সেই সকালে
রহিমা আক্তার কল্পনাপ্রকাশিত : মার্চ ০৬, ২০১৯
গন্তব্যস্থলের দিকে যেতে প্রায় এক তৃতীয়াংশ রাস্তা পার হবার পর প্রথম বিব্রতকর ঘটনাটি ঘটে। তরুণীটির সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেই পরিচয় হয়েছিল পাশের সহযাত্রী ভদ্রমহিলা, ড. শাহেদউদ্দিনের শ্বাশুড়ির। ভদ্রমহিলাকে সে বলেছিল জুঅলজির প্রফেসর আনিসের কাছে যাচ্ছে। এই তথ্য দেবার অল্পকথা পরেই, গাড়িটি কারো কোনো নির্দেশনা ছাড়া মসৃণভাবে ব্রেক করে দাঁড়িয়েছে রাস্তার একপাশে, প্রফেসর আনিস আহমেদ উঠে এসেছেন গাড়িতে। বোঝা গেল, তিনি প্রতিদিন এখান থেকে উঠেই মূল শহরের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে যান। পাশে বসা ভদ্রমহিলা, যিনি ড. শাহেদউদ্দিনের শ্বাশুড়ি এবং সদ্য পরিচিতা, একটু বিস্মিত চোখে তরুণীটির দিকে তাকান। তরুণীর কিছু করার থাকে না। হতচকিত একটা অবস্থা। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যই। অল্প পরেই সে আচমকা-অস্বস্তির বোধটি একাপাশে সরিয়ে রেখে প্রফেসর আনিসের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে।
আনিস সাহেব ‘কী খবর সব ভালো তো’ বললে সে মিষ্টি করে সৌজন্যের হাসি হাসে। মাথা কাত করে জবাব দেয় ভালো। সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রশ্নটি তিনি করে বসেন, যেটির আশংকা সে করছিল আনিস সাহেবকে দেখার পর থেকেই।
‘হঠাৎ এদিকে, কোতায়?’
‘আপনার কাছেই যাচ্ছি। আমি জানতাম আপনি ক্যাম্পাসেই থাকেন।’
চমৎকার স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এই মিথ্যা কথাটি তাকে বলতেই হয়। কারণ একটু আগেই শাশুড়ি মহিলাটির কাছে এবং কয়েকজন অল্প পরিচিত শিক্ষকের প্রশ্নের জবাবে সে এই কথাটি বলেছে। বলেছে নিরুপায় হয়ে।
আনিস আহমেদকে প্রসন্ন দেখায়।
‘মোস্ট ওয়েলকাম, তাহরে আফরিন, ওখানে পৌঁছে কথা হবে কেমন?’
কথাটা বলে আনিস আহমেদ সামনের কয়েক সারি দখলকৃত আসন পার হয়ে একটু পেছনে গিয়ে বসেন।
এবার শাহেদউদ্দিনের শাশুড়ির চোখ খানিকটা সরল হয়ে আসে। আশেপাশের অনেকেরও। তরুণীটি, যার নাম আফরিন, গাড়িটির সামনের দিকের একটি সুবিধাজনক আসনে এতক্ষণ বেশ সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বসেছিল, এখন সে কেমন যেন আড়ষ্ট বোধ করে। ড্রাইভারের সামনের গ্লাসটিতে সে তার চোখ ফেলতে সাহস করে না। মনে হয় এক্ষুনি কারো সাথে তার সরাসরি দৃষ্টিবিনিময় হয়ে যাবে, লোকটি তখুনি বুঝে নেবে যে সে মিথ্যা বলেছে। নিজের সমগ্র ভেতর বাহির তন্ন তন্ন করেও সে এই মিথ্যাচারের কোনো কারণ বের করতে পারে না। আসলে সে যাচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক খালেদ শাহরিয়ারের কাছে। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের ভেতরে এই প্রথমবারের মতো।
ওখানে গিয়ে শাহরিয়ারকে পাওয়া যাবে কিনা, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। দু’ জনের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। গতকাল বিকেলে প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে আসবার কথা ছিল তার। গিয়েছিল আফরিনও। শাহবিয়ার আসেনি। শাহরিয়ার সাধারণত কথা রাখে, তবে কখনো যে সে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেছে। তার বারবারই মনে হচ্ছিল, শাহরিয়ার নিশ্চয়ই অসুস্থ। তারপর আজ ভোরে পরিকল্পনাহীনভাবে শাহরিয়ারের কর্মস্থলের উদ্দেশে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-বাসে উঠে পড়া। সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে একধরনের যুক্তিহীন আবেগের প্রাধান্য অনুভব করে সে। প্রেম...?
সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। নিজের ওপর খানিকটা বিরক্তি আর খানিকটা মমতায় মেশামেশি এটি বোধ তাকে বিপর্যন্ত করে রাখে। আশ্চর্য, খালেদ শাহরিয়ার তার কেমন বান্ধব, কিভাবে নেবে তার এই অনির্ধারিত সফরের বিষয়টি- এসব কিছু ভাববার আগেই বিদ্যুচ্চমকের মতো যে প্রশ্নটি তার মাথায় তীব্রভাবে জেগে ওঠে, তা হচ্ছে, এই ভদ্রলোকের কাছে যাবার কথাটি সে সকলের কাছ থেকে আড়াল করছে কেন? কেনই বা সে নির্বিচারে মিথ্যা কথা বলছে সাধারণ একটি সত্য কথাকে লুকোবার জন্য? নিজেকে তার নিজের কাছেই অচেনা লাগে।
রাস্তার দু’পাশে খানিক জুড়ে নিবিড় গাছপালা, একটু পরেই বিস্তৃত খোলা মাঠ দুধারে, কিছুদূর গিয়ে আবার গাছপালা- মুগ্ধ হবার মতো প্রকৃতি। এর ভেতর দিয়ে ছুটতে গাড়ি। আফরিন এসবের কিছুই দেখে না। এখন তার কাছে পুরো ব্যাপারটাই অনিশ্চিত লাগছে। অস্বস্তিকরও। সে মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে। শাশুড়ি ভদ্রমহিলা তাকে লক্ষ্য করছিলেন। তার গা ঘেঁষে বসা প্রায় কৈশোর-উত্তীর্ণ কন্যাটি যত মনোযোগ দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখছিল, তিনি ঠিক ততটা মনোযোগই দিচ্ছিলেন পাশের সিটে গম্ভীর মুখে বসা একলা মেয়েটির দিকে।
আনিস আহমেদের সঙ্গে আফরিনের কথাবার্তায় মেয়েটিকে খানিকটা সহজভাবে নিলেও ভদ্রমহিলার ঔৎসুক্য যে কোনো মীমাংসিত সিদ্ধান্তে পৌঁছেনি, অচিরেই তা প্রকাশ পায় তার গ্রাম্য-শহুরে টানের মিশ্র কথামালায়।
‘আপনি তাইলে বহুদিন পরে ওইদিকে যাইতেছেন।’
‘জ্বি।’
‘এর আগে কখন গেছেন?’
‘ছাত্রী যখন ছিলাম, তখন গিয়েছি কয়েকবার।’
‘পড়াশুনা শেষ হইছে মনে হয় বেশিদিন হয় নাই।’
‘জ্বি না।’
‘এখন কিছু করেন?’
‘একটা বিদেশি ফার্মে চাকরি করছি।’
‘খুবই ভালো কথা। ছাত্রী থাকতে মনে হয় মাঝে মধ্যেই এইখানে বেড়াইতেন?’
ভদ্রমহিলার চোখে কৌতূহল। আফরিন স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে স্মিতমুখে বলে, ‘জ্বি না।’
‘তা হইলে? বললেন যে...’
‘বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেছি। গান করতে।’
‘ও। সেইজন্য আপনাকে চেনা চেনা লাগতেছে।’ ভদ্রমহিলাকে বেশ প্রীত মনে হয়। তার পাশে বসা কিশোরীটি এবারে জানালা থেকে মুখ ফেরায় এবং প্রথমবারে মতো উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘আপনি টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেন না?’ তারপর মুহূর্তেই সে তার মার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি আগেই বলেছিলাম. মা।’
আফরিন একটু সলজ্জ হাসে। শাশুড়ি বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, ‘আপনার গান আমি টিভিতে দেখেছি। খুব ভালো গান।’ কিশোরীটি উসখুস করে, ‘ও মা, উনি তো...’
