সাম্প্রদায়িক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং তার রাজনীতি

পর্ব ৮

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৮, ২০২০

বাংলার বাবুরা নিজেদের অজ্ঞতা নিয়ে খুশি ছিলেন। তাদের জানা ছিল না, মহাবিদ্রোহ সামন্ত সমাজকে ভেঙে ফেলবে সাম্রাজ্যবাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। মার্কস যা বলেছিলেন, সাম্রাজ্য্যবাদের জোয়াল থেকে মুক্ত হতে না পারলে আসলে ভারতের মুক্তি নেই। মহাবিদ্রোহ ছিল সেই মুক্তির প্রথম ধাপ। দিল্লির বিদ্রোহীরা স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছিল, সামন্ত যুগে তারা ফিরে যেতে চায় না। সম্রাট বাহাদুর শাহ বিদ্রোহের প্রধান নেতা হলেও দিল্লির মূল ক্ষমতা বাহাদুর শাহর হাতে ছিল না। বিভিন্ন সেনাধ্যক্ষদের নিয়ে সিপাহী আদালত গঠন করা হয়েছিল। চুরাশি বছরের বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ নিজে সে আদালতকে সমর্থন দিয়েছিলেন। নিজের পুত্র মির্জা মুঘলকে ব্যর্থতার জন্য প্রধান সেনাপতির পদ থেকে সরিয়ে বখত খাঁকে সেনাপ্রধান করা হয়েছিল বাহাদুর শাহর নিজের ইচ্ছায়। কিন্তু দুর্গের ভিতরে ছিল নানা বিশ্বাসঘাতকরা, যাঁর একটা অংশ ছিল দীর্ঘদিন ধরে মুঘল বাদশাদের প্রতিপালিত কর্মচারীরা। বিশ্বাসঘাতক ছিলেন দুর্গের বাইরেও। সিরাজদৌলা যেরকম বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলেন, তেমনটা এখানেও ঘটে। বড় বড় বণিক আর জমিদাররা ছিলেন বিদ্রোহের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাহাদুর শাহ সর্বশক্তি দিয়ে বিদ্রোহের জয় চেয়েছিলেন। তিনি সম্রাট হতে চাননি, চেয়েছিলেন হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা। বাহাদুর শাহ তখন পর্যন্ত অন্যান্য মুঘল শাসকদের মতো ভারতকে ‘হিন্দুস্তান’ বলেই জানতেন। তিনি ভারতকে তখনো হিন্দুস্তানই বলতেন।

বাহাদুর শাহ এ বিদ্রোহের প্রধান একটি চরিত্র। চুরাশি বছরের বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ সিদ্ধান্ত নিতে ভুল যে করেননি তা নয়। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে হারাবার জন্য তিনি ছিলেন আন্তরিক। এমনকি স্বাধীন ভারতে তিনি তাঁর ক্ষমতা দেশীয় রাজন্যদের হাতে তুলে দেবার জন্য ছিলেন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। বাহাদুর শাহর একটি চিঠির বক্তব্য এখানে উল্লেখযোগ্য। সেপ্টেম্বর মাসে রাজন্যবর্গের কাছে প্রেরিত এ চিঠিতে লেখা ছিল, ‘যে কোন উপায়ে হোক ইংরেজদের হিন্দুস্থান থেকে বিতাড়িত করাই আমার একান্ত ইচ্ছে। সমগ্র হিন্দুস্থান স্বাধীন হোক এ আমার আন্তরিক বাসনা। এ উদ্দেশ্যে যে বৈপ্লবিক যুদ্ধ আজ চলছে, তা কখনোই সাফল্য লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না একজন সুযোগ্য লোক এ বিদ্রোহকে পরিচালনা করার জন্য এগিয়ে আসছেন, যিনি এ আন্দোলনের গুরুত্ব বুঝতে সক্ষম, যিনি জাতির প্রত্যেকটি শক্তিকে, দেশের প্রতিটি ব্যক্তিকে নিজের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম। ইংরেজদের বিতাড়িত করার পর ভারতবর্ষ শাসন করার কিংবা আমার ব্যক্তিগত ক্ষমতা বিস্তার করার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। আপনারা দেশের রাজন্যবর্গ যদি শত্রুকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবার জন্য যুদ্ধে নামতে প্রস্তুত হন, তাহলে আমি আমার সার্বভৌম ক্ষমতা সংঘবদ্ধ রাজন্যবর্গের হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত আছি।’ কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর, এত আগ্রহ সত্ত্বেও ভারতের স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে পারলেন না। হিন্দুস্তানের তাঁর কবরটা পর্যন্ত হলো না।

