সুচরিত চৌধুরীর গল্প ‘নিঃসঙ্গ নিরাশ্রিত’
প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৫, ২০২৪
কথাসাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরীর আজ মৃত্যুদিন। ১৯৯৪ সালের ৫ জানুয়ারি মারা যান। চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালীতে ১৯৩০ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ‘নিঃসঙ্গ নিরাশ্রিত’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
ভাঙা সাঁকোর একপাশে বসে ছেলেটা কাঁদছিলো। হাতে ছিল রঙিন কাপড়ের পুটলি, তাতে মায়ের রাঙা শাড়ি বাপের কামিজ, মুড়ি বেচে সঞ্চয় করা পয়সা ভরা টিনের কৌটা, খালের জলে তার ছায়া স্থির। স্রোতে রক্ত মেশানো ছিল মানুষের। ওরা যদি কথা কইতে জানতো, তবে জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠতো— আমরা ওই গ্রামের তাজা রক্তে স্নান করে সমুদ্রে ফিরে যাচ্ছি। বলতে না পারলেও তাদের নিঃশব্দ গতিতে শোকের বেদনা ছিল। দূরের গ্রামগুলো কিছুক্ষণ আগে জ্বলতে জ্বলতে কালো হয়ে গিয়েছে, গতকালও সবুজ ছিল। ধু-ধু বিলের হাওয়া গরম, যেন একটি সীমাহীন তাপ মানুষ-মাটি-গাছ-ঘাসকে সেঁকে তোলার নিষ্ঠুর ফন্দি পেতেছে। ছেলেটা ভাবছিল, এখন তার কেউ নেই, যারা ছিল মরে গিয়েছে গুলি খেয়ে। বাপের লাশ এখনো পড়ে আছে ডোবার পাশে, মাকে তুলে নেয়া হয়েছে মিলিটারি ট্রাকে। ঘরও জ্বলে গেছে, এখন সে যাবে কোথায়? একটা কুকুর খালের ওপারে থেকে সাঁতার কেটে এপারে উঠে এসে গা ঝাড়া দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বিলের ওপর ছুটতে ছুটতে দূর গাছপালায় মিশে গেল। ছেলেটা কুকুরটার মত খালে নামতে যাবে অমনি পেছনে সশব্দে ফেটে পড়ল এক ভারি গলা। –এই পোয়া, কণ্ডে যাবি? কালোর দীর্ঘ বিরাটদেহী এক বৃদ্ধের ছায়া জেগে উঠলো খালের জলে।
কাপড়ের পুটলিটাকে বুকের আড়াল করে নিয়ে গুটি গুটি হয়ে বসে পড়ল মাটিতে। তারপর ককিয়ে উঠলো সেদিনের মত যেদিন তার মাকে জোর করে ধরে তুলে নিচ্ছিল টাকে হানাদার সৈন্যরা। পুটলিটা বুকে আরো জোরে চেপে ধরে সে চেচিয়ে উঠল, ন দিয়ম আঁই, ন দিয়ম। দেবে না, তার শেষ ধন কারো হাতে সে তুলে দেবে না। বৃদ্ধ খক খক করে কেশে উঠল। একদলা কফ বেরিয়ে এলো ঠোঁটে, খালের দিকে ছুঁড়ে বিকৃত স্বরে চেচিয়ে উঠল, কণ্ডে যাবি? পেছনে শ্যামরিক্ত মাঠ, মাথায় সূর্যের ক্রোধ, মুখে জান্তব চর্মরেখা, বৃদ্ধকে কোনো পৌরাণিক দানবের মতোই দেখালো। এককালে আচরণ ছিল দানবের মতোই, বিচরণ ছিল গ্রাম-গ্রামান্তের কোঠাঘরে। রাতের সাক্ষী তারা, তারার সাক্ষী আকাশ, আকাশের সাক্ষী শিশির সিক্ত মাটি– তার ভারি পায়ের শব্দ শুনে বলতে পারত বুধপুরার রোকন চলেছে নিশি অভিযানে।
লুট হবে, সিন্দুক ভাঙা হবে, গা থেকে অলঙ্কার ছিনিয়ে নেয়া হবে, দরকার হলে কেউ রুখে দাঁড়ালে লাঠি দিয়ে মাথা দু’ফাঁক করে দেয়া হবে। সেই আদিম হিংস্র রোকনকে এককালে চিনতো সবাই, সরু আল পর্যন্ত ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠতো তার নাম শুনে। আজ বটবৃক্ষের মত বৃদ্ধ এইখানে দাঁড়িয়ে, এই ভাঙা সাঁকো খালের পাড়ে ছেলেটাকে দেখে গর্জে উঠল, কণ্ডে যাবি? কে তার সামনে এসে বুক চিতিয়ে বলবে, তুমি কে জিজ্ঞেস করার? কত সাম্পানকে, কত পালকিকে এই সাকোর পাশে হকি মেরে দাঁড় করিয়েছে। মন নরম হলে ছেড়ে দিয়েছে, মন গরম হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রেখেছে। তার বিরুদ্ধে নালিশ কে শুনবে? থানার দারোগা পর্যন্ত যাকে ধমকে দিতে সাহস করে না। একবার এক বিলাতফেরত বাঙাল সাহেবের কোট-পাতলুম খুলে রেখে দিয়েছিল। অপরাধ কি? কিছুই না। মেজাজ দেখিয়ে তিনি শুধু বলেছিলেন, আমি অমুক রায় সাহেবের ছেলে, জানো তোমাকে আমি বছরের পর বছর জেল খাটাতে পারি? ব্যাস, নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল রোকন। তারপর বাঘের মত ঝাপিয়ে পড়েছিল সাম্পানে। মাঝি দাঁড় ফেলে পাড়ে লাফ দিয়ে পালিয়েছিল; রোকন আর কিছুই করেনি, বাঙালি সাহেবের কোট-পাতলুম খুলে নিয়ে। সাম্পানটাকে ঠেলে দিয়েছিল স্রোতের দিকে। অনাবৃত দেহে সাহেব সাম্পান নিয়ে ভেসে গিয়েছিলেন। এমনি শত শত খেয়ালখুশির ঘটনা রোকনের জীবনে ঘটে গিয়েছে। তার এই মেজাজের জন্যে সে ধনদৌলত লুট করেও ধনী বা দৌলতদার হতে পারলো না। রাতের নেশায় যারা একদিন তার সঙ্গী সাগরেদ ছিল তারা কেউ আজ বিত্তবান, কেউবা গ্রামের হোমরা-চোমরা। হাটে বিলে পথে ঘাটে দেখা হলে তারা বলে, ওস্তাদ, তুই ন হৈলি দরেয়ার, ন হৈলি খালর মাছ। কোটা বাড়ি কিছু ন কইরলি। কিছুই করেনি রোকন। টাকা লুটে এনে তার পরদিন উড়িয়ে দিয়েছে।
ডাব্বা খেলায়, মদ গিলেছে হাঁড়ি হাঁড়ি। মেয়েলোক নিয়ে তামাশা করেনি, কোনো বেশ্যার খোলা বুকে গিয়ে কুকুরের মত ঝাঁপিয়ে পড়েনি। যেদিন শরীরে মেয়ে শরীরের লোভ লেগেছে সেদিন একটিমাত্র মেয়েলোক নিয়ে রাত কাটিয়েছে, যে মেয়েলোক একদিন চোখ ইশারায় বন্দর এলাকার গ্রামাঞ্চল থেকে পালিয়ে এসেছিল। সাতদিন সাত রাত কক্সবাজারে ডাকাতি করে ফিরে এসে যখন রোকন এসে দাড়িয়েছিল ঘরের উঠোনে, তখন কোন মেয়েলোক দাওয়ার খুঁটি ধরে ‘হায় আল্লা এত টেয়া পৈছা কণ্ডে পাইলা? বলে ললিত ভঙ্গিতে কেউ এসে দাঁড়ায়নি। কলেরায় সমস্ত পাড়া উজাড় হয়ে গিয়েছিল, মাটি চাপা দেবার লোকও ছিল না। শকুন-শেয়ালে ভাগাভাগি করে শরীরের যেটুকু অংশ অবশিষ্ট রেখেছিল তা চরের বালিতে পায়ের দাগ মুছে যাবার মত মাটিতে মিশে মিশে গিয়েছিল। মায় কি মমতা কি বোঝে না রোকন। অমন কলজে জ্বালানো মেয়েলোকের বীভৎস মরণে একদও বসে অশ্রুপাত করেনি সে, থলিভরা টাকা আর অলঙ্কারগুলো নিয়ে সেই দিনই উহ্বা খেলায় মেতে গিয়েছিল। রোকনের মতে মেয়েরা হলো গভীর জলের এক একটি সোনার হরিণ, কখন কার থাবায় লুটিয়ে পড়বে, বলতে পারে না। রাতের সঙ্গীদের সঙ্গে রোকনের বিরোধ ছিল অনেক। তারা লুট করতো, ধর্ষণ করতো, নির্যাতন করতো।