সামান্য প্রাপ্তি, অসামান্য বেদনা

নাটক

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : আগস্ট ২২, ২০২০

(চট্টগ্রাম। ট্রেন স্টেশন। স্টেশনে যাত্রীর ভিড়। তারমধ্যে দেখা যায়, ছত্রিশ বছরের এক যুবককে ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করতে। যুবক এগিয়ে যায়। যাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে যুবকের কিছুটা পেছনে এগিয়ে আসতে দেখা যায় মালা ও রাশেদকে। স্টেশনে প্লাটফরমে একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে। যুবক এগিয়ে গিয়ে প্রথম শ্রেণির কামরায় ওঠে। প্রথম শ্রেণির কামরার ভিতর যুবককে দেখা যায় নিজের ব্যাগ রেখে জানালার পাশে একটি আসনে বসেছে। কিছুক্ষণ পর মালা ও রাশেদ উঠে আসে সেই কামরায় এবং যুবকের সামনে এসে দাঁড়ায়। রাশেদ কিছুটা ইতস্তত করে যুবকের সাথে পরিচিত হয়।)

রাশেদ: আমি ক্যাপ্টেন রাশেদ। আপনি কোথায় যাবেন?
যুবক: আমি ঢাকা যাব।  
রাশেদ: ও আমার স্ত্রী। আপনার উল্টোদিকের এই আসনটি আমার স্ত্রীর। সে ভৈরব পর্যন্ত যাবে।
যুবক: আচ্ছা, আচ্ছা।
রাশেদ: আমার স্ত্রী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে অর্থনীতি বিভাগে।  ভাইয়ের বিয়েতে ভৈরব যাচ্ছে।
যুবক: (রাশেদকে) তারমানে আপনি যাচ্ছেন না?
রাশেদ: ছুটি পাওয়া যায়নি। মূল বিয়েতে যাব। কাল হলুদ অনুষ্ঠান, সেখানে থাকতে পারব না।  
যুবক: বুঝতে পেরেছি। (মিষ্টি হেসে) স্ত্রীর সাথে যেতে পারছেন না বলে মন খারাপ লাগছে?
রাশেদ: (উত্তরে মিষ্টি হাসি দেয়।) ওর শরীরটা ভালো নয়, সেজন্য একা ছাড়তে খারাপ লাগছিল। ও একটু নার্ভাস টাইপের।
যুবক: নার্ভাস টাইপের নাকি? দেখে তো মনে হয় না।
রাশেদ: খুবই নার্ভাস টাইপের। কোনো সমস্যা হলে একটু নজর রাখবেন।
যুবক: নিশ্চয়। কতদিন হয় আপনাদের বিয়ে হলো?
রাশেদ: বছর খানেক হবে।
যুবক: ঠিক আছে, আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি খেয়াল রাখবো তার দিকে। কিন্তু একটা কথা বলি, তিনি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, নিজেই নিজের প্রতি খেয়াল রাখার জন্য যথেষ্ট।
রাশেদ: কথাটা আমিও বলি, কিন্তু ও বুঝতে চায় না। সে একা একা যেতেই রাজি হচ্ছিল না। বলেন তো একা যেতে কী সমস্যা? এই যে আমি উঠিয়ে দিয়ে গেলাম, এখান থেকে সামান্য কয়েক ঘন্টার পথ একা যাবে, স্টেশনে তার ভাই আসবে তাকে নিয়ে যেতে। তারপরও নাকি তার নার্ভাস লাগছে।
যুবক: শুনুন নার্ভাস টার্ভাস এসব আসল কথা নয়। স্বামীকে সাথে করে নিয়ে যেত পারলে হয়তো ভ্রমণটা বেশি ভাল লাগতো।
মালা: জী, কিন্তু সে কথাটা আবার ও বুঝতে চায় না।
রাশেদ: ছুটি না পেলে কী করব বলেন। মাঝে মধ্যে ও মিছামিছি রাগ করে আমার ওপর। শুধু শুধু কষ্ট পায়।
যুবক: বাহ! আপনি দেখছি তার মনের খবর ভালই রাখেন।

(হুইসেল শোনা যায়।)
রাশেদ: মালা, ট্রেন ছাড়বার সময় হয়ে গেল। আমি নিচে নেমে দাঁড়াই।
(রাশেদ ট্রেনের কামরা থেকে নেমে যায়। মালা জানালার পাশে তার আসনে বসে। ট্রেনের প্রথম শ্রেণিতে লোকজন নেই তেমন। রাশেদ নিচে নেমে ট্রেনের জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়।)
মালা: শোনো ঠিকঠাক মতো খাবে। নিজের যত্ন নেবে। (কিছুটা কান্না চলে আসে মালার কণ্ঠে।)
রাশেদ: মন খারাপ করছ কেন? মন খারাপ কর না। আম্মাকে আমার সালাম দিও। (মালার কান্না পায়। সে চোখ মোছে।) প্লীজ, মন খারাপ কর না। পরশু দিন সন্ধ্যায় রওয়ানা দিয়ে আমি চলে আসব।
(হুইসিল দিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করে। রাশেদ প্লাটফরমের ওপর জানালার বাইরে হাঁটতে থাকে। ট্রেনের গতি বাড়তে থাকলে হাঁটতে হাঁটতে দূরে সরে যেতে থাকে। মালা হাত নাড়ে। রাশেদও হাত নাড়তে থাকে। ট্রেন প্লাটফরমের বাইরে চলে যায়। ট্রেন লাইন চেঞ্জ করছে, তার খটাং খটাং শব্দ শোনা যায়। ট্রেনটা চট্টগ্রামের একটি লেভেল ক্রসিং পার হয়। ট্রেনের ভিতরের দৃশ্যে দেখা যায় চা নিয়ে এসেছে বেয়ারা ট্রেতে করে। যুবকের পাশে এসে দাঁড়ায়।)

বেয়ারা: (যুবককে) স্যার চা-নাস্তা দেব?
যুবক: (বেয়ারাকে) হ্যাঁ, চা দিন। (মালাকে) চা খাবেন তো?
মালা: ইচ্ছা করছে না।
যুবক: চা খান মনটা ভালো লাগবে। (বেয়ারাকে) হ্যাঁ, চা দাও ওনাকে। (বেয়ারা টেবিলের ওপর দু কাপ চা রেখে চলে যায়। যুবক মালার দিকে একটা কাপ এগিয়ে দেয়। মালা লাজুক ভঙ্গিতে চায়ের কাপটা হাতে নেয়। যুবক মালার কাছে জানতে চায়।) চা খাওয়ার অভ্যোস আছে তো? নাকি আমি চা খেতে জোর করছি?
মালা: না, না, খুব চা খাই আমি।
যুবক: প্রথমে খেতে চাইছিলেন না কেন? মন খারাপ বলে? (মালা ইতিবাচক মাথা নাড়ে।) স্বামীকে খুব ভালবাসেন?
