সানোয়ার রাসেল
সানোয়ার রাসেলের দশটি ইসলামি কবিতা
প্রকাশিত : নভেম্বর ৩০, ২০২০
খাদিজা
কার্তিকের কুয়াশার মতো আমার সমস্ত বোধ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে
শীত শোনাচ্ছে তার আগমনী গান
মানুষ তার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে
মানুষের উপর―
`মতবাদ`
ভেতরে ভেতরে ভয়ানক জিলজাল টের পাচ্ছি
শীত কিংবা শঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উঠছি বারবার
হে নবি―
সেই পরম সান্ত্বনার চাদর কোথায় পাব?
মা খাদিজা যে চাদরে আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন
আশ্বাস আর নির্ভরতার সেই চাদর
আমার যে বড্ড প্রয়োজন
আমার তো হেরা নেই
লুকানোর মতো নেই কোনো রাকিম
প্রজ্ঞা ও অজ্ঞতা― আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে
কুয়াশায় ঢাকা কলাপাতার মতো ভয় দেখায়
আমার বিপন্নতা দেখে দাঁত বের করে হাসে
নূরানি চন্দ্রালোকে আমি রজ্জুকে সাপ দেখি
সাপকে রজ্জু ভাবি
আর অকস্মাৎ ওরা―
সাপ কিংবা রজ্জু― আমার কণ্ঠরোধ করতে থাকে
আমি বলতে পারি না
শুধু ছটফট করি
বুকে জাবড়ে ধরে মুখে কথা ফোটানোর জন্য
আমার তো কোনো জিব্রাইল নেই
হে খোদা―
তুমি কি আমার জন্যও একজন জিব্রাইল পাঠাবে?
আমার সিনা চাক করে সমস্ত অন্ধকার কেন দূর করছো না?
নূর নূর বলে হাহাকার করতে করতে
তবে কি পৌঁছেই যাব জাহান্নামের আগুনে!
জাহান্নামের আগুন কি দূর করতে পারে এই শীত কিংবা শঙ্কা?
অথচ আমি তো চেয়েছিলাম মা খাদিজার সেই চাদর
আর বুকের সমস্ত কলুষ ধুয়ে ফেলতে
সেই বরফ শীতল জল―
আর চেয়েছিলাম কেউ আশ্বাস দিয়ে বলুক,
`খোদা আপনাকে অপমানিত করবেন না`
দুয়া কুনুত
সালাতুল বিতর পড়তে গিয়ে
আচানক তোমার কথা মনে পড়ে যায়।
কনে দেখা সাজ,
ভরা মজলিশ,
হাসি-হুল্লোর,
মিষ্টি-মেঠাই,
ময়-মুরুব্বি,
ভরা মজলিশ।
আসরের এক প্রান্তে ঘোমটাসমেত তুমি,
অন্য প্রান্তে আমি।
হঠাৎ তোমার প্রতি প্রশ্ন নাজেল হলো,
`দুয়া কুনুত পারো? শোনাও তো একটু।`
অপ্রস্তুতের মতো তুমি নিচু কণ্ঠে শুরু করলে,
আল্লাহুম্মা ইন্না নাস্তাঈনুকা, ওয়া নাস্তাগফিরুকা, ওয়ানু মিনুবিকা...
ভরা-মজলিশ
ময়-মুরুব্বি
তুমি ঘাবড়ে গেলে,
ওয়ানু মিনুবিকার পর দুয়া কুনুত আর এগুলো না।
ওদিকে তোমার কান্না চাপার প্রয়াস আর
আরক্তিম গণ্ডদেশ দেখতে দেখতে
আমি শেরোয়ানি পরা গর্দভের মতো
অক্ষম ক্রোধে ঘামতে লাগলাম।
এখনও ঘামি,
সালাতুল বিতরের মাঝে।
দুয়া কুনুতে আটকে গিয়ে ভাবতে থাকি
প্রশ্নটা সেদিন যদি আমাকে করা হতো?
এইসব ভেবে ভেবে
আমার সারাদিনের ইবাদত
সপ্ত-আসমানে ঘুরপাক খেতে থাকে।
ফজর
রাতের চরণ শেষ,
নিশাচর প্রাণীরা গেছে এবার বিশ্রামে।
পূবের আকাশে এক অদ্ভুত আলো আসে নেমে!
সুবহে সাদেক! সুবহে সাদেক!
এই আলো দেখবে না জগতের লোকে?
দেখবে না, রাত্রির ঘুম বাসা বেঁধে আছে
যাহাদের চোখে।
এমন সময়,
যেন এক সুবাতাসে বয়ে আসে
আজানের সেই শুভ ধ্বনি―
আস সালাতু খায়রুম মিনান নাওম...
