সাম্প্রদায়িকতা সবথেকে বড় অস্ত্র

রহমান মুফিজ

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৩, ২০১৯

‘সাম্প্রদায়িকতা’ একটা শতভাগ পলিটিক্যাল টার্ম। আমাদের দেশে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সম্প্রীতি যেমন আছে তেমনি একটা অবৈরি দ্বন্দ্বও আছে। কিন্তু সেটাকে বৈরিতার পর্যায়ে নিয়া যাওয়া বা উগ্রতার পর্যায়ে নিয়া গিয়া তার মধ্য দিয়া ব্যক্তিক, গোষ্টীক ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টাটারেই কয় সাম্প্রদায়িকতা। আমরা সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে অবৈরি দ্বন্দ্বটাকেও নির্মূল করতে চাই। এই মানসিকতারে কয় অসাম্প্রদায়িকতা। মনে রাখা দরকার, এ দেশে সব ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা সহিংসতার পেছনে রয়েছে রাজনীতি।

সাধারণ মানুষের সরল অনুভূতিকে খুঁচায়া, উস্কায়া উগ্র কইরা তুইলা তারে ব্যবহার কইরা কায়েমী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বারবার লাভবান হইছে। সাধারণ মানুষের তাতে বিন্দুমাত্র লাভ হয় নাই। কখনোই হয় নাই। সহিংসতায় প্রাণ, ভিটামাটি, বন্ধু, স্বজন, আত্মীয় সব হারাইছে সরল অবুঝ মানুষগুলা। সাম্প্রদায়িকতা একসময় পৃষ্ঠপোষকতা পাইতো সমাজের প্রভাবশালী, ক্ষমতাধর শ্রেণিটার হাতে। এখন এদের সঙ্গে যুক্ত হইছে রাষ্ট্র নামীয় প্রকাণ্ড এক দৈত্য।

এ দেশে শাসকশ্রেণির দুটি প্রধান বলয় প্রয়োজনমতো সাম্প্রদায়িক সহিংসতারে উসকায়া দেয়। একটা হইলো, ক্ষমতাসীন বলয় আরেকটা ক্ষমতার বাইরে থাকা বলয়। ক্ষমতাসীন বলয়টা একটু বাড়তি সুবিধা পায়, কারণ তার সঙ্গে থাকে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র। আর ক্ষমতার বাইরের বলয়টার হাতে থাকে নানা উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক গোষ্ঠী; যারা গাছেরটাও খায় তলারটাও কুড়ায়। এরা ঝোপ বুইঝা কোপাইতে ওস্তাদ। সুযোগের সন্ধানে থাকে এরা। শাসকশ্রেণির দুই বলয়ই এদের ব্যবহার করতে পারে নানা রাজনৈতিক উপঢৌকনের বিনিময়ে। সাধারণ মানুষ কেবল ক্ষমতার রাজনীতির কাঁচামাল হিসাবেই ব্যবহৃত হয়।

সরকারের অব্যাহত অবিচার, অনিয়ম, জুলুম, লুটপাট আর বদমায়েশির বিরুদ্ধে মানুষের যখন ফুঁসে ওঠার নানা বাস্তবতা তৈরি হয় তখন জনগনের ক্ষোভ ও রোষকে ভিন্নখাতে নিয়া যাইতে নানা কৌশল প্রয়োগ করে ক্ষমতাসীনরা। সাম্প্রাদায়িকতা এর মধ্যে সবথেকে বড় অস্ত্র। রাষ্ট্রের ক্ষত, সরকারের ব্যর্থতা বা বুজরুকি ঢাকতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার চেয়ে নিরাপদ তাদের কাছে আর কিছুই নাই। একটু উত্তেজনা, দুয়েকটা প্রাণপাত, রক্তপাত ইত্যাদির বিনিময়ে অন্তত বেশকিছুদিন নির্বিঘ্নে থাকে সরকার। এসব খেলার মাধ্যমে রাষ্ট্র বা সরকারের মূল সঙ্কট থেইকা মানুষকে দূরে রাখা যায়। এর মধ্য দিয়া সরকারও নানা এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার বাড়তি সুবিধা পায়।

অন্যদিকে ক্ষমতার বাইরে থাকা বলয়টাও সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে উস্কায় শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাওয়ার পথ প্রসারিত করতে। যে কোনো ধরনের অস্থিরতা তৈরি কইরা সরকারকে বেকায়দায় ফেইলা এমন একটা রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈয়ার করার চেষ্টা মত্ত থাকে, যেখানে দাঁড়ায়া তারা বলতে পারে সরকার মুসলমান/হিন্দু মারছে, প্রতিবাদ দমাচ্ছে। যাতে তারা বলতে পারে, তোমরা সরকার চালাইতে না পারলে ছাইড়া যাও।

এই যে এই সাম্প্রদায়িক বুজরুকি, ধর্মীয় উন্মাদনা তার সব ফল যতটা না এ দেশের শাসকশ্রেণি ভোগ করে, তার চাইতে বেশি ভোগ করে আবার ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলা। আগেও বলছি, এখানে দুয়েকটা হিন্দু মারতে পারলে ভারতে বিজেপি যে মুসলমানদের ওপর খড়গহস্ত হচ্ছে, সেটা জায়েজ হয়। তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত হয়। তো আওয়ামী লীগ কি বিজেপির ক্ষমতা পোক্ত করার মিশন নিয়া নামসে? নাকি বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগরে টপকায়া বিজেপির খাস লোক হওয়ার চেষ্টা করতেছে— এটা বোঝা মুশকিল।

বড় কঠিন অঙ্ক! যেহেতু এইটা একটা রাজনীতির খেলা, সেহেতু মানুষের সাবধান হওন দরকার, চোখ-কান খোলা রাখা দরকার তারা আসলে কার খেলায় মদদ যোগাইতেছে। সাধারণ মানুষ হয়তো এত জটিল বিষয় বুঝে না। যারা নিজেদের সামান্য অগ্রসর বলেও দাবি করেন, দেশপ্রেমিক বলে দাবি করেন, তাদের অন্তত উচিত এই রাজনীতির ভেদ মাইনষেরে বোঝানো। দেশের রাজনীতিতে কি ঘটতেছে, পাশের দেশে বা দূরের দেশে কী ঘটতেছে, কোন দেশের সঙ্গে কী চুক্তি হইতেছে— এইগুলা একটু খেয়াল কইরা চলতে পারলে অনেক অঙ্কই সহজ হয়া যায়। কারণ, এইটাতো জানা হয়ে গেছে যে, সহিংসতা দিয়া, রক্তপাত দিয়া ধর্ম তো কখনোই রক্ষা হই নাই। রক্ষা হইছে বদমাইশদের ক্ষমতা।

তো এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হইলো, জনগণ এইসব ফাসেকি কামে শক্তি ক্ষয় কইরা কি বদমাইশদের ক্ষমতা নির্বিঘ্ন করবে নাকি সে শক্তি সঞ্চয় কইরা বিনাবিচারে খুন, গুম, সীমাহীন লুটপাট, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও বর্বর সাম্প্রদায়িকতায় নিমজ্জমান রাষ্ট্রের বুকে একটা সজোরে লাথি মারবে?

লেখক: কবি ও গণমাধ্যমকর্মী