সাহসে ভর করেই বাঁচতে পারি বিপদ থেকে
মারিয়া সালামপ্রকাশিত : নভেম্বর ০৯, ২০১৮
চৈত্রের কাঠফাটা দুপুর, বৃহস্পতিবার স্কুলের হাফ ডে, সম্ভবত ১৯৯৩ সাল। স্কুলভ্যান থেকে যেখানে নামিয়ে দেয় সেখান থেকে একটা সরুপথ দিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় রোজ। এমনি দিনে জামাল বা কামাল যে কোন একভাই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের দুই বোনকে বাড়িতে এগিয়ে নিতে।
আমাদের একা বাড়ি থেকে বের হওয়াটা আমার মামারা ইনসিকিউরড মনে করতো, তাই আমাদের দুই বোনের সাথে সবসময় দুটো ছেলে থাকতো, তারা আমাদের সাথে সাথে থাকতো, পুকুরে নামলে খেয়াল রাখতো অন্য কেউ যেন না নামে, স্কুল শেষে ফেরার পথে এগিয়ে নিয়ে যেত।
ঐদিন আমার বোন কি কারণে যেন স্কুল যায় নি, আর ভ্যান থেকে নেমে দেখি জামাল বা কামাল কেউ নেই। একেতো চৈত্রের দুপুর, তারপরে রাজশাহীর গরম! সরু রাস্তার দুপাড়ে একটার পর একটা বাড়ি এ ওর গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, অনেকটা ঘিঞ্জি। কিন্তু, রাস্তায় জনমানুষ নেই। খুব ছোট থেকেই ভূতের ভয়। গলিতে নেমেই গা ছমছম করে উঠল।
একটু সামনে গিয়েই দেখি ডালপুরি দাঁড়িয়ে। এই এলাকার ক্যাবলা আর আনস্মার্ট টাইপ ছেলে, বয়স তখন হবে ২০/২২। তার আসল নাম বলছি না, তবে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে প্রায় ডালপুরি খেতে দেখা যেত বলে এই নাম। তাকে নিয়ে আমরা হাসতাম অনেক। আমার বাপির দাবা খেলার নেশা ছিল অনেক, তাই এলাকার ছেলেরা (সবাই না, যারা ভাল দাবা খেলতে পারে আর সাথে টেনেটুনে হলেও পড়াশোনাটা চালিয়ে যায়) আসত আমাদের বাড়িতে সকাল বিকাল দাবা খেলতে, মাঝে মাঝে আমিও খেলতাম তাদের সাথে। ডালপুরিও আসতো, তাই তাকে দেখে একটু সাহস পেলাম।
ডালপুরির কাছাকাছি যেতেই কথা নাই বার্তা নাই, সে আমার হাত ধরে তার ঘরের দিকে টানতে লাগলো। ব্যাপারটা এত দ্রুত হল যে আমার পুরোটা বিষয় বুঝতেই লাগলো বেশ কয়েক সেকেন্ড।
একটু সামলে নিয়েই নানুর কথা মনে হল, মেয়েদের ভয়ানক হতে হয় মাঝে মাঝে। তখন সবে সবে কমলা বেল্ট আমি আর তার সাথে প্রত্যেক কালী-রাত্রির সরিষার তেল মেখে শক্ত হয়ে ওঠা আমার হাত! দিলাম শক্ত করে দুখানা ঘুষি নাকের উপরে। ঘুষি খেয়ে ডালপুরি একহাতে নাক আর অন্য হাতে তার ঘরের দরজা ধরে কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, মনে রাখিস, নইলে এরপরে আরো শক্ত মাইর হবে তোর, আর আমাদের বাড়িতে দেখলেই খবর আছে, বুঝেছিস!
আমার গল্পটা খুবি সাধারণ আর নিরুপদ্রব ধরনের, অনেকটা হাসিরও। কারণ, আমরা ভাইবোনরা এসব নিয়ে এখনও হাসাহাসি করি। তার নামটা বলছিলা কারণ তাকে যে মাইরটা দিতে পেরেছিলাম, তাতেই আমি খুশি।
কিন্তু, একবার ভেবে দেখেন, এরকম সাধারণ টাইপ দেখতে, ভীতু আর আনস্মার্ট ছেলে সুযোগ পেয়ে যদি কোন মেয়েকে হ্যারাস করতে আসে, যারা চাল্লু টাইপ বা ক্ষমতাধর বা উঁচু পজিশন হোল্ড করে, তারা সুযোগ পেলে কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে! আমি বলছি না, সবাই খারাপ, তবে অপরাধী আমাদের সবার মাঝেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে, তাদের কেবল সুযোগ দরকার।
তাই, বলি আমাদের মেয়েদের আরো অনেক অনেক সাহসী হয়ে উঠা দরকার, একমাত্র সাহসে ভর করেও আমরা অনেক বিপদ থেকে বাঁচতে পারি। আজ যারা #মিটু নিয়ে মুখ খুলেছেন, তারাও অনেক সাহসী, এই সাহসেরও প্রয়োজন আছে।
তারা ঘটনাটা বলছে অনেক পরে, কিন্তু, তাতেই তাদের যেসব কথা শুনতে হয়, সেটাইতো অনেক বেশি ভয়াবহ। তারপরেও তারা যে সাহস করে বলছে, কেবল সেইজন্যই তাদের আমার হাজার সালাম।
আজ তারা এই স্টেপ নিচ্ছে বলেই, মেয়েদের মুখ খোলা যাবে না এই ট্যাবু ভাঙছে বলেই, আমাদের কন্যারা বা বোনরা সাহস পাবে, ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই মুখ খোলার। একবার মুখ খোলার অভ্যাস চালু হলেই, এইসব সুযোগের অভাবে ভাল মানুষগুলো নিজের খোলসের মধ্যেই থাকবে, আমাদের আশেপাশেও আসবে না।
আর আমাদের কাজ হবে, সাহসীদের সাথে থেকে, এই বিজয় যাত্রার একজন গর্বিত অংশীদার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা।