সাম্প্রদায়িক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং তার রাজনীতি
পর্ব ৭
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ২৭, ২০২০
সন্দেহ নেই ইংরেজরা ক্ষমতা গ্রহণের ফলে বর্ণহিন্দুরা সবচেয়ে লাভবান হয়েছে। বিশেষ করে বাংলায়। ইংরেজদের ভারত থেকে তারা তাড়াতে চায়নি এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রাম বর্ণহিন্দুরা তাই বহুকাল পর্যন্ত সমর্থন করেননি। বর্ণহিন্দুরা ইংরেজদের শাসনকে নিজেদের জন্য আশীর্বাদ মনে করেছে। মনে করেছে ইংরেজরা চলে গেলে তাঁদের কর্র্তত্ব চলে যাবে। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তথা কৃষকরা কখনো ইংরেজ শাসনকে তাদের জন্য আশীর্বাদ ভাবেনি। ভাববার কারণ ছিল না। বরং তা ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দুদের কাছে ভয়াবহ অত্যাচার। সেজন্যই বাংলা ইংরজদের দখলে চলে যাবার পরে সাধারণ হিন্দু-মুসলমানরা মিলিতভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটানা লড়াই চালিয়ে গেছে। কিন্তু দেশীয় দালালদের কারণেই সুবিধা করতে পারেনি। দালালদের মধ্যে মীরজাফরের মতো লোকরা যেমন ছিল, জগৎ শেঠরাও ছিল। রাজা কৃষ্ণদেব, দ্বারকানাথ রামমোহনরাও ছিল। মুসলমানদের নাম এ লেখায় কম উচ্চারিত হচ্ছে, আসলে মুসলামদের মধ্যে জমিদার আর উচ্চবিত্ত বা অভিজাত খুবই কম ছিল। মুসলমানদের ভিতরে যদি উচ্চবিত্ত বা জমিদার বেশি থাকতো, নিঃসন্দেহে তারা ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষেই থাকতো। দ্বিতীয় কারণ মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল না, সেজন্য ভদ্রলোক হতে পারেনি। ব্যবিংটন মেকলের ভাষায়, ইংরেজি শিখে ইংরেজদের দাসত্ব করার সুযোগ তাঁরা তখনো পায়নি।
হিন্দু-মুসলমানদের যে আলাদা করে দেখা হয় সেটা ভারতের ইতিহাসের আলোচনায় মস্ত বড় একটা ভুল। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানদের মিলিত লড়াইয়ের বিরাট উদাহরণ রয়েছে অনেক, সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো সারা উত্তর ভারত জুড়ে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ। বিদ্রোহের প্রথম শহীদ মঙ্গল পাণ্ডে এবং ঈশ্বরী পাণ্ডে। মীরজফরের বংশের মুসলমান নবাব মনসুর আলী খাঁ এই বিদ্রোহকে সমর্থন জানায়নি। ভিন্ন দিকে বিদ্রোহের পক্ষে ছিলেন সম্রাট বাহাদুর শাহ, বিদ্রোহের প্রধান নেতা। বিদ্রোহে যোগ দেন কানপুরের নানাসাহেব, কুনওয়ার সিং, অযোধ্যার হয়রত বেগম মহল, বির্জিস কাদের, ঝাঁসীর রানী লক্ষীবাঈ, তাতিয়া টোপী, পাটনার রাজা কুমার সিং, অযোধ্যার রাজা মানসিংহ, রোহিলাখণ্ডের খান বাহাদুর খান প্রমুখ সামন্ত রাজারা। বহু ব্রাহ্মণ এ বিদ্রোহে অংশ নিয়েছেন, বহু অভিজাত মুসলমান যুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রাণ দিয়েছেন। বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মৌলবী আজিমুল্লাহ, মৌলভী ফজলুল হক, সরফরাজ আলী, মৌলভি ইমদাদ আলীর মতো ধর্মপ্রাণ মুসলমান। বিদ্রেহের বিরুদ্ধে ছিলেন আবার সম্রাট বাহাদুর শাহর কাছের মানুষ মৌলভি রজ্জব আলী, হাকিম আহসানুল্লাহ, মির্জ এলাহী বক্স, মেহবুব আলী প্রমুখ। যাঁরা বাহাদুর শাহর বেতনভোগী তাঁরা বাহাদুর শাহর সঙ্গে বেঈমানী করেছেন। বিদ্রোহের বিরুদ্ধে ছিলেন দিল্লির নিকটবর্তী নবাব জিয়াউদ্দিন, নবাব আমিনউদ্দিন, বণিক শিউপ্রসাদ, বণিক গিরবার সিং, বণিক