সুনির্মল বসুর বিখ্যাত ৫ কবিতা

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : জুলাই ২০, ২০২২

কবি ও শিশুসাহিত্যিক সুনির্মল বসুর আজ জন্মদিন। ১৯০২ সালের ২০ জুলাই, ভারতের বিহারের গিরিডিতে তার জন্ম। ১৯৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত বিখ্যাত পাঁচটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

সব পেয়েছির দেশে

গল্প না ভাই, কল্পনা নয়,
স্বপন-বুড়ো এসে
আমায় নিয়ে উধাও হলো
সব পেয়েছির দেশে।
স্বপন-বুড়োর লম্বা দাড়ি,
পোষাকটি তার রং-বাহারি,
আমায় নিয়ে দিচ্ছে পাড়ি
হালকা হাওয়ায় ভেসে;
সব পেয়েছির দেশে রে ভাই,
সব পেয়েছির দেশে।
স্বপন-বুড়ো, রসিক-চূড়ো
নিদ্-মহলের রাজা,
থুত্থুরে তার শরীর বটে,
মনটি আজও তাজা;
সব পেয়েছির দেশে চলো
সকল ছেলেমেয়ে,
উঠব মেতে সবাই সেথায়
সকল জিনিস পেয়ে,
সেথায় হাসির ঝর্ণা হাসে,
আমোদ খুশির বন্যা আসে,
মাতিয়ে তোলে শিশুর দলে
অসীম ভালোবেসে,
সব পেয়েছির দেশে রে ভাই
সব পেয়েছির দেশে।

বাংলাদেশের কিশোর-শিশু
তোমরা যারা আছ,
নাচার মতো নাচো তারা
বাঁচার মতো বাঁচো।
আধ-মরা আর ঘুণে ধরা
বুড়োর কথা শুনবে যারা,
সত্যিকারের মানুষ তারা
হবেই অবশেষে,
সব পেয়েছির দেশে রে ভাই
সব পেয়েছির দেশে।

হবুচন্দ্রের আইন

হবুচন্দ্র রাজা বলেন গবুচন্দ্রে ডেকে,
‘আইন জারি করে দিও রাজ্যেতে আজ থেকে,
মোর রাজ্যের ভিতর,
হোক না ধনী, হোক না গরিব, ভদ্র কিংবা ইতর,
কাঁদতে কেহ পারবে না কো, যতই মরুক শোকে।
হাসবে আমার যতেক প্রজা, হাসবে যত লোকে।
সান্ত্রী-সেপাই, প্যায়দা, পাইক ঘুরবে ছদ্মবেশে,
কাঁদলে কেহ, আনবে বেঁধে, শাস্তি হবে শেষে।’

বলে গবু, ‘হুজুর,
ভয় যদি কেউ পায় কখনো দৈত্য, দানা জুজুর,
কিম্বা যদি পিছলে পড়ে মুণ্ডু ফাটায় কেহ,
গাড়ির তলে কারুর যদি থেঁতলিয়ে যায় দেহ;
কিম্বা যদি কোনো প্রজার কান দুটি যায় কাটা,
কিম্বা যদি পড়ে কারুর পিঠের ওপর ঝাঁটা;
সত্যিকারের বিপন্ন হয় যদি,
তবুও কি সবাই তারা হাসবে নিরবধি?’

রাজা বলেন, ‘গবু,
আমার আইন সকল প্রজার মানতে হবে তবু।
কেউ যদি হয় খুন বা জখম, হাড্ডিতে ঘুণ ধরে,
পাঁজরা যদি ঝাঁঝরা হয়ে মজ্জা ঝরে পড়ে,
ঠ্যাংটি ভাঙে, হাতটি কাটে, ভুঁড়িটি যায় ফেঁসে,
অন্ধকারে স্কন্ধ কাটা ঘাড়টি ধরে ঠেসে,
কিম্বা যদি ধড়ের থেকে মুণ্ডুটি যায় উড়ে,
কাঁদতে কেহ পারবে না কো বিশ্রী বিকট সুরে।
হবুচন্দ্রের দেশে
মরতে যদি হয় কখনো, মরতে হবে হেসে।’

পিটিয়ে দিলো ঢ্যাঁড়া গবু, রাজার আদেশ পেয়ে
‘কাঁদতে কেহ পারবে না আর পুরুষ কিম্বা মেয়ে।
যতই শোকের কারণ ঘটুক হাসতে হবে তবু,
আদেশ দিলেন রাজাধিরাজ হবু।
রাজার আদেশ কেউ যদি যায় ভুলে,
চড়তে হবে শূলে।’

সেদিন হতে হবুর দেশে উল্টে গেল রীতি,
হররা-হাসির হট্টগোলে
অট্টহাসির অট্টরোলে
জাগলো তুফান নিতি।
হাসির যেন ঝড় বয়ে যায় রাজ্যখানি জুড়ে,
সবাই হাসে যখন তখন প্রাণ কাঁপানো সুরে।
প্যায়দা পাইক ছদ্মবেশে হদ্দ অবিরত,
সবাই হাসে আশেপাশে
বিষম খেয়ে ভীষণ হাসে
আস্তাবলে সহিস হাসে, আস্তাকুঁড়ে মেথর,
হাসছে যত মুমূর্ষরা হাসপাতালের ভেতর।
আইন জেনে সর্বনেশে
ঘাটের মড়া উঠছে হেসে,
বেতো-রোগী দেঁতো হাসি হাসছে বসে ঘরে;
কাশতে গিয়ে কেশো-বুড়ো হাসতে শুরু করে।
হাসছে দেশের ন্যাংলা ফ্যাচাং হ্যাংলা হাঁদা যত,
গোমড়া উদো-নোংরা-ডেঁপো-চ্যাংরো শত শত;
কেউ কাঁদে না কান্না পেলেও,
কেউ কাঁদে না গাট্টা খেলেও,
পাঠশালাতে বেত্র খেয়ে ছাত্রদলে হাসে,
কান্না ভুলে শিশুর দলে হাসছে অনায়াসে।