রোকন কিছুই করতো না, শুধু লুটের ভাগ নিয়ে গা ঢাকা দিয়ে উধাও হয়ে যেত। ফুরিয়ে গেলে আবার সে আড্ডায় হাজির হতো। অদ্ভুত মনোভঙ্গি তার, যার হাতে এই বিদ্যার হাতেখড়ি তার ঘরই সে জ্বালিয়ে দিয়েছিল শেষরাতের ফিকে অন্ধকারে। সেই জমিদার নিত্যবাবুকে মনে পড়লে রোকনের থুতু ছিটোতে ইচ্ছে করে। দেখতে বাঘের মত হলে কি হবে, ভেতরে আস্ত একটি লেজ গুটোনো কুত্তা।
সে তখন তাগড়া জোয়ান, নির্জন গাছের ছায়ায় একলা পেয়ে নিত্যবাবু দরদ দেখিয়ে বলেছিলেন, এমন তাগড়া শরীর নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে কেন ঘুরে মরছিস। কাঠ বেচে ক’ পয়সা পাবি। রোজগারের পথ দেখিয়ে দেব, কাল আসিস আমার কাছারি ঘরে। মূলধন ছাড়াই প্রশস্ত রোজগারের পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন নিত্যবাবু। পাশের গ্রামের জমিদার কৃষ্ণ পালের দোমহলা বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে এসে রোকন একগাদা নোট বখশিশ পেয়েছিল নিত্যবাবুর কাছ থেকে। সেদিন তার বয়স ছিল প্রথম কুড়ি উকি দেয়া নারকেল গাছের মত, বাতাসে ঝাঁকুনি লাগলেও শির উদ্যত। ঘর জ্বালানো দিয়ে হাতেখড়ি, দল বেঁধে লুটতরাজ দিয়ে শুরু। নিত্যবাবু ছিল নেপথ্য খুটি–ধরা পড়লে থানা থেকে জামিন নেয়া, মামলা চললে জরিমানা দিয়ে খালাস করে দেয়া। মদের নেশাটাও শিখেছিল নিত্যবাবুর কাছ থেকে। দু’তিনদিন শহরের ঘোড়াগাড়ির সামনের সিটে বসে তাঁর সঙ্গে রোকন চোদ্দ নম্বর গলিতেও গিয়েছিল। মদ গিলেছিল, কিন্তু কোন বেশ্যাকে সিনায় লাগায়নি, বেশ্যা তার ভালো লাগে না, কেমন যেন ঘাটে বাঁধা পাথর খণ্ডে র মত–পা রেখে নৌকায় ওঠা যায়, বুকে বেধে নদীতে সাঁতার কাটা যায় না। নিত্যবাবু তার চোখে ঘোর লাগিয়ে দিয়েছিল ঠিক, কিন্তু একদিন সেই ঘোর কেটে গিয়ে জ্বলে উঠেছিল প্রতিহিংসার আগুন, খাজনার জন্যে কয়েক ঘর চাষী উৎখাত হয়ে গিয়েছিল সাঁইন্দার অঞ্চলে। সবাই অভিশাপ দিয়েছিল রোকনকে, আর সেদিন গভীর রাতে হিক্কা তুলে চোখ উল্টে মারা। গিয়েছিল তার ফুটফুটে ছেলে সদরুদ্দিন। পরদিন বউয়ের কাতর দৃষ্টি পর্যন্ত তাকে উপহাস করেছিল। এক চুমুকে মদের গেলাস শেষ করে রোকন নিত্যবাবুর মালিস দৃষ্টির দিকে দৃষ্টি মিলিয়ে বলেছিল, বও, এই কাম ছাড়ি দিয়ম। বিকট হাসিতে ফেটে পড়ে নিত্যবাবু বলে উঠেছিলেন, ছেড়ে দিলে উপোস করে মরবি হারামজাদা। এই পথ ছাড়া তোর আর কোনো পথ নাইরে রোকন। এ পথেই জীবন এ পথেই মৃত্যু, সরে দাঁড়ালে অপমৃত্যু। বউটা কলেরায় মারা যাবার পর রোকন আর লুটতরাজ, খুন জখম করবে না বলে নিত্যবাবুকে জানিয়ে দিয়েছিল। তবে অপমৃত্যু ঘটেনি, রক্তপাত হয়েছিল প্রচুর, মরেনি কেননা, তার প্রাণ ছিল আগুন জল বাতাসের চেয়ে শক্তিশালী।
আহত রোকনকে দেখতে এসে নিত্যবাবু চুপি চুপি বলেছিলেন, তোকে আগেই বলেছিলাম এই পথে গোলক ধাঁধা, যে বেরোতে যাবে তার মরণ ধাঁধার মতই আঁকাবাঁকা। সরতে গেলে কি সরা যায়? যারা তার সাঙাৎ ভাই তারাই যে পর মুহূর্তে দুশমন হয়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ নিত্যবাবু যেন জানতেন রোকনের এই দুর্ঘটনার ব্যাপার। হাট থেকে ফেরার পথে আঁধার রাতে কার লাঠি এসে রোকনের পিঠে পড়েছিল তাও যেন তার অজানা ছিল না। আকারে ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছিল মিন্নাত আলীর নামটা। মিন্নাত আলী রোকনের ফুফাতো ভাই। নিত্যবাবুর মুখে তার নামটা শুনে রোকনের চোখের তারায় হাটফেরত সেই অন্ধকার পথটা ফুটে উঠেছিল। মিন্নাত চাটাই বিছিয়ে শুতে যাবে, অমনি শব্দ হলো কাশির। –হিবা কন? জবাব এলো, আই। এই আইকে চেনে সবাই। ভীত কম্পিত মিন্নাত আলী কুকড়ে বলে উঠেছিল, আল্লার কছম, আই লডি মাইরতাম ন চাইলাম, নিত্য বও টেয়ার লোভে দেখাইল বলি লডি লই গেইলাম। টেয়াও না পাইলাম, তুইও ন মরিলি। নিত্যবাবুর নাম শুনে রোকন থ বনে গিয়েছিল। তাকে মারতে টাকার লোভ দেখিয়েছিল যিনাত আলীকে। এ যে গোলক ধাঁধা। এই গোলক ধাঁধার অবতার নিত্যবাবু নিজেই। সেই রাতেই নিত্যবাবুর শখের বাগানবাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল। তারপর পুরো দু’বছর রোকন গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়নি। এই দুই বছরে গ্রাম থেকে গ্রামে ছাউনি পড়ে গিয়েছিল ইংরেজ সৈন্যদের। সন্ত্রাসবাদীদের ধরার ছলনায় গ্রামীণ জনবাসীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করা হচ্ছিল। সেই সুযোগে নিত্যবাবুদের মত সুবিধাবাদী লোকেরা। বৃটিশ সরকারের সুনজরে পড়বার জন্যে দু’চারজন বিদ্রোহীকে ধরিয়ে দিচ্ছিলেন। নিত্যবাবু তার আপন ভাগ্নেকে তুলে দিয়েছিলেন ইংরেজ সুবেদারের হাতে। এর জন্যে লাভ করেছিলেন রায় সাহেব খেতাব। একদিন রাতে স্ত্রীর বাহুলগ্না হয়ে ঘুমাতে গিয়ে পিঠে ছোরা বিঁধে চিরকালের জন্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নিত্যবাবু। সন্ত্রাস-আন্দোলন থেমে যেতে রোকনকে আবার দেখা গিয়েছিল। বুধপুরাহাটে। নিত্যবাবুর অলৌকিক মৃত্যুরহস্য তখন হাটেঘাটে আলোচিত হতো। কেউ কেউ সন্দেহ করতো রোকনকে, শুনে মৃদু হাসির টোল খেলে যেত তার গালে, বলতো, এপথ গোলক ধাঁধা, সরে গেলে তার মরণও ধাঁধার মত আঁকাবাকা। এরপর রোকনের জীবন একক নিঃসঙ্গ, চরে ঠেকা ছুলুপের মত। বউ নেই, ছেলে নেই।
