স্বকৃত নোমান
স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’
পর্ব ৭৫
প্রকাশিত : আগস্ট ২৮, ২০২২
প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ে প্রতি বছর দশ লাখ টাকা পর্যন্ত বই কেনার সুযোগ থাকে। সরকারিভাবে বই কেনার জন্য এই টাকা বরাদ্দ থাকে। কিন্তু কোনো মন্ত্রণালয় বই কেনে না। কেন কেনে না? কারণ তারা ভালো করেই জানে বই কেনার সঙ্গে সঙ্গেই এক বিরাট হট্টগোল বেঁধে যাবে। রবীন্দ্রনাথ এসে বলবেন, আমার বই বাদ গেল কেন? নজরুল এসে বলবেন, আমার বই মাত্র একটা নেওয়া হলো কেন? জীবনানন্দ এসে বলবেন, আমার ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ না নিয়ে ‘বনলতা সেন’ নেওয়া হলো কেন? আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এসে বলবেন, আমার বই না নিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বই কেন নেওয়া হলো?
অপরদিকে, আদি প্রকাশনী এসে বলবে, আমার বই তো একটাও নেওয়া হলো না, অনাদি প্রকাশনীর কেন দুটি বই নেওয়া হলো? বর্তমান প্রকাশনী এসে বলবে, অতীত প্রকাশনী তো মুরগী প্রকাশক, তার বই কেন নেওয়া হলো? বাংলা বাজারের ইসলামি মার্কেটের প্রকাশকরা বলবে, আমাদের বই না কিনে রুমি মার্কেটের বই কেনা হলো কেন? এই সরকার ইসলাম বিরোধী। আজিজ মার্কেটের প্রকাশকরা বলবে, আমাদের এখান থেকে বই না কিনে কনকর্ড থেকে বই কেনা হলো কেন? এই সরকার দুর্নীতিবাজ। এ নিয়ে শুরু হবে ফেসবুকে স্ট্যাটাস, সমালোচনা, নিন্দা। পত্রপত্রিকায় হবে লেখালেখি, টিভিতে হবে টক শো। মূলত এই ক্যাঁচালের ভয়ে মন্ত্রণালয়গুলো বই না কিনে টাকাটা অর্থবছর শেষে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কে নেবে এত ঝুঁকি? সচিবদের কী এমন ঠ্যাকা বই কেনার?
এর আগের পর্বে লিখেছি, সরকারি কর্মকর্তাদের জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাস বাড়ানোর জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বই কেনার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বইয়ের তালিকায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নবীরুল ইসলাম বুলবুলের ২৯টি বই ছাড়া বাকি বই নির্বাচন খুব ভালো। একজনের ২৯টি বই নেওয়া বড় অন্যায়। এছাড়া তালিকায় আরো কয়েকটি দুর্বল বই আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। সেগুলো চিটা। ধানক্ষেতে কেবল ধান হয় না, চিটাও হয়। ক্ষেত থেকে শত ভাগ ধান আশা করা অপ্রাকৃতিক চিন্তা। চিটাও কি ফেলনা? না, ফেলনা নয়। চিটা জ্বালানির কাজে লাগে, মুরগির খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বইয়ের শতভাগ বিশুদ্ধ তালিকা করা কখনোই সম্ভব নয়, কিছু না কিছু ভেজাল থাকবেই। আসল থাকলে ভেজাল থাকাটা স্বাভাবিক। আলোর বিপরীতে অন্ধকার থাকবেই। সাধু থাকলে চোর থাকবেই। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। এই নিয়মের বাইরে যাওয়া পৃথিবীতে সম্ভব নয়, কল্পিত স্বর্গে সম্ভব।
আমাদের কোনো কোনো প্রকাশকের অভিযোগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বই কেনায় স্বচ্ছতার পরিচয় দেয়নি। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বই কেনার আগে প্রকাশকদের সঙ্গে আলোচনা করেনি মন্ত্রণালয়। আমার প্রশ্ন, বই কেনার জন্য প্রকাশকদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে কেন? ধরা যাক, কুমিল্লা জেলার ডিসি অফিসের জন্য দশটি চেয়ার কেনা হবে। চেয়ারগুলো কেনার জন্য কি বাংলাদেশ ফার্নিচার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সঙ্গে আলোচনা করতে হবে? ধরা যাক, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন অফিসের জন্য টিস্যু পেপার কেনা হবে। সে জন্য কি বসুন্ধরা, সেফ, বাংলা টিস্যুসহ সকল টিস্যু কোম্পানির সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে? ধরা যাক সিলেট পুলিশ সুপার কার্যালয়ের জন্য কিছু কম্পিউটার কেনা হবে। সেজন্য কি বাংলাদেশের সকল কম্পিউটার ব্যবসায়ীর জন্য আলোচনায় বসতে হবে?