রাজা হবু বলেন আবার গবুচন্দ্রে ডাকি,
‘আমার আদেশ মেনে সবাই আমায় দিলে ফাঁকি?
রাজ্যে আমার কাঁদার কথা সবাই গেল ভুলে,
কেউ গেল না শূলে?
একটা লোকও পেলাম না এইবারে
শূলে চড়াই যারে।
নিয়ম আমার কড়া
প্রতিদিনই একটি লোকের শূলেতে চাই চড়া।
যা হোক, আজই সাঁঝের আগে শূলে দেবার তরে
যে করে হোক একটি মানুষ আনতে হবে ধরে।’

গবুচন্দ্র বল্লে হেসে চেয়ে রাজার মুখে,
‘কাঁদতে পারে এমন মানুষ নাই যে এ মুল্লুকে;
আমি না হয় নিজেই কেঁদে আইন ভেঙে তবে
চড়ব শূলে, মহারাজের নিয়ম রক্ষা হবে।
কিন্তু একি, আমিও যে কাঁদতে গেছি ভুলে,
কেমন করে চড়ব তবে শূলে?’

রাজা বলেন, ‘তোমার মতো মূর্খ দেখি না যে,
কাঁদতে তুমি ভুলে গেলে এই ক’দিনের মাঝে।
এই দ্যাখো না কাঁদে কেমন করে।’
এই না বলে হবু রাজা কেঁদে ফেল্লেন জোরে।

মন্ত্রী গবু বল্লে তখন, ‘এবার তবে রাজা
নিজের আইন পালন করুন গ্রহণ করুন সাজা।’
বলেন হবু, ‘আমার হুকুম নড়বে না এক চুল,
আমার সাজা আমিই নেব তৈরি করো শূল।’

এমন কী আর খাই

তোমরা যাই বলো না ভাই,
এমন কী আর খাই!
আস্ত পাঁঠা হলেই পরে
ছোট্ট আমার পেটটা ভরে
যদি তার সঙ্গে ফুলকো লুচি
গণ্ডা বিশেক পাই
এমন কী আর খাই!
চপ কাটলেট পড়লে পাতে
আপত্তি আর নাই কো তাতে
আর কোপতা কাবাব কালিয়াতে
অমত আমার নাই
এমন কী আর খাই!
হয় না হজম এখন দাদা
খাওয়া দাওয়ায় অনেক বাধা,
এখন তাইতো অনেক বুঝেসুঝে
খাবার খেতে চাই
এমন কী আর খাই!
সের পাঁচ-ছ’য় রাবড়ি-দধি
তোমরা আমায় খাওয়াও যদি,
কষ্ট করে এই বয়সেও
খেতেও পারি তাই
এমন কি আর খাই!
সন্দেশ আর পান্তুয়াতে,
রুচি বিশেষ নাইকো তাতে,
আপাতত দুসের হলেই,
ঠাণ্ডা হয়ে যাই
এমন কী আর খাই!
মা কেঁদে কয়, ‘এমন করে
না খেয়ে তুই যাবি মরে
শুকিয়ে শরীর আমসি হলো।’
কি আর করি ছাই
এমন কি আর খাই!

সবার আমি ছাত্র

আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর কাছে পাই রে।

পাহাড় শিখায় তাহার সমান
হই যেন ভাই মৌন-মহান,
খোলা মাঠের উপদেশে
দিলখোলা হই তাই রে।

সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয়
আপন তেজে জ্বলতে,
চাঁদ শিখাল হাসতে মোরে,
মধুর কথা বলতে।

ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর
অন্তর হোক রত্ন-আকর
নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম
আপন বেগে চলতে।

মাটির কাছে সহিষ্ণুতা
পেলাম আমি শিক্ষা,
আপন কাজে কঠোর হতে
পাষাণ দিল দীক্ষা।

ঝরনা তাহার সহজ গানে,
গান জাগাল আমার প্রাণে;
শ্যাম বনানী সরসতা
আমায় দিল ভিক্ষা।

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানান ভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র।

এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়,
পাঠ্য যেসব পাতায় পাতায়
শিখছি সে সব কৌতূহলে,
নেই দ্বিধা লেশমাত্র।

আমরা কিশোর

কিশোর মোরা ঊষার আলো, আমরা হাওয়া দুরন্ত
মনটি চির বাঁধন হারা পাখির মতো উরন্ত।

আমরা আসি এই জগতে ছড়িয়ে দিতে আনন্দ
সজীবতায় ভরিয়ে দিতে এই ধরণীর আনন তো।

আমরা সরল কিশোর শিশু ফুলের মতো পবিত্র,
অন্তরেতে গোপন মোদের শিল্প, গীতি, কবিত্ব।

জাগাই যদি, লাগাই তাদের এই দুনিয়ার হিতার্থ,
ভবিষ্যতের নবীন ধরা হবেই তবে কৃতার্থ।

যে বীজ আছে মনের মাঝে চায় যে তারা আহার্য,
ফসল লয়ে ফলবে সে বীজ একটু পেলে সাহায্য।

একান্ত যার ইচ্ছা আছে, দাম আছে তার কথার তো,
এই জগতে অবশ্য সে মানুষ হবে যথার্থ।

শোনরে কিশোর ভাইরা আমার, সত্য পথের শরণ নে,
হারিয়ে তোরা যাস নে যেন অমানুষের অরণ্যে।