তিতুমীর
সাম্প্রদায়িক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং তার রাজনীতি
পর্ব ৬
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ২৬, ২০২০
সরকারের দলিলে আছে, ‘হিন্দু জমিদারের বাড়ির দুর্গা প্রতিমার সাজ-সজ্জার ব্যয় অথবা কোনো পৌত্তলিক ধর্মানুষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ করবার জন্য মুসলমান প্রজাদের নিকট হতে বলপূর্বক কর আদায় করা যে অসহ্য উৎপীড়ন তাতে সন্দেহ নেই। এর সমর্থনে এক মাত্র অজুহাত ছিল এই যে, এটা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে এবং জনসাধারণ দিতে অভ্যেস্ত।’ সরকারি দলিল মানে ফরিদপুর জেলার গেজেটিয়ারে বলা হচ্ছে, এর বিরোধিতা করে দুদুমিঞা যুক্তিসঙ্গত কাজই করেছেন।’ কিন্তু আশি হাজার ধর্মীয় লোকের একটি সংগঠন গড়ে ওঠা সম্পর্কে বলছে, ‘ইহাদের ভয়ে কোন দেশের ভূস্বামীগোষ্ঠী শঙ্কিত না হইয়া পারে না।’ সরকারি দলিলে দেখা যায়, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে এদের বিদ্রোহ কেবল মুসলমান সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, তাতে নিম্নতম বর্ণের হিন্দুগণও অংশগ্রহণ করেছিল। উইলিয়াম হান্টার নিজে লিখেছেন, ‘বঙ্গদেশে একটি সমগ্র ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ক্রমশ তাহাদের পক্ষ অবলম্বন করিয়াছিল। তাহারা হিন্দু সমাজের নিম্নতর স্তরে অবস্থিত চর্মশ্রমিক।’ কান্টোয়েল স্মিথ তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এইদিক থেকে ওয়াহাবি বিদ্রোহ ছিল পূর্ণমাত্রায় শ্রেণীসংগ্রাম। সংগ্রাম থেকে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নটি ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হয়েছিল। শিল্প বিকাশের পূর্বযুগে শ্রেণী-সংগ্রাম যেভাবে প্রায় সকল ক্ষেত্রে ধর্মীয় ধ্বনি গ্রহণ করেছিল, সেইভাবে এই শ্রেণী সংগ্রামেও ধর্মীয় ধ্বনি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সে ধ্বনি ধর্মীয় হলেও সাম্প্রদায়িক ছিল না।’
স্মিথ আরো দেখান যে, সুতরাং যাকে ওয়াহাবি বিদ্রোহ বলা হচ্ছে, সেখানে নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত ছিল না, কিংবা মুসলমান শ্রেণীশত্রুকে নিম্নশ্রেণীর মুসলমানরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করেনি। হান্টার লিখেছেন, ‘কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ব্যাপক কৃষক অভ্যুত্থানে কৃষকরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল জমিদারদের গৃহ লুণ্ঠন করেছিল। প্রকৃতপক্ষে মুসলমান ধনীদের অবস্থা হয়েছিল অপেক্ষাকৃত অধিক শোচনীয়।’ ‘ধর্মীয় আন্দোলন সত্ত্বেও উচ্চশ্রেণীর ধনী মুসলমানরা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয়েছিল।’ ‘হিন্দু হোক আর মুসলমানই হোক, যে কোনো স্থানে যে কোনো বিত্তশালী বা কায়েমী স্বার্থসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষেই ওয়াহাবিদের উপস্থিতি একটা স্থায়ী ভিতির কারণ ছিল। যে-সকল মসজিদের বা পথিপার্শ্বস্থ মন্দিরের কয়েক বিঘা করে ভূসম্পত্তি আছে, তার প্রত্যেকটি মসজিদ বা মন্দিরের মোল্লা বা পুরোহিতরাই গত অর্ধশতক ধরে ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে তারস্বরে চীৎকার করেছে। ভারতবর্ষের ভূস্বামীদের মতো মোল্লা-পুরোহিতগণ যে-কোনো পরিবর্তনকে ভয় করে।’ যখন পরবর্তীকালে কলকাতার উচ্চ-আদালতে বিখ্যাত ব্যবসায়ী আমির খাঁর বিরুদ্ধে মামলা চলছিল, তখন মামলার পক্ষে বিখ্যাত আইনজীবী অ্যানেস্টি বলেছিলেন, ওয়াহাবি বিদ্রোহ কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়, এই বিদ্রোহ ভারতের বিদেশী শাসন উচ্ছেদ করে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোটি কোটি মানুষের বিদ্রোহ। কারণ তারা ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষক ‘দার-উল-হারাব’ বা শত্রুর দেশ মনে করতো।