দলের লোকেরা এসে ডাকলে সাড়া দেয় না। নেহাৎ জোর করে ধরে নিয়ে গেলে সিন্দুক ভাঙে, এটা-ওটা নাড়ে কিন্তু লাঠালাঠিতে এগোয় না। সাঙাতরা বলে, ওস্তাদ তুই কমজোর হই গেইয়ছ। হাসে রোকন। একাজে যাদের লোভ কমে যায় তারাই তো কমজোর। এই দু’বছরের ফেরারী জীবনে ভিখারীর বেশে সে মানুষের শক্তি ও সাহসের পরিচয় পেয়েছে। আগে জানতো শরীরের শক্তি দিয়ে দুনিয়া জয় করা যায়। কিন্তু পাহাড়তলি জালালাবাদে লড়াই করা কচি কচি জোয়ানদের সাহস দেখে তার চোখে তাক লেগে গিয়েছিল। ওদের সাহসের পেছনে নিশ্চয় কোন বিরাট শক্তি ছিল, যার জন্যে গুলি খেয়েও ওরা পিছিয়ে যায়নি। কি সেই শক্তি, অনেক ভেবেছে রােকন, কূল-কিনারা পায়নি। কিছুদিন ঘোরাফেরা করেছিল বাউল ফকিরদের আস্তানায় শ্মশান সন্ন্যাসীদের আসরে। গাঁজা খেয়ে বুদ হয়েছিল, কূল তবুও পায়নি। একদিন কালার পোলের ধূলি-ধূসরিত সড়ক ধরে হাঁটছিল, পেছন থেকে অস্পষ্ট কণ্ঠস্বরে তার নাম উচ্চারিত হতে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিল। মাথায় টুকরি, খালি গা, পরনে ছেড়া লুঙ্গি—এক আধবয়সী লোক। খোঁচা খোঁচা দাড়ি ফাঁকে একগাল হেসে বলল, রোকন ভাই, সেলাম। সম্বোধনেই রোকন হতবাক। তারপর হাঁটতে হাঁটতে যেসব কথা। আলাপ হলো তাতে মনে হলো লোকটা যেন তার বহুদিনের চেনা। বুধপুরাহাটের কাছাকাছি এসেই রোকন জিজ্ঞেস করে, তুই কণ্ডে যাইবা? লোকটা ইতস্ততভাবে জবাব দেয়, বাঁশখালী। –বাঁশখালী তো বহু দূর। চল মিঞা, আঁয়ার ঘরৎ চল, রাইত কাড়াই ফজরৎ চলি যাইবা। কি ভেবে লোকটা রোকনের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল। রোকন বলল, ডর নাই, আই তোয়ার দুশমন ন অ।। দু’জন চিনলে দু’জনকে। ঘরে এসে হাঁড়ি উনুনে চড়িয়ে ভাত রাধলো, খেলো, তারপর চাটাই পেতে দুজনে শুয়ে পড়ল। মধ্যরাতে আচমকা শব্দ হল ভারি ভারি বুট জুতোর। সঙ্গে টর্চের জ্বালা-নেভা আলো। রোকন! হেই রোকনুনুদ্দিন। ওই ডাক রোকনের চেনা। নির্ভয়ে জবাব দিল সে,– আছি আছি। হেই কাম ছাড়ি দি ফেলাই দার্গা সাব। দারোগা সাহেব মিহি সুরে বললেন, ঝাপ খুলে দে, আমরা এমনি বেড়াতে এলাম। ঝাঁপ খুলতেই দেখা গেল উঠোনে একদল গুর্খা সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে।
তাদের সবগুলো টর্চের আলো এক সঙ্গে এসে পড়ল রোকনের মুখে। দারোগা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, চাটাইতে শুয়ে আছে ওটা তোর বউ নাকি? অবাক চোখে রোকন পেছন ফিরে দেখলো— চাটাইতে শায়া শাড়ি পরা একটি অবগুণ্ঠিত শরীর টর্চের আলোয় একবার জ্বলছে একবার নিতছে। বলল, হ। –মাথায় টুকরি, খালি গা, পরনে ছেড়া