সাম্প্রদায়িক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং তার রাজনীতি
শেষ পর্ব
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : নভেম্বর ০৩, ২০২০
গান্ধী জীবনের শেষে এসে যে সত্য উপলব্ধি করেছিলেন, ইতিহাসের দিকে নজর ফেলে তা লক্ষ্য করতে যেন আমরা অনেকেই চাইছি না। বিভেদ বাড়িয়ে তোলার মধ্যেই যেন আমাদের আগ্রহ। ভারতবর্ষের সুযোগ্য কতিপয় ইতিহাসবিদ বহু পরিশ্রম করে, ভারতের ইতিহাসের এরকম কানাগলি নিয়ে বহু সত্য উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু আমরা সেইসব দলিলপত্রকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের পুরানো বিশ্বাস নিয়ে বসে থাকি। জ্ঞানচর্চা মানেই তো নতুনকে জানা। কিন্তু নতুনকে জানার আগ্রহের চেয়ে পুরাতনকে আক্রে ধরে বিভেদ বাড়ানোতেই যেন আমাদের আনন্দ। মানুষের ইতিহাস বেশির ভাগ সময়ই রহস্যময়তার কুয়াশায় আবৃত থাকে। সেই কুয়াশা ভেদ করে সত্য জানাটাই তো ইতিহাস জানা বা জ্ঞানচর্চার লক্ষণ। পুরানোকে আক্রে থাকা মানেই তো রক্ষণশীলতা, ধর্ম পুরানোকে আক্রেই বাঁচতে চায়। নিজেদেরকে যাঁরা আমরা প্রগতিশীল ভাবি, তাঁরা কেন পুরানো বিশ্বাস বা জ্ঞানকে আক্রে বসে থাকছি? বিশ্ব জগতের বা ইতিহাস চিন্তার সবকিছুই স্থির, চিরন্তন বা পবিত্র মনে করার কারণ নেই। নানা রহস্যময়তা বা মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা সত্য আবিষ্কারই জ্ঞান সাধনার লক্ষ্য। যশোবন্ত সিংহ তাই নিজ রাজনৈতিক দলের বড় পদ বিসর্জন দিয়ে সত্য আবিষ্কারের পথ ধরে হেঁটেছেন। সত্যসন্ধানী বঙ্কিমচন্দ্র তাই ইংরেজদের লেখা ইতিহাসে বিশ্বাস স্থাপন করেননি। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, নতুন করে ভারতের ইতিহাস লিখতে হবে। কথাটা বলেছেন, ভীমরাও আম্বেদকর। সঠিক কথা বলে গেছেন তাঁরা, ভারতের ইতিহাস নতুন করে বিচার করতে হবে। নতুন ইতিহাস লিখতে গেলে দেখা যাবে, ভারতের সাধারণ হিন্দু-মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না; সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটানোর পেছনে তাঁদের হাত ছিল না। সবটাই ঘটেছিল রাষ্ট্রযন্ত্র আর ক্ষমতাবানদের টিকে থাকার ষড়যন্ত্র হিসেবে আর তার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ পরস্পরকে ভুল বুঝেছে।
ভারতে কয়েকমাস আগে দিল্লিতে মুসলমানদের উপর আক্রমণকে বলা হলো সাম্প্রদায়িক ঘটনা। কিন্তু সেটা মোটেই সাম্প্রদায়িক ব্যাপার ছিল না। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় সেটা প্রমাণিত হয়েছে। মুসলমানদের উপর এই আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মাঠে নামলেন। কী করে তাহলে সেটা সাম্প্রদায়িক হামলা হলো? বারবার এভাবেই নানা ঘটনাকে সাম্প্র্রদায়িক চেহারা দিয়ে জল ঘোলা করা হচ্ছে, পাশ্ববর্তী দেশগুলির সঙ্গে ভারতের জনগণের সম্পর্কের মধ্যে তা নানারকম টানাপোড়েন তৈরি করছে। সরকারী সন্ত্রাসী বা গুণ্ডাদের আক্রমণের দায় সারা ভারতের জনগণ নেবে কেন? ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ের সকল মানুষ সাম্প্রদায়িক হলে, ভারতের এক চতুর্থাংশ মুসলমানদের আরো আগে নিশ্চিহ্ন হওয়ার কথা। মুসলমানদের উপর আক্রমণ হলে ভারতের সাধারণ মানুষরা মানববন্ধন করে, পত্রপত্রিকায় তার সমালোচনা লেখা হয়। মানববন্ধন বা লেখালেখির কাজে অংশ নেয়া বড় অংশটাই হিন্দু পরিবারে জন্ম নেয়া। সেই মানুষগুলিকে কি সাম্প্রদায়িক বলা যাবে? ভারতের সকল হিন্দুরা যদি যুক্ত হয়ে সকল মুসলমানকে নিশ্চিহ্ন না করতে চায়, কী কারণে তাহলে সেটাকে সাম্প্রদায়িক বলে বিবেচনা করতে হবে? কারা এগুলিকে সাম্প্র্রদায়িক বলছে? ক্ষমতাবানদের বা সরকারের ব্যর্থতা সেগুলি, সাধারণ জনগণ সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অসহায়। কিন্তু তারপরেও তারা সবসময় প্রতিবাদ করছে এইসব আক্রমণের।
সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকা, ভিন্ন দলগুলির সঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে এগিয়ে যাবার উদ্দেশ্য নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার নামে এসব ঘটানো হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা সরকারের গুণ্ডবহিনীর লুটপাটের সঙ্গে এরকম ঘটনার যথেষ্ট সম্পর্ক আছে। ফলে বৃহত্তর জনগণকে এর সঙ্গে যুক্ত করাটা অন্যায়। সরকার বা বৃহৎ কোনো দলের এই ধরনের উদ্দেশ্যমূলক হামলাকে সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত করার মানেই হলো, বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত করে রাখা। দিল্লিতে কয়েক মাস আগে মুসলমানদের উপর যে আক্রমণ হয় সেটাকে সাম্প্রদায়িক বলা মানে, ভারতের বৃহত্তর হিন্দু জনগোষ্ঠীকে এর জন্য দায়ী করা। কিন্তু বৃহত্তর হিন্দু জনগোষ্ঠী এগুলির সঙ্গে যুক্ত তো নয়ই বরং এর বিরোধী। রাষ্ট্রের সরকার আর রাষ্ট্রের জনগণ এককথা নয়। হ্যাঁ, কখনো কখনো সরকারী প্রচার যন্ত্রের নানা উদ্দেশ্যমূলক প্রচরণা আর সৃষ্ট কিছু কিছু ঘটনায় জনগণ বিভ্রান্ত হয়, হঠাৎ জঙ্গী হয়ে ওঠে। কিন্তু সেটা জনগণের সঠিক তথ্য না পাওয়ার কারণে ঘটে থাকে। হিটলার যেভাবে ইহুদি নিধনের পক্ষে নানারকম প্রচারণার দ্বারা বিরাট সংখ্যক জনগণকে নিজের দলে টেনে নিয়েছিল। কিন্তু সকল জনগণকে বা জনগণের সচেতন অংশকে নিজের প্রচারে বিভ্রান্ত করতে পারেনি।
ভারতে আসলে হিন্দু মুসলমানরা পরস্পরের বড় শত্রু নাকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি একে অপরের বড় শত্রু। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় দুটি প্রতিপক্ষ হলো কংগ্রেস আর বিজেপি। দুটি দলেই হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। হিন্দু আর মুসলমানের লড়াই কোথায় এখানে? পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ বামফ্রণ্ট, দু দলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষরা হিন্দু সম্প্রদায়ের। ফলে হিন্দুরাও সেখানে নানাভাবে হিন্দুদের বড় প্রতিপক্ষ। ফলে হিন্দুরা যে কেবল মুসলমানদের আক্রমণে ব্যস্ত তা নয়, নিজের সম্প্রদায়ের মানুষকে প্রয়োজনে আক্রমণ করতে ছাড়ছে না। মূল দ্বন্দ্বটা ক্ষমতার, মূল দ্বন্দ্বটা রাজনৈতিক-সামাজিক আর অর্থনৈতিক; ধর্ম বা সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সেভাবেই স্মরণে রাখতে হবে। বাংলাদেশে হিন্দুদের বাড়ি আক্রমণ হলে সঙ্গে সঙ্গে বিবৃতিতে দেখা যায়, সেটা নাকি সাম্প্রদায়িক হামলা। সামান্য তদন্ত না করেই এরকম বলে বসেন অনেকে। সাম্প্রদায়িক আক্রমণ বললে মনে হয়, সকল মুসলমানরা হিন্দু নিধনে ব্যস্ত। কিন্তু সকল মুসলমানরা কি এইসব আক্রমণের পেছনে থাকে? নাকি থাকে ক্ষমতাবান কিছু মানুষ? বড় বড় রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় স্থানীয় গুণ্ডাপাণ্ডারা যা করবে, সারা দেশের জনগণকে তার দায় নিতে হবে কেন? ঘটনা