সাম্প্রদায়িক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং তার রাজনীতি

পর্ব ১২

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : নভেম্বর ০১, ২০২০

সংবিধান রচনার পর সংবিধান রচনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে তিনি দীর্ঘ বক্তৃতার শেষে বলেছিলেন, ভারতীয় সমাজ বিষয়ে প্রথমেই একটি কথা স্বীকার করে নেওয়া উচিৎ: দুটি ধারণা এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তার একটি হলো সাম্য আর অপরটি হলো ভ্রাতৃত্ব। ভারতে এমন একটি সমাজ বর্তমান যার ভিত্তি বহুস্তরীয় অসাম্য, বহু মানুষের অবদমনের বিনিময়ে যেখানে মুষ্টিমেয় মানুষের উন্নয়ন সাধিত হয়। স্বাধীন ভারতে সংবিধান চালুর দিনটির কথা কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘উনিশশো পঞ্চাশ সালের ছাব্বিশে জানুয়ারি আমরা এই স্ববিরোধময় জীবনে প্রবেশ করতে চলেছি।’ তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, এই স্ববিরোধময় জীবন আর কতদিন চলবে? তিনি স্পষ্ট করে বললেন, যত শীঘ্র সম্ভব এই স্ববিরোধের অবসান ঘটাতে হবে, নয়ত যারা অসাম্যপীড়িত তারা রাজনৈতিক গণতন্ত্রের এই কাঠামো ভেঙে চুরমার করে দেবে। তিনি আরো বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাতপাতের সমস্যা নেই, ভারতে রয়েছে। এই জাতপাতের বিভাজন জাতিগত ঐক্যের বিরোধী। প্রথমত এই সমস্যা সামাজিক জীবনে বিভেদ সৃষ্টি করে। ভবিষ্যতে বারবার সে কারণে ভারতে নানারকম সমস্যা দেখা দেবে।

যিনি স্বাধীন ভারতের মন্ত্রী ছিলেন, তিনি ধর্মান্তরিত হলেন মৃত্যুর আগে। বলে গিয়েছিলেন, ভারতের যে বিভাজন তা জাতিগত ঐক্যের বিরোধী। জিন্নাহ তখন বেঁচে নেই, ভারতের রাজনীতিতেও নেই তার প্রভাব। স্বাধীন ভারতে ভীমরাও আম্বেদকর যা বললেন সংবিধান রচনার পর, সেই সত্যি কথাগুলি অবিভক্ত ভারতে বারবার উচ্চারণ করেছিলেন জিন্নাহ মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে, ভারতে হিন্দু-মুসলমান সহ সকলের মধ্যে একটা ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে। জিন্নাহকে তখন বলা হয়েছিল সাম্প্রদায়িক। যদি মেনে নেয়া হয় জিন্নাহ সাম্প্রায়িক রাজনীতি করেছিলেন, তাহলে স্বাধীন ভারতে আম্বেদকর কেন ধর্মান্তরিত হন চার লক্ষ অনুসারী সহ? সরকারি কাগজপত্রে দেখা যায় ভারতে উনিশশো সাতষট্টি থেকে উনিশশো তিরাশি সাল পর্যন্ত সতেরো বছরে দাঙ্গার সংখ্যা পাঁচ হাজার চারশো একান্নটা। জিন্নাহ বা মুসলিম লীগ কারো প্রভাব ভারতে তখন ছিল না। কংগ্রেসের শাসনের সতেরো-আঠারো বছর পর ঘটে এই ঘটনাগুলি। ব্যাখ্যা কী তার? স্বাধীন ভারতের সকল মানুষ কি সাম্প্রদায়িক? সত্যিই এটা কি বিশ্বাসযোগ্য! তাহলে কি করে সেখানে একশো দশ কোটি হিন্দুর মধ্যে ত্রিশ কোটি মুসলমানরা টিকে আছে? সকল হিন্দুরা সাম্প্রদায়িক হলে মুসলমানদের তো এতদিনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার কথা। ভারতে যে হাজার হাজার দাঙ্গা হচ্ছে এখনো তার প্রধান কারণটা কি? জিন্নাহর পাকিস্তানে তো এত দাঙ্গার খবর নেই? তথাকথিত গণতান্ত্রিক ভারতে তাহলে ‘দাঙ্গা’ নামের ঘটনাগুলি বারবার ঘটছে কেন? মানুষ সাম্প্রদায়িক বলে, নাকি বড় বড় রাজনীতিকদের বিভ্রান্তিকর নীতি নির্ধারণের কারণে?

