সাদ রহমান

সাদ রহমান

সাদ রহমানের গদ্য ‘ফ্রিডম ও চলমান গভমেন্ট’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২৪

ফ্রিডম বা মুক্তি জিনিসটা সরল বিচারে বড়ই নান্দনিক আর রোম্যান্টিক। কিন্তু বাস্তবতার দিকে গেলে দেখা যায়, এইটা বেশ ইলুশনারি। এর ভিতরে একধরনের গভীর বিভ্রম বা বিভ্রান্তি আছে। আর ক্রিটিকালি তাকাইলে পরে বোঝা যায়, এই বস্তু বড়ই আপেক্ষিক। যদিও আরাধ্য, কিন্তু অসামাজিক, কঠিন এবং প্রায় অসম্ভব একটা গণচাহিদা।

এর কারণ, কখনোই কালেক্টিভলি ফ্রিডম বা মুক্তির সংজ্ঞা তৈরি করা যায় না। ফ্রিডমের ধারণা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে বদলাইতে থাকে। ফলে কালেক্টিভ ফ্রিডম বলতে যেই জাতীয় চেহারা তৈরি করে রাষ্ট্রগুলো, তার আদতে কোনো কালেক্টিভ চেহারা নাই। ফ্রিডম নানাজনে নানারকম, কার্যত রাষ্ট্রকে জাতীয় পর্যায়ে ফ্রিডম নিশ্চিত করতে হইলে নিয়ত পলিসি আর কৌশলগত ফাঁকিঝুকি ইত্যাদির মধ্য দিয়া যাইতে থাকতে হয়। রাষ্ট্র কখনোই আর ভালোমানুষ হইতে পারে না।

মানুষ যখন বিপ্লবে নামে তখন তার কাছে ফ্রিডমের অর্থ সংকীর্ণ থাকে। কারণ বিপ্লবও অন্য একধরনের আবিষ্টতা, বিপ্লবের মধ্যে মানুষ হারমনি ক্রিয়েট করতে বাধ্য হয়। কারণ এই হারমনি ছাড়া তখন সে মারা পড়বে। সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ আমরা পাইতে পারতাম, যদি মানুষ তার বিপ্লবকালীন আবিষ্টতা ও হারমনি বাকি সময়গুলাতেও ধইরা রাখতে পারতো।

কিন্তু বিপ্লব শেষ হইলে মানুষ ‘মানুষে’ ফেরত আসে। আর তখন সে বুঝতে পারে, তার হারমনি ছিল আসলে যুদ্ধাবস্থার একটা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। তার ব্যক্তিগত যুদ্ধ সবে আরম্ভ হইলো। জুলাই মাসের পরে এই চলমান সেপ্টেম্বরে চারপাশে আমরা দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত যেই মহা-গোলমাল দেখতেছি, তার তাত্ত্বিক ভিত্তি বা কারণ এই।

এইটা মৌসুমি বায়ু। নতুন সরকারের এক উপদেষ্টাকে দেখলাম সুন্দর কইরাই সময়টাকে ধরছেন। একটু রাগ কইরা তিনি বলছেন, ‘ধান কাটার মৌসুমের মতো দাবি আদায়ের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে।’ হে হে। সময়টা আসলেই বেশ ক্রিটিকাল, অনস্বীকার্য। কিন্তু সরকার এই সময় বা মৌসুমকে কিভাবে দেখবে ও হ্যান্ডেল করবে তার মধ্য দিয়া নির্ধারিত হবে দেশের মানুষ আগামী দিনে নিরাপদ নাকি নিরাপদ নয়।

কাজেই দেখার বিষয় হইলো, সরকার এই সময়ের চরিত্র বুইঝা সময়টাকে তার পকেটে নিতে পারতেছে কিনা। নাকি নিজেই সে এই সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া যাইতেছে, বা যাবে। শাহবাগে দুই রিকশাঅলা গোষ্ঠীর যেই ভিন্ন ভিন্ন দাবি, সরকার কি এই দুই গ্রুপের কাছেই সমান আস্তাভাজন হওয়ার চিন্তা করতে পারতেছে? নাকি একজনকে আজকে দিয়া কালকে আরেকজনকে দেওয়ার কৌশল নিতেছে?

