সাম্প্রতিক সহিংসতার কবিতায় রক্তাক্ত বাংলাদেশ

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : আগস্ট ২৩, ২০২৪

চোখ খুলে দেখা আমাদের এই জগৎ আর শিল্পের জগতের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আকাশে ঝকঝকে চাঁদ উঠেছে। এই চাঁদ আমরা দেখছি। ভালো লাগছে, তাই দেখছি। এর বাইরে আর কোনো উপলব্ধি আমাদের ভেতর তৈরি হবে না। কিন্তু যখন পড়ি, বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই, তখন বাস্তবে দেখা চাঁদের চেয়েও অনেক বেশি বাস্তব চাঁদ আমরা আমাদের অন্তর্জগতে দেখতে পাই। কেন এরকম ঘটে? ঘটে কারণ, আমাদের কল্পনার রঙ বাস্তবের রঙের চেয়ে আমাদের বেশি ঘনিষ্ঠ। আমাদের বোধের জগৎকে রাঙিয়ে যা কল্পনা হিসেবে ফুটে ওঠে, সেখানে আমাদের নিজের মতো করে দেখার চোখ তৈরি হয়। যে কোনো শিল্প ঠিক এই কাজটিই করে। শিল্পকর্মকে আমাদের বোধের রঙে রাঙিয়ে তোলে। আরসব শিল্পের মতো কবিতাও ঠিক এই কাজটিই করে। বোধের জগতে লুকিয়ে থাকা উপলব্ধিকে নানা রঙে রাঙিয়ে তোলাই মূলত কবিতার কাজ।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ঘটে গেল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। সরকার উৎখাতের আন্দোলনে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় গণঅভ্যুত্থান। ছাত্র-জনতার ওপর চালানো হয় গুলি। জানা যাচ্ছে, পাঁচশোর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। টালমাটাল ওই সময়ে দেশবাসী রক্তাক্ত যে বাংলাদেশ দেখল সেই বাংলাদেশকে দেশের কবিসমাজ কিভাবে দেখেছেন? আমরা জানি, সাধারণ মানুষের দেখার চোখ আর কবিদের দেখার চোখ আলাদা। সাধারণ মানুষ চোখের সামনে যা দেখছে সেই দেখার চিত্র থেকেই গভীরতর মানে খুঁজে বের করার এক প্রকার কৌশল হচ্ছে কবিতা। গণহত্যার সময়ে তাৎক্ষণিকভাবে অনেক কবি রক্তাক্ত সময়কে ধারণ করে কবিতা লিখেছেন। সেসব কবিতা শেয়ার দিয়েছেন ফেসবুকে। সেখান থেকে নিয়ে কয়েকটি কবিতার ওপর আমরা চোখ বোলাবো। দেখবো যে, সেসব কবিতায় ওই সময়ের রক্তাক্ত বাংলাদেশের স্বরূপ কিভাবে উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হয়েছে। এই প্রয়াস বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষ একটি সময়ের দলিল হিসেবে থেকে যাবে, সন্দেহ নেই।

তখনই সাহসের জাগরণ ঘটে গেল
আবু সাঈদের বক্ষ ভেদ করা গুলি
যখন জনতার বুকে এসে লাগল!
আমি নির্বাক হয়ে দেখলাম
হৃদয় গুলিবিদ্ধ হলে মানুষ
অপ্রতিরোধ্যভাবে জেগে ওঠে;
যার সামনে এসে থমকে যায়
এমনকি ছুটে আসা সীসার বুলেট!
          সাহস/কামরুজ্জামান কামু