ভারতের তথাকথিত দাঙ্গাগুলির একটি কারণ গরু জবাই। গরু জবাই নিয়ে সারা পৃথিবীর আর কোথাও কখনো দাঙ্গা হয়েছে বলে কি কেউ শুনেছে? ভারতে হচ্ছে কেন? ভারতের মহাত্মা, কংগ্রেসের বহুকালের অবিংসবাদী নেতা গান্ধী গরু রক্ষার আন্দোলন করে গেছেন। বৃহত্তর সাধারণ মানুষের মধ্যে গরু-রক্ষার বা গোহত্যা বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে গেছেন। বহুক্ষেত্রে সেই বাণীর ফলাফল হচ্ছে এই সকল দাঙ্গা। কংগ্রেসের নেতা এটা বুঝতে পারলেন না, যে দেশে এক চতুর্থাংশ মানুষ মুসলমান, ধর্মীয় কারণে তারা গরু জবাই করবে। ফলে তার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাবার ফল বা গোহত্যা নিষেধের ফল কখনো ভালো হবে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কংগ্রেস কী করে এটা মেনে নিল? গোহত্যা নিষেধের কথা বলে যে ব্যক্তি একটি দেশের দুই ধর্মের মানুষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, তিনিই বা কী রকম মহাত্মা? সারা পৃথিবীর গোহত্যা কি তিনি বন্ধ করতে পেরেছেন না পারবেন? সেখানে ভারতে গোহত্যা বন্ধ মানে, তিনি সংখ্যালঘুদের উপর সংখ্যাগুরুর ইচ্ছা চাপিয়ে দিয়েছেন। কংগ্রেস সেটাকে সমর্থন করেছে। গণতন্ত্র তাহলে রইলো কোথায়? ফলে জিন্নাহকে খলনায়ক বানিয়ে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। জিন্নাহ যেখানে নেই, সেই ভারতেই দাঙ্গার ঘটনা ঘটছে বেশি। কারণটা কি হিন্দু-মুসলিম পরস্পরকে পছন্দ করে না ? না, তা একেবারেই না। সমস্যার শেকড় আরো গভীরে, সকল ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের সঙ্গে। ভারতের বৃহত্তর জনগণকে এর জন্য দায়ী করাটা অনৈতিহাসিক, বিরাট মিথ্যাচার।

গান্ধীর সময়কালে ব্রিটিশ শাসকদের প্রতিটি সেনানিবাসে বা শহরগুলিতে গোহত্যা চলতো। সে কারণে ব্রিটিশ প্রভাবিত শহরে এখনো গোহত্যা চালু আছে। বাকি প্রদেশগুলিতে নেই। গান্ধী এবং কংগ্রেসের কতিপয় নেতারা বিষয়টিকে স্পর্শকাতর করে তুলেছেন। ভারতের দাঙ্গার পিছনে আছে ভোটের রাজনীতি, কিন্তু অনেক সঙ্কটের কারণ হচ্ছে গোহত্যা নিষেধের এই ঘটনা, যাতে গান্ধী ইন্ধন যুগিয়ে গেছেন, যার দায় নিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। কংগ্রেসের এবং হিন্দুমহাসভার এমন আরো অনেক প্রচরণার ফলে ভারতবর্ষের তিনটি দেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সত্যিকারের একটা সম্প্রীতির ভাব গড়ে উঠতে পারছে না। ইংরেজদের মিথ্যা প্রচার কী করে এই সম্প্রীতিকে নষ্ট করেছে, যা ইতিপূর্বেই দেখা গেছে। বাকিটা ঘটেছে কংগ্রেস আর হিন্দুমহাসভার দ্বারা। ভারতবর্ষের সাধারণ জনগণ তার দায় নেবে কেন? কংগ্রেস আর হিন্দু মহাসভা এতটাই ইতিহাস বিকৃত করেছে যে, হিন্দু মহাসভার প্রখ্যাত নেতা যশোবন্ত সিংহ পর্যন্ত জীবনের শেষলগ্নে কলম ধরেছেন জিন্নাহর পক্ষে। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা প্রথম জিন্নাহ বলেননি। বলেছে হিন্দু মহাসভা। ভারতকে বিভক্ত করার কথা প্রথম বলেছেন, হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেস নেতা লালা লাজপত রায় উনিশশো চব্বিশ সালে ‘ইরাবতী থেকে ব্রহ্মপুত্র’ প্রবন্ধে। বহু উদাহরণ দেয়া যাবে এরকম। গান্ধী বারবার বলেছেন, ‘রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার কথা’; হিন্দু মহসভা বারবার বলেছে তখন ‘হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা’।

জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বের কারণে যে ভারত ভাগ হয়নি সেকথা যশোবন্ত সিংহ সহ আরো ভারতের বর্ণহিন্দু ইতিহাসবিদরা প্রমাণ করেছেন। বহু কংগ্রেস নেতাও পরোক্ষে তা স্বীকার করে নিয়েছেন। কংগ্রেসের বহু নেতার স্মৃতিকথা, বিভিন্ন দলিলপত্র প্রমাণ করে ভারত ভাগের দায় প্রধানত কংগ্রেসের। জিন্নাহ চল্লিশ সালের আগে পর্যন্ত সর্বদা চেয়েছেন হিন্দু-মুসলমানের মিলন। ভারতকে ভাগ না করার লক্ষ্যে ক্যাবিনেট মিশন যে প্রস্তাব দিয়েছিল, জিন্নাহ সামান্য দ্বিধা ছাড়াই তা মেনে নিয়েছিলেন। যদি ক্যাবিনেট মিশন মেনে নেয়া হতো, অবিভক্ত বাংলা আর আসাম মিলে হতো স্বাধীন বঙ্গ প্রদেশ। কিন্তু মেনে নেয়নি কংগ্রেস। কংগ্রেসের সভাপতি মওলানা আজাদ স্পষ্ট করে তা বলে গেছেন আর দলিলপত্র তাই প্রমাণ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও জিন্নাহর ভূমিকা আর ভারত ভাগ নিয়ে ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয়নি। যশোবন্ত সিংহদের মতো মানুষদের ইতিহাসের সত্য স্বীকার করে নেয়ার যে উদারতা, তা অনেকেই দেখাতে পারেননি। বিভ্রান্ত আমাদের নানা প্রগতিশীল মহল। ইতিহাসের প্রমাণিত দলিলের চেয়ে তাদের কাছে প্রাধান্য পায় তাদের পুরানো বিশ্বাস। ফলে সাম্প্রদায়িক বিভেদকে চাঙ্গা করে রাখার ক্ষেত্রে তাদের অবদান কম নয়।

কংগ্রেসে যখন গান্ধীর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা হলো, কংগ্রেস তার ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্রটি হারিয়ে ফেললো। জওহরলাল নেহরুসহ বহুজনের লেখায় তা পাওয়া যাবে। গীতার ভক্ত গান্ধী সনাতন উপনিষদকে মনে করেছেন রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শ হাতিয়ার। তিনি বাস্তব সত্যকে এড়িয়ে গিয়ে হিন্দুত্বকেই মনের গভীরে স্থান দিয়েছিলেন। রামায়ণের কল্পিত রাম ছিলেন তাঁর কাছে আদর্শ শাসক। তিনি বর্ণপ্রথাকে জোরালোভাবে সমর্থন করেছেন আর কংগ্রেসের জনসভায় সর্বদা “রামরাজত্ব” প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন নির্দ্বিধায়। মুসলমানদের কি তাহলে তাঁর রামরাজত্ব থেকে বিভাজন করে দেওয়া হলো না? রামরাজত্ব কি মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? জিন্নাহ এসবের বাইরে ছিলেন। জিন্নাহ চাইলেও কি আর তিনি গান্ধীর রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার দাবি মেনে কংগ্রেসে থাকতে পারতেন? মুসলিম লীগ মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বললেও, কখনো কুরান-সুন্নাহ দ্বারা ভারত পরিচালনা করবে এমন কথা বলেনি। হিন্দু মহাসভা বলেছে “হিন্দুরাষ্ট্র” ঘোষণার কথা আর গান্ধী বলেছেন “রামরাজত্ব” ঘোষণার কথা। গান্ধী যে ভয়াবহরকম গোড়া ধার্মিক ছিলেন সেটাই তার প্রমাণ। ধর্মীয়ভাবে কট্টর মানুষদের সঙ্কট হলো, সকল ভালোমানুষী সত্ত্বেও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা তাঁর সামগ্রিক পরিকল্পনায় থাকে না। চলবে