সাদ রহমানের কলাম ‘সুগার ড্যাডির কনসেপ্ট’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৪, ২০২০

সুগার ড্যাডির কনসেপ্টকে সমাজ ঘৃণার সঙ্গে দেখে। বলতে চায়, এমনকি নৈতিক অর্থেও সুগার ড্যাডি হওয়া বা বানানো একটা নীতিহীন কনসেপ্ট। এই নীতিহীনিতার বিবিধ ধারা-উপধারা থাকতে হইতো অবশ্য, কিন্তু তার খবর আর কে রাখে! টম ইমাম সাহেব কি আর এত সহজে মুক্তি পায়? একদম পায় না। যদিও টম ইমাম সাহেব সুগার ড্যাডি কিনা, তা নিয়া সন্দেহ আছে। শুনছি উনি নাকি বিবাহ কইরা নিছিলেন। তবু উনাকে, আমার দিক থেকে সুগার ড্যাডিই ধইরা নিতে পারলে, এবং সেই কারণেই উনাকে ভালোবাসতে পারলে— মনে কিঞ্চিৎ ভালো লাগে।

এমনিতে টম সাহেবের বাইরে, সুগার ড্যাডির সমাপতনটা যেইভাবে ঘটে। সর্বপ্রথম সমাজে একজন নৈতিক পুরুষ আর একজন নৈতিক মহিলার মধ্যে এনি সামহাউ বিবাহ সংঘটিত হয়, এবং তার পরে ইনাদের যৌথ প্রচেষ্টায় তাদের মধ্যে একটা নৈতিক মেয়েসন্তানের জন্ম হয়। এর অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে, বিবাহ ঘটামাত্র এইখানে নৈতিকতার যে রাস্তা বা পথ খোলা হইছিল, সেই পথ ধইরাই আপনার আগানো হইলো বাধ্যতা। তারপরে সেই মেয়ের বয়স এরাউন্ড এইটটিন হইলে সেই মেয়ে তার বাবার বয়সী কোনো লোকের সঙ্গে শুইতে চইলা যায়, এবং এর মধ্য দিয়া মেয়েটির নৈতিকতার পতন ঘটে। একইসঙ্গে ওই বাবাবয়স্ক লোকটিকেও সমাজ আর নৈতিক ধরে না। সমাজের দৃষ্টিতে তারা ঘৃণিত হয়, এবং নিজেদের দৃষ্টিতে তারা আউটসাইডার হইয়া যায়।

২.
দ্বিতীয় বিষয় হইলো— সুগার ড্যাডির সঙ্গে পুঁজিবাদী আনুষ্ঠানিকতাগুলির একটা মৌলিক যোগাযোগ আছে, এরকম ধইরা নেয়া হয়। যেমন মেয়েটি তার নিজ অর্থের দ্বারা কিংবা নিজের বাবার অর্থের দ্বারা সম্পূর্ণ নয়, ফলে সে অন্যের অর্থের দিকে ধাবিত হইতেছে। চাহিদাগতভাবে নিজেকে এরকম অসম্পূর্ণ ভাবা বা নৈতিক বোধকে জলাঞ্জলি দিয়া অপর অর্থকে গ্রহণ করা— এই উভয়কেই পুঁজিবাদের দুইটা মৌলিক চরিত্র ভাবা হয়। কিন্তু মোটাদাগে, আমি বলবো যে, এইভাবে ভাইবা নেয়ার মধ্যে একটা বড়সড় গোঁজামিলও আছে। সেই একই গোঁজামিল আমাদের ধইরা নেয়া `পুজিবাদে`ও আছে।

যেমন ধরেন, পুঁজিবাদ আজকের দিনে তার এই বর্তমান শরীরে আইসা না দাঁড়াইলে, পুঁজিবাদের সেই অন্তর্নিহিত শক্তি, যাকে আমরা ডিজায়ার বলি, সেটা কি তবুও আমাদের মানবমনেরই একটা ইনবিল্ড ফিচার না? কোনোভাবেই কি, ইতিহাসের কোনোকালেই কি এই ডিজায়ার হইতে মানব-মানবীরা নিজেদের মুখগুলি ফিরাইতে সক্ষম হইছিল? প্রশ্নটা খুব ফান্ডামেন্টাল, কিন্তু আমরা এই প্রশ্ন করি না। এই না করার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন ট্যাবুও আছে বইলা মনে হয়।

৩.
দুইটা পর্যায়ে লোকেরা এই ট্যাবু তৈরি করে। প্রথম পর্যায়টা হইলো, আধুনিক দুনিয়ার পূর্ববর্তী সব দুনিয়াকেই ইনারা কমবেশি অন্ধকার ধইরা নেয়, এবং আধুনিককে তাহা সত্ত্বেও কিছুমাত্র ক্রিটিকের মধ্যে রাখতে গিয়া আধুনিক দুনিয়ার সকল অনুষঙ্গ-অনুষ্ঠানকে নিপাট আধুনিক `কালে`র মধ্যেই সংকুচিত কইরা আনে। কোনোপ্রকার কম্পারেটিভে আর যায় না। এর ফলে আধুনিক দুনিয়ার সকল কার্যকলাপ তার ঐতিহাসিক লিগ্যাসি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।

