স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমানের গদ্যসিরিজ ‘মহাকালে রেখাপাত’

পর্ব ৬০

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৩, ২০২১

আরিচা ঘাট পার হয়ে রাজবাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। কাছেই দৌলতদিয়া যৌনপল্লী। আমি যৌনপল্লীতে ঢুকে দেখতে পেলাম, এক যৌনকর্মী ঠোঁটে লিপিস্টিক মেখে পেট-পিঠ উদোম করে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে আমার বীর্যের স্খলন ঘটে যায়। অর্থাৎ সেই যৌনকর্মী আমার কৌমার্য আহত করেছে, নষ্ট করেছে। আমি আদালতে দিলাম তার বিরুদ্ধে কৌমার্যহানির মামলা ঠুকে। কিংবা আমি বাসায় বসে ইউটিইউবে ঢুকলাম। তখন মিয়া খলিফার একটি পর্নো ভিডিও দেখতে পেলাম। দেখেই আমি উত্তেজিত হয়ে পড়লাম এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার বীর্যপাত ঘটে যায়। আমি দিলাম মিয়া খলিফার বিরুদ্ধে কৌমার্যহানির মামলা ঠুকে।

‘মেঘদল’ ব্যান্ডের বিরুদ্ধে মামলার বাদী ইমরুল হাসানের অবস্থাও হয়েছে এমনই। তিনি বাসায় বসে ইউটিইউবে ঢুকলে মেঘদলের একটি গান দেখতে পান। ওই গানে একটি দোয়া বা ইসলামি প্রার্থনা বা তালবিয়া নিয়ে ইসলামে নিষিদ্ধ বাদ্য-বাজনা তথা আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে বিকৃত সুরে গান আকারে অশ্রদ্ধার সঙ্গে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মাতালের মতো করে গাওয়া হচ্ছে। এতে তার ধর্মানুভূতি ‘মারাত্মকভাবে’ আহত হয়েছে। এই আহত রোগ এমন এক রোগ, যার চিকিৎসা ঢাকা মেডেকেলে নেই, বিএসএমএমইউতে নেই, পঙ্গু হাসলপাতালে নেই, ল্যাব এইউ বা স্কয়ারে নেই। সুতরাং তিনি দিলেন ‘মেঘদল’ ব্যান্ডের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে।

সমুদ্রে জল থাকে, ফেনা থাকে, লবণ থাকে, মাছ থাকে, হাঙর-কুমির-তিমিও থাকে। কেউ সুন্দরবনের এমন এক পয়েন্টে সমুদ্রস্নানে নামল যেখানে হাঙর-কুমিরের বিচরণ। নামা মাত্রই একটা হাঙর এসে তার একটা হাত কামড়ে নিয়ে গেল। দোষটা কার? মানুষটার, না হাঙরটার? ইউটিইউবও একটি সমুদ্র। সেখানে গান আছে, নাচ আছে, নাটক আছে, বাঁশির সুর আছে, তবলার বোল আছে, ওয়াজ আছে, রান্নাবান্না আছে, পর্নোগ্রাফি আছে। যার যা খুশি তাই দেখবে। কেউ যদি বলে আমি নাটক দেখব না। ওকে, দেখো না। তোমাকে তো দেখতে বাধ্য করা হচ্ছে না। কেউ যদি বলে আমি ওয়াজ শুনব না। ওকে, শুনো না। তোমাকে তো কেউ শুনতে বাধ্য করছে না।

ইমরুলকে তো কেউ মেঘদলের গানটি শুনতে বাধ্য করেনি। তিনি কেন গানটিতে ক্লিক করে সেটা শুনে নিজে নিজে আহত হতে গেলেন? মেঘদলের শিল্পীরা যদি বাংলাদেশের নাগরিক না হতেন, তারা যদি গানটি বিদেশ থেকে ইউটিউবে দিতেন, ইমরুল তখন কার বিরুদ্ধে কীভাবে মামলা ঠুকতেন? ইমরুল অভিযোগটি খেয়াল করার মতো। তার অভিযোগ, ‘ইসলামে নিষিদ্ধ বাদ্য-বাজনা তথা আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে বিকৃত সুরে গান আকারে অশ্রদ্ধার সঙ্গে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মাতালের মতো করে গাওয়া হচ্ছে।’ এই অভিযোগে যদি মেঘদলের শিল্পীরা অভিযুক্ত হয়, তবে একই অভিযোগে কলন্দরিয়া তরিকার মুসলিম সুফিগণও অভিযুক্ত। তারা বাদ্য-বাজনার সঙ্গে গান তো বটেই, কোরানের আয়াতও গেয়েছেন, গেয়ে থাকেন। একই অভিযোগে অভিযুক্ত জালালউদ্দিন রুমি এবং তার অনুসারী ঘুর্ণয়মান দরবেশগণ। কেননা তারা নাচতে নাচতে বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে হামদ-নাত এমনকি কোরানের আয়াতও গাইতেন, গেয়ে থাকেন। একই অভিযোগে অভিযুক্ত ভারতবর্ষে ইসলাম প্রতিষ্ঠার অন্যতম নায়ক খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি এবং তার চিশতিয়া তরিকার অনুসারীগণ। কেননা তারাও বাদ্য-বাজনার সঙ্গে নানা হামদ-নাত ও ইসলামের বাণী গেয়েছেন, গাইছেন।