তিতুমীর প্রথম নিজ গ্রামে ধর্ম প্রচার আরম্ভ করেন। তিনি বলেন, ‘নামাজ পড়া, রোজা রাখা, ইসলামী ধরনে নাম রাখা, দাড়ি রাখা, ইদুল আজহার কুরবানি দেয়া, আকীকা করা, মুসলমানের পালনীয় কর্তব্য।’ তিনি বলেন কথাবার্তায় প্রকৃত মুসলমান হতে হবে আর এমনভাবে নাম রাখতে হবে যাতে বোঝা যায় সে মুসলমান। অমলেন্দু দে তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, তিতুমীর এ কথাও বলেছিলেন যে, কেবলমাত্র ধর্মের ব্যবধানের জন্য অ-মুসলমানের সঙ্গে বিবাদ করা আল্লার পছন্দ নয় এবং দুর্বল অমুসলমানকে সাহায্য করা মুসলমানের কর্তব্য। তিতুমীর বলেন, ‘ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম। যারা মুসলমান নন তাদের সঙ্গে কেবল ধর্মের ব্যবধানের জন্য অহেতুক বিবাদ করা আল্লাহ এবং আল্লাহর রসুল পছন্দ করেন না, বরং আল্লাহর প্রিয় রসুল এই কথা ঘোষণা করেছেন কোনো প্রবল শক্তিসম্পন্ন অমুসলমান যদি কোনো দুর্বল অমুসলমানকে তার ন্যায়সঙ্গত দাবী অগ্রাহ্য করে তার প্রতি অন্যায় জুলুম ও অবিচার করে মুসলমানেরা সেই দুর্বলকে সাহায্য করতে বাধ্য।’ সরফরাজপুর গ্রামের অধিকাংশ মুসলমান যখন প্ররোচিত হয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে বিরোধে অবতীর্ণ হয় তখন কয়েকজন মুসলমান দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে তিতুমীর সেই গ্রামে গিয়ে জুম্মার নামাজের পরে হিন্দু-মুসলমানদের সম্বোধন করে মন্তব্যগুলি করেছিলেন। ফলে রামমোহনদের হিন্দুত্বের সঙ্গে তিতুমীরের প্রচারিত ধর্মের বিরাট ব্যবধান ছিল। রামমোহনরা হিন্দুত্বের জয়গান গাইতে গিয়ে মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে কুৎসা করেছিলেন। তিতুমীর সেই পথে হাঁটেননি। তিনি তাঁর প্রচারিত ধর্মে
হিন্দু-মুসলমানের মিলনের কথা বলেছেন। হিন্দুধর্মের নিন্দাবাদ করেননি। তিতুমীরের প্রথম জীবনীকার রাজভক্ত বিহারীলাল সরকার লেখেন, ‘তিতু আপন ধর্মমত প্রচার করেছিলেন। সে ধর্মমত প্রচারে পীড়ন তাড়ন ছিল না। লোকে তার বাগ-বিন্যাসে মুগ্ধ হয়ে, তাকে পরিত্রাতা মনে করে তার মতাবলম্বী হয়েছিল। তিতু প্রথম শোনিতের বিনিময়ে তার প্রচার করতে চায়নি। জমিদার কৃষ্ণদেবের জরিমানার ব্যবস্থা তার শান্ত প্রচারে হস্তক্ষেপ করলো।’
প্রথমে ধর্মসংস্কার আন্দোলনরূপে শুরু হলেও ক্রমান্বয়ে এ আন্দোলন হিন্দু জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে মুসলমান কৃষকদের সামাজিক-অর্থনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। লক্ষণীয় যে, হানাফী সম্প্রদায়ভক্ত মুসলমান কৃষকদের ধর্মীয় আচরণ-বিধি সমালোচনা করায় তাঁরা তিতুমীরের আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না। যেহেতু তিতুমীরের সংগ্রাম মূলত হিন্দু-জমিদারদের বিরুদ্ধে ছিল সেজন্য জমিদাররা এই আন্দোলন দমনে সচেষ্ট হন। তিতুমীরের প্রভাব ক্ষুন্ন করার অভিপ্রায়ে বিক্ষুব্ধ হানাফি মুসলমান কৃষকদেরও জমিদারেরা কাজে লাগাতে চেষ্টা করেন। তারাগুনিয়ার জমিদার রামনারায়ণ, নগরপুরের গৌরপ্রসাদ চৌদুরী এবং পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় এই আন্দোলন দমনে অগ্রসর হন। তাঁদের মধ্যে পুঁড়ার জমিদার ও নীলকর কৃষ্ণদেব রায় প্রবল প্রতাপান্বিত জমিদার ছিলেন। তিনি হুকুম জারি করেন: ‘যারা তিতুমীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে দাড়ি রাখবে আর গোঁফ ছোট করবে তাদের প্রত্যেককে দাড়ির জন্য আড়াই টাকা আর গোঁফ ছোট রাখার জন্য পাঁচশিকা ফি দিতে হবে। মসজিদ প্রস্তুত করলে, প্রত্যেক কাঁচা মসজিদের জন্য পাঁচশত টাকা আর পাকা মসজিদের জন্য জমিদারকে সহস্র টাকা নজর দিতে হবে। পিতামাতা সন্তানের যে নাম রাখবে সে নাম পরিবর্তন করে আরবী নাম রাখতে হলে প্রত্যেক নামের জন্য পঞ্চাশ টাকা ফি দিতে হবে। গোহত্যা করলে হত্যাকারীর হাত কেটে নেওয়া হবে। তিতুমীরকে প্রজারা নিজে বাড়িতে স্থান দিলে তাকে ভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হবে।’ মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় বা ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতায় জমিদারের এরকম কঠোর হুকুম কী প্রমাণ করে? নিজেই কি তিনি পায়ে পা দিয়ে তিতুর সঙ্গে অন্যায়ভাবে বিরোধ তৈরি করেননি? ঘটনাটা এটাও প্রমাণ করে, ইংরেজ শাসনে মুসলমান কৃষকরা হিন্দুর জমিদারীতে কতোটা ইচ্ছার দাস ছিলেন। কথাটা নিম্নবর্গের হিন্দুদের ক্ষেত্রেও সত্যি ছিল। জমিদাররা তাদের উপরেও ভয়াবহ নির্যাতন চালাতেন।
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, জমিদারগণের শোষণউৎপীড়নই তিতুমীরের ‘শান্তিপূর্ণ ধর্মসংস্কার আন্দোলনেকে’ ব্যাপক বিদ্রোহে রূপান্তরিত করেছিল। থর্নটন বলেন, তিতুমীরের শান্তিপূর্ণ ধর্মসংস্কার আন্দোলনকে অহেতুক ভীতির চক্ষে দেখে এবং তার অজুহাতে কর আরোপ করে জমিদারগণ মুসলমান কৃষকদের উপর যে উৎপীড়ন আরম্ভ করে, তাই হলো বিদ্রোহের মূল কারণ। গৌতমভদ্র তাঁর ‘ইমান ও নিশান’ গ্রন্থে লিখেছেন, তিতুমীরের পক্ষের মানুষদের ‘নিজেদের আলাদা আর উন্নত বলে মনে করা এবং তাদের সেই উচ্চমনস্কতার জোর আর আত্মবিশ্বাস, উচ্চকোটির চোখে হয়ে দাঁড়ায় ঔদ্ধত্য আর দম্ভ। তাই সংখ্যায় কম হলেও এরা ক্ষমতাসীনদের চক্ষুশূল হয়ে ওঠে।’ সরকারি দলিলে স্পষ্ট বলা হয়েছে, দাঙ্গাহাঙ্গামা, খুনজখম বা লুঠতরাজ ইত্যাদি কাজে এই সম্প্রদায়ের আদি লক্ষণ ছিল না। কিন্তু এদের ব্যবহার আর ধর্মপ্রচারই নাকি এদের জমিদারি কর্তৃত্বের বিরুদ্ধ দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। তিতুর ধর্ম প্রচার কেমন করে জমিদারদের প্রভুত্বকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল? তিতু বলতেন, ‘সকল আদমী আল্লার বান্দা। বান্দার কাম বন্দেগী করা। ঈমানের দুটি খবর আছে। খোদাকে খোদা জানা আর রসুলকে রসুল মানা। খোদাকে মানা মানে হলো আর কাউকে তার শরিক না করা। ভিন্ন কারো কাছে মাথা নত না করা। বিশ্বাস রাখতে হবে, খাজাঞ্চিখানার চাবি আল্লার কাছে, তিনি কারুর হাতে সেটা দেননি আর কেউ তার খাজাঞ্চি নয়। পয়গম্বরের ভূমিকা সীমিত, তিনি খবর দেনেওয়ালা। বাকিটা সব আল্লার হুকুম। মনে রাখতে হবে আল্লার কাছে সবাই সমান। মানুষ নিজেদের মধ্যে সবাই ভাই ভাই। মালিক একমাত্র আল্লাহ, তিনি ছাড়া দিনদুনিয়ার মালিক আর কেউ নয়। দুনিয়ায় যারা সর্দারি করছে তারা সমানভাবে আল্লার বান্দা। বড় বা ছোট কেউ নয়।’ শাসক বা জমিদারদের সঙ্কটটা সেখানেই ছিল, তিতু জগতের সব মানুষকে সমান বানিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন নিজের প্রচারিত ধর্মে।
তিনি সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করতেন। গৌতম ভদ্র দেখাচ্ছেন, বর্ণবিভক্ত গ্রামসমাজে ‘একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া’ সামাজিকভাবে তাদের এক স্বতন্ত্র গোষ্ঠীতে পরিণত করেছিল। সমাজের দুটো নীতি থাকে। আত্মস্থ করার নীতি, বাঁধবার নীতি আর প্রভেদ করার নীতি। সীমার মধ্যে আনা আর সীমার বাইরে রাখার নীতি। কিন্তু তিতুমীর শাসকদের বিভেদ করা সমাজে নতুন সঙ্কট তৈরি করে বসলো, মিলনের নীতির কথা বলে। সকল মানুষকে সমান দাবি করে। সরকারি দলিল মতে, ‘তারা একইরকম পোষাক পরিধান করা, সকলে দাড়ি রাখার ভিতর দিয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য জারি রেখেছিল।’ খেয়াল করলে চেনা যেতো এরা তিতুর লোক। ফলে দাড়ি হয়ে ওঠে এক প্রতীক যার মধ্য দিয়ে এক নতুন সম্প্রদায়ের ক্ষমতা জাহির হতো, এই চিহ্ন দিয়ে এই সম্প্রদায়ের লোকরা নিজেদের অন্যদের থেকে আলাদা করতে পারতো। তিতুর মূল সামাজিক আবেদন ছিল অবশ্য গ্রামের নিম্নকোটির আদত মানুষদের কাছে। বারবার বলা হয়েছে জাতিতে তারা জোলা আর কৃষক। এদের অনেকেরই উপাধি ছিল কারিগর। এদের মধ্যে অনেকে তাঁত বুনতো আর নগণ্য রায়ত ছিল। মুসলমান সমাজে অন্ত্যজদের মধ্যে তিতুর প্রচার খুবই কার্যকর হয়েছিল। তিতুর নিজের সামাজিক মান মর্যাদা ছিল কিন্তু তার দলে সম্পন্ন বা মানী লোকদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। কলভিন বলেছেন, যাদের কিছু হারাবার আছে তারা তিতুর দলে যোগ দিয়ে ঝুঁকি নিতে চায়নি। দুর্গাচরণ রক্ষিতের সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, ‘তারা সাধারণ কৃষিজীবীর ন্যয় হালচাষ করে জীবীকা নির্বাহ করে। হিন্দুদের মধ্যে যোগীরা সে শ্রেণীস্থ মুসলমানদের মধ্যে জোলারাও সেই শ্রেণীস্থ। বস্ত্রায়ন তাদের প্রধান উপজীবীকা। তারা সকলেই নির্ধন।’ যুগী আর জোলাদের জল সাধারণে স্পর্শ করে না। এহেন লোকদের মধ্যে তিতু দল গড়েছিলেন।
বিহারীলাল সরকার সত্যের খাতিরে তিতুমীরের পক্ষে বহু কথা লিখলেও তিনি ছিলেন ইংরেজ পক্ষের লোক। তিনি তিতুমীরের ঘটনায় ইংরেজদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘এ ভারতের ইংরেজের রাজত্বে ইংরেজের করুণার মর্ম, ইংরেজের বাৎসল্যের ভাব, কে না বুঝে। ইংরেজর রাজত্বে সুখামৃতের নিত্যসুখাস্বাদ কে না করে?’ এই পরম রাজভক্ত ব্যক্তিটিই তিতুমীরের প্রথম বাঙালী জীবনীকার। তিনিও স্বীকার করেছেন, মুসলমানদের কাছ থেকে দাড়ির খাজনা আদায় করা আরম্ভ হলো, হিতে বিপরীত হলো। জমিদার কৃষ্ণদেব একাই তা আদায় করেননি, সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য জমিদাররা তা আদায় করতে আরম্ভ করেন। মুসলমানদের জন্য সেটা ভয়াবহ অসম্মান আর জমিদারের অত্যাচারের চিহ্ন বটে। তিতুমীর ক্রুদ্ধ হলেন। তথাপি তিনি শান্ত থেকে মুসলমানদের কাছারিতে না যেতে আর দাড়ির জন্য কর দিতে নিষেধ করলেন। বিহারীলাল জানাচ্ছেন, কৃষ্ণদেব তখন মুসলমানদের শিক্ষা দিতে তিন চারশো লাঠিয়াল এবং বরকন্দাজসহ সরফরাজপুর গ্রামে প্রবেশ করেন। ফলে দুপক্ষের মধ্যে দাঙ্গা হলো, জমিদারের লোকদের দ্বারা অনেকগুলি বাড়ি লুণ্ঠিত হলো। মুসলমানদের নামাজ-গৃহ ভস্মীভূত করা হলো। তিতুমীর এরপরেই তিনশত অনুচরসহ জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের বাসস্থান আক্রমণ করেন। ইতিপূর্বে কৃষ্ণদেবের লোকরা একটি মসজিদ ভস্মীভূত করেছিল, তিতুমীরের লোকরা প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্যে একটি গরু হত্যা করে মন্দিরে তার রক্ত নিক্ষেপ করে। সম্ভবত পুরোহিত বাধা দিতে গেলে নিহত হন। তিতুর দল এরপর পুঁড়াগ্রামের বাজার লুণ্ঠন করেন এবং যারা তাদের বিরুদ্ধ পক্ষ ছিল তাদের বাড়িঘর লুণ্ঠিত হলো। বিহারীলাল এবং থর্নটন দুজনেই এই তথ্য দিচ্ছেন।
বহুজন এই ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিতে চেয়েছেন। বুঝাতে চেয়েছেন তিতু একজন কট্টর ধার্মিক মুসলমান বলেই হিন্দুর উপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ চালিয়েছে। সরকারি দলিলপত্র, বিহারীলালের বক্তব্য বা থর্নটনের বর্ণনা তা বলছে না। অমলেন্দু দে আর সুপ্রকাশ রায়ও বলছেন তিতুর পক্ষেই। মূলত কয়েকজন হিন্দু জমিদারের সঙ্গে এটা ছিল নিম্নবর্ণের মুসলমান কৃষকদের লড়াই। পুঁড়াগ্রামের লড়াইয়ে কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় সহ নীলকুঠির লাঠিয়াল, সড়কিওয়ালা ও বন্দুকধারী পাইকরা তিতুর বাহিনীর সঙ্গে লড়তে এসে হেরে যায়। তিতুর সঙ্গে শাসকপক্ষের বহু জনের লড়াইয়ে তিতু প্রথম জয়ী হতে থাকে। তিতু নিজে কৃষকদের নিয়ে বিরাট বাহিনী গড়ে তোলেন। তিতুমীর এরপর গ্রামাঞ্চলের অত্যাচারী তালুুকদার, মহাজন, নীলকুঠির সাহেব এবং সুবিধাভোগী ধনী-মুসলমানদের উচিৎ শিক্ষা দেবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ধনীদের কাছেই এবার জমি ভোগ করার জন্য উল্টো রাজস্ব দাবি করেন আর তাঁর অঞ্চলের বিভিন্ন জমিদারের অধীনস্ত হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের খাজনা বন্ধ করার নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে কৃষকরা খাজনা দেয়া বন্ধ করে। তিতুমীরের