আফরিন কিশোরীর দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারা করে আর কিছু না বলার জন্য। মেয়েটিও কী ভেবে যেন চুপ করে যায়। ভদ্রমহিলা গুলিয়ে ফেলেছেন, বুঝতে পারে আফরিন। বেচারীকে বিব্রত করে কী লাভ।
কিশোরী মেয়েটি লজ্জিত চোখে আবার বাইরে তাকায়। এ বয়সের ছেলেমেয়েরা নিজেদের জানা-চেনার পরিধি এবং আত্মসচেতনতা সম্পর্কে খুব স্পর্শকাতর হয়। আফরিন প্রতি একরকম মায়া বোধ করে। ভদ্রমহিলা নির্বিকার। তিনি পান খাচ্ছেন। তার প্রবল ঔৎসুক্যের লক্ষণ আপাতত আর দেখা যাচ্ছে না। কিছু একটা যে গোলমেলে বলে ফেলেছেন সম্ভবত তা বুঝতে পেরেছেন। আফরিন ঠোঁটে উঠে আসা হাসিটা লুকাতে গিয়ে বাতাসে উড়তে থাকা চুল সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শাড়ি গোছগাছ করে। তবু অস্বস্তি কাটে না। কিন্তু সে মহিলার ভুল ভাঙিয়ে দেয়ার গরজও বোধ করে না।
আসলে সে কোনোদিনই টিভিতে গান করেনি। ওই মাধ্যমটিতে সে আবৃত্তি করে, বছর খানেক ধরে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছে। গান সে নিয়মিত করে রেডিওতে। যাকগে, অর্ধসত্য হলো আর কি। গানও সে করে, টিভি-প্রোগ্রামও করে। লজিকের ‘ফ্যালাসি’র কথা মনে পড়ে যায় তার। মনে মনে হেসে ফেলে সে।
গাড়ি ছুটছে। এক আশ্চর্য হীনমন্যতার বোধ আফরিনকে জড়িয়ে ধরে। সে চারপাশে তাকায়। বাসের ড্রাইভারের বাঁ পাশে লম্বালম্বিভাবে স্থাপিত যে সিটগুলোকে সাধারণত ‘মহিলা সিট’ বলা হয়, সেখানে বসেছেন একজন মহিলা শিক্ষক। তার গোড়ালির ওপর থেকে আলগা হয়ে উড়ছে শাড়ির পাড়। বাতাসের তোড়ে কিছুটা আলগাভাবে ফেঁপে উঠেছে দুই পা ঘিরে থাকা পেটিকোটও। তার নিরাসক্ত চেহারায় একটাই অভিব্যক্তি- বিরক্তি। আফরিনের দু’সারি সামনে ক’জন মধ্যবয়সী শিক্ষক নিজেদের মধ্যে কি একটা একাডেমিক বিষয়ে আলোচনা করছেন। আরো দুজন তরুণ মহিলা-শিক্ষক নিজেদের সংসার, বাচ্চা, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি নানান বিষয়ে আলাপচারিতায় মশগুল। আপাতদৃষ্টিতে যে যার মতো ব্যস্ত, কিন্তু প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সূত্রে একীভূত। আফরিন নিজেকে হঠাৎ দারুণভাবে বিচ্ছিন্ন বোধ করে। না, সে কারোই কেউ না। এই গাড়ির আরোহীদের তো নয়ই। সর্বত্রই তার অনধিকার। সর্বত্র অবাঞ্ছিত উপস্থিত।
কবে থেকে সে নিজেকে এমন অবাঞ্ছিত ভাবতে শুরু করেছিল? তার চিন্তা স্মৃতির সূক্ষ্ম সুতো ধরে খুব বেশি দূর পেছাতে পারে না। তার মাতৃহীন অনাদরের শৈশব, অসহায় পরাশ্রয়ী কৈশোর, সংগ্রামশীল বর্ণহীন তারুণ্য তাকে বাস্তবের দিকে ফিরে আসতে বাধ্য করে।
সে তার প্রথম যৌবনের ভালোবাসার কথা ভাবে। প্রায়শই ভাবে। ছেলেটি বহুদিন বুঝতেই পারেনি যে, আফরিন তাকে ভালোবাসে। যখন ব্যাপারটা স্পষ্ট হলো, তার দু’বছর আগেই ছেলেটি বিবাহিত। ততদিনে সেই খুব মেধাবী, বছর তিনেকের সিনিয়র তরুণটির প্রতি অর্ধস্ফূট ভালোবাসার অবয়বটি লালন করতে করতে আফরিন অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার দোর গোড়ায়। আর তার প্রিয় তরুণটি সৃজনশীলতার উন্মদনায় খামখেয়ালী মাত্র একবছর আগে স্নাতকোত্তর পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব শেষ করেছে। এবং পরিবার, বন্ধুবান্ধব-স্বজনের প্রবল বিরোধিতার মুখেও গোপনে সেরে রেখেছে তার বিপ্লবী বিবাহ। একসময় প্রবল জনশ্রুতির ভেতর দিয়ে প্রকাশ্যে আসে তথ্যটি। আফরিন তার প্রিয়জনটিকে ভালোবাসার কথা জানাবার জন্য কখনো নিভৃতে ডাকতে পারেনি। ডেকেছিলো তার বিয়ে বিষয়ক জনশ্রুতিটি সম্পর্কে জানবার জন্যে। এবং সেই প্রথম ও শেষবারের মতো নির্জনে বসেছিল তারা। শুধু দুইজনে একা। আফরিনের অনুসন্ধিৎসার জবাবে ছেলেটি হালকা ভঙ্গিতে স্মিত মুখে জানিয়েছিল, হ্যাঁ, হঠাৎ করেই হয়ে গেছিল বিয়েটা। কিন্তু সে তো বছর দুই আগের ব্যাপার শুনে আফরিন হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। আর কতটা মর্মাহত, সেটা তার অন্তর্যামী জানেন। কিন্তু সে বহুকষ্টে স্থির রাখতে পেরেছিল নিজেকে। সামনে, মাত্র সপ্তাহ দুই পরে অনার্স ফাইনাল। পিছু ফিরে তাকায়নি সে আর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করা পর্যন্ত এক মন্ময় বন্ধু সবসময় তার সহমর্মী হিসেবে পাশে ছিল, আশ্চর্য কান্তিমান, প্রতিভাবান তরুণ চিত্রশিল্পী সেই বন্ধুর সঙ্গে আফরিনের অসম্পূর্ণ ভালোবাস অবিশ্বাস্যভাবেই পূর্ণ হয়ে উঠেছিল মাস্টার্স পরীক্ষার পরে। ভালোবেসেছিল তারা। একে অপরের বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছিল। পরস্পরের প্রতি হয়ে উঠেছিল নির্ভরশীলও। দীর্ঘদিনের স্বপ্নময়তার ভেতর দিয়ে অনিবার্য বাস্তব হয়ে এগিয়ে আসছিল তাদের আকাঙ্ক্ষার যৌথ জীবন।