ক্লেদের বিছানা ছেড়ে মানুষেরা উঠবে এখনি।
পশ্চাতে পড়ে রবে ব্যয়িত অতীত আর
মরে যাওয়া রাত,
সুবহে সাদিক নিয়ে এলো এক নয়া সওগাত,
নতুন প্রশ্বাসে।
শীতল বাতাসে সব ক্লান্তি উবে যায়।
সুবহে সাদিকে যারা দেখে সেই অপূর্ব আলো,
মহান রবের নামে রয় তারা নিমগ্ন সেজদায়,
অটল বিশ্বাসে!
গল্পখোর মানুষেরা
আমরা সত্যের চেয়ে গল্প ভালবাসি।
আমরা সত্য গল্পের চেয়ে রূপকথা ভালবাসি।
আমরা দ্বীনের নবি মোস্তফাকে
গাছতলায় বান্ধা ছাগল দিয়া মহিমান্বিত করতে চাই।
আমরা খন্দক কাটার পরিশ্রমে যেতে চাই না,
বিপরীতে হরিণীর মুখে মানুষের ভাষার অলীক গল্প
গিলে গিলে খেতে পছন্দ করি।
কিছু মানুষের গল্পগুলো সত্যের চেয়েও সুস্বাদু।
আমার কোনো মহল্লা নেই, যখন ছিল
তখন মহল্লার ময়না মামা একদিন এসে বলতো,
`হুনছস নাকি? রফিক্যার বউয়ের প্যাটের তো একটা গতি হইয়া গ্যাছে।`
আমরা পেটের অনুবাদ ভুল করেও ক্ষুধা করতাম না।
কেননা, গল্পটা আমরা জানি।
রফিক্যার বউ আর লুম্পেন জামিরুলের বউয়ের কাহিনি।
জামিরুল এই হেতু লুচ্চা-লুম্পেন, যেহেতু
আমরা যেটা শুধু কল্পণায় কামনা করেছি
জামিরুল সেটা করে ফেলেছে। অতএব,
তাকে লুচ্চা-লুম্পেন বলতে দোষ কী?
যাই হোক, আমরা জামিরুল আর প্রবাসী রফিকের বউয়ের
সরস গল্পটা রসিয়ে রসিয়ে শুনতে ভাল পাই,
আর আমাদের অবচেতনে আরেকটি অবদমিত কামনার গিলাফ চড়াই।
আমরা সত্যটা জানতে চাই না, ডরাই।
যে সত্য রফিক্যার বউকে জামিরুলের দিকে ধাবিত করে,
যে সত্য জামিরুলকে ধাবিত করে রফিক্যার বউয়ের দিকে,
সেই সত্য ক্ষুধার সত্য।
সেই সত্য দেশে ভাত না থাকার সত্য,
সেই সত্য দেশে কাজ না থাকার সত্য,
রফিক্যার অনুপস্থিতিতে তার বউয়ের উপস্থিত জ্বালা থাকার সত্য।
আমরা গল্প শুনতে ভালবাসি, সত্যের চেয়েও।
আমরা রূপকথা ভালবাসি, সত্য গল্পের চেয়েও।
কেননা রূপকথায় আরাম আছে,
সত্যে নেই।
কবি
কবি আসছেন, তাই নিয়ে মস্ত তোড়জোড়।
উত্তরীয়, ফুলের তোড়া
ঘৃত-প্রদীপ পঁচিশ জোড়া
কবি আসছেন, তাই নিয়ে উৎসাহী সবাই বিভোর!
কবি আসছেন, ব্যস্ত সবাই, প্রোগ্রামের আগে।
মঞ্চ প্রস্তুত, সুসজ্জিত
কণ্ঠ তৈরি, সুললিত
ঢলানি মলানিও বলা আছে কিছু, যদি লাগে!
শুধু কি তাই, কবি আসছেন বলে ব্যাকস্টেজেও মস্ত হ্যাপা।
কখন কি চান,
প্রোগ্রামের ফাঁকে যদি তামুক টানতে যান!
কিংবা লালপানি
প্রস্তুত সব, কবিদের ওসব দরকার বলেই জানি।
গেল বারের কথা ভুলিনি,
ওসব না পেয়ে সেবারের কবি কি ভীষণ ক্ষ্যাপা!
অবশেষে চমকে গেলাম, যখন কবি এলেন আমাদের কাছে!
ঘৃত-প্রদীপ জ্বাললেন না,
লালপানি বা গাঁজা খেয়ে টললেন না,
ঢলানি মলানিদের সাথে ঢললেন না!
বক্তৃতার ফাঁকে ব্যাকস্টেজে এসে বললেন, `এখানে কি জায়নামাজ আছে?’