দ্বিতীয় পর্যায় হইলো, নিপুণ ও একরোখা কৌশলে ইনারা দুনিয়ার `অনাধুনিক` পর্বগুলিকে বেটার বা মৌলিক ধইরা নেয়, এবং আজকের আধুনিক সময়ের তুলনায় ওইসব সময়কে ক্রমেই সাধু-সন্ত বানাইতে থাকে। প্রকারান্তরে ওই সময়গুলোকে তারা রাজরাজড়া কর্তৃক কেবলই নির্যাতিত বা প্রশ্নাতীত কইরা তুলতে চায়। যদিও সেই নির্যাতক রাজাও যেন আর বাস্তবিক চরিত্র থাকেন না, অনাঙ্ক্ষিত দুঃস্বপ্নের মতোই তাকে গঠন করা হয়। এইখানেও কোনো ঐতিহাসিক লিগ্যাসি রক্ষা সম্ভব হয় না।

মূলত, আধুনিক সময়গুলিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে গিয়া আমরা এই দুইভাবে পৃথিবী হইতে আধুনিক সময়কে ক্রমে বিচ্ছিন্ন করতে থাকি। হয়তো এইটাই নিয়তি ছিল, বা আমার অজানা কোনো মানবিক প্রয়োজনেও এইটা ঘইটা থাকতে পারে।

৪.
কিন্তু— এর ফলে যা হয়, পুঁজিবাদের মানবীয় ফান্ডামেন্টাল অবকাঠামোকে আর প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না। তার বদলে পুঁজিবাদের মস্তবড় বায়বীয় বাহ্যিক শেইপটাই আমাদের আলোচনারত বিষয়। এবং এইভাবে আমাদের ত্রস্ত-ত্রাপিত মনটাই খালি আঘাত খাইতে থাকে।

একটা জিনিস খেয়াল করতে বলবো যে, পুঁজিবাদের পিছনের এই মানবীয় ফান্ডামেন্টাল প্রশ্নটাকে এভয়েড কইরা, আমরা যে ইহার অতিশয় বাহ্যিক শেইপ– যেমন বুর্জে খলিফাকেই শুধু ইন্ডিকেট করি— তা শেষপর্যন্ত আমাদেরকে কী পরিণতি দেয়?

দেয় হইলো, আমাদের সেই গভীর ফান্ডামেন্টাল মানবীয় প্রবৃত্তিকেই যে আমরা কৌশলে অগ্রাহ্য করবো, তার সঙ্গত একটা রাস্তা। এইভাবে ট্যাবুর জন্ম হয়।

বুর্জে খলিফায় বইসা সুগার ড্যাডির মতোন, কটকটা রঙের স্যুট পইরা এই সুবোধ মনটাও চায়— লাগাইতে, নৈতিক কোনো ঘর থেকে আসা একটা এইটটিন বয়সের কচি খুকিকে, যার নৈতিক আবরণকে এক্ষুণি বিচ্ছিণ করা হবে। কিন্তু এই চাওয়া সঙ্গত কারণেই না পাওয়ার সমুদয় গড্ডালিকায় ভাসতে ভাসতে, শেষপর্যন্ত সুগার ড্যাডি নামক একটা বর্গকে ঘৃণা ও ট্রল কইরা ঘোলে সাধ মিটায়।

৫.
বিবাপপ্রথাও ঠিক একই কাজ করে। বিবাহকে `রিজনেবল` আয়ের মানুষ নৈতিকতার পোষাক হিসাবে দেখাইতে বাধ্য হয়, কারণ এছাড়া আর কোনো পথ তার সামনে নাই। যদি থাকতো, তাহলে সে ওই পথেই যাইতো। অর্থাৎ যেই পথ তার আকাঙ্ক্ষা, সেই পথের অপ্রাপ্যতাকে সে অনৈতিকতা ছাড়া আর কি দিয়া অন্যায্য ঘোষণা করবে, অন্তত তার ওই ছোট্ট মাথায়।

তেমনই আজকাল দেখা যায়, উচ্চ আয়ের সমাজে বিবাহপ্রথা ক্রমেই বিলুপ্ত হয়। আর সাধারণ আয়ের মেয়ে বা ছেলেরাও উচ্চ আয়ের মধ্যে ক্রমশ অবলুপ্ত হইতে থাকার মধ্য দিয়া, তারা আসলে বিবাহপ্রথাকেই অবলুপ্ত ঘোষণা করতে থাকে।

লেখক: কবি