ছেলেটির ক্যান্সার ধরা পড়ে খুব আকস্মিকভাবেই। কতজনের এরকম ঘটনা শেষ পর্যন্ত ডায়াগনোসিসের ভুল বলে প্রমাণিত হয়। দেশের রিপোর্ট ভুল হলে বিদেশে গিয়ে দেখা যায়, কিচ্ছু হয়নি। আফরিনের বন্ধুকে প্রথমে বোম্বে, পরে ব্যাংকক নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নাহ্, বাংলাদেশের ঢাকার ডায়াগনোসিস তার ক্ষেত্রে নির্ভুলই হয়েছিল।
আফরিন আর কাউকে ভালোবাসার কথা ভাবেইনি এরপর। ভাবতে পারেনি। ছোটকাল থেকে পারিবারিক বঞ্চনা তাকে এমনিতেই যে কোনো বিষয়ে অধিকারবোধ রহিত করে তৈরি করেছে। তার ওপর ঘটনা দুটি তাকে এমন বিপর্যস্ত করে, সে নিজেকে গুটিয়ে নেয় নিভৃতে।
এখন তার স্তাবকের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু আজকাল সে এত নিঃসঙ্গবোধ করে! আর এত অনিশ্চিত!
এখন এই মুহূর্তে তার জীবনের অনেক দৃশ্যমান সাফল্যের আড়ালে লুকানো ব্যর্ততা তার সামনে দাঁত বের করে হাসতে থাকে। একটি ভয়ের কাঁপন শুরু হয় তার ভেতরে। কী সে করতে যাচ্ছে আজ? কেন সে যাচ্ছে শহরতলীর ওই মনোরম আনাত্মীয় ভূমিতে! কে আছে ওখানে তার!
শাহরিয়ার?
কে নিশ্চিত করে বলবে এই তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক তার কে! আত্মীয়? অনাত্মীয়?
‘আপনি মনে হয় কিছু নিয়া চিন্তিত আছেন।’
কিছুটা চমকে ওঠে জবাব দেয় আফরিন, ‘না না, আসলে আমি জার্নিতে খুব অভ্যস্ত না তো, একটু শরীর খারাপ লাগছে।’
ড. শাহেদউদ্দিনের শাশুড়ি ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ‘একি কথা। আগে বলবেন না? আমরা এই গাড়িতে সবাই একটা পরিবারের মতো। একজনের বিপদ আপদ হইলে...’
ভদ্রমহিলার আচরণ কিছুটা অযাচিত মনে হলেও তার মমতা আফরিনকে স্পর্শ করে। তবু সে তাকে মাঝপথে থামিয়ে দেয়, ‘না খালাম্মা। ওরকম কিছু না। মাথাটা সামান্য ধরেছে।’ বলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুঁজে জানালার ফ্রেমে মাথা রাখে সে।
‘কী বলেন। রাস্তাঘাটে শরীর খারাপ হইলে সামান্যটাই অনেক।’ ভদ্রমহিলা উশখুশ করছেন বুঝতে পারে সে। তার বলা কথাটি আফরিনের কানে বারবার প্রতিধ্বনি তোলে, ‘এই গাড়িতে সবাই একটা পরিবারের মতো।’ নাহ্, আফরিন এই ‘বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক বাস পরিবারের’ কেউ না। সে একা। আগন্তুক। আবার সেই প্রবল বিচ্ছিন্নতাবোধ তাকে পীড়িত করতে থাকে।
ভোরবেলা তেকে শাহরিয়ার এক অদ্ভুত আলস্যে ভুগছিল। কর্তব্য স্থির করতে পারছিল না সে। গতকাল প্রেসক্লাবের আলোচনা সভাটিতে সে যায়নি কেন, বিষয়টি ভাবলে সে একটু আশ্চর্য হয়। ওখানে আলোচক বা প্রবন্ধকার হিসেবে তার কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। কিন্তু তার বিষয়-সংশ্লিষ্ট বলে সভাটিতে সে যাবে বলে স্থির করেছিল। শুধু আলস্যের কারণে সে কোনো গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বা ক্লাস বাদ দিয়েছে, এমনটি তার স্মরণে আসে না। ছাত্রাবস্থায় নয়, শিক্ষক হিসেবে যোগ দেবার পর তো নয়ই। আর কাউকে কথা দিলে তা যথাসম্ভব রক্ষা করার চেষ্টা করে সে। বিচ্যুতির ঘটনা বিরল।
ছাত্রকালে বন্ধুরা এই নিয়ে নিয়মিত হাসি ঠাট্টা করেছে। বন্ধুদের মতে তার ‘প্রেম জিনিসটাই’ হলো না অতিরিক্ত আদর্শবাদিতার জন্য। শাকুর একদিন বলেছিল, ‘খালেদ তো কথা দিলে রাখতে হবে বলে কাউকে কথাই দেবার সাহস করে না।’
শিবলি ফোড়ন কেটেছিল, কিছুটা সুরেলা ঢঙে গীতিকা পাঠের মতো করে, ‘পাছে সেই কথা বন্ধু রাখিতে না পারে...’ ঊর্মি, জামাল, শাহীন, সবাই সহাস্যে গা দুলিয়ে ধুয়া ধবেছিল, ‘কথা রাখিতে না পারে...’