মালা: জানি না। তবে ওকে ছেড়ে থাকতে ভাল লাগে না। খুবই ভাল মানুষ ও।
যুবক: সামরিক শাসনের মধ্যে বাস করছি আমরা। সামরিক বাহিনীর লোকরা কি ভাল না হয়ে পারে? (যুবকের কথায় হোচট খায় মালা।)
মালা: সামরিক বাহিনীর লোকদের কে কী খুব ঘৃণা করেন আপনি?
যুবক: না, মোটেও না। কেন ঘৃণা করব? আপনার স্বামীর সাথে আমার ব্যবহারে কি তাই মনে হলো? মনে হয়েছে যে তাকে আমি অপছন্দ করছি?
মালা: না তা মনে হয়নি। কিন্তু এখন যে সামরিক বাহিনীর লোক বলে খোটা দিলেন?
যুবক: মজা করলাম আপনার সাথে। একটা কিছু কথা বলে তো সময় কাটাতে হবে? যেভাবে আপনি মন খারাপ করে আছেন।
মালা: সত্যি কথা বলব আপনাকে?
যুবক: হ্যাঁ, সত্যিটাই বলেন। মিথ্যা বলবেন কেন?
মালা: আপনি মানুষটা খুব ভাল?
যুবক: মোটেও না। আপনি আমার কতটুকু জানেন? কতটুকু জেনে আমাকে ভাল বলছেন?
মালা: যতটুকু দেখেছি তাতে বুঝতে পারছি আপনি খুব ভাল মানুষ।
যুবক: মানুষকে এতো সহজে বিচার করা যায় না। কিন্তু আপনার একটা ভাল গুণ কী জানেন?
মালা: কী?
যুবক: মানুষকে ভাল ভাবতে পারেন। কোনো মানুষকে খারাপ না ভেবে, মানুষ সম্পর্কে খারাপ ধারণা না করে-মানুষ সম্পর্কে ভাল ভাবতে পারা একটা বিশেষ গুণ।  
মালা: মানুষ সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
যুবক: স্বভাবটা আমার খুবই খারাপ। খুবই সমালোচনামূলক লোক আমি। সমালোচনা না করে কিছুই আমি গ্রহণ কতে পারি না। কোনো ব্যাপারেই আমার অন্ধ বিশ্বাস নেই।   
মালা: কী মনে করেন আপনি, সব মানুষ খারাপ?
যুবক: ঠিক তা নয়। কোনে মানুষকেই আমি সম্পূর্ণ ভাল বা সম্পূর্ণ খারাপ ভাবি না।
মালা: মানে?
যুবক: প্রতিটা মানুষের মধ্যেই দোষগুণ আছে। যে মানুষটা খুব নিষ্ঠুর, সেও তার সন্তানের কাছে সবচেয়ে স্নেহপ্রবণ পিতা। কোনো মানুষের ভাল কাজের প্রশংসা যেমন তার একার প্রাপ্য নয়, তেমনি খারাপ কাজের দায়ও তার একার নয়।
মালা: কেন, আমি যদি পরীক্ষায় ভাল ফল করি তার প্রশংসা কি আমার একার প্রাপ্য নয়?
যুবক: না। সে প্রশংসার প্রাপ্য অনেকেই। যেমন আপনার শিক্ষক কিম্বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যার বইপত্র পড়েছেন এবং যিনি আপনাকে পড়াশুনা করার সুযোগ করে দিয়েছেন; সকলের।   
মালা: কেন?
যুবক: ধরুন যার পড়াশনা করার সুযোগই হয়নি সে ভাল ফলাফল করবে কী করে?  ধরুন একটা লোক না খেয়ে আছে কদিন। কেউ তাকে খেতে দিচ্ছে না, তখন তার চুরি করা ছাড়া আর উপায় কি? দায়টা কী তাহলে শুধু ঐ চোরের, না সমাজ ব্যবস্থার?
মালা: হ্যাঁ, কথাটা ঠিক বলেছেন আপনি। আপনি কী করেন?
যুবক: আমি যে আসলে কী করি সেটা বলা কঠিন।
মালা: কিন্তু আপনি যে রাজনীতির সাথে যুক্ত, সেটা তো ঠিক?
যুবক: হ্যাঁ। বুঝলেন কী করে?
মালা: আপনার কথা শুনে। কোন দল করেন?
যুবক: আমার দলের নাম শুনে কী হবে? আমার দল কখনো ক্ষমতায় যায়নি। আর খুব শীঘ্রই যাবে বলে মনে হয় না।
মালা: তার মানে আপনি কোনে প্রগতিশীল দল বা বাম দল করেন, তাই না?
যুবক: হ্যাঁ, লোকজন তো তাই ভাবে।
মালা: বহুদিন ধরে কি আপনি রাজনীতি করছেন?
যুবক: হ্যাঁ।
মালা: মাহমুদ আলম নামে কি আপনি কাউকে চেনেন?
যুবক: মাহমুদ আলম!
মালা: হ্যাঁ।
যুবক: মাহমুদ আলম মানে? যিনি কারাগার ভেঙে একবার পালিয়েছিলেন এবং পরে সে কাহিনী নিয়ে গল্প লিখেছেন?
মালা: হ্যাঁ, আমি তাঁর কথাই বলছি, তাঁকে চেনেন আপনি?
যুবক: আপনি তাঁকে কিভাবে চেনেন?।
মালা: চিনি।
যুবক: কিভাবে বলেন।
মালা: আপনি তাঁকে চেনেন কিনা আগে বলেন।
যুবক: হ্যাঁ, চিনি। কিন্তু আপনি কী করে চেনেন? (মালা চুপ করে থাকে।) বলেন। চুপ করে আছেন কেন?
মালা: (মালা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর) তিনি আমার বড় ভাই।
যুবক: আপনার বড় ভাই! আপনার আপন ভাই?
মালা: হ্যাঁ। আমার আপন ভাই।
যুবক: কিন্তু সবাই যতদূর জানে তার কোনো ভাইবোন বা কোনোরকম কোনো আত্মীয় স্বজন নেই।
মালা: সবাই মিথ্যা জানে। আমি তার আপন বোন। একমাত্র বোন। সবার ছোট। (যুবক অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে মালার দিকে।) কী ব্যাপার আপনি এভাবে করে তাকিয়ে আছেন কেন আমার দিকে? ভাবছেন আমি মিথ্যা বলছি? আপনি অবশ্য বলেছেন যে আপনি মানুষকে সহজে বিশ্বাস করেন না।
যুবক: না, আপনাকে আমি অবিশ্বাস করছি না। কিন্তু কখনো তো কেউ বলেনি যে মাহবুবের ভাইবোন আছে, তাই মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল।  
মালা: তার সাথে কি আপনার খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে?
যুবক: না। তাকে আমি চিনি। দেখা হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ নয়।
মালা: মাঝে মধ্যে কি আপনার সাথে তাঁর দেখা হয়?