বাহাদুর শাহ জাফরের চিঠিটি কি প্রমাণ করে পুরানো দিনে ফিরে যেতে চেয়েছিল বিদ্রোহীরা? ব্রাহ্মণ, রাজপুত, অভিজাত, রাজন্যবর্গ, সিপাহী, কৃষকরা যুক্ত ছিলেন এ বিদ্রোহে। সারা ভারতে কখনো আর ইংরেজদের বিরুদ্ধে এত বড় স্বতঃষ্ফূর্ত আন্দোলন গড়েনি ওঠেনি, কংগ্রেসের যুগেও নয়। কিন্তু বাংলার বর্ণহিন্দু জমিদার আর সকল সুবিধাভোগীরা নিজেদেশের জনগণের বিদ্রোহের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। কবি ঈশ্বর গুপ্ত পর্যন্ত মহাবিদ্রোহের বিরুদ্ধে এবং ইংরেজ শাসকদের পক্ষে কলম ধরেছেন। তিনি কানপুরের নানাসাহেব, ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈকে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক অশ্লীল কবিতা লিখেছেন। ব্যাঙ্গাত্বক লেখা লিখছেন অক্ষয়কুমার দত্ত। বিদ্যাসাগরের ভূমিকা প্রশ্নবোধক, তিনি বিদ্রোহকে সমর্থন দেননি। কিন্তু তার বিরুদ্ধে তিনি আবার কলম ধরেননি। দিল্লিতে যেদিন বিদ্রোহীরা হেরে যায় কলকাতায় সেদিন বাঙালী বাবুরা বিরাট ভোজের আয়োজন করেছিলেন, বিদ্যাসাগর সেখানে যাননি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত লড়াইয়ের কালে বাবুরা তার বাইরে দাঁড়িয়ে বিষোদগার করেছেন। বিরাট ব্যতিক্রম সেখানে পেট্রিয়ট পত্রিকার হরিশচন্দ্র। তিনি বিদ্রোহের বিরুদ্ধে ছিলেন না কিন্তু মাঝে মধ্যে শক্তভাবে বিদ্রোহের পক্ষে কলম ধরেছিলেন। অন্যান্য পত্রিকার মতো সম্পূর্ণ নির্লজ্জ আচরণ করেননি। সুকুমার মিত্র লিখেছেন, দুর্গদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণদাস পাল, কিশোরী চাঁদ, উপেন্দ্র চন্দ্র মিত্র ভারতীয় মহাবিদ্রোহের সময় শাসকদের প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রমাণের জন্য যে অশোভনীয় আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, হরিশচন্দ্র কখনো তা দেখাননি। কালীপ্রসন্ন সিংহ আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাকিদের মতো নির্লজ্জ হতে পারেননি। বাঙালী অভিজাতরা রাজানুগত্য দেখাবার জন্য যেভাবে বাড়াবাড়ি করছিল কালীপ্রসন্ন তাতে সম্পূর্ণ সায় দিতে পারেননি। তিনি বিদ্রোহের ন্যায্যতার প্রশ্নটিকে এড়িয়ে গিয়ে ইংরেজ শাসকদের প্রতিশোধমূলক আচরণের নিন্দা করেছিলেন।  

রবীন্দ্র গুপ্ত লিখেছেন, বাংলার বুদ্ধিজীবীরা যারা এই সময়ে এই বিদ্রোহে যোগদান করেননি, বরং ব্রিটিশের সহায়তা করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন বিপ্লবের শত্রু, ইংরেজের পঞ্চম বাহিনী। বহু ভদ্রলোকরা নিজেদের দায় অস্বীকার করে পরে বলতে চেয়েছেন, সামন্তপ্রভুদের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ সফলতা লাভ করলে দেশ নাকি রসাতলে যেতো। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো ইতিহাসবিদরা পরবর্তীতে একই সুরে কথা বলেছেন। রমেশচন্দ্র বিদ্রোহের সমালোচনা করেছেন কঠোরভাবে। প্রমথনাথ বিশীর মতো বড়মাপের একজন উপন্যাসিক ‘লালকেল্লা’ লিখেছেন বিদ্রোহকে সমালোচনা আর নিন্দা করার জন্য। কিন্তু বহু ইংরেজ বিদ্রোহের পক্ষে কলম ধরেছেন, বিদ্রোহীদের সাহসিকতা প্রশংসা করেছেন, যাদের মধ্যে আছেন আলেকজান্ডার ডাফ, মেটকাফ, কে প্রমুখ। রমেশচন্দ্র মজুমদারের সেখানে নির্লজ্জ হতে বাধেনি। বিদ্রোহের পর নরহরি কবিরাজ মহাবিদ্রোহে বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের কথা লিখতে গিয়ে লিখেছিলেন, কলকাতা এবং কলকাতার উপকণ্ঠে অবস্থানকারী প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবীরা নীরব দর্শক মাত্র ছিলেন। নীরব দর্শক বলতে তিনি বুঝিয়েছেন বিদ্রোহের পক্ষে উচ্চবাচ্য করেননি বা বিদ্রোহের পক্ষে ছিলেন না। নরহরি কবিরাজ স্পষ্ট ব্যাখ্যা করেছেন, নতুন যে বুদ্ধিজীবীদের জন্ম হয়েছিল এঁরা ছিলেন সমাজের মুষ্টিমেয় অংশ। কিন্তু সামন্ত প্রভুদের নেতৃত্ব থাকা সত্ত্বেও বিদ্রোহের প্রাণ শক্তি ছিল ভারতের জনসাধারণ। জনগণের এই বিদ্রোহে সিপাহীরা ছিল পুরাভাগে, কৃষকেরা ছিল এই বিদ্রোহের প্রধান শক্তি। মহাবিদ্রোহ নিয়ে পরবর্তীতে ভদ্রলোকদের মধ্যে দুটা দল সৃষ্টি হয়েছিল। বিদ্রোহের পক্ষে কলম ধরলেন রজনী গুপ্ত, প্রমোদ দাশগুপ্ত, সুশোভন সরকার প্রমুখ অনেকে। ফলে এ রকম ভাবার কারণ নেই, সব হিন্দুরা একদলে আর সব মুসলমানরা আর একদলে। হিন্দুরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, মুসলমানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। মূল দ্বন্দ্বটা হচ্ছে স্বার্থের, সঠিকভাবে বললে শ্রেণীস্বার্থের। সাম্প্রদায়িক প্রশ্নটা এখানে কখনোই প্রধান নয়।