মেঘদলের ‘ওম’ গানটিতে খৃস্ট, ইসলাম, সনাতন ও বৌদ্ধ—এই চার ধর্মের চারটি শ্লোক চয়ন করা হয়ছে। অনেকটা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের মতো। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে পৃথিবীর ধর্মগুলোর বিভিন্ন আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা ব্যক্তিকে বিভিন্ন ধর্মের অভ্যন্তরীণ মৌলিক দর্শন, যেমন নৈতিকতা, অধিবিদ্যা ও চিরমুক্তির ধারণা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান দান করে। মেঘদলের গানটিতে প্রধান চারটি ধর্মের শ্লোক চয়ন করে আন্তধর্মীয় একটা আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে। একইসঙ্গে বৌদ্ধ ছাড়া বাকি তিন ধর্মের সমালোচনাও করা হয়েছে গানটিতে। সমালোচনার জন্য চাইলে তিন ধর্মের লোকেরা মেঘদলের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারত। কিন্তু মুসলমান ছাড়া অন্যরা করেনি। করবেও না। কারণ তাদের বুদ্ধির মুক্তি কিছুটা হলেও ঘটেছে। তারা বুঝতে পারে, অনুভূতি অনুভূতি খেলা শিশুদেরকে মানায়, প্রাপ্তবয়স্ক বা প্রাপ্তমনষ্কদের নয়। আবার গানটিতে যে ইসলামের সমালোচনাও করা হয়েছে, সে বিষয়ে অনুভূতি ব্যবসায়ী ইমরুলের কোনো অভিযোগ নেই। না থাকারই কথা। সমালোচনাগুলো এতই সুক্ষ্ম যে ইমরুলের মতো লোকের পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন।

ব্যাপারটা এমন নয় যে, ধর্মের সমালোচনা এই প্রথম মেঘদল করল। যুগে যুগে ইসলামের বড় বড় মনীষী ইসলামের কট্টর সমালোচক ছিলেন। মধ্যযুগের মুসলিম মনীষীরা ইসলামকে সমালোচনা করেই এর সংস্কার সাধন করেছেন। ইসলাম ও মুসলমানের কঠোর সমালোচক পাকিস্তানের কবি ইকবাল। কবীর, লালন প্রমুখ বাউল-ফকিরগণও ইসলামের কঠোর সমালোচক। আর নজরুল তো ‘খোদার আসন আরশ ছেদ’ করতে চেয়েছেন। গীতিকার ও শিল্পী রমেশ শীলত তো ইসলামের কালেমাসহ নানা কোরান-হাদিসের উক্তি বাদ্যবাজনা সহযোগে গেয়েছেন। মামলা দিতে হলে উল্লিখিত মনীষীদের বিরুদ্ধেও মামলা দিতে হয়, তাঁদের মরণোত্তর বিচার করতে হয়।

ইমরুল তার অভিযোগে বলেছেন, ‘মেঘদল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মাতালের মতো করে গানটি গেয়েছেন।’ অথচ দেখা যাচ্ছে ইমরুল নিজেই উদ্দেশপ্রণোদিতভাবে মামলাটি দায়ের করেছেন। বোঝা যাচ্ছে, ইসলামের কোনো জ্ঞান তো তার নেই-ই, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও তার নেই। অনুমিত হচ্ছে, তিনি আসলে একজন অনুভূতি ব্যবসায়ী। মেঘদলের গানটিকে পুঁজি করে তিনি নাম-খ্যাতি চাইছেন এবং পাচ্ছেনও। কিংবা ভালো করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে ইমরুল এমন এক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হয়ে আদালতে কার্যক্রম চালাচ্ছেন, যে গোষ্ঠীটি এই দেশকেই স্বীকার করে না, যারা এই দেশেকে আফগান-পাকিস্তান বানাতে চায়।

আদালতের উচিত ছিল মামলাটি আমলে না নিয়ে খারিজ করে দেওয়া। আদালতে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ঘাপটি মেরে আছে কিনা খুঁজে দেখা দরকার। সরকারের উচিত ইমরুল হাসান সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ-খবর নেওয়া। তার উদ্দেশ্য কী জানা। গানটি পনেরো বছর আগের। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টির কালে টিএসসিতে যখন সম্প্রীতি পক্ষে গানটি পরিবেশিত হলো, তখনই এই গানের বিরুদ্ধে মামলা দিলেন ইমরুল। বোঝাই যাচ্ছে মামলাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আর দ্রুতই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংস্কার জরুরি। এই আইন অনেকটা বানেরর হাতে ছুরি দেওয়ার মতো। বানর ছুরি চালাতে জানে না। তার হাতে ছুরি দিলে অপরকে তো অহত করেই, নিজেকেও করে। বাংলাদেশের মানুষ এখনো প্রযুক্তির ব্যবহারের অপরিপক্ক। এমন আইন মানুষের চিন্তার বিকাশের প্রতিবন্ধক।

আর হে মুসলমান, কথায় কথায় অনুভূতি আহত হওয়ার এই খেলা বন্ধ করো। ইসলামে অনেক ময়লা জমে গেছে। এই ময়লা দূর করা আবশ্যক। সমালোচনার দরজা খোলা না রাখলে তোমাদের মুক্তি নাই। দম বন্ধ হয়ে এক সময় মারা যাবে। কারো ধর্মানুভূতি আহত হলে সে নিজেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠুক, যদি কোথাও এর চিকিৎসা থেকে থাকে। তার একার আহত হওয়াকে কেন্দ্র করে আইন-আদালত এবং গোটা সম্প্রদায় এমনকি গোটা জাতিকে জড়িয়ে ফেলা সম্পূর্ণ অনুচিত। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক