষ্ঠ কবিদের একটি যৌথ বিবৃতি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন সংসদের সভাপতি সৈয়দ কামরুল আজাদ। দ্রুত একটি বিবৃতি ড্রাফট করলেন তিনি। শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথের ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস/ শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস’ পংক্তি দিয়ে। তারপর লিখলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, বাঙালি-বিরোধী একটি চক্র দিন দিন সক্রিয় হয়ে উঠছে। বাঙালি সংস্কৃতিকে উৎখাতের জন্য তারা নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্র রবীন্দ্রবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছিল। তখনও তাদের দোসররা মেতে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নানা রকম মিথ্যে প্রচারণায়। পাকিস্তানের সেই প্রেতাত্মারা আজও বাংলাদেশে রয়ে গেছে এবং মিথ্যে প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতির অবসান হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। আমরা বিশ্বাস করি, নতুন প্রজন্ম সঠিক তথ্য জেনে বড় হোক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে অধ্যাপক মনজুর মোরশেদ যে মনগড়া বক্তব্য দিয়েছেন, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। তার মতো পণ্ডিতের কাছ থেকে আমরা এমনটা আশা করিনি। আমরা মর্মাহত। আশা করি তিনি জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে জনমনের বিভ্রান্তি দূর করবেন।

এক তরুণ কবিকে পাঠিয়ে আজিজ মার্কেট থেকে বিবৃতিটি কম্পোজ করিয়ে আনা হলো। বিবৃতিতে দশজন বিশিষ্ট কবির সাক্ষর নেওয়ার কথা। সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাক্ষর আনতে হবে। জটিল কাজ। সংসদের সাধারণ সম্পাদক কবি জুবায়ের মতিন বললেন, সাক্ষর আনতে গেলে তো বিবৃতিটা আগামী কালের পত্রিকায় ধরানো যাবে না। তার চেয়ে বরং সবাইকে ফোন করে সম্মতি নিয়ে নিন, তাহলেই হবে।

প্রস্তাবটা সভাপতির মনে ধরল। ফোন করে তিনি ছয়জন কবির সম্মতি নিলেন। একজনের মোবাইল বন্ধ, আরেকজন সাকুরায় বসে মদ খাচ্ছেন, ফোন দিলেই কবিতা শুনিয়ে দিচ্ছেন এবং আরেকজন দেশের বাইরে। বাকি থাকল প্রবীণ কবি সুখরঞ্জন রায়। তিনি বললেন, মনজুর মোরশেদ এমন বক্তব্য দিয়েছেন কিনা আমি জানি না। ভিডিওটি আমি দেখিনি। শুনেছি তিনি এখন দেশের বাইরে। দেশে ফিরুক। কেন এসব কথা বললেন, আমরা তার কাছে জানতে চাইব। সন্তোষজনক উত্তর না পেলে তখন বিবৃতি দেওয়া যাবে।
জুবায়ের মতিন বললেন, সুখরঞ্জনদা ঠিকই বলেছেন। আসলে আমাদের অপেক্ষা করা উচিত। প্রয়োজনে ফোন নম্বর জোগাড় করে মনজুর মোরশেদের সঙ্গে কাল একবার কথা বলে নেওয়া যাবে।
দমে গেলেন সৈয়দ কামরুল আজাদ। বিবৃতিটা আপাতত স্থগিত করলেন।

রাত ন’টার দিকে সাংবাদিক মীর কামালের সহকর্মী নন্দিতা রায় ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানাল, একটু আগে পত্রিকা অফিস থেকে মীর কামালকে তুলে নিয়ে গেছে ডিবি পুলিশ। ব্যাস এটুকুই। কেন নিয়ে গেল, কোথায় নিয়ে গেল, কিছুই লিখল না।

ফেসবুক কি আর ঠান্ডা থাকে? গরম কড়াইয়ে ধান দিলে যেমন খই ফোটে, তেমনি ফুটতে লাগল নিন্দা ও প্রতিবাদের খই। অধ্যাপক মনজুর মোরশেদের ভিডিও ক্লিপটা তো প্রথমে মীর কামালই শেয়ার নিয়েছিল। নিশ্চয়ই এ অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে! রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বাজে কথা বলেছেন তো অধ্যাপক মনজুর মোরশেদ। গ্রেপ্তার করলে তো তাকেই করা উচিত। এ কেমন বিচার! সরকার কি রবীন্দ্রবিদ্বেষী মৌলবাদী চক্রের খপ্পরে পড়ল? ধিক্কার জানাই। মীর কামালের মুক্তি চাই।

ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পর, শুক্রবার রাত সোয়া দশটায়, নব্বই দশকের কবি শওকত জহির তার ফেসবুক আইডিতে শেয়ার নিল একটি ভিডিও ক্লিপ। জাতীয় অধ্যাপক মনজুর মোরশেদের একটি সাক্ষাৎকার। দেড় মিনিটের ক্লিপ। বোঝাই যাচ্ছে ক্লিপটি একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ। মনজুর মোরশেদ বলছেন, সেদিন এক ইউনিভার্সিটির শিক্ষকের সঙ্গে দেখা। পূর্বপরিচিত। একটা কাজে এসেছিলেন। নানা বিষয়ে আলাপ হলো। কথা উঠল শিল্প-সাহিত্য নিয়ে। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন সাঁইর গান চুরি করেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, নজরুলের কবিতা চুরি করে তিনি নোবেল পেয়েছিলেন। বোঝেন অবস্থা! একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মূর্খতা দেখুন! তার কাছ থেকে ছাত্ররা কী শিখবে?...আমার কথা হচ্ছে, যারা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এসব কথা বলে বেড়ায় তারা কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।

রচনাকাল: ২৫.৯.২০১৯