এই ধরনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নদীয়া জেলা ও চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাত অঞ্চলের বহু তালুকদার, মহাজন, ধনী মুসলমানরা ইতস্তত পলায়ন করতে থাকে। সুপ্রকাশ রায় দেখাচ্ছেন যে, ১৮৩১ সালের ১৪ অক্টোবর তিতুর বাহিনী খাসপুর গ্রামের এক ধনী মুসলমানের বাড়ি লুণ্ঠন করেন। তিতুর বাহিনী সেসময়ে রামচন্দ্রপুর ও হুগলী গ্রামের সকল ধনী মুসলমানের গৃহ লুণ্ঠন করেছিলেন। নদীয়া চব্বিশ পরগণার বহু গ্রাম থেকে তিতুর বাহিনীর ভয়ে পুলিশ পালিয়ে যায়। প্রজাগণও খাজনা দেয়া বন্ধ করে। গ্রামের হিন্দু-মুসলমান কৃষকগণ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে তিতুকে স্বাধীন বাদশাহ বলে স্বীকার করে নেন। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিতু জানতেন এই স্বাধীনতা ঘোষণার অনিবার্য পরিণাম ঘোরতর যুদ্ধ আসন্ন। তিতু এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তিনি চারদিক থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ইংরেজকে আক্রমণ না করে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। বাঁশের কেল্লার লড়াইয়ে তিনি প্রথমবার একটি বৃহৎ যুদ্ধে জয়ী হলেও, পরবর্তীকালে ইংরেজদের কামানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাঁশের কেল্লার লড়াইয়ে অসম সাহসী বীর শেষ পর্যন্ত হেরে যান এবং মৃত্যু বরণ করেন।
ফরায়জীদের ব্যাপারটা প্রায় একইরকম ছিল। সেটা একরকম ধর্মীয় সংস্কার কর্মসূচী দিয়ে আরম্ভ করে কৃষক আন্দোলনে রূপ নেয়। ফরায়জীরা কখনো নিজেদের আন্দোলনকে ওয়াহাবি বলে চিহ্নিত হতে দেয়নি। ফরায়জী আন্দোলনের পথিকৃত হাজী শরীয়তউল্লাহ সম্পর্কে জেমস ওয়াইজের রচনা থেকে একটি চমৎকার অধ্যায় জানা যায়। তিনি মাত্র আঠারো বছর বয়সে মক্কা গমন করেন শিক্ষালাভের জন্য। যখন তিনি ফরিদপুরে ফিরে এলেন তখন ডাকাতদের কবলে পড়েন। ডাকাতরা তাঁর সর্বস্ব কেড়ে নেয়, তিনি আরবদেশে বসে যে স্মৃতিকথা লিখেছিলেন সেটাও ডাকাতদের দখলে চলে যায়। তিনি নিজে পরবর্তীতে ডাকাত দলে যোগদান করেন এবং ডাকাতদের সঙ্গে বহু স্থান ভ্রমণ করেন। ডাকাতদের সঙ্গে অবসর সময়ে তিনি ধর্মালোচনা করতেন। ডাকাতরা তাঁর ধর্মমতে মুগ্ধ হয়ে তাঁর অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং ক্রমে তাঁদের ধর্মবুদ্ধি জাগ্রত হওয়ায় তারা শরীয়তউল্লাহর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বলা হয় এই ডাকাতগণই ছিলেন তাঁর প্রথম শিষ্য। শরীয়তউল্লাহ এর পর তাঁর শিষ্যদল সহ ঢাকা জেলার নয়াবাড়ি অঞ্চলে উপস্থিত হন এবং গ্রামে গ্রামে ঘুরে ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। তিনি যেখানে গিয়েছেন সেখানেই বহু সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মুসলমান কৃষকরা তাঁর সরল ধর্মমতে মুগ্ধ হয়ে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কৃষকদের মধ্যে শরীয়তউল্লাহর ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করে জমিদারগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। স্থানীয় জমিদার আর ধনী মুসলমানরা তখন শরীয়তউল্লাহকে ঢাকা জেলা ছাড়তে বাধ্য করেন। শরীয়তউল্লাহ তখন জন্মস্থান ফরিদপুরে ফিরে এসে পল্লী অঞ্চলে ধর্ম প্রচার করতে লাগলেন।
শরীয়তউল্লাহর প্রচারিত ধর্মে ইসলামের ফরজ দিকগুলির প্রতি নজর দেয়া হলে তা ধর্ম ব্যবসায়ী মোল্লা মৌলভিদের বিরুদ্ধে চলে যায়। ইসলাম ধর্মে ‘ফরজ পালন অত্যাবশ্যকীয়’ শরীয়তউল্লাহর এই মতবাদ থেকেই ফরায়জী আন্দোলনের জন্ম। তিনি মুসলমান কৃষক কারিগরদের স্বার্থই সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছিলেন। সকল ধর্মীয় উৎপীড়কদের কবল থেকে উৎপীড়িত মুসলমান কৃষক ও শ্রমজীবীদেরকে রক্ষার দায়িত্ব নেন। মুসলমান ধর্মে ‘পীর’ ও ‘মুরিদ’ শব্দ দুটি ব্যবহৃত হতো। পীর শব্দে বুঝায় প্রভু আর মুরিদ শব্দে বুঝায় ‘অনুগত শিষ্য’। তিনি পীর মুরিদ শব্দের জায়গায় শিক্ষক শিক্ষার্থী মানে ওস্তাদ এবং সাগরেদ কথাটির প্রচলন করেন। শরীয়ত উল্লাহর ধর্ম সংস্কারে রক্ষণশীল ধনী মুসলমানগণ তাঁর উপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হলো। ভিন্ন দিকে ফরিদপুরের মুসলমান কৃষকরা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাঁর নেতৃত্বে জমিদারী শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠতে থাকলে জমিদাররা ভীত হয়ে পড়েন। অমলেন্দু দে জাানাচ্ছেন, ‘লক্ষণীয় এই যে, কোনো অর্থবান মুসলমান ফরায়জী মতবাদ গ্রহণ করেননি। তাছাড়া অনেক গোঁড়া মুসলমানও ফরায়জীদের দ্বারা প্রচারিত আচরণ-পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেননি। আর যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে ফরায়জী আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল তার সঙ্গে অর্থবান ও শহরবাসী মুসলমানদের স্বার্থ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না থাকায় তাঁরা ফরায়জীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচীতে আকৃষ্ট হননি। সুতরাং ফরায়জী মতবাদ নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদেরই উদ্বুদ্ধ করে এবং পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ মুসলিম সমাজে প্রসারিত হয়।
শরীয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসীন দুদুমিঞা পিতার কার্যভার গ্রহণ করেন। দুদুমিঞা-পরিচালিত ফরায়জীরা ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদ সাধন করে স্বাধীন ভারত বা স্বাধীন বঙ্গে ফরায়জীদের রাজ্য স্থাপনের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন সে কথা সরকারি বিবরণ থেকে জানা যায়। মুসলমান কৃষক, কারিগর প্রভৃতি জনসাধারণের প্রতি দুদুমিঞার গভীর দরদ এবং সকল প্রকার শোষণ হতে তাদের মুক্তির বাণী প্রচারের জন্য অল্পকালের মধ্যেই দরিদ্র মানুষের ‘বন্ধু, শিক্ষক এবং পিতার আসন’ লাভ করেন। দুদুমিঞা ফরিদপুর জেলার পল্লী অঞ্চলের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে প্রচার করতে লাগলেন যে, সকল মানুষই সমান এবং আল্লার সৃষ্ট এই পৃথিবীতে কর ধার্য করার অধিকার কারো নেই। দুদুমিঞার এই বাণী মুসলমান কৃষক ও শ্রমজীবী জনসাধারণের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারদের নানা নির্যাতনে দিশেহারা কৃষক এবং শ্রমজীবী মানুষরা এর মধ্যে খুঁজে পেল তাঁদের মুক্তির দিশা। শত প্রকার কর আদায়কারী জমিদার গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, জমিদার-নীলকর-মহাজনদের পৃষ্ঠপোষক এবং রক্ষক ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার সাহস পেল কৃষকরা দুদুমিঞার যুক্তিতে। দুদুমিঞার নেতৃত্বে জমিদার আর ইংরেজ শাসনকে অগ্রাহ্য করতে আরম্ভ করলো তারা। দুদুমিঞা তাঁর অনুসারীদের কাছে জ্বলন্ত ধর্মীয় নেতা এবং স্বাধীনতার প্রতীকরূপে দেখা দিলেন। তিনিই তাঁদের জমিজমার বিরোধের নিস্পত্তি করে দেন এবং নিজ অঞ্চলের বিচার-কার্য সম্পাদন করেন।
শশীভূষণ চৌধুরী দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, দুদুমিঞা নিজ অঞ্চলে ইংরেজদের শাসনের বিকল্প প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত করেন। গ্রামের ফরায়জী মতাবলম্বী বৃদ্ধ কৃষকদের অধীনেই বিচারালয় বসতো। সেই বিচারালয়কে অগ্রাহ্য করে কেউ ইংরেজদের বিচারালয়ে বিচারপ্রার্থী হলে তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হতো। ফরায়জীদের এই বিচারব্যবস্থা শীঘ্রই জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। জমিদারের প্রবর্তিত ‘পূজাকর’ সহ অন্যান্য অন্যায্য কর থেকে রক্ষা পাবার জন্য কৃষকরা দুদুমিঞার নিকট সাহায্যপ্রার্থী হলে তিনি সর্বশক্তি দিয়ে কৃষকদের রক্ষা করতেন। তিনি জমিদারের