সাম্প্রদায়িক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং তার রাজনীতি

পর্ব ৯

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৯, ২০২০

রবীন্দ্রনাথের পরিবার হিন্দুত্বের মহিমা প্রচারে নানারকম ভূমিকা রেখেছিলেন সেটা একটা সত্য। কিন্তু সেটাই সম্পূর্ণ  বা একমাত্র  সত্য নয়। সকল সত্যের উল্টো পিঠ থাকে। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাংলার শিল্পকলার উন্নয়নে তাদের নানান অবদান রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সেখানে এক ব্যতিক্রমী সংযোজন, পুরো বাংলার ইতিহাসেই। রবীন্দ্রনাথকে যেন এখানে চট করে বিতর্কিত না করা হয়। তিনি জন্মেছেন মহাবিদ্রোহের পর, প্রথম জীবনটা পার করেছেন হিন্দুত্বের অহমের দ্বান্দ্বিক টানাপোড়েনে। ফলে কিশোর বয়সেই মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধকাব্যে’র কঠোর সমালোচনা করে বসেছিলেন। কারণ রাম তখন তাঁর কাছে দেবতাতুল্য, রাবণ হলো দানব। মধুসূদনের রচনাকে এক কথায় খারিজ করে দিয়েছিলেন তিনি সেই বয়সে। রামরাজত্বের স্বপ্নে তখন বিভোর বাংলার বাবুরা, পরিবার বা নিজ সম্প্রদায়ের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ উত্তরাধিকার সূত্রে তা মাথায় ঢুকিয়ে ফেলেন কম বয়সে। তিনিই আবার নতুন সত্য প্রকাশ করবেন, গুণগান গাইবেন মধুসূদনের। তিনিই আবার পরে বারবার শক্তহাতে মুসলমানদের অধিকারের পক্ষে কলম ধরবেন। হিন্দুত্বকে যে তিনি সম্পূর্ণ বাতিল করে দেবেন তাও নয়, তিনি আশ্রয় খুঁজবেন উপনিষদ আর ব্রাহ্ম সমাজের কাছে। গানের মধ্যে বারবার ফুটে উঠবে উপনিষদের বাণী। যিনি নিজ পরিবারে এত মৃত্যু দেখেছেন তিনি উপনিষদ ছাড়া আর কোথায় সান্ত্বনা পাবেন? ফলে গ্রহণ করবেন উপনিষদ, বাতিল করবেন পৌত্তলিকতা। সরাসরি বিদ্রোহ করবেন না কখনো ঠিকই, প্রয়োজনে বিসর্জন দেবেন ‘নাইট’ উপাধি। নিজের কলম দিয়ে লিখবেন বিসর্জন, রক্তকরবী, অচলায়তন, মুক্তধারা, নটিরপূজার মতো সব বিপ্লবী নাটক। লিখবেন ‘গোরা’, ‘ঘরেবাইরে’ উপন্যাস, মুসলমানদের পক্ষে কথা বলবেন সেখানে। লিখবেন নিজ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে ‘কালান্তর’ এর প্রবন্ধাবলী। নিজের ভিতরে যা বিশ্বাস করবেন না, কখনো তা লিখবেন না। কিন্তু তারপরেও কতিপয় মানুষের দৃষ্টিতে তিনি ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে পরিচিত হবেন, যাঁরা তাঁর সকল লেখা পাঠ করে দেখবেন না।

রবীন্দ্রনাথের দাদা ছিলেন ইংরেজদের ভক্ত, মহাপ্রয়াণ ঘটেছে ইংল্যান্ডে, তিনি দাদার পক্ষে কথা বলবার জন্য জীবনে কখনো কলম ধরেননি কেন? বিরাট প্রশ্ন সেটা। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন ভারতে ইংরেজ শাসনের নানা সুফল আছে, কিন্তু সবটাই যে সুফল তা মানতেন না। ইংরেজদের শাসনের বিরুদ্ধে, ইংরেজদের শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রচুর লিখেছেন। তিনি গান্ধীর সমালোচনা করে বলেছেন, অহিংস দিয়ে স্বাধীনতা আসবে না। মাতৃভাষা বাদ দিয়ে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদানকে বিরুদ্ধতা করে তাঁর মতো আর কেউ লেখেননি। তিনি আধুনিক সভ্যতার বহু কিছু পছন্দ করতে পারেননি, ভারতকে আবার সম্পূর্ণ পিছনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাননি গান্ধীর মতো। চরকা দিয়ে ভারতের অর্থনীতি পাল্টে ফেলতে হবে গান্ধীর সঙ্গে এসব বিষয়ে দ্বিমত করেছেন। রুশদেশের সমাজতন্ত্রের পক্ষে লিখেছেন, দরকার মতো সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। নিজের বিশ্বাসের পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন সবসময়, পরের মুখে ঝাল খাননি।