সরকার উৎখাতের আন্দোলনের প্রথম শহিদ আবু সাঈদ রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। আন্দোলনের সময় তিনি দুই হাত প্রসারিত করে পুলিশের সামনে দাঁড়ান। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সবার আগে এগিয়ে আসে ছাত্রসমাজ। সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। তারা পরিবার নিয়ে নীরিহ জীবন কাটাতে চায়। এই সুযোগে সাধারণ মানুষকে শোষণ করে একদল ক্ষমতাবান মানুষ। ছাত্ররা কিন্তু ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে ভয় পায় না। কারণ, তাদের শরীরে বইছে তারুণ্যের টগবগে রক্ত। চোখে জ্বলছে জ্ঞানের মশাল। জ্ঞানের আলোয় তারা দেখতে পায় অত্যাচারীর থাবার নিচে অন্ধকারে বাস করছে জাতি। জাতিকে মুক্ত করতে নানা সময়ে ছাত্ররা আন্দোলনে রাজপথে নেমেছে। তাদের রক্তে ভিজে উঠেছে বাংলার শ্যামল মাটি। সাধারণ মানুষ যে বাংলাদেশ আশা করে, ছাত্রসমাজ সেই বাংলাদেশ নির্মাণ করতে রাজপথে নেমে আসে। ছাত্রদের চোখেই সাধারণ মানুষ নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দ্যাখে।

সাধারণ মানুষের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতেই সাঈদ বীরের মতো পুলিশের বুলেটের সামনে বুক পেতে দেন। তিনি শহিদ হওয়ার পরপরই ক্ষোভে জ্বলে ওঠে ছাত্র-জনতা। প্রায় সাড়ে ১৫ বছর সাধারণ মানুষ সরকারের দুঃশাসনে কেবল হা-হুতাশ করেছে। সাহস করে প্রতিবাদের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করতে পারেনি। কামু অবাক হয়ে দেখলেন, সাঈদের আত্মত্যাগ সাধারণ মানুষের ভেতর স্বাধীনতার স্পৃহাকে জাগিয়ে তুললো। সাহসী হয়ে দেশের মানুষ দলে দলে নেমে এলো রাজপথে।  নির্বিচারে গুলি চালানো হলো ছাত্র-জনতার ওপর। বাংলার সবুজ-শ্যামল প্রান্তর মুহূর্তে রক্তজবার রঙে রাঙিয়ে গেল।

রক্তজবা ভেসে যাচ্ছে অঝোর শ্রাবণে...
এক লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে
কীভাবে মুছে ফেলবে তরুণ জবার দাগ!
হোসেন, আহাদ, তাহমিদ, রিয়া গোপ...
দেবদূতের মতো ছোট-ছোট নিষ্পাপ শিশুদের—
হত্যা করা হলো কোন অপরাধে?
সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে দুর্যোধন-মেঘ
এখন সময় সত্য উচ্চারণের, স্রোতের প্রতিকূলে—
থেকেও যে নির্দ্বিধায় সত্য উচ্চারণ করতে পারে
সেই তো প্রকৃত সাহসী— এই সময়ের অর্জুন।
এই রক্তাক্ত জনপদে সময়ই সবচেয়ে বড় বিচারক
বন্দুকের নল একদিন ঘুরে যাবে হন্তারকের দিকে।
                               রক্তাক্ত শ্রাবণ/শাহেদ কায়েস

শহিদ শিক্ষার্থীদেরকে শহিদি রক্তকে শ্রাবণের বৃষ্টিধারায় রক্তজবার মতো বাংলাদেশজুড়ে ভেসে যেতে দেখছেন শাহেদ কায়েস। তিনি প্রশ্ন তুলছেন, দেবদূতের মতো নিষ্পাপ শিশুদের বুক গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হলো কোন অপরাধে? শাহেদের এই প্রশ্ন নিঃসন্দেহে সাহসী উচ্চারণ। তখনো নির্ধারিত হয়নি সরকার পতন। ফ্যাসিস্ট হাসিনার নির্যাতনের ভয়কে উপেক্ষা করে শাহেদের প্রশ্নের এই তীর সত্যের প্রতি তার নির্ভীক অবস্থান ব্যক্ত করে। তিনি বলছেন, সরকারপ্রধান সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন। তিনি দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছেন, এখনই সত্য উচ্চারণের সময়। সর্বগ্রাসী মহাপ্লাবনের মতো ফ্যাসিস্টের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যে এই মুহূর্তে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করতে পারবে সে-ই প্রকৃত সাহসী। কারণ শাহেদ জানেন, সময়ই সবচেয়ে বড় বিচারক। শাহেদ বিশ্বাস করেন, যে বন্দুকের নল আজকে বাংলাদেশের বুককে রক্তাক্ত করছে সেই বন্দুকের নলই সময়ের পটপরিবর্তনে হত্যাকারীর বুককে রক্তাক্ত করবে। করতেই হবে। এটাই প্রকৃতির বিধান। নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র বলছে, প্রত্যেক ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া আছে।