সরকারকে তাইলে মাথায় রাখতে হবে, আজকের দুই বিপদ কালকে এক বিপদ হবে না। বরং কালকেও দুইটা বিপদই থাকবে, বরং সেইটা তিন বিপদও হইতে পারে। দেশের শ্রমিক জনগোষ্ঠী, পরিচয়-সংকটাপন্ন জনগোষ্ঠী, বা এমনকি চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত সমাজের নানান অংশগুলাও নিজ নিজ মুক্তি ও ফ্রিডমের ধারণাকে রাস্তায় ও গণমাধ্যমে পেশ করতে চাইতে পারে।

আমি বলবো সরকারকে তাই আকৃতি হিসেবে এই ‘দাবিদাওয়া মৌসুমে’র বিরোধীপক্ষ হওয়া চলবে না। বরং সময়টাকে কিভাবে নিজের কইরা নেওয়া যায় তার বিবিধ উপায় ও কৌশল খুঁজতে থাকতে হবে।

২.
নতুন এই সরকার বৈপ্লবিক কারণেই দেশের মানুষের কাছে আস্থাভাজন। কিন্তু সেই তুলনায় মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগের জায়গাটা দুর্বল। আমার মতে, সরকারের তরফ থেকে একটা বড় ধরনের পাবলিক সংলাপের কার্যক্রম আসা দরকার। যেই পাবলিক সংলাপের দুইটা মেইন অবজেক্টিভ থাকবে।

নাম্বার ওয়ান, মানুষ যেইসব দাবিদাওয়া করবে, সরকারই তাদের আগে সেইসব দাবি জনসম্মুখে নিয়া আসার ব্যবস্থা করবে। নাম্বার দুই. মানুষের দাবিদাওয়া শোনার জন্য শহরাঞ্চল থেকে শুরু কইরা গ্রাসরুট পর্যন্ত একটা ‘অস্থায়ী সরকারি কান’ বসানো বা ঘোরানো হবে, যাতে মানুষের দাবি জানানোর জন্য চিৎকার করা না লাগে।

পাবলিক সংলাপের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিসমূহ নিয়া এই এনজিও-বুঝদার সরকারের অভিজ্ঞতা অনেক আছে নিশ্চয়ই। সেইটা তারা কাজে লাগাবে। তবে যেহেতু এই সরকারের রাজনৈতিক মাইন্ডের অভাব আছে, ফলে রাজনৈতিক বিবেচনায় অতো ভালো পাবলিক সংলাপ তারা কইরা উঠতে নাও পারে। সেক্ষেত্রে তাদের কিছু বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত।

শ্রমিক বা ট্রেড ইউনিয়ন ধরনের যতো সংগঠন আছে, সরকারের উচিত তাদের কাছে যাইচা গিয়া কথা বলা। আয়, অর্থ, বৈষম্য সংক্রান্ত যত ধরনের সংস্কার এই সরকার হাতে নেবে, সেইসব যেন আগে দাবি আকারে নাগরিকদের মুখ থেকে উচ্চারিত হইয়া নেয়। এমনকি, দাবিদাওয়াকে কেন্দ্র কইরা সরকার নতুন নতুন ইউনিয়ন ইত্যাদি খোলার বুদ্ধিও কাউকে কাউকে ডাইকা নিয়া দিতে পারে।

চাকরির বাজারের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সার্ভে সরকার নিজ থেকেই করতে পারে, এবং নিজেই সেইগুলা মানুষের সামনে পইড়া পইড়া শোনাইতে পারে। তাতে চাকরির বাজার লাইনে আনতে হইলে যেই সময়টা সরকারের প্রয়োজন, মানুষের কাছে এই সময়টাকে আর অপচয় বইলা মনে হবে না। অন্যদিকে, ডান, মধ্যম ও বাম নির্বিশেষে গ্রাসরুট লেভেলে কাজ করে বা করতে চায় এমন ছোট ছোট রাজনৈতিক দল খুঁইজা বাইর করতে হবে সরকারকে। যারা সরকারের সঙ্গে হায়ারার্কিক্যাল লড়াইয়ে নামবে না, বরং সরকারের সংযোগ-বাহিনী হিসাবে কাজ করবে।

বরিশালের ডা. মনিষা চক্রবর্তীর কথা যেমন মনে পড়তেছে। এরকম বা এর চাইতে আরও কম সেক্যুলার ও কম নামি নেতাদেরকেও কাছে ভিড়াইতে হবে। বলতে চাচ্ছি, নতুন নেতাও বানাইতে হবে, যারা পাবলিক সংলাপের ক্ষেত্রে গ্রাসরুট লেভেলে সরকারের হইয়া পদাতিক হিসেবে কাজ করতে পারে। এইখানে অতি গুরুদ্বপূর্ণ একটা দিক হইলো, ইসলাম বা মুসলিমভাবাপন্ন আইকন ও সেলিব্রিটিদেরকে সঙ্গেও সরকারের বসতে হবে। পাবলিক সংলাপের ক্ষেত্রে পরিবেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করে। ফলে মানুষের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ আছে এমন লোকদেরকে সংলাপের প্রক্রিয়ায় হাজির রাখা খুবই দরকার।

এই ধর্মীয় আইকনদের যে খুব সংলাপ করতে হবে এমন না, কিন্তু তাদের অবস্থানের কারণে মানুুষের আত্মিক সম্মতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।