নিজে কখনো সমাজতন্ত্র চাননি, সমর্থন ছিল রাজতন্ত্রের পক্ষে,  কিন্তু প্লাটোর মতো দার্শনিক রাজা বা ‘জ্ঞানী রাজা’দের আকাঙক্ষা করেছেন তাঁর স্বপ্নরাজ্যে। ফলে তাঁর নাটকের সৃষ্ট সব রাজারা ভিন্ন চরিত্রে উপস্থিত, রাজর্ষি হয়ে দেখা দেয় তারা, কখনোই তারা শোষক নয়, আদর্শ মানুষ, জ্ঞানী পুরুষ। রক্তকরবীতে তারপরেও সমাজতন্ত্রের আদর্শই ঘোষিত হয়েছে নিজের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। রাজা সেখানে সকল মহত্ব নিয়েও ক্ষুদ্র আর ক্ষমতার জালে জড়ানো, শ্রমিকরা সেখানে প্রচণ্ড শোষণে সংখ্যায় পরিণত, মার্কস যা বলতে চেয়েছিলেন তাঁর বিয়োজন তত্ত্বে, রবীন্দ্র ঠিক তাই বলছেন শ্রমিকদের সম্পর্কে। রক্তকরবীতে পুরাতন সবকিছু চূর্ণ করেই তবে নতুন মুক্তির  তথা বলেছেন নাট্যকার।

রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনা করা দরকার হয় তাই খুব সতর্কতার সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ কেন, ভারতবর্ষের বর্ণহিন্দুদের নিয়ে, ভারতের ইতিহাসবিদদের নিয়ে আলোচনা করার সময় খুবই নৈর্ব্যক্তিক এবং সচেতন থাকা দরকার। ভারতবর্ষের চিন্তার জগতে বর্ণহিন্দুরা যেমন অচলায়তন সৃষ্টি করে গেছেন, সেটা ভেঙেছেন যাঁরা তাঁদের বড় একটা অংশই আবার বর্ণহিন্দু। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহটা করেছে একদিকে বর্ণহিন্দুরা, অন্যদিকে দলিতরা। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে মুসলমানদের বড় সঙ্কটটা হলো, ভারতের ইতিহাসকে ঠিকভাবে তাঁরা মূল্যায়ন করতে পারেননি। ইতিহাসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে বহু সময়ই তাঁদের চিন্তাভাবনাগুলি ছিল একপেশে। নিজেদের পশ্চাদপদতার হীনমন্যতা কাটিয়ে বুদ্ধির জগতে সঠিকভাবে আলো ফেলতে পেরেছেন খুব কম সংখ্যক মুসলমান চিন্তাবিদ। কিন্তু স্বাধীনতার আকাঙক্ষায় সামগ্রিকভাবে মুসলমানরা কি পিছিয়ে ছিল কখনো? ছিল না। পৃথিবীর কোনো দেশকে, কোনো অঞ্চলকে, কোনো সম্প্রদায়কে খণ্ডিতভাবে দেখাটাই ইতিহাস বিরুদ্ধ। বাংলাদেশের মানুষ বা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের লোকরা পর্যন্ত, নাটকে, গল্পে, কথাবার্তায়, কিছু কিছু জেলা বা অঞ্চলের মানুষকে খাটো করে দেখে, তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করে, রসিকতা করে; এটা অন্যায় আর অভ্যতা। কুশিক্ষা। মানুষের সব কিছুকে সহানুভূতির চোখ দিয়ে দেখতে না পারলে, কখনো মানুষের সঠিক মূল্যায়ন বা বিচার করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন, যখন দণ্ডদাতা নিজেই কাঁদে দণ্ডিতের সাথে, সেটাই সর্বশ্রেষ্ঠ বিচার।

ফলে সবকিছু বিচারে ইতিহাসবোধ, সমাজবিজ্ঞানের ধারণা নিয়ে মানুষের নানা সীমাবদ্ধতাকে মাথায় রাখতে হয়। সকল সত্যের বিপরীত সত্য থাকে। সকল সত্যই দ্বান্দ্বিক, একপেশে নয়। ঘটনার স্রোতের ভিতর দিয়ে মানুষে মানুষে ভিন্নতা ঘটে। গতকাল যে শিশুটি রাজার ঘরে জন্মেছে আর যে কৃষকের ঘরে জন্মেছে, দুজন একভাবে গড়ে উঠতে পারে না। দুটো শিশুর নিজের কিছুই করার নেই, ঘটনা তাদের জীবনকে ভিন্ন ভিন্ন খাতে বইয়ে নিয়ে যাবে। বিশ বছর পর মানুষ রাজার ছেলেকে দেখে হয়তোা বলবে, দেখো বীরপুত্র আর কৃষকের পুত্রকে গ্রাম্য বলে হেয় করবে। সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে আবার। রাজপুত্র ভিন্ন রাজার আক্রমণে সর্বস্ব হারিয়ে ভিক্ষুক হয়ে ঘুরে বেড়াবে, কৃষকের পুত্র নতুন রাজার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে অপরিচিত ভিক্ষুক রাজপুত্রকে অবজ্ঞা করবে। ঘটনা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে চট করে কি বলে দেয়া যায়? চলবে