যুবক: খুব কম।
(ট্রেনটা খট খট করে দ্রুত বেগে ছুটছে। যুবক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্যাবলি দেখে।)
যুবক : তোমাকে কি আমি তুমি করে বলতে পারি? কারণ, তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় আমি; তাছাড়া তোমার ভাইয়ের বন্ধু।
মালা: নিশ্চয়, আপনি আমাকে অবশ্যই তুমি করে বলবেন।
যুবক: তোমার ভাইয়ার সাথে তোমার শেষ দেখা কবে হয়েছে?
মালা: (মালার কান্না আসতে চায় কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়।) মুক্তিযুদ্ধের পর একবার দেখেছিলাম। তারপর আর কখনো দেখিনি।
যুবক: কেন?
মালা: না, কিছু না।
যুবক: মাহমুদ আলম তোমার বড় ভাই। আবার বলছ গত চোদ্দ বছরে তোমার সাথে তার দেখাই হয়নি। কেন?  
মালা: সত্যি কি আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন? ভাবছেন মিথ্যা বলছি আমি?
যুবক: না, একদম না। তোমার চোখ দেখে বুঝতে পারছি তুমি সত্যি বলছ। কিন্তু ভাইয়ের সাথে তোমার দীর্ঘদিন দেখা হয়নি কেন? তোমাদের ভাইবোনের মধ্যে কি কোনো বিরোধ-
মালা: না, না, আমার সাথে কিছু হয়নি।
যুবক: তাহলে তোমাদের দেখা হচ্ছে না কেন?
মালা: কী করে যে আপনাকে বোঝাই!
যুবক: বলো তুমি, আমি বুঝে নেব।
মালা: আপনি কি জানেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার ভাইয়া সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।  
যুবক: হ্যাঁ শুনেছি। তাতে সমস্যা কী?
মালা: আমার বড় ভাইয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও (মালা থেমে যায়।)
যুবক: বলো।
মালা: আমার বাবা এবং আমার চাচাত ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। আমার বাবা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন।
যুবক: হ্যাঁ, তারপর?
মালা: যুদ্ধের পর আমার ভাইয়া গ্রামে ফিরে আসেন এবং...
যুবক: এবং?
মালা: গ্রামে ফিরে এসে আমার ভাইয়া নিজ হাতে আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করেন।
যুবক: কি বলছ!
মালা: হ্যাঁ, সত্যি বলছি।
যুবক: পরে কী হলো?
মালা: ভাইয়ার বয়স তখন আঠার-উনিশ বছর। ভাইয়া যখন ঘরে ঢুকে বাবাকে হত্যা করেন, মা সেটা দেখতে পান। বলতে পারেন ঘটনাটা আমার মায়ের সামনেই ঘটে, কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই। বাবা সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।   
যুবক: তোমার মা তখন কী করলেন?
মালা: বাবা স্বাধীনতা বিরোধী হলেও আমার মা এই হত্যাকাণ্ডকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলেন না। আপনিই বলেন, পুত্র পিতাকে হত্যা করবে এটা কি আমাদের সমাজ বা কোনো সমাজ সহজে মেনে নিতে পারে?
যুবক: না, পারে না।
মালা: বাবা স্বাধীনতা বিরোধী হলেও তো তিনি ছিলেন আমার মায়ের স্বামী। চোখের সামনে নিজের পুত্র নিজের স্বামীকে গুলি করছে এটা মেনে নেয়া কঠিন। যদিও আমার মা স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন না। বাবার অনেক কিছুই মার পছন্দ ছিল না, তবুও সেই মুহূর্তে ভাইয়ার এই হত্যাকাণ্ড তিনি মেনে নিতে পারেননি।
যুবক: সেই মুহূর্তে মেনে নেননি, পরে কি মেনে নিয়েছিলেন?
মালা: হ্যাঁ, পরে মেনে নিয়েছিলেন, বহু পরে।
যুবক: প্রথমে মেনে নিলেন না কেন?
মালা: চিন্তা করে দেখেন, একদিকে স্বামী অন্যদিকে পুত্র। স্বামী নিহত, পুত্র হত্যাকারী। এই অবস্থায় একজন মহিলার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে? তিনি কি সঠিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? তাৎক্ষণিকভাবে হত্যাকারী পুত্রের প্রতি ঘৃণা জন্মানোটাই তো স্বাভাবিক।
যুবক: তোমার নিজের কী মনে হয়? তোমার মা এবং তোমার ভাই, দুজনের মধ্যে কে ঠিক ছিলেন সেদিন?
মালা: যুক্তি দিয়ে কি সবসময় সব সিদ্ধান্ত নেয়া যায়? যে মহিলা এইমাত্র তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন তাঁর কাছে কি যুক্তির কোনো মূল্য আছে? আমার মা তেমন শিক্ষিত কেউ নন, গ্রামের একজন সাধারণ মহিলা। তিনি চাইতেন দেশ স্বাধীন হোক, তাঁর স্বামী সন্তানরা ভাল থাক। সহজ হিসাব তাঁর।
যুবক: কী ঘটল তারপর, এই হত্যাকাণ্ডের পর কী হলো?
মালা: আমার মা আমার ভাইয়ার প্রতি প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হলেন, সেই মুহূর্তে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আমাদের আত্মীয়-স্বজনরাও কেউ খুশি হয়নি এই ঘটনায়। পুত্র পিতাকে হত্যা করবে কেউ এটা মেনে নিতে পারেনি। আমি তখন খুব ছোট।
যুবক: বড় হলে কী করতে?
মালা: সে মুহূর্তে কী করতাম জানি না। কিন্তু আজ বুঝি ভাইয়া সেদিন যা করেছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। বাবার মৃত্যুর জন্য আমার কষ্ট হলেও, আমি মনে করি ভাইয়া সঠিক কাজটিই করেছিলেন।
যুবক: তোমার ভাইয়ার সাথে পরে আর তোমাদের যোগাযোগ হয়নি কেন?
মালা: ঐ যে বললাম মা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আত্মীয়দের ব্যাপারটা পছন্দ হলো না। ভাইয়া তো ভেবেছিলেন এরকম ঘটনার পর তিনি মহাভারতের যুধিষ্ঠিরের মতো ন্যায়পরায়ণ বলে পরিচিত হবেন। কিন্তু সমাজ তো আর ভাইয়ার যুক্তিতে চলে না। সকলের মধ্যে অন্যরকম প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি বিরাট অভিমান নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন।
যুবক: আর কখনোই গ্রামে ফিরে আসেননি?
মালা: ফিরে আসেননি। ফিরে আসার উপায়ও ছিল না।
যুবক: কেন?
মালা: ভাইয়ার বিরুদ্ধে থানায় খুনের মামলা করা হয়েছিল। আমার বড় চাচা নিজে এ মামলা করেন। (মালা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।) দুঃখ লাগে কী জানেন? স্বাধীন দেশে একজন স্বাধীনতা বিরোধীকে হত্যা করার জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে খুনের মামলা হলো।  
যুবক: সন্দেহ নেই যে তিনি একটি খুন করেছিলেন।
মালা: খুন করেছিলেন! কী বলছেন আপনি! তিনি একজন স্বাধীনতা বিরোধীকে শাস্তি দিয়েছিলেন।
যুবক: ভুল বলছ। যুদ্ধের মাঠে যা সম্ভব বা যা ন্যায়সঙ্গত, স্বাধীন দেশে তা সম্ভব নয়। স্বাধীন একটা দেশ তো আইনের দ্বারাই চলে। সেখানে চোর-ডাকাত-খুনী বা দেশপ্রেমিক সবাই নাগরিক অধিকার প্রাপ্ত।
মালা: কিন্তু আমার মা নিজের ছেলের বিরুদ্ধে এই মামলা করতে চাননি। স্বামীকে হারিয়ে ছিলেন, নতুন করে সন্তানকে হারাতে চাননি। কিন্তু বড় চাচা এই মামলা করেন। থানার ওসি ছিলেন স্বাধীনতা বিরোধী লোক, তিনি সাগ্রহে এ মামলা গ্রহণ করেন।  
যুবক: তোমার চাচা মামলা না করলেও রাষ্ট্র মামলা করতো তোমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে। (স্বরে ব্যঙ্গ এনে) বুঝলে রাষ্ট্রের চোখে, আইনের চোখে সবাই সমান। (স্বর পাল্টে) এখন মামলার কী অবস্থা?
মালা: আমার ভাই তো নিখোঁজ ছিলেন বহুদিন, কেউই তাঁর খবর জানতো না; তাই মামলা নিয়ে আর উচ্চবাচ্য হয়নি।
যুবক: পরে ভাইয়ের খোঁজ তোমরা কিভাবে পেলে?
মালা: ভাইয়া তো পালিয়ে গিয়ে গুপ্তদলে যোগ দিয়েছিলেন। তার নামও তখন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। ফলে তার কোনো খবরই আমরা জানতাম না। পরে ধরা পড়ল, জেল ভেঙে পালিয়ে গেল আবার ধরা পড়ল। তখনো তাঁর আসল পরিচয় জানতাম না। কিন্তু কিছুদিন আগে যখন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রাজনীতির ওপর বইটা লেখেন তখন জানতে পারি তিনি আমার ভাই।
যুবক: সত্যিই কি তুমি নিশ্চিত যে তিনি তোমার ভাই? এমন তো হতে পারে তোমার ভাই মারা গেছেন। যাকে তুমি ভাই বলে ভাবছ সে তোমার ভাই নন।
মালা: না, আমি নিশ্চিত। ভাইয়ার সাথে আমাদের পাশের গ্রামের আর একজন গুপ্তদলে যোগ দিয়েছিলেন, তিনি ছাড়া পেয়ে এসে এই খবরটি দেন যে মাহবুব আলম আমার বড় ভাই।
যুবক: তাহলে হয়তো খবরটি ঠিকই আছে।
(ট্রেন চলতে চলতে একটি স্টেশনে এসে থামে। আবার চলতে শুরু করে।)
মালা: ভাইয়ার সাথে আপনার শেষ দেখা হয় কবে?
যুবক: মাস দুয়েক হবে।
মালা: কোথায় দেখা হয়েছিল?
যুবক: খুলনায়। দলের একটা সভা ছিল আমাদের।
মালা: ভাইয়া আর আপনি কি একই দল করেন?
যুবক: না, কাছাকাছি চিন্তার লোক আমরা।
মালা: এখানে মানে চট্টগ্রামে কোথায় থাকেন আপনি?
যুবক: চট্টগ্রামে তো আমি থাকি না।
মালা: তাহলে? চট্টগ্রামে এসেছিলেন কেন?
যুবক: জরুরি একটা কাজ ছিল।
মালা: রাজনীতি সম্পর্কিত কিছু?
যুবক: হ্যাঁ।
মালা: চট্টগ্রামে কবে এসেছিলেন?
যুবক: গতকাল বিকেলে।
মালা: গতকাল এসে আজই আবার চলে যাচ্ছেন?
যুবক: হ্যাঁ।
মালা: নিশ্চয় খুব জরুরি কাজে এসেছিলেন?

(যুবক মালার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দ্রুত ছুটছে ট্রেনটা। যুবক জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।)

পরের দৃশ্য
(বড় একটি বাড়ির ভিতরে মুখোমুখি বসে আছে যুবক ও বারী সাহেব।)
যুবক: খবরটা তাহলে সত্যি? বর্তমান সরকারের আপনি একজন মন্ত্রী হতে যাচ্ছেন?
বারী: হ্যাঁ। ওদের দিক থেকে একটি প্রস্তাব এসেছে।
যুবক: ঠিক করে বলুন, মন্ত্রী হচ্ছেন কিনা আপনি? শুধুমাত্র এই খবরটার সত্যতা জানবার জন্য খুলনা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এসেছি।
বারী: বললাম তো, মন্ত্রী হবার প্রস্তাব এসেছে আমার কাছে। মনে মনে আমি ইচ্ছা প্রকাশ করছি মন্ত্রী হব। কিন্তু সরকারকে এখনো চূড়ান্ত কিছু বলিনি।
যুবক: সামরিক সরকারের মন্ত্রী হবেন আপনি!
বারী: বললাম তো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেইনি।
যুবক: নিজে আপনি এতদিন সামরিক সরকারের বিরোধিতা করে আবার সামরিক সরকারের মন্ত্রী হবার কথা ভাবছেন কী করে?
বারী: ধরো যদি আমি মন্ত্রী হতে রাজী হই? তোমার কী বক্তব্য এ ব্যাপারে?
যুবক: দীর্ঘকাল বাম রাজনীতি করে যদি আপনি সামরিক সরকারের মন্ত্রী হন আমার কিছুই বলার থাকবে না।
বারী: বাম রাজনীতির বহুলোক তো সামরিক সরকারের মন্ত্রী হয়েছে।
যুবক: হয়েছে। সাধারণ মানুষ তাদের ঘৃণা করছে।
বারী: (কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যুবকের দিকে তাকায়।) যদি আমি মন্ত্রী হই, দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তুমি কি আমাকে হত্যা করবে?
যুবক: হঠাৎ আপনার এ কথা মনে হলো কেন?
বারী: নিজের বাবাকেও তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য ক্ষমা করোনি। (হাতটা চেপে ধরে যুবকের।) সত্যি করে বলো তো, আমাকে হত্যা করার কোনো মতলব নিয়ে কি তুমি এখানে এসেছে?
যুবক: চোদ্দ বছর আগের ঘটনার সাথে আজকের ঘটনাকে মিলাচ্ছেন কেন?
বারী: পরেও তুমি হত্যার রাজনীতিই করেছ।
যুবক: হত্যার রাজনীতি করেছি এবং পরে সে রাজনীতির ভুল স্বীকার করেছি। লিখিতভাবে আমার বইয়ে।
বারী: মাহবুব আলম, তুমি সৎ এবং ভিন্ন চরিত্রের লোক। সত্যি কথাটা তোমাকে বলি। মন্ত্রী হবার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, হয় আমাকে মন্ত্রী হতে হবে; নতুবা
যুবক: নতুবা?
