সাহিত্যিক সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজ মৃত্যুদিন

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৯, ২০২০

লেখক, সংগীতস্রষ্টা ও ভাষাবিদ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজ মৃত্যুদিন। ১৯২৩ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম ১৮৪২ সালের ১ জুন।

তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদানকারী প্রথম ভারতীয়। ব্রিটিশ ভারতের নারীমুক্তি আন্দোলনে সত্যেন্দ্রনাথ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। পারিবারিক পরিচয়ে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ।

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ঠাকুর পরিবারের জোড়াসাঁকো শাখার দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র। তিনি বাড়িতেই সংস্কৃত ও ইংরেজি শিখেছিলেন। হিন্দু স্কুলের ছাত্র হিসাবে সত্যেন্দ্রনাথ ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন এবং প্রথম বিভাগে স্থান অধিকার করে প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন।

সেকালের রীতি অনুযায়ী, ১৮৫৯ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। এই বছরই সত্যেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্র সেন দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে সিংহল (অধুনা শ্রীলঙ্কা) ভ্রমণ করেন।

দীর্ঘকাল কেবলমাত্র ব্রিটিশ অফিসারেরাই সকল সরকারি পদে নিযুক্ত হতেন। ১৮৩২ সালে মুনসেফ ও সদর আমিন নামের দুটি পদ সৃষ্টি করে সেগুলি ভারতীয়দের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ১৮৩৩ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদদুটি চালু করে সেগুলির দরজাও ভারতীয়দের জন্য খুলে দেয়া হয়। ১৮৬১ সালে আইসিএস আইন বলে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস চালু হয়। এর আগেই অবশ্য ১৮৫৩ সালের আইন বলে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের প্রথা চালু হয়ে গিয়েছিল।

সেযুগে ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে সরকারি উচ্চপদ লাভ খুব কঠিন কাজ ছিল। এই ব্যাপারে সত্যেন্দ্রনাথকে উৎসাহ ও অর্থসাহায্য জোগান বন্ধু মনমোহন ঘোষ। ১৮৬২ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণের উদ্দেশ্যে দুজনে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১৮৬৩ সালের জুন মাসে সত্যেন্দ্রনাথ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে নির্বাচিত হন। এরপর শিক্ষাধীন প্রশিক্ষণ (প্রবেশনারি ট্রেনিং) সমাপ্ত করে ১৮৬৪ সালের নভেম্বর মাসে দেশে ফিরে আসেন।

মনমোহন ঘোষ পরীক্ষায় কৃতকার্য না হলেও বারে ডাক পেয়েছিলেন। বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে কর্মে বহাল হন সত্যেন্দ্রনাথ। সেযুগে বোম্বাই প্রেসিডেন্সি গঠিত ছিল বর্তমান মহারাষ্ট্র, গুজরাত ও সিন্ধু প্রদেশের অংশ বিশেষ নিয়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে চার মাস বোম্বাই (অধুনা মুম্বই) শহরে বহাল হলেও, তার প্রথম কার্যকর নিযুক্তি হয়েছিল আমেদাবাদে।

এরপর বদলি চাকরির সূত্রে তিনি সারা দেশ ভ্রমণ করেন। বাড়ি থেকে দূরে থাকতেন। তাই আত্মীয়স্বজনেরা প্রায়ই তার কাছে আসতেন এবং বেশ কিছুদিন করে কাটিয়ে যেতেন। নিয়মিত আসতেন তার দুই অনুজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ও বোন স্বর্ণকুমারী দেবী।

বাংলার বাইরে বদলির চাকরির সূত্রে সত্যেন্দ্রনাথ অনেকগুলি ভারতীয় ভাষা শেখারও সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি বাল গঙ্গাধর তিলকের গীতারহস্য ও তুকারামের অভঙ্গ কবিতাবলি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। তার অনুজ রবীন্দ্রনাথও তুকারামের কয়েকটি কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ যেখানেই বদলির সূত্রে গিয়েছিলেন, সেখানেই ব্রাহ্মসমাজের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমেদাবাদ ও হায়দ্রাবাদ (সিন্ধু প্রদেশ) শহরে ব্রাহ্মসমাজের প্রসারে তার বিশেষ অবদান ছিল।

সত্যেন্দ্রনাথ মহারাষ্ট্র অঞ্চলের অগ্রণী সমাজ সংস্কারক ও প্রার্থনা সমাজ নেতৃবর্গের সংস্পর্শে আসেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, কাশীনাথ ত্রিম্বক তেলঙ্গ, রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর ও নারায়ণ গণেশ চন্দবরকর। ৩০ বছর তিনি আইসিএস পদ অলংকৃত করেছিলেন। ১৮৯৭ সালে মহারাষ্ট্রের সাতারার জজ হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন।

১৯০০-০১ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতিত্ব করেন। ১৮৯৭ সালে নাটোরে আয়োজিত দশম বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনেরও পৌরোহিত্য করেন। তার লেখা বইগুলো হলো, সুশীলা ও বীরসিংহ (নাটক, ১৮৬৭), বোম্বাই চিত্র (১৮৮৮), নবরত্নমালা, স্ত্রীস্বাধীনতা, বৌদ্ধধর্ম (১৯০১), আমার বাল্যকথা ও বোম্বাই প্রবাস (১৯১৫) এবং ভারতবর্ষীয় ইংরেজ (১৯০৮)।
    
সত্যেন্দ্রনাথের দুই সন্তান সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭২-১৯৪০) ও ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী (১৮৭৩-১৯৬০) ছিলেন কৃতি ব্যক্তিত্ব। তাদের ছেলেবেলা কেটেছিল ইংল্যান্ডে। সুরেন্দ্রনাথ ইংরেজি ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায় উপন্যাসটি তিনিই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। এছাড়া মহাভারতের মূল অংশটির একটি সংক্ষিপ্ত পুনর্লিখন তিনি প্রকাশ করেছিলেন।

সুরেন্দ্রনাথ সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন ফরাসি ভাষায়। তিনি ছিলেন এক বিশিষ্ট সংগীতবিদ। রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান ছিল। সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী ছিলেন তার স্বামী। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী ছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা উপাচার্য।