রক্তের রঙ রক্তজবা
কালো নয় কালো নয়
কাক কখনো কোকিল নয়।

চোখে গুলি বুকে গুলি
আমার শিশু আমার কোলে
ঢলে পড়ে ঝরে পড়ে।

দ্রোহের রঙ রক্তজবা
জীবনের রঙ রক্তজবা
ঘুমন্তরা জাগো রে...।
      রক্তের রঙ রক্তজবা/মাহবুব কবির

মাহবুব কবিরের প্রত্যেকটি কবিতাই আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহৃত পরিচিত শব্দের বুননে নির্মিত। এই কবিতাতেও সেই বৈশিষ্ট্য আমাদের চোখে পড়ে। এই কবিতার এক-একটি শব্দ যেন এক-একটি তীর। কোলের শিশু গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ছে কবির বুকে। কবি এখানে দেশের মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন। শিশুদের রক্তে রক্তজবার রঙে রাঙিয়ে যাচ্ছে শত-শত বাবা-মায়ের বুক। নির্বিচারে চালানো হচ্ছে গুলি। ছাত্র-জনতার চোখে, বুকে ও মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যাচ্ছে তপ্ত সীসা। দেশের মানুষের আর্তনাদে বাংলার বাতাস কেঁপে-কেঁপে উঠছে। তবু কাঁপছে না ফ্যাসিস্টের বুক। দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেশকে পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো। দেশবাসীকে চলমান পরিস্থিতির তথ্য জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হলো। শুরু হলো গণহত্যা। এই হত্যার বিরুদ্ধে দেশবাসীকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আহ্বান জানাচ্ছেন মাহবুব। তিনি বলছেন, রক্তের রঙই কেবল রক্তজবা নয়, দ্রোহ ও জীবনের রঙও রক্তজবা। রক্তাক্ত এই সময়ে আর ঘুমিয়ে থাকা চলবে না। ঘুম থেকে এবার সবাইকে জেগে উঠতে হবে। প্রতিরোধের আন্দোলনে উৎখাত করতে হবে অত্যাচারী শাসককে। ‘রক্তের রঙ রক্তজবা’ এখানে সময়ের প্রয়োজনে গণমানুষের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। শিল্পের ইতিহাসে কবিতাকে এইভাবে হাতিয়ার হয়ে উঠতে দেখা গেছে বহুবার। ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশের অসংখ্য এ কবিতা এই সত্য বহন করছে।

নেমে আসে দ্রুত দুর্দমনীয়
তেজি মানুষের ঢল
ফুঁসে ওঠে ক্রমে পুরো বদ্বীপের
নদনদী ঢেউজল।
লক্ষ্যে অটুট, দৃঢ়, অবিচল,
মরিয়া, দুর্নিবার
দুঃসাধ্যকে ঠিকই করে তোলে
সম্পাদ্য সবার।
......
ঘটিয়ে পুরনো ভিত-কাঠামোর
পুরোপুরি অবসান,
উদিত হয় যে নতুন কাঠামো
নতুন সংবিধান।
                   মুক্তিসংগ্রাম/মাসুদ খান

শোষণের কাল সুদীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে না। বিশ্বের ইতিহাসে অনেক অত্যাচারীর শাসকের গল্প আমরা পড়েছি। কেউ-ই শেষপর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেনি। শোষিত মানুষ একটা সময়ে ফুঁসে উঠেছে। পথে-পথে প্রতিবাদী মানুষের ঢল নেমে আসে। যে ঢল কোনোভাবেই দমন করা শোষকের পক্ষে সম্ভব নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ নামের বদ্বীপে মানুষের যে ঢল নেমে এসেছিল, শাসকগোষ্ঠি সেই দৃঢ়চেতা আন্দোলনকে কোনো উপায়েই প্রতিহত করতে পারেনি। যা ছিল দুঃসাধ্য, দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে তা সবার জন্য সহজ হয়ে যায়। কবিতার শেষ স্তবকে কবি আশা প্রকাশ করছেন, পুরনো শাসনের অবসান ঘটিয়ে নতুন শাসন-ব্যবস্থার সংবিধান প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। যে সংবিধান হবে জনকল্যাণমূলক। জনগণের শোষণের কোনো ফাঁক-ফোকর যে সংবিধানে আর থাকবে না।