ফচকেমি করে দুলাল বলেছে, ‘আহারে বালক!’ শোনামাত্র শিবলি ‘বালক’ শব্দটিকে যেন খামচি মেরে ধরে, ‘‘বালক নহে বালক নহে, নাবালক বল।’
সকলের উচ্চহাসির মধ্যে শিবলি চালিয়ে যায় তার নিজস্ব ভঙ্গির রসিকতা, ‘ভাষা শুদ্ধ করিয়া বলিবে। উহাকে আজীবন দুগ্ধপোষ্য নাবালক বলিলে অধিক শুদ্ধ হয়।’ শিবলির রসিকতায়, সকলের উচ্ছ্বসিত কৌতুকে শাহরিয়ার একটু ম্রিয়মান হয়েছিল।
বন্ধুরা এখন যে যার কর্মস্থলে। দেশে, বিদেশে। ঘনিষ্ট বন্ধুবৃত্তের মধ্যে শুধু সে আর ঊর্মি আছে এই ক্যাম্পাসে, শিক্ষকতায়। ঊর্মি এখন গণিতের সহকারী অধ্যাপক শামসুদ্দিনের স্ত্রী, ঊর্মিলা শামস্। এক পুত্রের জননী। কিন্তু আজকাল তার হয়েছে কি? সবকাজে এক অচেনা অকারণ দ্বিধাগ্রস্ততা তাকে অস্থির করে তুলছে। এই অস্থিরতার কারণ কী?
বিভিন্ন ঘটনাবলি খুঁজে খুঁজে সে তার অন্তরস্থিত দোলাচলের সঙ্গে সম্পর্কিত হিসেবে চিহ্নিত করেছে একজনকে। মোটামুটি বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যে পড়ে এমন একটি মেয়েকে। আফরিন মুর্শিদা। এই তরুণীর প্রতি তার কোনো আসক্তি নেই। তাকে, তার স্বাভাবের সবটুকুকে শাহরিয়ার পছন্দ করে বলে ভাববারও কোনো কারণ নেই। শাহরিয়ারের মৃদু নম্র স্বভাবের প্রায় উল্টো সে। এবং খুবই, যাকে বলে ‘ক্যাপাব্ল্’। মানে কী? শাহরিয়ার শব্দটির বাংলা খোঁজে। ‘সক্ষম’ বলা যায় কি? মোট কথা, মেয়েটি নিজের যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে যথেষ্ট পারঙ্গম। স্বাবলম্বী।
সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্রী, পড়াশুনায় ভালো করেছিল। চাকরি একটা করছে ভালো, কী একটা বিদেশি কোম্পানিতে যেন আছে, এক্সিকিউটিভ। রেডিওতে গানটান করে। টেলিভিশনে কী কী প্রোগ্রাম যেন করে দীর্ঘদিন, আজকাল একটা এক ঘণ্টার ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছে। মাসে একদিন পিক আওয়ারে। চাট্টিখানি কথা নয়। বছরখানিক হয়ে এলো প্রোগ্রামটার। ভালো কথা। কোনোটাই ফেলে দেবার মতো যোগ্যতা নয়।
কিন্তু মেয়েটার মধ্যে কি যেন একটা নাই। কী একটার যেন অভাব। সফিসটিকেশন? কথাটা ভেবে শাহরিয়ার নিজের মধ্যে সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। মেয়েটিকে জোর করে অপছন্দ করতে চাইছে সে! আর সেজন্যেই খুঁজে খুঁজে তার ঘাটতি আবিষ্কার করতে তৎপর হয়ে উঠেছে নাকি? নাহ্, অতটা উচিত হয় না। তবে এটা সত্যিই তার মনে হয়, আফরিনের মধ্যে কিরকম একটা দৈন্য যেন আছে, কী একটা ‘নাই নাই’ ভাব। কিছু কি আড়াল করে সে সবার কাছ থেকে? কোথাও কি একটা ভীষণ অপূর্ণতা আছে তার গোপনে গোপনে? কাথাটা ভাবলে শাহরিয়ার মনে মনে কেঁপে ওঠে। ওরে বাবা, মেয়েদের কত রকমের গোপন সমস্যা থাকে বলে সে শুনেছে! কত বিচিত্র ধরনের ঘাটতি। এসব ভাবলে তার কাছে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারটা সত্যিই খুব ঝুঁকির বলে মনে হয়। তার এমনিতেই সিরিয়াস ধরনের স্বভাব। সবকিছু নিয়ে সে একটু বেশি ভাবে বলে সকলের ধারণা। কিন্তু আফরিন...