বারী: জেলে যেতে হবে মিথ্যা মামলা ঘাড়ে নিয়ে।
যুবক: জেল তো আগেও খেটেছেন।
বারী: প্রথম যৌবনে জেল খাটা আর বৃদ্ধ বয়সে এসে জেল খাটা এক নয়। তুমি কী পরামর্শ দিচ্ছ আমাকে?
যুবক: কিছুই পরামর্শ দিতে পারছি না।
বারী: দরকার নেই। কাল দুপুরের ট্রেনে ঢাকা যাব ভাবছিলাম। প্রথমশ্রেণীর একটা টিকেটও কেটে রেখেছি। এখন ভাবছি কাল রাজধানীতে যাব না।
যুবক: কেন?
বারী: মাহবুব তুমি চট্টগ্রাম এসে ভালই করেছ। কি করবো এখনো জানি না। তবে তাড়াহুড়ো করে কিছু করব না। যদি সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে না পারি আমাকে ক্ষমা করো।
যুবক: সঠিক সিদ্ধান্তই আপনি নেবেন বলে আমার বিশ্বাস।
বারী: কালকেই তো তুমি ফিরে যাচ্ছ?
যুবক: হ্যাঁ।
(টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ট্রেনের টিকিট বের করে দেয়।)
বারী: টিকেটটা নাও। টিকেটটা এখন তোমার কাজে লাগবে। ঢাকা পর্যন্ত ট্রেনে চলে যেতে পারবে।
 
দ্বিতীয় পর্ব
(যুবকের চিন্তার জায়গা থেকে বর্তমানে ফেরে। দ্রুত বেগে ট্রেনটা ছুটছেই। ট্রেনের কামরায় এখনো মুখোমুখি বসে আছে যুবক ও মালা। মালা তার ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে। সেখান থেকে কিছু  খাবার বের করে যুবকের দিকে এগিয়ে দেয়। স্যান্ডউইচ। যযুবক একটা স্যান্ডউইচ তুলে নেয়।)
যুবক: তোমার কি মনে হয় তোমার ভাই আর কোনোদিন তোমাদের মাঝে ফিরে আসবেন?
মালা: মনে হয় ফিরবেন না।
যুবক: কেন?
মালা: যখন এতদিন ফেরেননি, আর কি নিজে থেকে ফিরবেন? তাছাড়া...
যুবক: কি?
মালা: (কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।) আমার অন্য ভাইরা চান না তিনি আর ফিরে আসুন। কারণ তাহলে তিনি সম্পত্তিতে ভাগ বসাবেন।
যুবক: তোমার কী ইচ্ছা? তুমি কী চাও তোমার ভাইয়া আবার তোমাদের মাঝে ফিরে আসুক?
মালা: অবশ্যই চাই। ভাইয়াকে আমি কতো খুঁজে বেড়াই আপনি জানেন? কতোভাবে চেষ্টা করেছি একবার যেন ভাইয়ার সথে দেখা হয়।
যুবক: দেখা হলে কী করতে?
মালা: ভাইয়াকে ফিরিয়ে আনতাম। বলতাম ভাইয়া ফিরে চলো। আর অভিমান করে থেকো না; তোমার জন্য আমার অনেক কষ্ট হয়।
যুবক: ভাইয়ার জন্য তোমার এতো কষ্ট কেন? তুমি তো তখন ছোট। ভাইয়ার কথা কি তোমার মনে আছে?
মালা: কেন থাকবে না? মনে আছে একটু একটু। আমি একমাত্র বোন ছিলাম এবং সবার ছোট, ভাইয়া তাই আমাকে খুব আদর করতেন। মা বলেছেন ভাইয়া নাকি বহুসময় আমাকে তার বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকতেন।
যুবক: তোমার ভাইয়া তো আর ফিরবে বলে মনে হয় না।
মালা: কিন্তু আমার সাথে দেখা হলে যেকোনোভাবেই হোক আমি তাঁকে ফিরিয়ে আনবো। ভাইয়ার হাত-পা ধরে, কেঁদেকেটে ফিরিয়ে আনবোই। মা দিনের পর দিন ভাইয়ার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকে শুধু একনজর ভাইয়াকে দেখবার জন্য।
যুবক: খুব স্বাভাবিক। তোমার ভাইয়ারও নিশ্চয় তোমাদেরকে দেখতে খুব ইচ্ছা করে।
মালা: তাহলে আসে না কেন? একবার তো আসতে পারে।
যুবক: ঐ যে তুমি বললে সে এক বিরাট অভিমান নিয়ে চলে গেছে। তারপর কতো বছর; হয়তো অনেক কষ্ট, অনেক সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। সে হয়তো ভাবছে কেন ফিরবে আর? বোনটাকে হয়তো খুব দেখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু নতুন করে হয়তো সে আর কারো মায়ায় জড়াতে চায় না।   
মালা: কিন্তু আমার কী দোষ? আমি কী করেছি?
যুবক: তুমি কিছু করনি। কিন্তু তুমি যে বললে তোমার ভাইয়া তোমাকে খুব ভালবাসতেন। যখন যুদ্ধে ছিল, তোমার ভাইয়া হয়তো তোমার কথা খুব মনে করেছে। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তোমাকে হয়তো গভীর মমতায় বুকের মধ্যে টেনে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু পারল না, যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেই আবার তাকে ঘর ছাড়া হতে হলো। ঘর ছেড়ে কি সে শান্তি পেয়েছে? তোমাদের কথা কি তার বারবার মনে পড়েনি? তারপর একসময় সব ভুলতে চেয়েছে। হয়তো নীরবে অনেক অশ্রুজল ফেলেছে একসময়। সবাইকে ছেড়ে যখন একটা মানুষ একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়; এক মুহূর্তে সব বাঁধন ছিড়ে ফেলতে হয়, তার কষ্টটা কি তুমি বোঝো?
মালা: হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। ভাইয়ার কষ্ট অনেক। মুক্তিযুদ্ধ শেষে সুন্দর একটা দেশ দেখতে চেয়েছিলেন, পারেননি। যুদ্ধ শেষ করে মা-ভাই-বোনের সাথে শান্তিতে থাকতে চেয়েছেন, পারেননি। বনবাদাড়ে খেয়ে না খেয়ে কতো ছুটাছুটি করেছেন রাজনীতির প্রয়োজনে, কিন্তু অমি চাই না ভাইয়া আর নিঃসঙ্গ থাক। ভাইয়াকে একবার পেলে আমি তাঁকে আর আমাদের ছেড়ে কোথাও থাকতে দেবো না। দরকার হলে আমার কাছে রাখব ভাইয়াকে। আমার স্বামী খুব ভাল। সে বলেছে ভাইয়াকে খুঁজে পেলে এবং তিনি আমাদের সাথে থাকতে চাইলে তার কোনো আপত্তি নেই।    
যুবক: তোমার স্বামী চাইলেই কি তা সম্ভব? তোমার স্বামী সামরিক বাহিনীর লোক আর তোমার ভাইয়া সরকার বিরোধী রাজনীতি করেন। দুজনের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। তোমার স্বামী যতো ভাল মানুষই হোক সরকার বিরোধী একজন লোককে কাছে রাখতে পারবে? না কি তোমার ভাইয়া রাজী হবে?