ঘটবার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বলা মানে কি, সকল জনগণের উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে সেইসকল গুণ্ডাদের রক্ষা করা বা নিজের অজান্তে সেইসব গুণ্ডাদের পক্ষে বিবৃতি দেয়া নয় কি? বিকাশ হত্যার ঘটনায় কী প্রথম ঘটেছিল? বলা হলো সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, পরে দেখা গেল ছাত্রলীগের কতিপয়ের দ্বারা হত্যাকাণ্ডটি হয়েছে। বাংলাদেশে কি মুসলমানদের সম্পত্তি লুটপাট হয় না? মুসলমানদের জমিজমা ঘরবাড়ি দখল হয় না? মুসলমানের মেয়েরা কি ধর্ষণের শিকার হয় না? তখন সেটা কারা করে? যদি সেটা গুণ্ডারা করে, যদি সেটা ক্ষমতায় থাকা সন্ত্রাসীর করে, হিন্দুর বাড়ি ঘর যারা লুট করে বা অন্য ধরনের আক্রমণ চালায় সহজ হিসেবে তারাও সন্ত্রাসী, রাষ্ট্রের পেশী শক্তি। কিন্তু সেটা না করে ভিন্নভাবে ঘটনাকে চিহ্নিত করতে হয় কেন? পুরো একটা সম্প্রদায়ের উপর দায়টা চাপানো হয় কেন? কার স্বার্থে, কাদের অপরাজনীতি সেটা? সন্ত্রাস যে করবে দায় তার, যারা মদদ দেবে তাদের। সমাজের যে অংশের হোক তারা অপরাধী, প্রধান পরিচয় তারা পেশীশক্তি।
সন্ত্রাস করার জন্য ক্ষমতাবানদের হাতে লোক থাকে সেটা ভুলে যান বিবৃতিদাতারা। সকলকে বা বিশেষ একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে তার দায় নিতে হবে কেন? বাংলাদেশের একজন নাগরিকের প্রথম পরিচয় হিন্দু মুসলমান হবে কেন? হিন্দু বা মুসলমান পরিবারে জন্মে একজন কি ধর্মহীন হতে পারেন না? বিপ্লবী রাজনীতি করার জন্য হিন্দু পরিবারের সাধারণ একজন সন্তান কি প্রশাসনের আক্রমণের শিকার হতে পারেন না? কিছু না জেনেই বলে দিলেই হবে যে ব্যাপারটা সাম্প্রদায়িক আক্রমণ? কাকে রক্ষা করার জন্য বলা হয় এসব? হিন্দু পরিবারের দুজন মানুষের মধ্যে কি সম্পত্তি নিয়ে বিরোধে নানারকম অঘটন ঘটতে পারে না? কিন্তু সাম্প্রদায়িক বলে কাকে রক্ষা করা হচ্ছে? সবসময় অত্যাচার চলে শক্তির, ক্ষমতাবানদের। চট করে সব ঘটনার দায় সাম্প্রদায়িক শক্তির উপরে চাপালে তো শক্তিমানদেরকে রক্ষা করা হয়। লড়াই কি সবসময় সরকারি দলের আর বিরোধী দলের মধ্যে চলে? সরকারি দলের মধ্যে কি বিভিন্ন গোষ্ঠীর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলে না? মূল লড়াইটা অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বারা প্ররোচিত, এই সত্যটা মনেপ্রাণে না থাকলে রাজনীতি, সমাজ আর ইতিহাসকে বোঝা আর ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে একটা দেশের রাজনীতি আর আগাতে পারে না, বাক্সবন্দী কিছু শব্দের মধ্যে আটকা পড়ে থাকে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক শব্দটাও তাই। গত পাঁচ মাসে পাশ্চাত্যের সাড়ে তিনশো বছরের ইতিহাস-রাজনীতির নানা গ্রন্থ পাঠ করে তাই সাম্প্রদায়িক শব্দটা পাওয়া গেল না। ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি গ্রন্থে এই শব্দটা যেন থাকতেই হয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে শিক্ষিত মানুষের কথাবার্তায়ও। সংখ্যালঘু মানুষের উপর আক্রমণের ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য সঠিক শব্দটাই খুঁজে বের করা দরকার নয় কি আমাদের? সব সময় সকল ঘটনায় ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটি ব্যবহার করে তাকে বিচার করতে গেলে মূল সত্য থেকে দূরে সরে যাওয়া হয়, ঘটনার বিরাটরকম অপব্যাখ্যা হয়।