সুবর্ণ কঙ্কন পরা ফর্সা রমণীরা

লতিফ জোয়ার্দার

প্রকাশিত : এপ্রিল ৩০, ২০১৯

সকালের সাদা পালক শুকানো মিষ্টি রোদে, পার্কের এক কোণে বসে আছে এক বৃদ্ধা। কিছু সময় পূর্বে এখানে আরো অনেকেই ছিলো। মনে হলো অল্প সময়ের মধ্যে পার্কটা ফাঁকা হয়ে গেল। যারা এখানে হাঁটতে এসেছিলো, যারা বসে বসে গল্প করছিলো, তাদের কাউকেই আর দেখা গেল না। অথচ সেই বৃদ্ধা এখনো বসে আছে। বৃদ্ধার শরীরে একটা পুরনো চাদর। কতদিন কাপড় ধোয়া পাউডারের সাথে তার দেখা হয়নি। কত কত জীর্ণতা, কত কত মলিনতা বৃদ্ধার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে। তবে আবার কিছু সময় পরই পার্কটি সরব হয়ে উঠবে। সেই সরবতার ভিতর আর বৃদ্ধাকে দেখা যাবে না। যেমন দেখা হবে না এই স্নিগ্ধ সকালের মিষ্টি রোদের সাথে আর। একাকী আর কথা হবে না পার্কের শিশির ভেজা বেঞ্চের সাথে। আবার নাগরিক ব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়ে যাবে সামান্য সময়ের একাকিত্ব। আবার সরব হবে অন্ধ বধির এই শহরের জেগে ওঠার গল্প।

সারাটা দিন আর সেই বৃদ্ধাকে কোথাও দেখা যাবে না। হয়তো তার কথা আর কেউ ভাববে না। করুণার দৃষ্টি তুলে কেউ একবার ফিরে তাকাবে না তার দিকে। অথচ একদিন সুনীলের কবিতার নাদের আলির সাথে তার পরিচয় ছিলো। নাদের আলির সাথে মেঘের ভেলায় ভেসে ভেসে দেখা হতো। আবেগী উচ্ছ্বাস নিয়ে কথা হতো। একদিন চৌধুরী বাড়ির পুকুরঘাটে নাদের আলি তাকে দেখে চুপিচুপি বলেছিলো, তুমি কোনো মানবী নও, হয়তো তুমি দেবী, হয়তো তুমি ঈশ্বরী। তোমার জন্যে সব ব্যকুলতায় হারাতে পারি আমি স্মৃতির জঞ্জাল। তোমার জন্য স্বপ্নবীজ বপন করতে পারি। বিশ্ব সংসারে পুষ্পভোর এনে দিতে পারি প্রতিদিন।

তখন সে ছিলো, কেবলি একজন নারী, কেবলি একজন রমণী। তার ফর্সা শরীরে সুগন্ধি আতরের গন্ধ ছিলো। নাদের আলিরা এমনই হয়। নাদের আলিরও দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে লাল কাপড় বাঁধতে ইচ্ছে করে। চুপিচুপি দেখতে ইচ্ছে করে, সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা কীভাবে সমস্ত পৃথিবীর সব যুবকের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। নাদের আলি একজন যুবক। কিন্তু দু’হাত দিয়ে কিছুতেই অন্ধকার সরিয়ে আলোর সন্ধান পায় না তারা। তখন কেবলি মনে হয়, এই অন্ধকারই তার প্রেম, এই অন্ধকারই তার ভালোবাসা। একদিন আরো কত কত নাদের আলি এসেছিলো তার জীবনে, অবিরল রঙের ধারার মধ্যে। তার বুকের মাংসের গন্ধে যারা হারিয়েছিলো কিছু সময়ের জন্য ঘর-সংসার।

রেললাইনঅলা এক কাব্যিক শহরে জন্ম হয়েছিলো তার। কিন্তু জন্ম ঘরে তার বেশি দিন ঠাঁই হয়নি। এগার পেরুতে না পেরুতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিলো তাকে। কিন্তু সংসার না বোঝা বালিকার জন্য লিখতে হয়েছিলো নতুন কাব্য। একদিন নিজের নাম ভুলে নুতন পরিচয়ে এসে উঠেছিলো কোন এক মাসির ঘরে। সেখানে কারো কোন বালিকাবেলা থাকে না। সেখানে রাজপুত্ররা অতিথি হয়ে আসে। রাতভর গান-বাজনা হয়। সেই মাসি তাকে তার নাম দিয়েছিলো বীনা। সেখানে একদিন অনিবার্য ঢলে পরেছিলো সে বিপদগামীতার পথে। এভাবেই হাত বদল হতে হতে বালিকা থেকে একদিন রমণী হয়েছিলো বীণা।

অতঃপর বীণা থেকে সবিতা। আর সবিতা থেকে মোহিনী মালা কত নাম ধারণ করতে হয়েছিলো তাকে। এক মাসির ঘর থেকে আরেক মাসির ঘরে উচ্চ মূল্যে বিক্রি হয়েছিলো। এক নাদের আলি থেকে কত কত নাদের আলির সাথে দেখা হয়েছিলো, কথা হয়েছিলো তার। প্রণয় সংঘাত ঘটেছিলো। আর মধ্যবয়সে এসে চৌধুরী বাড়ির সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণী হয়েছিলো। পায়ে তার ঠাই মিলেছিলো সোনার শিকল। রাশি রাশি প্রাচুর্য। কিন্তু সেখানেও সব থেকে কিছুই ছিলো না তার। অবেশেষ তার মনে হয়েছিলো, সে চৌধুরী বাড়ির নাচ ঘরের নর্তকী ছাড়া আর কী বা হতে পারে। বীণাদের সবিতাদের কখনো কোনদিন সংসার হয় না। তারা সংসারী হতে পারে না। তাদের সামনে চৌধুরীরা থাবা বিস্তার করে তাকে। নাদের আলিরা প্রেমিক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।তবুও প্রেম সেখানে মূল্যহীন! প্রেম কেবলি পোড়া মাংসের গন্ধ!

কত কত অন্ধকার রাত পেরিয়ে, একদিন বীণা চেনা শহর থেকে অচেনা শহরে এসেছিলো। চেনা ভাষা থেকে অচেনা ভাষায় নিচের নাম লেখিয়েছিলো। সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে বিদেশ বিভূইয়ে পারি দিয়েছিলো। সমতল ভূমি থেকে পাহাড়ের দেশে এসেছিলো। একদিন ধর্মহীন থেকে এবার ধর্মের পথে পা বাড়ানোর সংকল্প বাসা বেধেছিলো তার মনে। আর এভাবেই একদিন, একটা বয়িং বিমান তাকে জেদ্দা আন্তজার্তিক এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়েছিলো। সেখান থেকে একটা সাদা মাক্রোবাসে করে অতঃপর চাকুরিস্থল। নতুন করে অচেনা এই শহরের বাসিন্দা হয়েছিলো বীণা। নতুন জীবনের আশায় সব পুরাতন পিছনে ফেলে স্বপ্নের চারা গাছ রপন করেছিলো। সেখানে এক শেখের বাসায় গৃহপরিচালিকার কাজ জুটেছিলো তার। এবার বীণা ভাবলো, আর কোন অন্ধকার ছুঁবে না তাকে। আর জ্যামিতিক নক্সায় বন্দি হতে হবে না তাকে।

ঘর যাকে পর করে দেয়। পরবাসও তার জন্যে কারাগার হয়। প্রবাস জীবনেও আলো ঝলমল নূপুরঘরে দেখতে পায় বিষাক্ত সাপের ফণা। সেখানে জেলখানার কেয়েদীর মত জীবন। ইচ্ছে করলেই ঘর থেকে বেরুতে পারে না বীণা। ইচ্ছে করলেই নতুন জীবনের স্বাদ গ্রহন করতে পারে না।