কতকাল পরে আসবে নতুন কাল
প্রতীক্ষা করে কে আর পেয়েছে তাকে
আমাদেরই খুনে দিগন্ত হবে লাল
সে আলো ছড়াবে বাংলার বাঁকে বাঁকে।
.......
প্রাণগুলো সব প্রতিবাদ হয়ে ফোটে
দাবায়ে রাখতে পারবা না কোনো কালে
মরতে মরতে বারবার বেঁচে উঠে
এই গান যেন লড়াইয়ের কথা বলে।
             দিগন্ত হবে লাল/ফিরোজ এহতেশাম

ফ্যাসিস্ট সরকারের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, গুলি চালিয়ে কয়েকশো ছাত্র-জনতাকে মেরে ফেললেই বুঝি ভয় ও আতঙ্কে গণ-অভ্যুত্থান থেমে যাবে। কিন্তু তা ঘটেনি। বরং পুলিশের গুলিতে যত প্রাণ ঝরেছে তারচেয়ে বেশি প্রাণ বাংলার প্রতিটি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আন্দোলনে মুখর করে তুলেছে রাজপথ। যে মানুষ মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়েই এসেছে, তাকে কি বারবার মেরে ফেলা যায়? আমরা যদি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্মরণ করি দেখব যে, হানাদার বাহিনী তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও মৃত্যুপ্রতিক্ষ বাঙালিকে বারবার মারতে পারেনি। ফ্যাসিস্ট সরকারপ্রধানের পক্ষেও সেটা সম্ভব হয়নি। ভাবতে অবাক লাগে, নিজের দেশের মানুষকে কিভাবে এত নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারলেন শেখ হাসিনা? যে দেশটি গড়ে তুলেছিলেন তার পিতা? পাকিস্তানিরা বিজাতীয়। আমাদের বুকে গুলি চালাতে তাদের তেমন মমতা থাকার কথাও নয়। কিন্তু হাসিনা তো এই দেশেরই সন্তান। এই বাংলার জলমাটি ও বাতাসে তার বেড়ে ওঠা। তিনি কিভাবে পারলেন সেই দেশকে রক্তাক্ত করতে? তিনি কি ভেবেই নিয়েছিলেন দেশটা তার বাপের? যেহেতু বাপের, সেহেতু উত্তরাধিকার সূত্রে এই দেশটার কর্তৃত্ব একমাত্র তারই।

উত্তাল গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে একটি গান বারবার বেজে উঠতে শোনা গেছে। মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে গানের কথাগুলো। ইথুন বাবুর লেখা সেই গানের শব্দ-বুনন লক্ষ্য করলে সেটাকে কবিতা হিসেবে পড়তে সমস্যা হয় না। তো পড়া যাক:

দেশটা তোমার বাপের নাকি করছ ছলাকলা
কিছু বললে ধরছ চেপে জনগণের গলা।
মনে রেখো যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে দেশ পেয়েছি
দেশ দেশ দেশ বাঁচাতে রক্ত দিতে রাজি আছি।
ভয় দেখিয়ে হবে না রে কাম
ও বাছারাম।
লুট করে চুরি করে পালাবে কোথায়
দাঁড়িয়ে আছে জনগণ তোমার পাহারায়।
উন্নয়নের কথা বলে করছ সর্বনাশ
জনগণের গলা টিপে দিচ্ছ তাদের ফাঁস।