লুঙ্গি, খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা কোন লোককে এদিকে আসতে দেখেছিলি? রোকন বলল, না। ওরা চলে গেল শব্দ আর আলোর ধ্বনি জাগিয়ে। শাড়ি পরা লোকটা দাওয়ায় এলে রোকনের কাঁধে হাত রেখে বললো, ধন্যবাদ রোকন ভাই। তোমার এই উপকার আমি জীবনে ভুলব না। রোকন তার প্রতিজবাবে বলল, তুই মিয়া যেমন তেয়ন মানুষ ন অ। আইলা মরদ হই, গেলা মাইয়া পোয়া। ভোররাতে যাবার সময় লোকটা যা বলে গিয়েছিল তা রোকনের গলায় আজ পর্যন্ত কবচ হয়ে ঝুলে আছে। বলেছিল, তুমি আমাকে আশ্রয় দাওনি, আশ্রয় দিয়েছে স্বাধীনতাকে। ইংরেজরা আমাদের দেশের মানুষকে চেনে না, তাই বুট জুতোর তলায় সবাইকে দাবিয়ে রাখতে চায়। তারা আমাদের দশটি লোককে হত্যা করলে আমরা পারি না পারি তাদের একটি লোককে হত্যা করব। ঈশ্বর আমাদের পক্ষে থাকবেন; কেননা আমরা হত্যা করি অত্যাচারীকে–তারা হত্যা করে অত্যাচারিতকে। রোকন ভাই সেলাম। যদি পারো পাহাড়তলির কর্নেল সাহেবকে হত্যা করো। সে আমাদের আঠারজন বিদ্রোহীকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। একজন গিয়ে যদি তাকে মেরে ফেলতে না পারে। তবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম বৃথা। তিনদিন পর কর্নেল সাহেবের বাংলায় উনত্তি ছােরা হাতে ধরা পড়েছিল রোকন। আর্দালি দারোয়ান-বয়-বাবুর্চি কেউ তাকে ধরে রাখতে পারছিল না, একটানা চেঁচাচ্ছিলে সে,– উগগ্যা কালা আদমী মারা গেলে তার বদলে ঔগগ্যা শাদা আদমী খতম্। বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল রোকনের।
সাতচল্লিশে দুটো দেশে ভাগ করে দিয়ে ইংরেজ যখন পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গিয়েছিল তখন। রোকন আন্দামান থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরে এলো গ্রামে। বার্ধক্যের ভারে তার শরীর তখন ঝাঁঝরা। দলের লোকেরা পরামর্শ দিত, ওস্তাদ, আবার তোর কাম শুরু কর। এবার মওকা ভালা, দাঙ্গা লাগিয়ে লালে লাল। থুথু ছিটিয়ে রোকন বলত, হে গুন কুত্তার কাম। গ্রামাঞ্চলে দাঙ্গার ত্রাস জাগিয়ে মিন্নাত আলী অনেক জমি দখল করে। নিয়ে ধনী বনে গিয়েছিল। সে মাঝে মাঝে রোকনকে ফুসলাত, টেয়া লাগিয়ে লইও ভাইজান। টাকা? টাকা দিয়ে কি করবে সে? বউ নেই, ছেলে নেই, মায়া নেই, বাঁধন নেই– টাকা দিয়ে কি করবে সে? হাঁ লাগতে, যদি সদরুদ্দিন বেঁচে থাকতো, লাগত যদি বউটা নাকের নথ দুনিয়ে বলত, তুই আয়ার লগে আর ন মাতি বা। একদিন কি মনে করে ফাঁকা ভিটের ওপর ঘর বাঁধতে বসে গেল রোকন। গাছের খুঁটি, বাঁশ ও ছন যোগাড় করে এনে দিনরাত টুকটাক শব্দ জাগিয়ে কাজ করে যেতে লাগল। এক কানি পৈতৃক জমি ছিল। এর ওর কাছ থেকে লাঙ্গল গরু ধার করে এনে চাষে নেমে গেলো। মাটির গন্ধে, ধানের গন্ধে, বৃষ্টির ছন্দে মেতে গেল রোকন। মাঝে মাঝে একটি নারীর মুখ মনে উঁকি দিত, আবার কি মনে করে মনে মনেই সেই নারীকে গলা টিপে মেরে ফেলত। কি হবে ওই সোনালি হরিণে? এমনি করে গাছের বয়স বাড়ে, খালের পাড় ভাঙ্গে, বন্ধ্যা মাটি ফসল সম্ভবা হয়। লুটতরাজে ডাকাতদলের আড়ড়ায় এখন রোকনের নাম বিস্মৃত। জোয়ান ডাকাতরা এখন রোমহর্ষক নায়ক। তবে কখনো কখনো তার নাম উচ্চারিত হয় যখন কোন জমিতে ধান লুট করার দাঙ্গা হয়। যখন কোনো জোয়ান ডাকাতের মাথা লাঠির আঘাতে দু’ফাক হয়ে যায় তখন বলাবলি হয়– এই অব্যর্থ ঘা রোকনের লাঠির ছাড়া আর কারো নয়। থানার দারোগা পর্যন্ত ডায়েরীতে লিখে রাখেন,– এই বৃদ্ধ এককালে দুর্ধর্ষ ডাকাত ছিলো, সম্প্রতি চাষীদের পক্ষ লয়ে লাঠালাঠি করে। বেআইনী কাজেকর্মে নির্লিপ্ত থাকলেও কোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতির সময় সন্দেহজনক ব্যক্তি।
এই ডায়েরীর জন্যে কখনো কখনো পুলিশ এসে তার খোঁজ নেয়। রোকন তখন হাসে। মনে মনে বলে– চাষ করি, ধান কাটি, কাজ করে খাই। তাতেও যদি অপরাধ হয় তবে আগুনে অন্যদিক জ্বলে উঠবে। আগুন জ্বালার এই মনোবাসনা তার দেখা দিত যখন কোনো অন্যায় অবিচার দেখতো। মিন্নাত আলী এসে বলত, ভাইজান এই কামে কেয়া নামি লা ? লাভ তো নাই, খালি লোকসান, দুশমনও বাড়ি যাইব। বাড়ুক। দুশমন কি জানে রোকন। দুর্বলরাই দুশমন। এই কয় বছরে মাটির সঙ্গে মাখামাখি করতে গিয়ে সে জানতে পেরেছে, মাটিকে যারা ভালোবাসে না তারাই দেশের দুশমন। সেবার জিরি অঞ্চলে দাঙ্গা লেগে গিয়েছিল। কয়েক ঘর চাষী কোন এক বাস্তুত্যাগী হিন্দু জমিদারের জমিতে চাষ করত। জমি থেকে ধান তুলতে গেলে চেয়ারম্যান ইউসুফ সদাগরের ভাড়া করা গুণ্ডারা ঝাপিয়ে পড়েছিল চাষীদের উপর। কাস্তে আর লাঠিতে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল ধান ও মাটি। শত্রু সম্পত্তির অজুহাতে ইউসুফ সদাগর জমির মালিকানা দাবি করে জমির সমস্ত ধান গভীর রাতে তার গোলায় তুলতে চেয়েছিলেন। চাষীদের সঙ্গে লেগেছিল সংঘর্ষ। রোকনের বৃদ্ধ শরীরে জেগে উঠেছিল বিশ বছর আগের সেই দুর্ধর্ষ মানুষটি। গুণ্ডাদের মধ্যে একজন লাঠির আঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছিল । দারোগা রোকনকেই গ্রেফতার করেছিলেন। শৃঙ্খলিত হাত উর্ধ্বে তুলে রােকন গর্জে উঠেছিলেন,– তারা চাষ করিলো, ধান কা তুলি লইব সদাগরে? সেদিন তার প্রশ্নের জবাব কারো কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। বিচারক রায় দিয়েছিলেন, বার বছর সশ্রম কারাদণ্ড । জেলে যাবার পথে পথে থুথু ছিটিয়ে রােকন বলেছিল, — বিচার হইব একদিন, আইজ ন হইলে কাইল। একাত্তরের একত্রিশ মার্চ জেলখানার ফটক খুলে দেওয়া হয়েছিল। হানাদার পশ্চিমা সৈন্যরা তখন বাংলাদেশের গ্রাম শহরে নির্যাতন চালাচ্ছিল। উল্লসিত কয়েদীদের সঙ্গে বেরিয়ে এলো রোকন। শহরে লুটতরাজ চলছে, ঘরবাড়ি জ্বলছে, পালাচ্ছে মানুষ আলো থেকে অন্ধকারে। গ্রামে এসে রোকন ভিটের দাওয়ায় বসে বসে শুধু ঝিমায়। সব বদলে গেছে, আকাশ বাতাস মাটি পর্যন্ত; ঘরে ঘরে আতঙ্ক। শহর শেষ করে এবার হানাদার সৈন্যরা গ্রামে এসে ঢুকবে।