মহাবিদ্রোহে যখন উত্তর ভারতের বিরাট সংখ্যক হিন্দু মুসলমানরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নেমেছিল, ভিন্ন দিকে উত্তর ভারতের বিরাট সংখ্যক হিন্দু মুসলমান জমিদার ইংরেজদের পক্ষে রয়ে গেলেন। ফলে ভারত কি সাম্প্রদায়িক দেশ ছিল তখন? সাম্প্রদায়িক কোনো হানাহানি ছিল তখন পর্যন্ত? কিন্তু কিছুদিন পর কি ঘটলো? ভারত সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে গেল মহাবিদ্রোহের পর। বিদ্রোহী হিন্দু-মুসলমানদের উপর ভয়াহয় অত্যাচার আর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দমন করা হলো পূর্ব ভারতের মহাবিদ্রোহকে। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় সকলে তাঁরা প্রাণ দিয়েছেন কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করেননি কেউ বিদ্রোহের সঙ্গে। নিম্নবর্গের মানুষরা তখনো ভদ্রলোকদের মতো বিশ্বাসঘাতকতা বা বেঈমানী করতে শেখেননি নিজ জনগণের সঙ্গে। না জানতেন তাঁরা সাম্প্রদায়িকতা কী জিনিস। সামন্ত যুগের মুসলিম শাসকরাও সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে তুর্কী মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষকতায়। কিন্তু ইংরেজ শাসনে বাবুরা বা ভদ্রলোকরা প্রথম সাম্প্রদায়িক আচরণ করলেন। ভারতের রাজনীতিকে ঘোরালো করে তুললেন। হিন্দুরা ছিল বহুকাল একটি জনগোষ্ঠী, কিন্তু বাবুরা নিজেদের বৈদিক ধর্মকে বানালেন হিন্দুধর্ম। বহু শতকের প্রাচীন বৈদিকধর্ম হয়ে গেল রাতারাতি হিন্দু ধর্ম, ইংরেজদের উৎসাহে। রবীন্দ্রনাথের পরিবার সহ অন্যান্য বাবুরা হঠাৎ জাতীয়তাবাদী চেতনায় চালু করলেন ‘হিন্দুমেলা’। বাংলার জাতীয়তাবাদ হলো হিন্দু জাতীয়তাবাদ, ভারতীয় মুসলমানরা বাদ পড়লেন সেই জাতীয়তাবাদ থেকে, যাঁরা একশো বছর ধরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, ১৮৫৭ সালে সবচেয়ে বেশি প্রাণ দিয়েছিলেন।

মাত্র কয়েকদশক আগে হিন্দু-মুসলমানরা এক লক্ষ্যে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করলো আর ভদ্রলোকরা হিন্দুদের আলাদা করে ফেললেন মুসলমানদের থেকে। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ঘটেছিল প্রথমত ধর্মকে আশ্রয় করে কিন্তু ধর্মের সংকীর্ণতা নিয়ে নয়। হিন্দু মুসলমানরা নিজনিজ ধর্মের স্বার্থ রক্ষা করেছে সম্প্রদায় বা সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বাইরে দাঁড়িয়ে। নিজনিজ ধর্মের মর্যাদা রক্ষার জন্য দুপক্ষ এক হয়ে হয়েছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে। যখন বিদ্রোহ চলছে তখন বকরীর ঈদ এলো। ইংরেজরা আর তার দালালরা পরিকল্পনা করলো, বকরীর ঈদের গরু জবাইকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমানরে মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে দেবে। সম্রাট বাহাদুর শাহর কাছে সে খবর পৌঁছে গেল। তিনি সকলকে ডেকে জনসমক্ষে নির্দেশ দিলেন কেউ যেন এবারের ঈদে গরু জবাই না করে। সম্রাট বললেন আমি নিজে একটি ছাগল কুরবানী দেবো। তিনি বললেন, মুসলমানরা যদি আমার ডান চোখ হয় হিন্দুরা আমার বা চোখে। দুটোই আমার চোখ। সামন্ত একজন শাসক বুঝতেন কী করে মানুষে মানুষে সৌহার্দ রক্ষা করতে হয়। বাবর তাঁর ইচ্ছাপত্রে লিখেছিলেন হুমায়নের উদ্দেশ্যে, ভারতে যদি তুমি গরু জবাই না করো মানুষের সম্মান পাবে। মুঘল সম্রাটদের এরকম জেদ ছিল না যে, ধর্মীয় অনুশাসন পালনের জন্য অন্যেদের মনে আঘাত দিতে হবে। মহাবিদ্রোহের সময় খান বাহাদুর খান পর্যন্ত শাসকরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে চাইছে শুনে, সম্পূর্ণরূপে তার রাজ্যে গরু জবাই নিষেধ করে দিলেন। সামন্ত যুগের মুসলিম শাসকরা ছিলেন এসব ব্যাপারে সহনশীল। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষিত বাবুদের সে সহনশীলতা ছিল না। মূলত অন্য কারণে নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতা আর আর্থিক স্বার্থে তাঁরা অন্ধ হয়েছিলেন। ইংরেজদের কাছ থেকে পাওয়া হিন্দুত্বে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা তখন তাঁদের অন্ধ করে রেখেছিল।