গানের কথাগুলো এতটা জনপ্রিয় হওয়ার কারণ কি? খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, গানের প্রতিটি কথাই যেন দেশের মানুষের কথা। তাদের দীর্ঘদিনের প্রাণের ভেতর পুষে রাখা ক্ষোভ। দেশবাসী প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে শুনছে হাসিনা ও তার মন্ত্রীরা দেশের ইন্নয়নের কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন। অথচ দেশের মানুষ চোখের সামনে দেখছে আওয়ামী লীগ দেশজুড়ে লুটপাট করছে। এসব দেখেশুনে দেশবাসীর প্রশ্ন ছিল, রে হাসিনা, দেশটা কি তোমার বাপের? উত্তাল গণ-আন্দোলনের সময়ে গানটি যখন প্রচারিত হয় তখন সহজেই দেশের মানুষ গানের কথাগুলোর সাথে নিজের মনের কথাগুলো জানান দেওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল। ফলে, গানটি হয়ে উঠলো বাংলার জাগরণের গান। মানুষ জেগে উঠল। শহিদ হলো কয়েকশো মানুষ। তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু এরপর? এরপর যে কী তা জানিয়ে নব্বইয়ের নির্ভীক কবি সাজ্জাদ বিপ্লব ‘বিজয়’ কবিতায় লিখছেন:

কোনো বিজয়ই শেষ কথা নয়
এখনো অনেক পথ যেতে হবে
পার হতে হবে অনেক ঝড় ও ঝঞ্ঝা
প্রলোভন প্ররোচনা ঘুরবে তোমার আশপাশে
তুমি থাকবে অটল।

আপাত মনে হচ্ছে যে, আমরা স্বাধীন হয়েছি। জনগণের বিজয় অর্জিত হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। দেশের কল্যাণে দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে। মূর্খের পক্ষে দেশের কল্যাণ সাধন করা সম্ভব নয়। নিজের কল্যাণও মূর্খেরা করতে পারে না। কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, সেই বিবেচনা বোধ থাকতে হবে। বাংলাদেশে যেহেতু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেহেতু জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে নৈতিক মানদণ্ড দিয়ে। জ্ঞান দিয়ে। নিজের আখের গোছানোর ফিকিরে আমরা যদি জনপ্রতিনিধি কিংবা রাজনৈতিক দল নির্বাচন করি তাহলে আবারও আরেকটি ফ্যাসিস্ট সরকার এই দেশে জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসবে। সেই পাথরকে নামাতে আবারও রাজপথ ভিজে উঠবে কয়েকশো বাঙালির রক্তে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না। আমাদের চিন্তা থাকবে, নিজ পরিবার নিয়ে কেবল আমি একাই সুখে থাকবো না, দেশের সবাইকে নিয়েই আমি সুখে থাকবো। মনে রাখতে হবে, পরিবার হচ্ছে ব্যক্তির ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান। আর রাষ্ট্র হচ্ছে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান।

শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পরপরই আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগ নেতাদের আলিশান বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বপরিবারে পুড়ে মারা গেছেন অনেক নেতা। তারা দেশের সবাইকে নিয়ে সুখে থাকার চেষ্টা করেনি। নিজের পরিবার ও নিজের সুখই ছিল তাদের একমাত্র চিন্তা। কিন্তু সত্যিই কি সুখে তারা থাকতে পেরেছে? ইতিহাস থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এখন নতুন স্বপ্নে বাংলাদেশ হাসছে। বাংলার জনগণ এখন নতুনভাবে দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে। এরই মধ্যে রাষ্ট্র মেরামতের কাজও শুরু হয়ে গেছে।

রক্তাক্ত যে বাংলাদেশ এখন আমাদের সামনে সেই বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যুগে যুগে বাঙালির বীরত্ব আর দৃঢ় মনোবলের কথা। যে কোনো ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে বাঙালি সঠিক সময়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, বাংলাদেশের ইতিহাসের এর প্রমাণ রয়েছে। যারা ইতিহাস ভুলে বাঙালিকে দুর্বল জ্ঞান করে তারা আসলে নিজেই নিজের কবর রচনা করে। বাংলাদেশকে নতুনভাবে সাজিয়ে তুলতে ইতিহাসের দিকে চোখ রেখে আমাদেরকে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোতে হবে।