বিরুদ্ধে মামলা করার অর্থ সংগ্রহ করে দিতেন। প্রয়োজন মতো জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লাঠিয়াল দল পাঠাতেন। ফরায়জীরা এইভাবে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে হিন্দু জমিদার এবং ইউরোপীয় নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রবল শক্তিরূপে দেখা দিয়েছিল। দুদুমিঞা সংগ্রাম ঘোষণা করেছিলেন জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে। জমিদার-নীলকররা শুধু মুসলমান কৃষক নয়, হিন্দু কৃষকের শত্রু ছিল। তাই হিন্দু কৃষকরা দুদুমিঞার নেতৃত্বে এই সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলমান কৃষকের মিলিত শক্তিতে ফরায়জীদের আন্দোলন এইভাবে ক্রমশ ফরিদপুর, বিক্রমপুর, খুলনা, চব্বিশ পরগণা প্রভৃতি জেলায় বিস্তার লাভ করে। দুদুমিঞার নেতৃত্বে অন্তত পঞ্চাশ হাজার হিন্দু-মুসলমান কৃষক যে কোনো সময়ে জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত ছিল।
সরকারি নথিপত্রে দেখা যায়, দুদুমিঞা তার পরিকল্পিত স্বাধীন ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসেবে এক অপূর্ব সংগঠন স্থাপন করেছিলেন। সমগ্র পূর্ববঙ্গকে কতিপয় অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রত্যেক অঞ্চলে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে একজন খলিফা নিযুক্ত করেন। এই খলিফাগণ নিজ নিজ অঞ্চলের সকল ফরায়জী মতাবলম্বীদের একতাবদ্ধ রাখতেন, তাদের উপর যাতে কোনো উৎপীড়ন না হয় তার ব্যবস্থা করতেন। এই খলিফা বা প্রতিনিধিগণ দুদুমিঞাকে নিয়মিতভাবে নিজ নিজ অঞ্চলের সকল সংবাদ জ্ঞাপন করতেন। যে-স্থানে জমিদাররা কৃষকদের উপর অন্যায় কর বসাতেন বা উৎপীড়ন করতেন, সেই স্থানেই কেন্দ্রীয় তহবিল গঠন করে ইংরেজদের আদালতে জমিদারের বিরুদ্ধে মামলা চালানো হতো, কিংবা লাঠিয়াল দল পাঠিয়ে জমিদার এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের শান্তি দেওয়া হতো। ফলে সকল জমিদার আর নীলকরগণ দুদুমিঞার বিরুদ্ধে একত্র হলেন। দুদুমিঞাকে প্রচলিত মুসলমান ধর্মের সংস্কার সাধন করতে দেখে রক্ষণশীল মুসলমানগণ পূর্ব থেকেই দুদুমিঞার উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। দুদুমিঞা একদল ভণ্ডপীরকে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করতে দেখে তিনি প্রকৃত ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। তিনি সেখানে মুসলমানদের ফরজ পালন বা মূল প্রার্থনা পালনের প্রতি জোর দেন। ধর্মের নামে বুজরুকি বা ধর্মের নামে নানা ফন্দিতে গরীবের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। মুসলমানদের সেই অংশটি জমিদার আর নীলকরদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ফরায়জীদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
ফলে ভারতবর্ষে বা বাংলায় কখনো এরকম ঘটনা ঘটেনি যে, মুসলমানরা সব একদিকে ছিল আর সব হিন্দুরা অন্যদিকে। হিন্দুরা বিরাট এক পক্ষ হয়ে সকল মুসলিমদের বিরুদ্ধে কখনো লড়াই করেনি। খুব স্পষ্টভাবে তা প্রমাণ করে, বাংলায় হিন্দু আর মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি সাম্প্রদায়িক আক্রমন কখনো হয়নি। সকল সময় হিন্দু-মুসলমান কৃষকরা একদিকে ছিল, ভিন্ন দিকে ছিল সুবিধাভোগী হিন্দু-মুসলমানরা। বাস্তবতা হলো এই যে, মুসলমানদের মধ্যে জমিদার, অভিজাত বা ভদ্রলোকের সংখ্যা সবসময় কম ছিল। ফলে হিন্দু-মুসলমান কৃষকরা যখন মিলিতভাবে জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সেখানে মুসলমান জমিদার ছিল হাতে গোনা। হিন্দু ভদ্রলোকরা সে-কারণে তিতুমীরের আর দুদুমিঞার নেতৃত্বে কৃষকদের আক্রমণকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছে। কারণ কৃষকদের পক্ষের দুজন প্রধান নেতাই ছিলেন মুসলমান। কিন্তু তাদের দলে যে বহু হিন্দু কৃষকরা যুক্ত হয়েছিলেন সেটা তাঁদের অনেকে সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। মনে রাখতে হবে ভারতে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলছে ন্যূনতম আড়াই হাজার বছর ধরে। চার্বাকদের সংগ্রাম, বৌদ্ধ আর জৈনদের সংগ্রাম, নিম্নবর্গের সংগ্রাম। ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের সংগ্রাম আজও থামেনি। যতদিন ভারত থেকে জাতপাতের প্রশ্ন সম্পূর্ণভাবে উধাও না হবে তা থামবে না। সকলরকম শ্রেণী সংগ্রামের সঙ্গে যেমন পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলবে, ঠিক একইভাবে সকল রকম শ্রেণী সংগ্রামের পাশাপাশি ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে বা ব্রাহ্মন্যধর্মের বা বর্তমান হিন্দুধর্মের বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলবে। স্মরণ রাখকে হবে, পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম যেমন সাম্প্রদায়িক সংগ্রাম নয়, ঠিক তেমনি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামটা সাম্প্রদায়িক সংগ্রাম নয়। দুটাই শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, মার্কসবাদীদের মতে যেটা শ্রেণীসংগ্রাম।
ব্রাহ্মণ বা বর্ণবাদীরা যে শোষণ চালিয়ে আসছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে, সাম্প্রদায়িক সংগ্রাম বলে বর্ণবাদীরা নিম্নবর্গের মানুষকে নিজেদের সঙ্গে পেতে চায়। নিজেদের দল ভারী করার জন্য। বছরের পর বছর ধরে সেই খেলাটা চলছে। কিন্তু ভারতের মুসলমানরা কারা? নব্বই শতাংশের বেশি নিম্নবর্গের হিন্দুরা, অন্ত্যজরা; যাঁরা বর্ণহিন্দুদের নিস্পেষণ থেকে মুক্তি পেতে মধ্যযুগে মুসলমান হয়েছে। বাংলায় মধ্যবিত্তশ্রেণীর কাতারে এঁরা বহুকাল জায়গা পায়নি। ধর্মান্তরিত মুসলমানদের একাংশ মধ্যবিত্তের মধ্যে জায়গা পেয়েছে সেদিন, তিতুমীরের আন্দোলন আর ফরায়জী আন্দোলনের বহু পরে। মূলত পাট ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলায় প্রথম মধ্যবিত্তশ্রেণীর জন্ম। বাংলার এই মধ্যবিত্তশ্রেণীর বড় অংশটাই যে-কারণেই হোক নিজের ইতিহাসটা জানেন না। বা তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবনা চিন্তা করেন না। পক্ষান্তরে নিম্নবর্গের মুসলমানদের থেকে দূরে সরে থাকেন। মনে করেন সেটাই তার আভিজাত্য আর প্রগতিশীলতা। মধ্যযুগ থেকে নিম্নবর্গের মানুষের বহু প্রগতিশীল ভূমিকা রয়েছে রাজনীতিতে, হিন্দু-মুসলমান মিলিতভাবে সেই ভূমিকা রেখেছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার বা তার পূর্ব-পুরুষের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। নিম্নবর্গের হিন্দুদের সঙ্গে মিলেমিশে তারাই ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছে আবার তারাই বর্ণহিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়েছে আবার তারাই মুসলমান ধনী-শোষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। মুসলিম শাসনে ভারতের বৃহত্তর বর্ণহিন্দুরা আর স্বল্প সংখ্যক অভিজাত মুসলমানরা ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল। মুসলিম শাসনে বর্ণহিন্দুরা তাদের প্রতিপত্তি হারায়নি, ঠিক তেমনি নিম্নবর্গের যে হিন্দুরা মুসলমান হয়েছিল সামগ্রিকভাবে তারাও বাড়তি কোনো সুবিধা পায়নি। সমাজের উচ্চস্তরে থাকা হিন্দু-মুসলমানরাই সকল ক্ষমতা ভোগ করেছে, আর তারাই ছিল শাসক আর শোষক। কখনো ধনী হিন্দুরা গরীব হিন্দুর বন্ধু হয়নি, কখনো গরীব মুসলমানরা ধনী মুসলমানের অতিথি ছিল না। বরং ধনী হিন্দু-মুসলমানরা পরস্পরের গৃহে অতিথি হিসেবে আপ্যায়িত হয়েছে। দুপক্ষই শোষক হিসেবে দরিদ্র হিন্দু-মুসলমানের ছোঁয়া বাচিয়ে নিজেদের আভিজাত্য রক্ষা করেছে। মধ্যযুগে কৃষক হিন্দু-মুসলমানরা দরিদ্র কৃষকই থেকে গিয়েছিল। ফলে মধ্যযুগ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান হিসেবে তাদের মধ্যে কখনো সামান্য কোনো বিরোধ দেখা দেয়নি। চলবে