যেদিন দু’টি বোমারু বিমান পটিয়ায় বোমা ফেলল সেদিন গ্রামবাসীদের মধ্যে দু’টি দল তৈরি হয়ে গেলো। একদল লুট করার পক্ষে, অন্য দল জানমাল আত্মরক্ষার পক্ষে। রোকন ঝিমায় আর মাঝে মাঝে হাঁক দেয়, বিচার হইবে একদিন; আইজ ন হইলে কাইল। বিরাট একটি ঘটনার জন্যে গ্রামবাসীরা অপেক্ষা করে বসেছিল। অবশেষে ঘটলো। অর্থাৎ কয়েক ট্রাক খানসেনা পটিয়া ক্যাম্প থেকে ভোরে রওনা হবার সঙ্গে সঙ্গে মহিরা, কাশিয়াইশ, পরৈখোরার ঘরবাড়ি জ্বলে উঠলো দাউ দাউ করে। জ্বলন্ত দুপুরে গরু- ছাগল, মেয়েমানুষ নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল গ্রামবাসীদের মধ্যে। কচি কচি মেয়েদের করুণ চিৎকারে ভেঙে পড়লো আকাশ। রোকন ঝিমাচ্ছিল। হঠাৎ তার শরীরের মধ্যেই সেই তাগড়া মানুষটা জেগে উঠল। এক লাফে ছুটে গেল সড়কে— যেদিকে সামরিক যানগুলো চলে গেছে দক্ষিণদিকের গ্রাম-গ্রামান্তরে। সেগুলো হাজার হাজার নারী শিশু বৃদ্ধ হত্যা করে বীরদর্পে এই সড়ক দিয়ে আবার ফিরে যাবে পটিয়ায়। এই মুহূর্তে রোকন একটি বিরাট কাজ করতে পারে, সেই কাজটি হলো সামনের কাঠের পুলটার কাঠগুলো আলগা করে দেয়া। সব না হোক অন্তত একটা ট্রাককে পড়ে যেতেই হবে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে পুলের সব কাঠগুলোকে আলগা করে দিয়ে রোকন এখানে এসে হাঁফাচ্ছিল।
ছেলেটাকে দেখে গর্জে উঠলো,– এই পোলা কণ্ডে যাবি? ছেলেটা গুটি গুটি হয়ে শুয়ে পড়েছে ঘাসের ওপর, ভয়ে ও ক্লান্তিতে। তার অচেতন পাতলা দেহখানা কাঁধের ওপর তুলে নিয়ে রোকন নেমে পড়ল খালে। আর কিছুক্ষণ পর হানাদার সৈন্যেরা ফিরবে দক্ষিণাঞ্চল থেকে, পুলটা পেরোতে গিয়ে প্রথম ট্রাকটা হুড়মুড় করে নড়ে যাবে, তারপর শুরু হবে এই অঞ্চলের ওপর ভীষণ নির্যাতন! সমস্ত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবে। জ্বালুক, এই গ্রামের শিশু থেকে প্রত্যেকটি বৃদ্ধ পর্যন্ত লুট করার জন্যে বেরিয়ে গেছে গ্রামে গ্রামে। লুটের মাল নিয়ে ফিরে এসে দেখবে তাদের ঘরগুলো ছাই হয়ে পড়ে আছে ভিটের ওপর। ইউসুফ সদাগর আর মিন্নাত আলীর ঘরও বাদ যাবে না। তার আগে পালিয়ে যাবে রোকন অন্য গ্রামে। এবার আর একা নয়, সঙ্গে একটি মা হারানো, বাপ হারানো, ঘর হারানো ছেলে, তারই মত নিঃসঙ্গা মাটি যার জননী, শক্তি যার পিতা, সত্য তার বন্ধু। সে তো আবহমান বাঙালি, নিরাশ্রিত নির্যাতিত বিদ্রোহী সন্তান।