ফলে বাংলা তথা ভারতের বিরাট সংখ্যক মানুষকে নাই করে দিয়ে জাতীয়তাবাদের পতাকা উড়ালেন বাবুরা হিন্দুত্বের নামে। কিন্তু তার মানে মোটেই এ নয় যে, সকল হিন্দুরাই এর পেছনে ছিলেন। সাধারণ হিন্দুরা কখনো তার পেছনে দাঁড়াননি। কতিপয় সুবিধাভোগী ভদ্রলোকদের জাতীয়তাবাদ ছিল সেটা। কতিপয় বর্ণহিন্দুদের এই হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণার ভিতর দিয়েই ভারতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নষ্ট হবার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র আর বিবেকানন্দ সত্যিকারভাবে সাম্প্রদায়িক না হলেও হিন্দু জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির মূলে কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের পরিবারের ভূমিকা কম ছিল না প্রথমদিকে। ১৮৬৭ সালে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্যারীমোহন সরকার, রথীন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রমুখের সহযোগিতায় ‘হিন্দুমেলা’ আয়োজনের মধ্য দিয়ে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের পরিমণ্ডল বিস্তৃত করা হয় কিন্তু মুসলমানরা সেখানে জায়গা পেল না। না পবারই কথা কারণ নামই ছিলো “হিন্দুমেলা”। বাংলার মুসলমানদের অস্তিত্বের প্রতি স্বীকৃতি সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়ে শুরু করা হয়েছিল ‘হিন্দুমেলা’ উদযাপন। কিন্তু হিন্দু ভদ্রলোকদের মধ্য থেকেই কয়েকজন আপত্তি তোলেন হিন্দুমেলা নিয়ে। পত্রিকায় লিখে তাঁরা সমালোচনা করে নামটা পাল্টাতে বলেন। হিন্দুমেলা নাম বাদ দিয়ে তখন হয়ে গেল তা ‘চৈত্র সংক্রান্তি’। সমাজের সবটাই যে নেতি তা নয়, পুরো সমাজ হচ্ছে ইতি আর নেতির যোগফল। কিন্তু “চৈত্র সংক্রান্তি” নামকরণ করেও শেষরক্ষা হলো না।

ইংরেজদের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ বাধিয়ে তোলার খেলা বন্ধ হলো না। ইংরেজরা তা আরো বাড়িয়ে তোলার জন্যই ঘোষণা করলো বঙ্গভঙ্গ। বহুদিন ইংরেজরা হিন্দুদের তোষণ করেছে, নিজের স্বার্থেই মুসলমানদের তোষণ শুরু করলো এবার। মুসলমানদের বুঝাতে শুরু করলো, তোমরা অনেক পিছিয়ে আছো হিন্দুদের থেকে, এবার নিজেদের উন্নতি ঘটাও। বঙ্গভঙ্গ হলে তোমাদের লাভ, পূর্ব বাংলার মুসলমানরা আলাদা রাজধানী পাবে, মুসলমানরা চাকরি বাকরি পাবে। প্রথমে ইংরেজরা বাংলার শিক্ষিত এবং সাধারণ মুসলমানদের টোপটা গেলাতে পারলো না। কিন্তু হিন্দু ভদ্রলোকদের জীবনে সংকট তৈরি হয়ে গেল। বাংলার প্রায় সকল জমিদারই হিন্দু। বাংলা ভাগ হলে মুসলমানের ভাগ্য পাল্টাতে পারে, কিন্তু তাঁদের কী হবে? যাঁরা জমিদার নন, হিন্দুদের সেই স্বচ্ছল একটা গোষ্ঠী হচ্ছেন আইনজীবী। পূর্ব বাংলার কৃষকরা তাঁদের মক্কেল। বাংলা ভাগ হলে তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটবে! ফলে বঙ্গভঙ্গ মেনে নেয়া যেতে পারে না। যাঁরা এতদিন ছিলেন ইংরেজদের বন্ধু আর দালাল, হঠাৎ তাঁরা হয়ে গেলেন জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক। কারণ বাংলা ভাগ মানে তাঁদের সুযোগসুবিধা হারানো। যাঁরা মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে ছিলেন ইংরেজ শাসনের পক্ষে, যাঁদের কাছে ইংরেজ শাসন ছিল আশীর্বাদ, সেই গোষ্ঠীর মানুষরা হঠাৎ এবার ইংরেজকে বিতারিত করতে চান। কিন্তু বিতারণ করতে চান হিন্দুত্বের নামে। ভদ্রলোকদের জাতীয়তাবাদ আরম্ভ হলো হিন্দু জাতীয়তাবাদের মধ্য দিয়ে। ভারতবর্ষের মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় কুফল বয়ে আনলো এই ঘটনা। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে, হিন্দুদের বিরাট অংশই এই জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ছিলেন না। কারণ পুরোপুরিভাবে এ জাতীয়তাবাদের আরম্ভ হয়েছিল সুবিধাভোগীদের স্বার্থে। বাংলার জমিদাররা ছিল এই জাতীয়তাবাদের উদগাতা, স্বভাববতই এই জাতীয়তাবাদকে জমিদারদের দ্বারা শোষিত হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের সমর্থন করার কোনো কারণ নেই। রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু লেখা লি‌খে‌ছেন তখন মুসলমান‌দের স্ব‌দেশী অা‌ন্দোল‌নে যোগ না দেবার সমর্থ‌নে। ব‌লে‌ছি‌লেন, সব সময় মুসলমান‌দের দূ‌রে স‌রি‌য়ে রে‌খে, মুসলমা‌নের স্পর্শ বাঁচি‌য়ে চ‌লে, হঠাৎ স্বা‌র্থের সময় ভাই ডাক‌লেই হ‌বে! সে ভাই ডাকাটা যে স্বা‌র্থের, অন্ত‌রের নয়, সেটা অ‌শি‌ক্ষিত কৃষকরা ঠিক বুঝ‌তে পা‌রে।