মালা: ঠিক আছে ভাইয়া যদি আমার কাছে থাকতে না চায়, সে যেখানে থাকবে আমি সেখানে যাব। তার দেখাশুনা করব। ভাইয়া তো শুধু আর আমার ভাইয়া না, সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার তো আলাদা সম্মান।
যুবক: মুক্তিযোদ্ধা তাতে কী হয়েছে? তোমার ভাইয়া যুদ্ধে যাবার সুযোগ পেয়েছে, যুদ্ধ করেছে। নিশ্চয় যারা যুদ্ধ করেছে তাদের একটা সম্মান তো আছেই। কিন্তু বাড়তি সম্মান কেন সে পাবে?
মালা: কিন্তু যারা যুদ্ধ করেছে তাদের সম্মান তো বেশি হবেই।
যুবক: তোমার ভাইয়ার সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একবার আমার কথা হয়েছিল। সে কিন্তু তোমার সাথে একমত নয়। সে মনে করে, সে একজন সচেতন মানুষ হিসাবে দেশের প্রযোজনে যুদ্ধে গিয়েছিল। এরজন্য তার কোনে বাড়তি সম্মান পাওনা নেই। তার বক্তব্য হলো, রাষ্ট্রে সকলের অধিকার হবে সমান। ধরো, যে কৃষক মাঠে কাজ করে সেও দেশ-জনগণকে বাঁচিয়ে রাখার প্রতিদিনের যুদ্ধে লিপ্ত। যোদ্ধা হিসাবে তারও সম্মান কম নয়। তোমার ভাইয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সাধারণ সম্মানের বাইরে বাড়তি কোনো সম্মান আশা করে না। তোমার ভাইয়া কখনো মনে করে না, মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে দেশের কাছে তার বাড়তি কিছু পাওনা আছে।   
মালা: ভাইয়ার সাথে আপনার কতোবার দেখা হয়েছে?
যুবক : খুব বেশিবার নয়। সেই তো রাজনীতির কারণে দেখা, আলাপ-আলোচনা? রাজনীতি নিয়েই কথা বলেছি আমরা। [কিছুটা চুপচাপ সময় কাটে। ট্রেনটা ছুটতে থাকে একবেঁকে।] ভাইয়াকে তোমার খুব দেখতে ইচ্ছা করে তাই না?
মালা: কী বলছেন, আমার জীবনে সবচেয়ে আনন্দের ঘটনা হবে ভাইয়ার সাথে দেখা হওয়া।
যুবক: কেন যেন আমার মনে হচ্ছে তোমার সাথে তোমার ভাইয়ার একবার দেখা হবে।
মালা: সত্যি মনে হচ্ছে?
যুবক: ধরো, তোমার ভাইয়ার সাথে ফের দেখা হলে তোমার কাছে নিয়ে এলাম। কিন্তু যদি তুমি তাকে ধরে রাখতে না পারো? যদি সে আবার নিজ কক্ষপথে ফিরে যায়? তোমার কষ্টটা কি তখন বাড়বে না?  
মালা:  ভাইয়ার সাথে একবার দেখা হলে তাকে আর আমি চলে যেতে দেবোই না।
যুবক: ধরো, তুমি যেতে দেবে না কিন্তু ভাইয়া থাকল না। সে তার নিজ গন্তব্যে চলে গেল। তখন তোমার কষ্ট কি আরো বাড়বে না? সেজন্য বলছি তোমার সাথে তোমার ভাইয়ার দেখা না হওয়াটাই ভাল।
মালা: না, না, একবারের জন্য হলেও তাঁকে আমি দেখতে চাই।
যুবক: কিন্তু ঐ যে বললাম, যদি তাঁকে ধরে রাখতে না পারো; তোমার কষ্ট শতগুণ বেড়ে যাবে।
মালা : যতো কষ্ট হোক, সারাজীবন যদি আমাকে কষ্ট পেতে হয়; তবু তাঁকে একবারের জন্য হলেও দেখতে চাই। তাঁর বুকের মধ্যে মাথা রেখে কাঁদতে চাই। শুধু একবার আপনি তাঁর সাথে আমার দেখা করিয়ে দিন।
যুবক: ঠিক আছে আমি চেষ্টা করব।
মালা: আমাকে কিন্তু আগে জানাবেন। আমি মাকেও সাথে করে নিয়ে আসব। মা আর আমি দুজনে তাঁর পথ আগলে দাঁড়াব। মা-র রোগা মুখটা দেখলে ভাইয়া আর ফিরে যেতে পারবে না।
যুবক: মালা, তোমাকে একটা কথা বলব?
মালা : বলেন।
যুবক: তোমার ভাইয়া মানুষটা খুবই নিষ্ঠুর। যতোটা দেখেছি খুবই নিষ্ঠুর মনে হয়েছে। না হলে কি নিজের বাবাকে হত্যা করতে পারে?
মালা: বাবাকে হত্যা করার পেছনে তার যথেষ্ট যুক্তি ছিল। কারণ ছিল।
যুবক: কিন্তু তার বাবাই তো তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন। স্নেহ-মমতা দিয়েছেন।
মালা: হ্যাঁ, দিয়েছেন। সেটা তো ভাইয়া জানতেন। কিন্তু দেশ ও জনগণ ভাইয়ার কাছে বড় ছিল।  
যুবক: থাক্ এসব প্রসঙ্গ। যেভাবেই হোক তোমার সাথে একবার তোমার ভাইয়ার দেখা করিয়ে দেবো।
মালা: সত্যি বলছেন তো?
যুবক: হ্যাঁ।
মালা: ভাইয়া আমাকে কতো ছোট দেখেছে। যখন দেখবে এতো বড় হয়ে গেছি খুব অবাক হবে।
যুবক: জানো, আমার জীবনেও একটা চমৎকার গল্প আছে। আমার নিজের বোনকে আমি হারিয়েছি অনেকদিন। সেজন্য তোমাকে দেখে বোনটার কথা মনে পড়ছে।
মালা: কি হয়েছিল আপনার বোনের?
যুবক: তোমার গল্প শোনার পর মনটা আমার খুবই বেদনার্ত হয়ে আছে। আমার বোনের গল্প বলে তোমার মনটাকে আর ভারাক্রান্ত করব না। যদি তোমার সাথে আবার দেখা হয় তখন সে গল্প বলব। চলো তোমাকে কিছু খাওয়াই। নিজের বোনের জন্য তো কিছু করতে পারিনি, তোমার জন্য কিছু একটা করি আজ। খুব মিস্টি মেয়ে তুমি। তোমাকে খুব আদর করতে ইচ্ছা করছে।  
মালা: ঠিক আছে, ঐ ফেরিওয়ালার কাছ থেকে আমাকে চকোলেট কিনে দেন। চকোলেট আমার খুব পছন্দ।
যুবক: ওর কাছে যতো চকোলেট আছে সব তুমি নিয়ে নাও।
মালা: না-না, ওতো চকোলেট দিয়ে কী হবে?
