সুকুমার রায়ের গল্প ‘টাকার আপদ’
পুনর্মুদ্রণ
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৩
বুড়ো মুচি রাতদিনই কাজ করছে আর গুনগুন গান করছে। তার মেজাজ বড় খুশি, স্বাস্থ্যও খুব ভালো। খেটে খায়; স্বচ্ছন্দে দিন চলে যায়।
তার বাড়ির ধারে এক ধনী বেনে থাকে। বিস্তর টাকা তার; মস্ত বাড়ি, অনেক চাকর-বাকর। মনে কিন্তু তার সুখ নাই, স্বাস্থ্যও তার ভালো নয়। মুচির বাড়ির সামনে দিয়ে সে রোজ যাতায়াত করে আর ভাবে, এ লোকটা এত গরিব হয়েও রাতদিনই আনন্দে গান করছে, আর আমার এত টাকাকড়ি, আমার একটুও আনন্দ হয় না মনে, গাওয়া তো দূরের কথা। ইচ্ছা হলে তো টাকা দিয়ে রাজ্যের বড় বড় ওস্তাদ আনিয়ে বাড়িতে গাওয়াতে পারি, নিজেও গাইতে পারি, কিন্তু সে ইচ্ছা হয় কই?
শেষটায় একদিন সে মনে মনে ঠিক করল, এবার যখন সে মুচির বাড়ির সামনে দিয়ে যাবে তখন তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথাবার্তা বলবে।
পরদিন সকালেই সে গিয়ে মুচিকে জিজ্ঞাসা করল, কী হে মুচিভায়া, বড় যে ফুর্তিতে গান করো, বছরে কত রোজগার করো তুমি?
মুচি বলল, সত্যি বলছি মশাই, সেটা আমি কখনো হিসাব করিনি। আমার কাজেরও কোনোদিন অভাব হয়নি। খাওয়া-পরাও বেশ চলে যাচ্ছে। কাজেই টাকার কোনো হিসাব রাখার দরকার হয়নি কোনোদিন।
বেনে বলল, আচ্ছা, প্রতিদিন কত কাজ করতে পারো তুমি?
মুচি বলল, তারও কোনো ঠিক নেই। কখনো বেশি করি, কখনো কম করি।
মুচির সাদাসিধে কথাবার্তায় বেনে বড় খুশি হলো। তারপর একটা টাকার থলে নিয়ে সে মুচিকে বলল, এই নাও হে, তোমাকে এই একশো টাকা দিলাম। এটা রেখে দাও। বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখের সময় কাজে লাগবে।
মুচির তো ভারি আনন্দ; সে সেই টাকার থলেটা নিয়ে মাটির তলায় লুকিয়ে রেখে দিল। তার জীবনে সে কখনো একসঙ্গে এতগুলি টাকা চোখে দেখেনি।
কিন্তু আস্তে আস্তে তার ভাবনা আরম্ভ হলো। দিনের বেলা বেশ ছিল; রাত্তির হতেই তার মনে হতে লাগল, ওই বুঝি চোর আসছে।
বেড়ালে ম্যাও করতেই সে মনে করল, ওই রে, আমার টাকা নিতে এসেছে। শেষটায় তার আর সহ্য হলো না। টাকার থলিটা নিয়ে সে ছুটে বেনের বাড়ি গিয়ে বলল, এই রইল তোমার টাকা। এর চেয়ে আমার গান আর ঘুম ঢের ভালো।