ফি আমানিল্লাহ
আমি ও আমরা
প্রতিদিন মৃত্যুকে দেখি
এক লহমার দূর থেকে
প্রতিদিন।
যেরকম
উড়ন্ত চিলের নখ থেকে
আচমকা খসে যায় একেকটা
কপাইল্যা মাছ, সেইভাবে দৈনিক বেঁচে ফিরি।
পথে, ঘাটে, বাজারে, বন্দরে
মৃত্যুর গায়ের খসখসে কাপড়ের
স্পর্শ পাই, বেঁচে ফিরি কেউ কেউ
ফিরে এলে
নিদাঘ বেলার মতো
মায়েদের তপ্ত হৃদয়
তরপানি শেষে ফেলে স্বস্তির শ্বাস।
পরদিন বের হতে গেলে
দোয়া পড়ে রোজকার মতো বুকে ফুঁক দিয়ে বলে,
`বাপ আমার, সাবধানে যাস।`
আখিরাত
মৃত্যুকে দুহাতের তালুর মাঝে তুলে ধরে
মোনাজাতের মতো মেখে নিই চেহারায়।
এরপর?
এরপর এক বর্ণনাতীত অপূর্ব ঘটনা ঘটে যায়!
যেমন ঘটনার কথা কখনোই শোনো নাই তুমি
ঘটতে দেখো নাই কখনও
এমন কী কল্পনাতেও নয়!
কী সেই ঘটনা?
বললাম না, অপূর্ব, অভূতপূর্ব, অকল্পনীয়, বর্ণনার অতীত সেই ঘটনা?
তবে এর বর্ণনা দিই কোন অভিজ্ঞতায়?
তোমাকে তবে মৃত্যুর অভিজ্ঞতা নিতে হয়,
তারপর তাকে মেখে নিতে হয় মুখমণ্ডলে।
ততদিন তোমাকে কেবল মোনাজাতের অভিজ্ঞতাতেই সুখি হতে হবে।
ভাষার অভাবকে ব্যক্ত করবে তুমি কোন ভাষায় হে…
ধাবমান অশ্বাদির শপথ
যে ঘোড়াগুলো ছুটে চলে ঊর্ধ্বশ্বাসে
বুকের ভেতর থেকে হাপরের মতো বাতাস ছাড়তে ছাড়তে
আমি সেগুলোকে জন্ম দেইনি
যে ঘোড়াগুলো ক্ষুরের ঘায়ে স্ফুলিঙ্গ ছিটিয়ে ছুটে চলে
পাথর দুমড়ে―
সেগুলোকে আমি সৃষ্টি করিনি (বস্তুত সৃষ্টি করিনি কিছুই)
যে ঘোড়াগুলো প্রভাতের প্রথম সূর্যোদয়ের সাথে সাথে
আমার ইশারায় ধুলোর মেঘ উড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুব্যুহে―
তাদের ঘাস-বিচালি কিছুই আমার তৈরি নয়
(শুধু এগিয়ে দেওয়া ছাড়া আর দলাইমলাই ছাড়া
আর কী-ই বা আমি করতে পারি!)
অথচ তবু তারা আমার প্রতি বিশ্বস্ত
অবিচল তাদের কর্তব্যনিষ্ঠা
তাদের প্রভুভক্তি কিংবদন্তি তুল্য
(যেহেতু প্রভুর নির্দেশেই তারা আমার সেবায় নিয়োজিত)
এবার আমার দিকে চাও (কাণ্ডজ্ঞানে আমি ঘোড়ারও অধম হই বলে)
আমার কর্মদোষে সেই সব ঘোড়াদের নাম নিয়ে
শপথ করেছে আল্লাহ
পড়ে দেখি বলা আছে
ওয়াল আদি য়াতি দাবহা―
কলম এক আশ্চর্য অসুখের নাম
ওই যে অর্জুনপাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে
মন্দ্র হাওয়ারা হেথা নিয়ে আসে রোদ
দুপুর স্তব্ধতায়
শ্রবণ― এক তেপান্তরের মাঠে হারিয়ে যাওয়া
জামের শাখার মৃদু কম্পন
জমাজলে দাড়কিনি মাছের ভগ্নস্থবিরতা
নিসঙ্গ দোয়েলের শিষ―
বিলপাড়ে অদৃশ্য হাওয়ার সঙ্গীত
এই যে আকাশটা পুড়ে যায়
মেঘদল বিহ্বল
নিজেই জানে না বুঝি
কতটুকু ভারি হলে ধারাজল
বইবে ধরায়
কলম―
দৃশ্য ও দৃশ্যাতীতে সংক্রমিত
এক আশ্চর্য অসুখ
কলবে কলবে সব লিখে যেতে চায়