কৃষকদের সমর্থন না পেয়ে এ জাতীয়তাবাদ হয়ে পড়লো জনবিচ্ছিন্ন, ফলে সন্ত্রাসবাদের পথে তা পা বাড়ালো। ইংরেজদের বিরুদ্ধে এ জাতীয়তাবাদী আন্দালনে ত্যাগ-তিতিক্ষা যতোই থাক, এ জাতীয়তাবাদ ছিল জনবিচ্ছিন্ন তো বটেই আর সেইসঙ্গে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। যখন বিরাট সংখ্যক মানুষকে সঙ্গে না পাওয়া যায়, তখনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সন্ত্রাসের পথে পা বাড়ায়। বিভিন্ন গুপ্তদলের সৃষ্টি হয়। বঙ্গভঙ্গের ঘটনায় বাংলায় ইংরেজ শাসনকে উৎখাতের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন যাঁরা সকলে তাঁরা নমস্য কিন্তু ভয়াবহ ক্ষতি করে গেছেন তাঁরা। বাংলার মানুষকে তারা হিন্দু-মুসলমান দুভাগে বিভক্ত করে রেখে গেছেন। বাংলার নতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল হিন্দুধর্মকে ঘিরে, হিন্দুত্বের নামে বঙ্কিমের “আনন্দমঠ” উপন্যাসের দ্বারা সকলেই এঁরা প্রভাবিত। বঙ্কিম কায়মনবাক্যে বহু বছর আগে একটি হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর “আনন্দমঠ” উপন্যাসে। বঙ্গভঙ্গকে ঘিরে তা দানা বাঁধতে থাকে। ইতিহাসের এই দ্বান্দ্বিকতা, ইংরেজকে তাড়াবার জন্য যাঁরা প্রাণ দিতে এগিয়ে গেলেন, ধর্মের কুসংস্কার আর গোঁড়ামির মধ্যে তাঁরা বাঁধা পড়লেন। তাঁদের বিপ্লবী ইতিহাসে তাঁরা বিরাট সংখ্যক মুসলমানকে বাতিল করে রাখলেন। মনে করলেন, হিন্দুত্বের জাগরণ মানেই মুক্তি। সকল মানুষকে বাদ দিয়ে যে জাতীয় মুক্তি সম্ভব নয়, সেটা ১৮৫৭ সালের সাধারণ মানুষরা বুঝতে পারলেও, বঙ্গভঙ্গ রদ করার সঙ্গে যুক্ত ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীরা বুঝতে পারলেন না।

বঙ্কিমের মতো চিন্তাবিদ লিখেছেন যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসন পূর্ব নির্ধারিত। কেননা সে শাসনের মধ্য দিয়েই হিন্দুত্বের আদি শক্তি পুনরুজ্জীবিত হবে। তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘আমি হিন্দু, তুমি হিন্দু। রাম হিন্দু, যদু হিন্দু, আরো লক্ষ লক্ষ হিন্দু আছে। এই লক্ষ লক্ষ হিন্দু মাত্রেরই যাতে মঙ্গল হয়, তাতেই আমার মঙ্গল।’ তিনি মুসলমানদের কোনো বিবেচনার মধ্যেই রাখেননি। শিক্ষিত হিন্দুরা সমাজে তখন এগিয়ে থাকা শক্তি। বঙ্কিম তাঁদের মঙ্গল নিয়ে ভাবছেন কিন্তু পশ্চাদপদ মুসলমানদের প্রতি তাঁর সামান্যতম সহানুভূতি নেই। তিনি তাঁদেরকে মনে করছেন শত্রু পক্ষ। ইংরেজ রাজত্বে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই না করে মুসলমানদের সবংশে নিপাত করতে চেয়েছেন। তাঁর রচিত ‘আনন্দমঠ’-এর ইতিবাচক চরিত্র সত্যানন্দ স্পষ্ট বলছেন, ‘রাজ্য চাহি না, কেবল মুসলমানেরা ভগবানের বিদ্বেষী বলে তাঁদের সবংশে নিপাত করতে চাই।’ বঙ্কিম সত্যিকারভাবে মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন না। কিন্তু হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে হিন্দুত্বের জয়গান গাইতে গিয়ে ভয়ানক ক্ষতিই করে ফেললেন, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে বিষিয়ে তুললেন। বাংলার ইতিহাস লিখতে গিয়ে সেই বঙ্কিমই আবার মুসলমানদের পক্ষে কলম ধরলেন। ইতিহাসের এ এক অদ্ভুত স্ববিরোধিতা!