আবার আফরিন তার চিন্তাভাবনা দখল করে বসে। নিজের ছেলেমানুষী অস্থিরতায় নিজেই অপ্রস্তুত বোধ করে সে। ধূর! সকাল বেলাটা কি বেসামাল ধরনের অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। এবং খুবই আশ্চর্যজনক যে, এক দুর্নিবার টান সে অনুভব করছে আফরিনের জন্য।
এরকমটা এই প্রথম নয়। গতবছর শীতে, রাজশাহীতে গেলে, শীর্ণ পদ্মা নদীতে নৌকায় করে ঘুরতে তার প্রবলভাবে মনে পড়ছিল আফরিনকে। সে অনেক যুক্তি দিয়ে নিজেকে বুঝাতে চেয়েছিল, এই মেয়েটি তার কেউ নয়। এর সঙ্গে সম্পর্কটাকে কেউ শ্রেফ পরিচয় বলবে, কেউ বন্ধুত্ব বললেও বলতে পারে। কিন্তু এমন আকুলি বিকুলি করে মনে পড়বার মতো অন্তরঙ্গতা আদৌ নেই তাদের। প্রেমের প্রশ্ন তো অবান্তর। আর প্রেমের বিষয়টি শাহরিয়ারের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে ছেলেখেলাকে সে ঘৃণা করে। যে কারণে পদ্মার বুকে বসে একান্ত নিজস্ব মুক্তচিন্তার অবকাশে সে ভেবেছিল অনেক, অনেক কিছু। তার মা-বাবা আর পরিবার যেরকমটি ভাবে, আফরিন সে ধাঁচের মোটেও নয়। ফর্সা, নিটোল হাতপা, নম্র, লাজুক, পৃথিবীর কোনো রূঢ়তা যাকে স্পর্শ করেনি তেমন একটি বধূ তাদের কাম্য। শাহরিয়ার যেমন সর্ব অর্থে সুযোগ্য, সেরকম একটি পরিবারের আদরের সুকন্যা হবে তার স্ত্রী, সংসারের সকলের কাছে নন্দিত বউ। আফরিনের কিছুটা চোয়ালভারী সাদামাটা জেদি ধরনের মুখে সেই কল্পনার গৃহলক্ষ্মীর আদল আবিষ্কারের সম্ভাবনা শূন্য, সমগ্র পরিবারের প্রত্যাশা পূরণের প্রতিমূর্তি সে কখনো হতে পারে না।
পদ্মার পশ্চিমপাড়ে সবুজ গাছগাছিল ঘেরা লোকালয় ক্রমশ ঘনবর্ণ হয়ে আসছিল। ঘোলাটে লাল সূর্য ডুবছিল কৃষ্ণবর্ণ ধরে আসা অস্পষ্ট গ্রামগুলোর মাথায়। আকাশেও রক্তরঙ আর কালো-ধূসর মিশ্রণের বুক হু হু করা কোলাজ। শাহরিয়ারের কেন যে কান্না পাচ্ছিল! আর ঠিক আজকের মতোই, সমস্ত যুক্তি-বিশ্লেষণ ছাপিয়ে, অকারণে তুমুল আবেগে মনে পড়ছিল আর কাউকে নয়, আফরিনের মুখ। ভারি চোয়াল, সাদামাটা চেহারায় একজোড়া বাক্সময় চোখের দুঃখী দুঃখী মুখটা।
সে নদীর উপরে বসেই পকেটে পেয়ে যাওয়া পেন্সিলে নৌকার পাটাতনে পড়ে থাকা সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে ভেতরের সাদা অংশে একটা তীব্র আবেগের চিঠি লিখে ফেলেছিল। পরে অবশ্য বাড়ি ফিরে নদীতে বসে লেখা অংশটুকু অবিকৃতভাবে অন্য একটি সুন্দর কাগজে লিখে, আরো কিছু কথা জুড়ে দিয়ে চিঠিটা পাঠিয়েছিল ডাকে। সে চিঠিতে উন্মোচিত অনুভূতির প্রত্যেকটি বাক্য, প্রতিটি বর্ণ সত্য। কিন্তু ক’দিন পরই নিজেকে সে সামলে নিয়েছিল। বিচারবুদ্ধি। পরের ঘটনা ভাবরে তার নিজের কাছেই নিজেকে লজ্জিত লাগে।