যুবক: আমি জানি এগুলো খুব সস্তা চকোলেট।
মালা: হ্যাঁ, জানি সস্তা চকোলেট। কিন্তু গ্রামে যখন বড় হয়েছি তখন এরচেয়েও সস্তা চকোলেট খুব আনন্দ করে খেয়েছি। মা বলেন, যখন আমি ছোট ছিলাম ভাইয়া আমার জন্য সবসময় লাঠিওয়ালা লাল লজেন্স নিয়ে আসতেন।
যুবক: ভাবো তো সেটা কতো বছর আগের কথা।
মালা: হ্যাঁ।
(মালাকে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে প্রচুর চকোলেট কিনে দেয় যুবক।)
যুবক: কী কারণে যেন বাড়ি যাচ্ছ তুমি? তোমার কোনো ভাইয়ের হলুদের অনুষ্ঠানে?
মালা: হ্যা, আমার ছোট ভাইয়ের কাল গায়ে হলুদ।  
যুবক: গ্রামের বিয়ের অনুষ্ঠান খুব অন্যরকম হয়। কতোরকম রঙ মাখামাখি, কাদা ছুঁড়াছুঁড়ি।
মালা: আপনি জানেন?
যুবক: কেন জানব না? এক সময় কতো গ্রামের বিয়ে দেখেছি।
মালা: চলেন আমার সাথে আমার ভাইয়ের বিয়েতে।
যুবক: কী যে বল তুমি!
মালা: কেন আমাদের বাড়ির সবাই খুব খুশি হবে। মা তো খুব খুশি হবে যখন জানবে আপনার সাথে ভাইয়ার পরিচয় আছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কতো প্রশ্ন করবে আপনাকে।
যুবক: আপনার মায়ের শরীর কেমন আছে? ওনার তো এখন অনেক বয়স, তাই না।
মালা: হ্যাঁ, তিপান্ন বছর। বয়স ততো বেশি নয়, কিন্তু ভাইয়ার দুশ্চিন্তায় অনেক রোগা হয়ে গেছে। বোঝেন তো মায়ের কষ্ট। ছেলে বেঁচে আছে কিন্তু কতো বছর তাকে দেখতে পাচ্ছে না। ছেলে অভিমান করে মাকে ছেড়ে চলে গেছে এটা যে একজন মায়ের জন্য কী যন্ত্রণার-
যুবক: মা ঠিক ঠিক চোখে দেখতে পান?
মালা: হ্যাঁ, মা এখনো সেলাই করেন।
যুবক: বইপত্র পড়েন না? গল্পের বই?
মালা: হ্যাঁ, খুব বই পড়েন কিন্তু আমার মা। বেশি লেখাপড়া করেননি। কিন্তু ছোট থেকেই মাকে দেখেছি গল্পের বই পড়তে।  
যুবক: আমার মাকেও আমি দেখেছি খুব বই পড়তেন। এই যেমন শরৎচন্দ্রের লেখা।  
মালা: আমার মাও ঠিক তাই। জীবনের প্রথম দিকে শরৎচন্দ্রের লেখা পড়তেন খুব।
যুবক: আমাদের সময়ের মায়েরা তাই পড়তেন।
মালা: আপনার মা কি এখনো বেঁচে আছেন?
যুবক: হ্যাঁ, হ্যাঁ।
মালা: এখনো কি তিনি বই পড়েন?
যুবক: হ্যাঁ, হ্যাঁ পড়েন। তবে কী বই এখন বেশি পড়েন বলতে পারব না। (প্রসঙ্গ পাল্টাতে চায়।) জানালা দিয়ে বাইরে তাকাও। দেখ, কী সুন্দর বাংলার গ্রামগুলো। নদী-ধানক্ষেত-প্রান্তর।
মালা: সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।
(ট্রেন ছুটছে। জানালা দিয়ে বাইরের গ্রাম দেখা যাচ্ছে। ঝিলে মাছ ধরছে জেলেরা। কৃষক চাষ করছে। দরিদ্র মানুষ মাথায় বোঝা নিয়ে হেঁটে চলেছে।)

যুবক: সকল দেশের সেরা যে দেশ, সে দেশের মানুষগুলো খুব দরিদ্র। দেখলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।
মালা: কতো আন্দোলন, কতো রক্তপাত, কতো উত্থান-পতন, দু দুবার স্বাধীনতা লাভ কিন্তু মানুষের দারিদ্র দূর হলো না।
যুবক: তুমি কি রাজনীতি করো নাকি?
মালা: তেমন কিছু না, বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝে মধ্যে মিছিলে যাই বন্ধুদের সাথে। ভাইয়ার কথা মনে হয়। মনে হয় আমি মিছিলে যোগ দিয়েছি শুনলে ভাইয়া খুশি হবেন।  
যুবক: মালা, তোমার ভাইয়া খুব একটা মিছিলে যোগ দেয় না। জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির মধ্যে সে কখনো যায় না। মনোযোগ দিয়ে খুব পড়াশুনা করে, অতীত রাজনীতির ভুলগুলি বুঝতে চেষ্টা করে। সে গঠনমূলক রাজনীতির কথা ভাবছে এখন। তার ধারণা, শুধু ক্রোধ প্রকাশ করলে ফল হয় না। ঠাণ্ডা মাথায় অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তোমার ভাইয়া মনে করেন, লক্ষ্যহীনভাবে জ্বালাও পোড়াও রাজনীতি দেশের অনেক ক্ষতি করেছে।
মালা: কিন্তু আমরা জানি, তিনি গলাকাটা রাজনীতি করতেন। জনগণের কোনো শত্রুকে ক্ষমা করতেন না।
যুবক: তিনি তার সে রাজনীতিকে এখন ভুল মনে করেন। তিনি মনে করেন, পুরো জাতি সচেতন না হলে দু-একজনের গলা কেটে সমাজ পাল্টানো যায় না। তিনি মনে করেন, প্রগতিশীল রাজনীতির প্রথম কাজ সাধারণ মানুষের কাছে মানবিকতার বাণী পৌঁছে দেয়া। সমাজ ইতিহাসের সত্য তাদেরকে জানতে দেয়া। সকল মানুষকে অন্ধকারে রেখে দু-একজনের গলা কেটে বিপ্লব হয় না, সেটা হয় সন্ত্রাস বা ক্ষোভ প্রকাশ। দেশের মূল সমস্যাগুলো কী আগে সকলকে বুঝতে দিতে হবে।
মালা: ঠিক বলেছেন। মাঝে মধ্যেই সুযোগ পেলে আমিও রাজনীতির বই পড়ি। মনে হয়, ভাইয়া থাকলে বইগুলি কিনে দিয়ে আমাকে পড়তে বলতেন।
যুবক: মুক্তিযুদ্ধ তোমাদের ভাই আর বোনকে আলাদা করে দিল।
মালা: ভাইয়ার সাথে সত্যি আমাকে দেখা করিয়ে দেবেন তো?