বাংলার ইতিহাস লিখতে গিয়ে ইংরেজরা যে মুসলমানদের উপর মিথ্যা দায় চাপিয়ে ইতিহাস বিকৃত করেছে, বঙ্কিমচন্দ্র উচ্চ কণ্ঠে নিজের লেখা ইতিহাসে সেকথা স্বীকার করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস আছে কি? সাহেবেরা বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে ভুরি ভুরি গ্রন্থ লিখিয়াছেন। ..আমাদিগের বিবেচনায় একখানি ইংরেজি গ্রন্থেও বাঙ্গালার প্রকৃত ইতিহাস নাই। সে সকলে যদি কিছু থাকে, তবে সে সকল মুসলমান বাঙ্গালার বাদশাহ, বাঙ্গালার সুবাদার ইত্যাদি নিরর্থক উপাধিধারণ করিয়া, নিরুদ্বেগে শয্যায় শয়ন করিয়া থাকিত, তাহাদিগের জন্ম মৃত্যু গৃহবিবাদ এবং খিচুড়িভোজন মাত্র। ইহা বাঙ্গালার ইতিহাস নয়, ইহা বাঙ্গালার ইতিহাসের এক অংশও নয়। বাঙ্গালার ইতিহাসের সঙ্গে ইহার সম্বন্ধও নাই। বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস ইহাতে কিছুই নাই। যে বাঙ্গালী এ সকলকে বাঙ্গালার ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করে, সে বাঙ্গালী নয়। আত্মজাতি-গৌরবান্ধ, মিথ্যাবাদী, হিন্দুদ্বেষী মুসলমানের কথা যে বিচার না করিয়া ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করে, সে বাঙ্গালী নয়।’ তিনি দেখাচ্ছেন, মুসলমানদের দ্বারা হিন্দু নিধনের কথা সঠিক নয়। তিনি লিখেছেন, ‘মুসলমানেরা দেশের রাজা ছিল, কিন্তু জমিদারি সকল তাহাদিগের করগত না হইয়া হিন্দুদিগের করগত হইল কি প্রকারে?’

তিনি লিখেছেন, ‘সত্য বটে, বাঙ্গালী মুসলমান কর্তৃক পরাজিত হইয়াছিল। কিন্তু পৃথিবীতে কোন্ জাতি পরজাতি কর্তৃক পরাজিত হয় নাই? ইংরেজ নর্মানের অধীন হইয়াছিল, জর্মানি প্রথম নেপোলিয়নের অধীন হইয়াছিল। ইতিহাসে দেখি, ষোড়শ শতাব্দীর স্পেনীয়দিগের মত তেজস্বী জাতি, রোমকদিগের পর আর কেহ জন্মগ্রহণ করে নাই। যখন সেই স্পেনীয়েরা আট শত বৎসর মুসলমানের অধীন ছিল, তখন বাঙ্গালী পাঁচ শত বৎসর মুসলমানের অধীন ছিল বলিয়া, সে জাতিকে চিরকাল অসার বলা যাইতে পারে না।’ ‘পরাধীন রাজ্যের যে দুর্দশা ঘটে, স্বাধীন পাঠানদিগের রাজ্যে বাঙ্গালার সে দুর্দশা ঘটে নাই। রাজা ভিন্নজাতীয় হইলেই রাজ্যকে পরাধীন বলিতে পারা যায় না। সেসময়ের জমিদারদিগের যেরূপ বর্ণনা দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতে তাহাদিগকেই রাজা বলিয়া বোধ হয়; তাহারা করদ ছিলেন মাত্র। পরাধীনতার একটি প্রধান ফল ইতিহাসে এই শুনা যায় যে, পরাধীন জাতির মানসিক স্ফূর্তি নিবিয়া যায়। পাঠানশাসনকালে বাঙ্গালীর মানসিক দীপ্তি অধিকতর উজ্জ্বল হইয়াছিল। বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস বাঙ্গালার শ্রেষ্ঠ কবিদ্বয় এই সময়েই আবির্ভূত;...এই দুই শতাব্দীতে বাঙ্গালীর মানসিক জ্যোতিতে বাঙ্গালার যেরূপ মুখোজ্জ্বল হইয়াছিল, সেরূপ তৎপূর্বে বা তৎপর আর কখনও হয় নাই।’ ‘বাস্তবিক তখন এ দেশে স্থাপত্যবিদ্যার আশ্চর্যরূপ উন্নতি হইয়াছিল এবং গৌড়ে যেখানে সেখানে মৃত্তিকা খনন করিলে যেরূপ ইষ্টক দৃষ্ট হয়, তাহাতে অনুুমান হয় যে, নগরবাসী বহুসংখ্যক ব্যক্তি ইষ্টকনির্মিত গৃহে বাস করিত। দেশে অনেক ভূম্যধিকারী ছিলেন এবং তাহাদিগের বিস্তর ক্ষমতা ছিল।’ বাংলার ইতিহাস লিখতে গিয়ে বঙ্কিম পুরোপুরি নিরপেক্ষ থাকছেন, কিন্তু তাঁর উপন্যাসে রয়েছে মুসলিম বিদ্বেষ। ফলে এক কথায় কি সমগ্র মানুষটাকে বিচার করা যায়? মহাভারতের সেই উক্তি আবার সত্যি প্রমাণিত হয়, পৃথিবীতে কোনো মানুষই সম্পূর্ণ ভালো বা সম্পূর্ণ মন্দ নয়।

বঙ্কিমের লেখা বাঙ্গালার ইতিহাসে দেখা যায়, মুসলমানদের শাসনে বাঙ্গালার যতো উন্নতি, যতোটা দীপ্তি দেখা গিয়েছিল, তা আর তার আগে পরে দেখা যায়নি। কিন্তু ফলাফল এই যে, শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত বর্ণহিন্দুদের জাতীয়তাবাদী সেই আন্দোলনে মুসলমানদেরই স্থান নেই। ফলে সেটাকে জাতীয়তাবাদ বলা যাবে না, স্বভাবতই এ আন্দোলন হিন্দু জাতীয়তাবাদ হিসাবে চিহ্নিত। মুসলমানরা বহুদিন পর্যন্ত শাসক হিসেবে ইংরেজদের ঘৃণা করতো, কিন্তু এসব ঘটনায় ইংরেজদের প্রতি তাদের অনেকের মন নরম হলো। যখন শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত হিন্দুরা তাদেরকে ছুড়ে ফেলেছে, তখন মুসলমানদের আর কী করবার ছিল? খুব শীঘ্রই মুসলমানদের কতিপয়ের মধ্যেও সেই হিন্দু-ঘৃণা জাগ্রত হলো। ফলে সাম্প্রদায়িক শব্দটা বাদ দিয়ে আর কিছুই আলোচনা করা যায় না ভারতীয় নানা ঘটনাকে বিচার বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে বা ইতিহাস রচনায়।