দেবী সিং, বণিক জুৎসিপ্রসাদ প্রমুখ। ফলে হিন্দু-মুসলমান বলে কাউকে আলাদা করা যাচ্ছে না। বিদ্রোহের পক্ষে যুক্ত ছিলেন বহু বড় বড় কৃষক নেতা। কৃষকনেতা লুধরাম মীরাটে বিদ্রোহের শুরুতেই প্রাণ দেন, জাঠনেতা সামাহল সহ মীরাটের কোতোয়াল বিষ্ণু সিং, রেভারির তুলারাম, বানাওয়ারের কৃষক নেতা কালান্দর খান, পরিচিত গড়ের কদম সিং, আক্কেলপুরের নরপতি সিং, নাজিম খান সকলে একজোট হয়ে বিদ্রোহ করেন। সিপাহী নেতাদের মধ্যে ছিলেন ঘাউস মোহম্মদ, বখত খাঁ, হীরা সিং, মহম্মদ সুফি, হিয়াৎ খান, কাদির বক্স, টিকা সিং, নৃপৎসিংহ খঞ্জ, সদাশিব রাও, রানা বেনুমাধু, সামুদ খান প্রমুখ; হাজার হাজার নাম; বলে শেষ করা যাবে না। লক্ষ লক্ষ সিপাহী আর কোটি কোটি সাধারণ মানুষের বিদ্রোহ ছিল সেটা। হিন্দু মুসলমানরা কি কেউ পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল, নাকি শাসকদের বিরুদ্ধে? এটা কি সামান্য সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ ছিল? নাকি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সংগ্রাম ছিল?
সারা উত্তর ভারতের কোটি কোটি মানুষ যে যুদ্ধের পক্ষে, বাংলার আলোকপ্রাপ্ত সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাটা কী ছিল তখন? সমসাময়িক পত্রপত্রিকা বলছে ভদ্রলোকদের সিপাহীযুদ্ধের প্রতি সামান্য সমর্থন ছিল না। সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লেখা হলো, ‘সম্প্রতি এতদ্দেশীয় সিপাহী সেনা দ্বারা যে বিদ্রোহ উপস্থিত হইয়াছে তাহার নিমিত্ত গবর্ণমেন্টের প্রতি ভক্তি ও অভিপ্রায় প্রকাশের জন্য এতদ্দেশীয় সম্ভ্রান্ত মহাশয়রা গত দিবস হিন্দু মেট্রোপলিটান কালেজে যে সভা করিয়াছিল তাহাতে শ্রীযূত রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরম শ্রীযূত রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, শ্রীযূত বারু রাজেন্দ্র দত্ত, শ্রীযূত রায় হরচন্দ্র ঘোষ, শ্রীযূত বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রভৃতি অনেকানেক মহাশয়েরা উপস্থিত হইয়াছিলেন, শ্রীযূত রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর সভাপতির আসনে উপবিষ্ট হইলে নিম্নলিখিত প্রস্তাব সকল অবধারিত হয়, অন্যান্য বিবরণ সকল আগামীতে প্রকাশ করিব অদ্য স্থানাভাব হইল।’ সভায় কী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল সেদিন? ছয়টি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাতে বলা হয়েছিল, সভা বিদ্রোহের খবর শুনে খুবই দুঃখিত হয়েছে, এ দেশের কয়েকদল সৈনিক যে সরকারের বিরোধী হয়ে স্থানে স্থানে অত্যাচার করনে প্রবৃত্ত হয়েছে এবং তাদের অসচ্চরিত্র ব্যবহারের জন্য সভা ঘৃণা প্রকাশ করছে। রাজ্যের প্রজামণ্ডলীর যারা সিপাহীদের সহায়তা না করে সরকারের প্রতি রাজভক্তি প্রকাশ করেছে সভা সেজন্য আনন্দিত। বর্তমান বিদ্রোহে দেশের শান্তি রক্ষায় সরকারকে যতরূপ সহযোগিতা করা প্রয়োজন সভা তা করবে, মহারানীর প্রজাহিসেবে প্রাণপণে সরকারকে সাহায্য করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কার্য। সভার বিবরণ সর্বসাধারণের বিদিতার্থে প্রচলিত ভাষায় অনূদিত হয়ে সর্বত্র প্রেরণ করা হয়। সভার এই বিবরণ থেকে এটা বোঝা গেল, সভা ইংরেজি ভাষায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সকলের বোধগম্য করে প্রচারের জন্য তা বাংলা ভাষায় বা প্রচলিত ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল।
স্পষ্ট তৎকালীন ভদ্রলোকরা এর বিরুদ্ধে ছিলেন। মুসলমানদের নাম পাচ্ছি না, কারণ কলকাতা শহরে মুসলমানদের মধ্যে তখনো উচ্চবিত্তর সংখ্যা কম ছিল। সরকারের পক্ষে এবং বিদ্রেহের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই সংবাদ প্রকাশ বা লেখা ছাপা হতো। সংবাদ প্রভাকর বিশে জুন লিখছে, ‘ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের অধীনতায় অধুনা দুর্ব্বল ভীরু বাঙালি ব্যুহ যেরুপ সুখসচ্ছন্দতা সম্ভোগপূর্বক সানন্দে বাস করিতেছেন, কস্মিনকালে তদ্রুপ হয় নাই, রামরাজ্য আর কাহাকে বলে? এই রাজ্যইতো রাম রাজ্যের ন্যায় সুখের রাজ্য হইয়াছে, আমরা যর্থাথরূপে স্বাধীনতা সহযোগে পদ, মান, বিদ্যা, এবং ধর্ম, কর্ম্মাদি সকল প্রকার সাংসারিক সুখে সুখি হইয়াছি; কোন বিষয়েই ক্লেশের লেশমাত্র জানিতে পারি না, জননীর নিকট পুত্রেরা লালিত ও পালিত হইয়া যদ্রুপ উৎসাহে ও সাহসে অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া অন্তঃকরণকে কৃতার্থ করেন আমরাও অবিকল সেইরূপ পৃথিবীশ্বরী ইংলন্ডেশ্বরী জননীর নিকটে পুত্রের ন্যয় প্রতিপালিত হইয়া সর্ব্বমতে চরিতার্থ হইতেছি।’ পত্রিকাটিতে সেখানে বাঙালীদের প্রতি নিবেদন করা হয়েছে, ‘হে বঙ্গদেশীয় মহাশয়গণ! আমরা আর অধিক কি নিবেদন করিব? সুযোগ্য পরমবিজ্ঞ অদ্বিতীয় রাজনীতিজ্ঞ বিচারদক্ষ সর্ব্বাধ্যক্ষ গবর্নর জেনারেলে শ্রীযূত লর্ড কেনিং বাহাদুর তোমারদিগের অকপট প্রভুভক্তিতা, কৃতজ্ঞতা, সুশীলতা, মনের অখলতা, নির্মলতা এবং সচ্চরিত্রতার বিষয় বিশিষ্টরূপেই অবগত হইয়াছেন, কারণ বাঙাল জাতি কাঙালি অপেক্ষাও দুর্ব্বল অত্যন্ত ভীত সাহসহীন, মাছ, ভাত খাইয়া শরীর ধারণ করে, অস্ত্রের নাম শুনিলেই কাঁপিতে থাকে, যাহারা আপনারা আপনার দিগের শরীর রক্ষা করিতে পারে না তাহারা কি আবার কস্মিকালে অরির-ভাব ধারণ করিয়া প্রবলতা প্রকাশ করিতে পারে? যে পর্য্যন্ত এদেশে ইংরেজের প্রভুত্ব হইয়াছে সেই পর্য্যন্ত তোমরা প্রভুভক্তরূপে বিখ্যাত হইয়া আসিতেছ, এই কৃতজ্ঞতা মহৎগুণের প্রভাবে উপযুক্ত মত রাজানুগ্রহ ও প্রসাদ লাভ করিতেছ, এই কৃতজ্ঞতা ধর্ম্ম জন্য ধর্ম্ম তোমারদিগের ক্রমেই মঙ্গল করিবেন। এবং লর্ড বাহাদুর অপ্রসন্ন হইয়া যথাযোগ্য কৃপা বিতরণে কখনই কৃপণতা করিবেন না; তিনি প্রসন্ন হইয়া ভবিষ্যতে অধিক দয়া বিতরণ করিবেন।’
যা কিছু সংবাদ প্রভাকরে লেখা হয়েছে, এমন উদাহরণ আরো বহু দেয়া যাবে। প্রভাকরের এই বক্তব্য সকল তৎকালীন শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত ভদ্রলোকদের মানসিকতা প্রতিফলন যাঁরা বাংলায় নবজাগরণ এনেছিলেন। নবজাগরণের প্রথম লক্ষণটি হচ্ছে ইংরেজদের দাসত্ব করা বা দাসত্ব করে সুখ অনুভব করা। ইংরেজদের দাসত্ব করার জন্য ইংরেজি শেখা, ইংরেজদের কাছে অনুনয়-বিনয় করার জন্য পত্রিকা প্রকাশ করা, ইংরেজদের অনুসারী হয়ে ইতিহাস রচনায় মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো, ইংল্যাণ্ডের রানী আর প্রশাসকদের দয়া লাভ। পাশাপাশি হিন্দুত্বের জয়গান। হিন্দুত্বের জয়গানে সামান্য সমস্যা ছিল না, যদি তা মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন না করে দিতো। মহাবিদ্রোহে উত্তর ভারতের সকল সকল ধর্মের মানুষ সম্রাট বাহাদুর শাহকে বিদ্রোহের নেতা মেনে নিলেন। কারণ তাঁরা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। হীনমন্যতার