স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৬৮

প্রকাশিত : জুলাই ০৮, ২০২২

একদিন মহাদেব ও দেবী পার্বতী গহীন বনে ভ্রমণ করছিলেন। হঠাৎ তারা শুনতে পেলেন মন্ত্রোচ্চারণে শব্দ, ওঁ নমঃ শিবাঃ। দেখলেন, এক আশ্রমে একদল ঋষি প্রার্থনায় মগ্ন। পার্বতী জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্বামী, এই সঘন বনে কে আপনার প্রার্থনা করছে?’ মহাদেব বললেন, ‘সনকাদি ঋষি।’ পার্বতী হেসে বললেন, ‘আচ্ছা। এখন বুঝতে পেরেছি আমার সঙ্গে ভ্রমণে বের হওয়া আপনার একটা বাহানা মাত্র। আপনি আসলে ভক্তদের সঙ্গে দেখা করতেই এখানে এসেছেন। বলুন, আমি ঠিক বলেছি কিনা?’

মহাদেব বললেন, ‘শোনো মহেশ্বরী, ভক্ত তার ভগবানকে দেখার জন্য যতটা উদগ্রীব থাকে, ভক্তের সঙ্গে দেখা করার জন্য ভগবানও ঠিক ততটাই উদগ্রীব থাকে।’ পার্বতী বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়াব না।’

মহাদেব ও পার্বতী আশ্রমস্থ ঋষিদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দুজনকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়ালেন, প্রণাম জানালেন। কেবল উঠলেন না ঋষি সনৎকুমার। মহাদেব বললেন, ‘এ কী সনৎকুমার! আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে, অথচ তুমি আমাকে অভিবাদন করলে না!’

সনৎকুমার বললেন, ‘মহাদেব, কে আপনাকে প্রণাম করবে? আমার শরীর, না আমার আত্মা? কোনটা চান আপনি? আমার এই শরীর তো মিথ্যা, নশ্বর। একদিন না একদিন এই শরীরের ধ্বংস অনিবার্য। তাই এ শরীরের তো কোনো মাহাত্ম্য নেই। সত্য হচ্ছে আমার আত্মা। আপনি কি আমার আত্মার অভিবাদন চান? কিন্তু আমার আত্মা তো সেই পরমের অংশ, যা স্বয়ং আপনি। অর্থাৎ আপনি ও আমি অখণ্ড, এক। তাই যদি হয়, তবে কে বড়, কে ছোট? আমি উঠে আপনাকে কেন প্রণাম করব?

আখ্যানটি নিয়েছি শিবপুরাণ থেকে। এই আখ্যান বলছে, ভারতীয় আধ্যাত্মবাদ সর্বপ্রাচীন। এই আখ্যান সর্বেশ্বরবাদের কথা বলছে, যেমন বলেছেন শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবতগীতায়, অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ দর্শনের সময়। উপনিষদেও একই কথা প্রোক্ত হয়েছে : ‘ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।’ অর্থাৎ এই গতিশীল বিশ্বে যা কিছু অনিত্য বস্তু আছে সমস্তই পরমাত্মার দ্বারা আচ্ছাদনীয়।

মধ্যযুগে সহজিয়া মুসলিম সাধকদের অনেকে সর্বেশ্বরবাদের তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। অর্থাৎ একই উৎস থেকে সব কিছুর সৃষ্টি। তাই প্রত্যেক বস্তু ও অবস্তুর মধ্যে পরম বিদ্যমান, প্রত্যেকে তারই অংশ। মনসুর হাল্লাজ যেমন বেলেছিলেন `আনাল হক` বা আমিই আল্লাহ। ভারতীয় মুসলিম সুফি-সাধকরা বলতেন, ‘যত কল্লা তত আল্লা।’ চৈতন্য, কবীর, লালনও এই অদ্বৈতের কথা বলেছেন। চলবে