৩.
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা এইখানে আলাদাভাবে উল্লেখ করা দরকার। চলমান গভমেন্টে তাদের ছায়া সরকারি ভূমিকা বাদেও আরো কিছু ভূমিকা নেওয়ার আছে। সেইসব দিকে তাদেরকে এখনো সেইভাবে মনোযোগ ফেলতে দেখতেছি না।

বিগত আওয়ামী রেজিমের পতনের পরে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে ছোটভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনকে উদাহরণ রাইখা কিছু আলাপ শুরু হইছিল। দুঃখজনক হইলেও সত্যি, সেইসব আলাপ খুব একটা আগায় নাই।

আগের আওয়ামী রেজিমের অপরাধ ও অপরাধীদের ফায়সালা কীভাবে হবে, এই প্রশ্নটাকেই যেন পর্দার আড়ালে নিয়া যাওয়া হইছে। বিচার, প্রতিহিংসা, ক্ষমা, ভুয়া মামলা, রাজনৈতিক ফায়সালা, মব জাস্টিসসহ ইত্যাদি আরও যা যা বিষয় আছে, এইসব আলাদা আলাদা বিষয় নিয়া আলাদা আলাদা আলোচনা হইতেছে না।

তার ফলশ্রুতিতে, দেশের রাজনৈতিক বিদ্যমানতা পুনরায় কীভাবে নিশ্চিত হবে বা প্রতিষ্ঠিত হবে, সেই পুরা আলোচনাটাই হুমকির মুখে পইড়া গেছে। শহরাঞ্চল ও গ্রাসরুট উভয় লেভেলেই মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক পুনর্মিলনের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট ধারণা নাই, এতে বড় শূন্যতা তৈরি হইতেছে। এই শূন্যতা যেমন রাজনীতি-শূন্যতা, তেমনই ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য রাজনীতি-নির্ভরশীলতারও শূন্যতা।

রাজনৈতিক পুনর্মিলন মানেই যে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন নয়, এই কাজটা কাউকে হাতেনাতে কইরা দেখাইতে হবে। এইরকম রাজনীতিশূন্য পরিস্থিতি চলতে থাকলে সরকারের মেয়াদ নিয়াও আস্তে আস্তে অস্বস্তি তৈরি হবে। ফলে আমি বলবো, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতাদের এইখানে বড় ভূমিকা পালন করা দরকার।

এই কাজ তারা সামাজিক প্লাটফর্ম থেকে করবে, নাকি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম থেকে করবে, এইটা তাদের এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়। কিন্তু দেশব্যাপী তাদের গণসংযোগ শুরু করা দরকার। আমার মতে, সামগ্রিক রাষ্ট্রসংস্কারকে মাথায় রাইখা একটা শ্বেতপত্র ধরনের কিছু বানাইয়া তারা সামাজিক পর্যায়ে গণসংযোগ শুরু করতে পারে। তাতে কইরা একই সঙ্গে এই সময়টা যে সংস্কারের সময়, এমন বার্তা মানুষের মধ্যে পৌঁছাবে।

৪.
রাজনৈতিক উইজডম সংক্রান্ত একটা ছোট যুক্তি দিয়া আজকের আলাপ শেষ করি। শুরুতেই যেমন বলছিলাম, এই দাবিদাওয়ার মৌসুমটাকে সরকারের আপন কইরা নিতে পারতে হবে। নিপীড়ক আর নিপীড়িতের মাঝখানে তফাৎ টানা যেমন খুব সহজ, তেমনই আকাঙক্ষাগতভাবে নিপীড়িতের পক্ষে থাকাও খুব সহজ-ই। আমাদের নতুন সরকার ও তার আশপাশ দিয়া চলা সরণি-প্রতিসরণিরা এই বিষয়টা মাথায় রাখলে ভালো করবে।

নিপীড়িতের সঙ্গে তাদের এই যোগাযোগ সর্বত বস্তুবাদী হবে, ব্যাপারটা তা না। এইটা আত্মিক হইতে পারে। ফলে বস্তুগত বিচারে অনেক দাবিদাওয়া মাইনা না নিয়াও রাষ্ট্রের সরকারগুলো তার মানুষের বন্ধু হইতে পারে। যেমন দেখেন, আমরা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সামনে কতো সহজেই মাথা নামাইয়া রাখি। তার বিচার করার মহা-ক্ষমতার সামনে আমাদের আত্মমর্যাদাবান হইয়া উঠতে হয় না। ক্যানো?

কারণ এর ভিতর দিয়া সার্বভৌমত্বের যেই মহাদণ্ড তৈরি হয়, আমরাও তার অংশিদার। ইহাই জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি। প্রজাতন্ত্রের ভিতরে আত্মিক সম্পর্ক গইড়া তুলতে পারলে সেই রাষ্ট্রে সোনা ফলে। এই আত্মিকতার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমরা এক পরিবার–সরকার প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের এই ডায়লগটা সুন্দর হইছে।

লেখক: কবি