ভারতের দুর্ভাগ্য, হঠাৎ সাম্প্রদায়িক ঘটনা চলে এলো ইতিহাসে নতুন আলোকপ্রাপ্ত যুগে। দেখা গেছে ইংরেজদের আগমনের আগে ভারতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বলে কিছু ছিল না। হিন্দু জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের নানা মিথ্যা প্রচারের বিপরীতে হরবনস মুখিয়া জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের সংজ্ঞা নিরূপনের চেষ্টা করেছেন। তিনি তাঁদের চিন্তার বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে বলেছেন, তিনি মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাসকে এক অবিচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের চিত্র বলে মনে করেন না। মনে করেন তা ছিল এক গৌরবময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যুগ। জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা মুসলমান সুলতান বাদশাদের সব কার্যাবলীর পেছনে ধর্মীয় মনোভাব কাজ করেছে, এই তত্ত্ব সম্পর্কে তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন। মুঘল-তুর্কী বা মুসলমানদের শাসনে তাঁরা মনে করেন বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট দেওয়া নেওয়া ঘটেছিল। যার ফলে সৃষ্টি হয়েছিল এক মিশ্র সংস্কৃতির। ‘ভারতীয় সংস্কৃতির ধারা’ প্রবন্ধে অন্নদাশংকর রায় যে কথাগুলি লিখেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি লিখেছেন, আমাদের বদ্ধমূল সংস্কার ভারতবর্ষ আর্যদের দেশ। আর্যরাই ভারতবর্ষের আদি অধিবাসী বা প্রকৃত অদিবাসী, তারা আর কোনো দেশ থেকে আসিনি। তারা কোনোদিনই বহিরাগত ছিল না। ভারতীয় সভ্যতার উন্মষ হয়েছে তাদের সঙ্গেই, তাদের পূর্বে নয়। ভারতীয় সংস্কৃতির মূল হচ্ছে বেদ, বেদে সবকিছু আছে। বেদজ্ঞ যাঁরা তারা সর্বজ্ঞ। বেদ যে ভাষায় রচিত সে ভাষা হচ্ছে দেবভাষা।’ তিনি কিছু পরেই লিখছেন, ‘উপরে যে সংস্কারের কথা বলা হল তার বিরুদ্ধে গত দুশো বছরে অসংখ্য প্রমাণ জমেছে। ভারতবর্ষ প্রধানত অনার্যদের দেশ, অনার্যরাই তার আদি অধিবাসী। তাদের কেউ বা অস্ট্রিক, কেউ বা মঙ্গোল, কেউ বা দ্রাবিড়। আর্যরা বাইরে থেকে এসেছে।’ তিনি বলছেন, ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখার সময় এসেছে। এদেশ আর্যদের অধিকারে আসার আগে যাদের অধিকারে ছিল তারাও বহু পরিমাণে সভ্য ছিল। তারা যে কী পরিমাণ উৎকর্ষ লাভ করেছিল তার প্রমাণ মোহেনঞ্জোদারো ও হরপ্পার নাগরিক সভ্যতা। তিনি লিখেছেন, পরবর্তীকালে যাকে হিন্দু বলে অভিহিত করা হয় তার যেটি উদারতার ধারা সেটি বৌদ্ধ সাধনার মতো ভারতের বাইরেও প্রসারিত হয়। তার গতিবেগ চীন জাপান, মালয় ইন্দোনেশিয়া তিব্বত মধ্য-এশিয়া বার্মা আর ইন্দোচীনেও অনুভূত হয়। কিন্তু প্রসারণের পর আসে সংকোচনের যুগ। সব সভ্যতার ইতিহাসে এটা দেখতে পাওয়া যায়। ভারতীয় আর্যপ্রভাবিত ত্রিজাতি পরিচালিত বৈদিক বৌদ্ধ উদারনৈতিক সংস্কৃতিভিত্তিক সংস্কৃতি একদা তার চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসে, থেমে আসে, আপনাকে গুটিয়ে আনে। চূড়ান্ত পর্যায়ের কাল আমাদের ইতিহাসের স্বর্ণ যুগ, গুপ্তবংশীয় রাজাদের যুগ। এরপরের অধ্যায় কূপমণ্ডুকতা। সমূদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। হিমালয় অতিক্রম করাও তাই। হিন্দুসমাজের নিয়মকানুন দিন দিন আরো কড়া হয়। কেউ তো বিদেশে যাবেই না বিদেশ থেকে কেউ এলে তাকেও সমাজে নেওয়া হবে না। এই কূপমণ্ডুক অবস্থায় ভারতের দুর্বলতা ইসলামকে সহজে পথ ছেড়ে দেয়। আরবি-তথা পারসিকভিত্তিক সংস্কৃতির প্রয়োজন ছিল।