দ্বারাও আক্রান্ত ছিলেন না। বৃহত্তর লড়াই পরিচালনায় তাই তাঁরা সকলের গ্রহণযোগ্য একজন বর্ষীয়ান মানুষকে আবার ভারতের স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করলেন। ইংরেজ শাসনেও ইংরেজ শাসকদের কাছে বাহাদুর শাহ সম্রাট বলেই বিবেচিত ছিলেন, কিন্তু স্বাধীন ছিলেন না। ছিলেন একপ্রকার বন্দী, ইংরেজদের বৃত্তিভোগী; নিজের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা ছিল না। ইংরেজরা কেন মুঘলদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়নি, কেন তাঁদের সম্রাট উপাধি কেড়ে নেয়নি? প্রমোদ দাশগুপ্ত তাঁর গবেষণায় জানাচ্ছেন, ইংরেজরা জানতেন ভারতের মানুষের কাছে মুঘল সম্রাটের একটা গুরুত্ব ছিল। যদি তাঁদের ক্ষমতা থেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে দেয়া হয়, তাহলে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। কারণ ভারতবাসীর কাছে এই নামটাই ছিল একটা স্বাধীন ঐতিহ্যের প্রতীক।’
কথাটা প্রমাণিত হয় যখন হিন্দু-মুসলমান সকলে, সকল সামন্ত রাজারা তাঁকেই বিদ্রোহের প্রধান নেতা করেন। কারো দিক থেকে আপত্তি ওঠেনি। না হলে হয়রত বেগম মহাল, রানী লক্ষীবাঈ, নানাসাহেব, রাজা কুমার সিং এদের মধ্যে কাকে প্রধান করা যেতো, যিনি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য? সকলেই ছিলেন প্রাদেশিক নেতা, বাহাদুর শাহ ছিলেন সর্বভারতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক। মধুসূদন দত্ত সহ আরো কয়েকজন বাংলার আলোকপ্রাপ্ত বিদ্রোহের বিরুদ্ধে কিছু বলা থেকে দূরে ছিলেন। মধুসূদন ছিলেন সামগ্রিকভাবে অসাম্প্রদায়িক ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ, তিনি কখনো ইংরেজদের দালালী বা মোসাহেবী করেননি। ফলে ‘মেঘনাদবধকাব্য’ তিনিই লিখতে পারেন। সুলতানা রিজিয়াকে নিয়ে তিনি নিবন্ধ লিখেছেন। নাটক লিখতে চেয়েছিলেন সুলতানা রাজিয়াকে প্রধান চরিত্র করে, কিন্তু বাংলার নাট্যজগতের সেইসব মহান ‘আলোকপ্রাপ্তরা’ কিছুতেই মুসলিম চরিত্র প্রধান হয়ে নাটকে আসবে, মানতে পারছিলেন না। মধুসূদনের নারী চরিত্র প্রধান করে তখন নাটক আর লেখা হলো না। যাঁরা সুলতানা রিজিয়াকে নাটকের প্রধান চরিত্র হিসেবে নিতে রাজি নন, বাংলার সেইসব আলোকপ্রাপ্তরা বাহাদুর শাহকেই বা কেমন করে মেনে নেবেন! কথাটা হলো বিদ্রোহকে মেনে নিলে না তবেই বাহাদুর শাহকে মেনে নেয়ার প্রশ্ন আসে। বিদ্রোহের পক্ষে থাকলেন না বরং নিজেদের ইংরেজপ্রীতি আর ইংরেজদের দাসত্বকে যুক্তিসঙ্গত করার জন্য বললেন, মহাবিদ্রোহ ছিল আসলে ভারতকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য একটা হটকারিতা। পুনরায় মুসলিম শাসন আর সামন্ত যুগকে ফিরিয়ে আনবার প্রচেষ্টা। কিন্তু ইংরেজ শাসনে ‘বাংলার শিক্ষিত ভূস্বামীরা’ নিজেরাই কি সামন্তযুগের বন্ধনেই বাঁধা ছিলেন না? ধর্ম হিসেবে হিন্দুত্বকে মহিমান্বিত করা, জমির উপর অর্থনীতিকে নির্ভরশীল করে তোলা, সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নুইয়ে থাকা কি সামন্ত সংস্কৃতি ছিল না? ভদ্রলোক নামধারী আলোকপ্রাপ্ত নবজাগরণের হোতা বাবুদের দ্বারা বাংলায় ‘দুর্গাপূজা’র রমরমা কি সামন্ত সংস্কৃতির বাইরে ছিল? বঙ্কিম নিজেই ব্যঙ্গ করে বাবুদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, ধনের গৌরব দেখাবার জন্য বাবু হতে গেলে দুর্গাপূজা করতেই হবে! চলবে