যুবক: হ্যাঁ। কিন্তু দেখা হবার পর কষ্ট বাড়বে তোমার। হয়তো তোমার ভাইয়ারও। তোমাদের সাজান জীবনে একটা গোলমাল হবে।
মালা: কী মনে হয় আপনার ভাইয়া কি তার ছোট বোনটার কথা শুনবে না। যে বোনকে সে একসময় নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুমিয়েছে তার কথা কি সে ফেলতে পারবে? ভাইয়াকে আমি আমার সকল ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখবো, তবুও সে কি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারবে? না, না, পারবে না। পারবে না।
(মালা কেঁদে ফেলে। হঠাৎ তার কণ্ঠ থেকে চীৎকার বের হয়ে আসতে চায়। কিন্তু নিজেকে সম্বরণ করে। যুবকটি খুব শান্ত স্বরে বলে।)

যুবক: মালা। সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। তোমার ভাইয়া এখন সুন্দর একটা সমাজ গড়বার জন্য সবকিছু ত্যাগ করে লড়ে যাচ্ছে। কোনো বন্ধনই তোমার ভাইয়ার পথে এখন বাধা হতে পারবে না। তোমাকে তো বলেছি, তোমার ভাইয়া খুবই নিষ্ঠুর।   
মালা: ঠিক আছে সেটা প্রমাণিত হোক। আপনি শুধু ভাইয়ার সাথে আমার দেখা করিয়ে দিন।
যুবক: খুব শীঘ্রই তোমার সাথে তোমার ভাইয়ার দেখা হবে। (ট্রেন ছুটছে। ছুটছে আর ছুটছে।) মালা, মনে হয় তোমার স্টেশন প্রায় এসে গেছে। সামনের স্টেশনটাই তো?
মালা: হ্যাঁ। আপনার সাথে গল্প করতে করতে সুন্দর সময় পার হয়ে গেল। দাঁড়ান আপনাকে আমার ঠিকানা দিচ্ছি। (সে একটা কাগজ বের করে ঠিকানা লিখে দেয়।) এখানে আমার ফোন নম্বরও আছে। (কাগজটা হাতে নেয় যুবক) আপনার ঠিকানাটাও আমাকে দিন।
যুবক: আমরা গোপন রাজনীতি করি। আমাদের ঠিকানা আমরা কাউকে দেই না। (মালা যুবকের বক্তব্যে থতমত খায়। কোনো কথা বলতে পারে না।) দরকার হলে আমি নিজে তোমার সাথে যোগাযোগ করবো। মালা, তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। খুব লক্ষী মেয়ে তুমি। তোমার কথা কোনোদিন ভুলব না। রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িও না। তোমার সাথে আরও সময় কাটাতে পারলে ভাল লাগতো।
মালা: চলেন তাহলে, আমার সাথে আমাদের বাড়িতে চলেন।
যুবক: সম্ভব নয়। ট্রেনটা থামছে। এবার তোমাকে নামতে হবে। মালা, ট্রেনটা যতক্ষণ স্টেশনে থাকবে তুমি কি এসে এই জানালার পাশে দাঁড়াবে?
মালা: কী ব্যাপার, মনে হয় আপনি কাঁদছেন!
যুবক: না তো। তোমার কাছ থেকে তোমার ভাইয়ার ঘটনাটা শুনে মনটা খুবই খারাপ লাগছে। আমার নিজের ছোট বোনটার কথাও মনে পড়ছে।
মালা: মনটা আপনার খুবই নরম। যখনই ভাল লাগবে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। দরকার হলে বেড়াতে আসবেন।

(ট্রেন স্টেশনে থেমে পড়েছে। স্টেশনের বাইরে কোলাহল। লোকজনের ছুটাছুটি।)
যুবক: মালা তুমি এবার নেমে যাও। দেখ স্টেশনে হয়তো তোমার ভাই এসে দাঁড়িয়ে আছে।
(যুবক মালার স্যুটকেস নামাতে সাহায্য করে। মালা বাধা দিলে যুবক শোনে না। একজন তরুণ এর মধ্যে বগিতে উঠে মালার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।)
মালা: মন্টু তুই, ভাইয়া আসেনি?
মন্টু: চাচা, আমাকে পাঠাল। চাচার কি যেন কাজ আছে।
মালা: (মন্টুকে দেখিয়ে যুবককে বলে) আমার বড় চাচার ছেলে। (মন্টুকে) স্যুটকেসটা নে। মন্টু যুবকের হাত থেকে স্যুটকেসটা নেয়। মালা যুবকের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে বগি থেকে নেমে যেতে শুরু করে। যুবক নিজের স্যুটকেস খুলে একটা বই বের করে। বইয়ের ভিতরে কলম দিয়ে কিছু একটা লেখে। মালা বগি থেকে নেমে জানালার পাশে যুবকের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ট্রেনটা মানুষের ভীড়ের মধ্যে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে।)
যুবক: চট্টগ্রাম কবে ফিরবে তুমি?
মালা: দশ বারো দিন পর।
যুবক: ভালো থেকো।
মালা: আপনিও ভাল থাকবেন।
যুবক: হুইসেল দিয়েছে, ট্রেন এবার ছাড়বে।
মালা: আপনি কিন্তু আপনার প্রতিশ্রুতি ভুলবেন না। ভাইয়ার সাথে আমার দেখা করিয়ে দেবেন।
(ট্রেন চলতে শুরু করে।)
যুবক: ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। এই বইটা তোমার জন্য আমার উপহার।
(যুবক মালার হাতে বইটা দেয়। ট্রেনটা তখন গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। মালা জানালা থেকে দূরে সরে গিয়েছে। বইটার দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকায় সে। বইয়ের ওপরে লেখকের নাম লেখা ‘মাহমুদ আলম’। মালা চমকে ওঠে। ভিতরের পৃষ্ঠায় চোখ বুলায়। সেখানে সাদা কাগজের ওপর লেখা ‘প্রিয় ছোট্ট বোনটিকে, বারো বছর পর যার সাথে দেখা হলো। সামান্য এই প্রাপ্তি আমার সারা জীবনের বেদনা হয়ে রইলো। মাকে আমার সালাম দিও, ভাইয়া’। যারপর নাই বিস্মিত হয়ে মালা ট্রেনের দিকে তাকায়। ট্রেন তখন নাগালের বাইরে চলে গেছে। মালা চেঁচিয়ে ওঠে)
মালা: মন্টু, ট্রেনটা থামা। বড় ভাইয়া ঐ ট্রেনে রয়েছে।
(ট্রেন তখন নাগালের বাইরে চলে গেছে। মালা চীৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে স্টেশনে বসে পড়ে। লোকজন বিমূঢ় হয়ে দেখে, কিছু বুঝতে পারে না। ট্রেনটা বহু দূরে চলে গেছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে রয়েছে যুবক বিষণ্ণভাবে। ছুটতে ছুটতে ট্রেনটা ভৈরব ব্রিজে উঠে পড়েছে।)