বক্ষ্যমান প্রবন্ধে অন্নদাশংকর আরো লিখছেন, ভারতে মধ্যযুগ শুরু হয় ইউরোপের মধ্যযুগেরই প্রায় সমসাময়িককালে। প্রায় সমসাময়িক বলার কারণ, ভারতে মধ্যযুগ শ দুয়েক বছর পরে আসে আর শ দুয়েক বছর বিলম্বে চলে যায়। মধ্যযুগের প্রথম আধখানা জুড়ে ছিলেন রাজপুত রাজন্যরা আর আধখানা তুর্ক ও মুঘল সুুলতান ও বাদশাহরা। মধ্যযুগীয় হিন্দু তথা মুসলিম শক্তিতে নিশ্চয় তফাত ছিল। কিন্তু উভয়েই মধ্যযুগীয়। তুর্ক মুঘল প্রভৃতি ইসলামপন্থীদের আগমনের পূর্বেই ভারতের সংস্কৃতভিত্তিক সংস্কৃতি বস্তুজ্ঞান হারিয়েছিল। বস্তুজ্ঞান না থাকলে কি ব্রহ্মজ্ঞান থাকে? ব্রহ্মজ্ঞান থাকলে আরো কয়েকখানি গীতা উপনিষদ লেখা হতো, রাশি রাশি টিকা ভাষ্য নয়। আরো কয়েকটি দর্শনের উৎপত্তি হতো, রাশি রাশি ভক্তিগ্রন্থের বা পুরাণের নয়। এমন সময় হাজির হয় পারসিক বা ফারসিভিত্তিক সংস্কৃতি, তার সঙ্গে আরব্য সংস্কৃতি। আরব্য সংস্কৃতি যে কোরানসর্বস্ব ছিল তা নয়। তার সঙ্গে অঙ্গীভূত গ্রিক দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতিষ। আরবি ফারসি শিক্ষার দ্বার হিন্দুদের কাছে মুক্ত ছিল। ভারতীয় নিম্নবর্গের যারা টোল চতুষ্পাঠিতে প্রবেশ করার অধিকার পায়নি কখনো, তারা মাদ্রাসায় প্রবেশাধিকার পেয়েছিল। ভারতের শূদ্ররা সংস্কৃত বা বেদ পাঠকরার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল, আরবি ফারসি থেকে বঞ্চিত হলো না।  কায়স্থ প্রভৃতি জাতের ছেলেরা এই প্রথম মাথা তোলার সুযোগ পায়। শাসক তুর্ক ও মুঘল শাসনে হিন্দুদের ভাগ্যে যেসব পদ জোটে সেসব আর ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়দের একচেটিয়া নয়, হিন্দু সমাজের নিম্নতম অংশও তার শরিক হয় এবং প্রতিযোগিতায় আরো উচ্চে ওঠে। মুসলিম শাসন এদিক থেকে বৈপ্লবিক। কথাগুলি বলছেন অন্নদাশংকর রায়।

তিনি বলেন, হিন্দু মুসলমানের সাংস্কৃতিক মিলন হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে তথা ইন্দো-পারসিক স্থাপত্যে তথা উর্দু সাহিত্যে মূর্ত হয়েছে। তা ছাড়া বেশভূষায় আদব কায়দায় চালচলনে অভিজাত মহলের হিন্দু মুসলমানের একত্ব ঘটেছে। কিন্তু ভারতীয় মুসলমানদের একজোড়া উত্তরাধিকার; একটা ভারতীয় আর একটা মধ্যপ্রাচ্য। তাদের সেই মধ্যপ্রাচ্য উত্তরাধিকারের অল্পই হিন্দুরা পেয়েছে। তেমনি হিন্দুদের উত্তরাধিকারের যেটা প্রাচীনতর অংশ তার ভাগও মুসলমানরা কমই পেয়েছে। ব্যাপারটা ঠিক তাই। খুব গুরুত্বের সঙ্গে ভারতে মুসলমানদের আগমনের সংক্ষিপ্ত একটি বিবরণ তুলে ধরেন অন্নদাশংকর রায়। তিনি ইংরেজদের সময়কার ইতিহাস মেনে নিচ্ছেন না, বরং বলছেন ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখার সময় হয়েছে। কথাটা যেমন তিনি বলেছেন, ঠিক একইভাবে ভারতের হিন্দু-সম্প্রদায়ে জন্ম নেয়া বহু বিদগ্ধ মানুষ নতুন করে ভারতের ইতিহাসকে মূল্যায়ন করেছেন নিজেদের রচনায়। ইংরেজদের দ্বারা রচিত বিকৃত ইতিহাসে মুসলিম বিদ্বেষ প্রকাশের বিরুদ্ধে শক্তভাবে কলম ধরেছেন তাঁরা, নতুন আলোতে সেখানে উদ্ভাসিত ভারতের ইতিহাস। কিন্তু তার পরেও কতিপয়ের দ্বারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধ হয়নি, নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার জন্য হিন্দু-মুসলমান বিরোধ টিকিয়ে রাখছে তারা। ফলে সকলের রচনায় ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে সাম্প্রদায়িক কথাটা চলে আসতে বাধ্য। কিন্তু ইতিবাচক লেখকরা বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, ভারতে হিন্দু-মুসলমান বিরোধটা শাসকদের বানানো। সাধারণ মানুষ সাম্প্রদায়িক নন। সাম্প্রদায়িকতাকে সামনে এনে তাই সকল ঘটনার বিশ্লেষণ করাটা সঠিক নয়। চলবে