আফরিন কি আহত হয়েছিল? কারণ, ওর কাছ থেকে খুব সুন্দর একটি জবাব পাবার পর মুগ্ধ হলেও শাহরিয়ার আর লেখেনি। রাজশাহী থেকে ফিরে আফরিনের অফিসে একবার যেতে হয়েছিল নিজের পেশাগত প্রয়োজনে। আফরিনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে নিছক মামুলী কুশল বিনিময়ে শেষ করেছিল সৌজন্য। আফরিনের দু’ চোখে কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গে অনেকটা কৈফিয়ত, ‘আপনি আপনার চিঠির জবাব পেয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ। জ্বি। থ্যাংক ইউ।’ বলে প্রায় পালিয়ে এসেছিল সে। কেন পালিয়েছিল আজো জানে না। কিছুদিন ধরে প্রায় প্রায়ই দেখা হচ্ছে। এখন শাহরিয়ারের চাইতে আফরিনকেই বেশি নিরাসক্ত মনে হয়। পদ্মার ওপর থেকে লেখা চিঠির প্রসঙ্গে আর কোনো কথা সে কখনো তোলেনি। তবে এখন সম্পর্কটি যেরকম, তাকে বন্ধুত্ব বলা চলে।
কিন্তু আজ শাহরিয়ার কেন এত পুড়ছে মনে মনে?
কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। আজকাল এরকম হচ্ছে তার। গতকাল প্রেসক্লাব যাবার জন্য তৈরি হয়েছিল সে। যায়নি। অস্থিরতা এত শক্তিশালী অনুভূতি, এই প্রথম সে জানলো। সমস্ত রাত তার ঘুম হয়েছে কেটে কেটে। বারবার ভেঙে ভেঙে।
আচমকা একটা ঘোর থেকে যেন জেগে ওঠে খালেদ শাহরিয়ার। অবাক কাণ্ড, মনেই ছিল না, লেকচার থিয়েটার সকাল এগারোটায় তার বক্তৃতা। এখন সাড়ে আটটা। সমস্ত ভাবালুতা ঝেড়ে সে তৈরি হতে শুরু করে। সবার আগে প্রয়োজন টানা একটা শাওয়ার। ডোরবেল বাজচিল। শাহরিয়ার গোসল শেষে গা মুছছে তখন। দ্রুত বেরিয়ে কোনোমতে লুঙ্গি-শার্ট পরেই দরোজা খোলে। হতভম্ব হয়ে যায় সে মুহূর্তেই। দরোজায় আফরিন।
‘আরে কি আশ্চর্য, আপনি!’
‘হ্যাঁ, খুব হঠাৎ করেই...’
‘ভেতরে আসেন প্লিজ।’
শাহরিয়ারকে যথেষ্ট আন্তরিক মনে হয়। আফরিন অতটা আশা করেনি। তবু খুব দ্বিধাজড়িত পায়ে সে ভেতরে আসে। ড্রয়িং রুমে ঢুকতে গিয়ে সে অবাক হয়ে যায়। চমৎকার গোছানো একটা ঘর। বাঁ পাশের পুরো দেয়াল জুড়ে বইয়ের র্যা ক। ঘরে ওটাই শোকেসের ভূমিকায়। পুরো ঘরের এখানে মানানসই শো-পিস। দু’চারটা স্ট্যাচু। একপাশে মিউজিক্যাল সেন্টার আর টিভি পাশাপাশি। মিউজিক্যাল সেটটা সে চিনতে পারে। পাইওনিয়ার কোম্পানির।
‘আপনি বসেন। একটু সময় নেবো আমি। আসছি।’ কথাটা বলে দ্রুত ভেতরের দিকে যায় শাহরিয়ার। সে অন্তর্হিত হওয়ামাত্র এই প্রথমবার নিজের ভেতরে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে আফরিন। করেছে কি সে?
প্রায় মিনিট বিশেক পর ফিরে আসে শাহরিয়ার। সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারা এখন। পোশাক পাল্টেছে। আর কী আশ্চর্য, তার হাতে একটা বড়ো ট্রেতে একটা বড়োসড়ো মিষ্টির প্যাকেট, পাশে প্লেটে গোটা একটা মাঝারি সাইজের পাউরুটি, জেলি, ছুরি, চারটা কলা, একটা সেদ্ধ ডিম আর একবাটি সবজি। আফরিনকে তটস্থ হয়ে উঠতে দেখে শাহরিয়ার বলে, ‘না না, এসব আপনার আসার পরে করিনি বুঝতেই পারছেন। বাইরে বেরুবো বলে আগেই রেডি করা ছিল। দেখছেন না-’
আফরিন প্রায় হেসে ফেলে, ‘কী?’