কারো কারো অভিযোগ, মন্ত্রণালয় ৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকার বই কিনছে, এর জন্য কোনো টেন্ডার আহ্বান করেনি, কোনো বিজ্ঞপ্তি দেয়নি। অভিযোগকারীদের সদয় অবগতির জন্য, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোনো বই কিনছে না, বই কিনছে স্থানীয় ইউএনও অফিস। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কেবল অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে এবং বই সাজেস্ট করেছে। প্রত্যেক ইউএনও ওই তালিকা অনুসরণ করে দুই লাখ টাকায় তাদের পছন্দমতো স্থানীয় এবং ঢাকার বিভিন্ন বইয়ের দোকান থেকে পছন্দমতো বই কিনছে। তালিকায় ১৪৭৭টি বই আছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে, তারা ঠিক ১৪৭৭টি কিনছেন। কিনছেন তাদের পছন্দমতো। আর কোটেশনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকার যে কোনো জিনিসপত্র কিনতে পারেন একজন ইউএনও। সেই বিধান রয়েছে।
সরকারি অফিসগুলোতে বই আগেও কেনা হতো। তখন কেনা হতো সরকারি চাকরি, জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্ট বইগুলো। এই প্রথমবারের মতো তালিকায় যুক্ত হলো সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়ের বই। এটা খুব ভালো ব্যাপার। লেখক-বুদ্ধিজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে নানা ক্ষেত্রে পাঠ্যাভ্যাস বৃদ্ধির কথা বলে আসছেন। এটা তারই বাস্তবায়ন। কিন্তু এই উদ্যোগ প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল অতিরিক্ত সচিব মো. নবীরুল ইসলামের কারণে। শেষ পর্যন্ত তার ২৯টি বই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন সচিব।
কিন্তু তবু আশঙ্কা থেকেই যায়। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে কেবল নবীরুল ইসলামের বই নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি, পুরো উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই উদ্যোগ নিয়ে নানা বিরূপ মন্তব্য এসেছে। কেউ বলেছেন, জনগণের টাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বই কিনতে হবে কেন? কেউ বলেছেন, বই কেনার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়নি। কেউ বলেছেন, এসব বই পড়া হবে না, এটা জনগণের টাকা লুটপাট করার অপকৌশল। কেই বলেছেন, বই না কিনে এসব টাকা সরকারি কর্মকর্তারা মেরে দেবেন।
অনুমান করি, ফেসবুকে এমন বিরূপ সমালোচনায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হয়ত থমকে দাঁড়িয়েছে। দুপুর থেকে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে যে, পুরো উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এবার ভেস্তে না গেলেও আগামী বছর থেকে আর বই কেনার মতো এমন ঝুঁকি নেবে না মন্ত্রণালয়। সেটা না হোক, এই কামনা করি। আমরা চাই, সরকার বই কিনুক। যেসব মন্ত্রণালয় বিতর্কের ভয়ে বই কেনা থেকে বিরত থাকছে, তারাও বই কিনুক। বিতর্ক থাকবেই। আগেই বলেছি, শতভাগ বিশুদ্ধ পৃথিবীতে কিছু নেই।
সরকারি উদ্যোগে বই কেনা হলে প্রকাশকরা উপকৃত হবেন, লেখকরা উপকৃত হবেন। বই কেনা হলে সরকারি কর্মকর্তাদের পাঠাভ্যাস অন্তত ১ পার্সেন্ট হলেও বাড়বে। তাতে ক্ষতি কী? সরকারি টাকায় কত কিছুই তো হয়, কত আমোদ-প্রমোদ, কত ভোগ-বিলাসই তো হয়; কিছু বই কেনা হলে ক্ষতি তো কিছু দেখছি না।
হ্যাঁ, বই কিনতে গেলে হয়ত আদি প্রকাশনীর বই বাদ পড়বে, তাতে আদি প্রকাশনীর প্রকাশক ক্ষিপ্ত হবেন। অনাদি প্রকাশনীর মাত্র একটি বই গেল বলে তিনিও ক্ষিপ্ত হতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ না গিয়ে ‘ঘরে বাইরে’ গেল বলে তিনি মনে কষ্ট পাবেন, সৈয়দ হকের ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’ না গিয়ে ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনি’ যাওয়াতে তিনিও ক্ষুব্ধ হতে পারেন। এগুলোকে পাত্তা না দিলেই হলো।
বই কেনা হোক। ভালো বইগুলো। দেশের এবং বিদেশি লেখকদের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো। জনপ্রশাসনকৃত এই তালিকায় চালর্স ডারউন, অমর্ত্য সেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবননান্দ, বুদ্ধদেব বসু, দেবেশ রায়, নীরদ সি চৌধুরী, ক্লিন্টন বি সিলি, অন্নদাশঙ্কর রায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, নোয়াম চমস্কি, বার্টান্ড রাসেল, চিনুয়া আচেবে, সৈয়দ মুজতবা আলী, আরজ আলী মাতুব্বর, গার্সিয়া মার্কেস, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখ দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের বই দেখে ভালো লেগেছে। নবীরুল ইসলাম বুলবুলের ২৯টি বই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে আন্তরিক ধন্যবাদ।
সরকারি অফিসের চেয়ার, টেবিল, পর্দা, এসি, দরজা, জানালা, ওয়েট পেপার, টিস্যু যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি প্রয়োজনীয় বইও। বইকে প্রয়োজন হিসেবে দেখা হোক। বই পড়ার মধ্য দিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মানবিক গুণাবলী বৃদ্ধি হোক। আমাদের প্রত্যাশা, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রতি বছর এভাবে বই কেনার উদ্যোগ অব্যাহত রাখুক। সরকারি কর্মকর্তাদের বইপাঠের প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে। আরও প্রত্যাশা, প্রত্যেক মন্ত্রণালয় এভাবে প্রতি বছর বই কিনুক। বইয়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা ফেরত না দিক। আমাদের আরও প্রত্যাশা, প্রত্যেক উপজেলায়, ইউনিয়নে, গ্রামে একটি করে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে দিক সরকার। সেসব পাঠাগারের জন্য প্রতি বছর বই কিনুক। তাতের পাঠকরা যেমন উপকৃত হবে, তেমনি উপকৃত হবে লেখক ও প্রকাশকরাও। চলবে
২৮.৮.২০২২