‘এই যে ডিম সেদ্ধ একটা?’
‘আরেকটা চাপিয়ে দিয়ে আসেননি এক্ষুণি?’
‘তা অবশ্য দিয়েছি।’
শাহরিয়ারের মুখ লালচে দেখায়। আফরিন সাজানো খাবারের কিছুতেই হাত না দিয়ে প্রথমেই বলে, ‘একটু পানি খাব। এবং পানিটা আমি নিজে নিয়ে খেতে চাই।’
শাহরিয়ার কিছু বুঝে উঠবার আগে সে বলে, ‘কোত্থেকে নেব?’
‘ওই যে ডাইনিং টেবিলে জগ আছে। ফ্রিজেও আছে, বোতলে।’
ডাইনিং রুম থেকে পানি খেয়ে এসে আফরিন ড্রয়িং রুমে একটা সোফায় বসে। ততক্ষণে আরেকটা সেদ্ধ ডিম নিয়ে কিচেন থেকে ফিরেছে শাহরিয়ার, ‘আগে খেয়ে নেন কিছু।’
আফরিন স্মিত মুখে বলে, ‘একটু পরে।’
কিছুক্ষণের মধ্যে তারা দুজনেই আবিষ্কার করে যে, তারা কোনো কথা বলছে না। এক অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ্যে ভরে আছে পুরো বাড়ি। বাইরে গাছে গাছে পাখিদের কথা বলবলি। এই সময়ে তারা কী নিয়ে কথা বলতে পারে তা যেন খুঁজে পায় না। কী এক অচেনা দ্বিধায় কিছুটা সময় স্থির বসে থাকে দুজনেই। হঠাৎ যেন সমস্ত সৌজন্যের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে তারা। আকস্মিক চলে আসা অতিথিকে শাহরিয়ার যেমন সপ্রতিভভাবে আপ্যায়ন শুরু করেছিল, তা যেন আর তেমনভাবে অগ্রসর হয় না।
আফরিন আনতমুখে বসা। তার চেহারায় ক্লান্তি। কিন্তু ক্লান্ত মুখটায়-কোথেকে যেন ফুটে বেরুচ্ছে এক অপার্থিব আলো। আর মুখটাকে, আশ্চর্য, এত কোমল দেখাচ্ছে! এমন মায়াবী।
ওর ঠোঁট জোড়ায় দৃষ্টি পড়ে শাহরিয়ারের। অজান্তেই বুকের ভেতর ছটফট করে ওঠে তার।
আস্তে করে উঠে দাঁড়ায় শাহরিয়ার। চকিতে মুখ তুলে তার দিকে তাকালো আফরিন। কয়েক সেকেন্ড মাত্র। কোনো কথা বললো না সে। যেন একটা বোবা শিশু। যেন সে কোনোদিন কারো সঙ্গে কথা বলেনি। কয়েক সেকেন্ড এই নির্বাক তাকিয়ে থাকার মধ্যে কত অজস্র কথা যে লুকিয়ে ছিল। এরপরই আবার নতমুখী হয়ে গেল সে। এই অপ্রত্যাশিত সুন্দর তরুণ সকালবেলা এ জীবনে আর আসবে না, শাহরিয়ার ভাবে। হ্যাঁ, এখনই সে বলবে কথাটা। নিজের কাছে আর কোনো অস্পষ্টতা নেই। দ্বিধা নেই। দু’হাত দূরে সোফায় বসা মেয়েটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। গভীর মমতায় হাত রাখে তার কাঁধে, ‘আফরিন!’
মুহূর্তে কী একটা যেন ঘটে যায়। কোথাও কি বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে? ভূমিকম্প হচ্ছে? সর্বাঙ্গ শিউরে উঠেছে আফরিনের। কোনো জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে শাহরিয়ারের মুখোমুখি। ব্রীড়া আর ভয় মেশামেশি হয়ে আফরিনের বুকের ভেতর তিরতির করে কাঁপছে একটি আগুনের শিখা। তৃষ্ণা এবং শংকার। ভালোবাসা এবং ভীতির।
হঠাৎ করেই যেন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে আসে শাহরিয়ারের কাছে। শীর্ণধারা পদ্মার জলের উপর নৌকায় বসে গত বছরের আকুলতা, পরবর্তী ঘটনাবলি এবং আজ সকালে আফরিনের এই উপভ্রান্ত চলে আসা— সমস্ত কিছুর অর্থ যেন সহসাই তাকে সচকিত করে তোলে। নিজেকে সে বুঝতে পারে। আফরিনকেও।
গত দেড় বছর ধরে বরাদ্দ পাওয়া ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারের এই বাড়িতে সে একা। প্রায় অসহনীয় এক ঘেঁয়ে বসবাসের দিনগুলিতে আজকের এই সকাল সম্পূর্ণ আলাদা।