সাদত হাসান মান্টোর গল্প ‘টোবাটেক সিং’
প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৮, ২০২০
উর্দু ভাষার কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক সাদত হাসান মান্টোর আজ মৃত্যুদিন। ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম ১৯১২ সালের ১১ মে, পাঞ্জাব লুধিয়ানার পাপরউদি গ্রামে। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ‘টোবাটেক সিং’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
দেশ বিভাগের দু’তিন বছর পর পাকিস্তান ও ভারতের প্রশাসনের উপলব্ধি হলো, সাধারণ বন্দীদের মতোই দু’দেশের পাগলদেরও বিনিময় হওয়া উচিত। যে মুসলমান পাগল হিন্দুস্তানের পাগলাগারদে আছে, তাকে পাকিস্তানে পৌঁছিয়ে দেয়া হবে। আর যেই হিন্দু ও শিখ পাগল পাকিস্তানের পাগলাগারদে আছে, তাকে হিন্দুস্তানের পাগলাগারদের অধীন করে দেওয়া হবে। খোদা মালুম, এ অদ্ভুত বুদ্ধি কার মাথা থেকে প্রথম বের হয়েছিল; আর এটা কতটুকুই বা বাস্তবসম্মত ছিলো! জায়গায় জায়গায় উঁচা পর্যায়ের কনফারেন্স হলো। একদিন পাগল বিনিময়ের দিনতারিখও ধার্য হয়ে গেলো।
যেসব মুসলমান পাগলের আত্মীয়স্বজন হিন্দুস্তানেই ছিলো, তাদেরকে সেখানেই রেখে বাকীদের সীমান্ত এলাকার দিকে রওনা করানো হলো। এদিকে পাকিস্তানে— যেহেতু প্রায় সব হিন্দু-শিখ হিন্দুস্তানে চলে গিয়েছিল, তাই তাদের পাগলদের কাউকেই আর পাকিস্তানে রেখে দেওয়ার প্রশ্ন ছিলো না— সবাইকে পুলিশি হেফাজতে সীমান্তে নিয়ে আসা হলো। এদিকে কী হচ্ছে কে জানে? ওদিকে লাহোরের পাগলাগারদে যখন এই বিনিময়ের খবর পৌঁছুলো, তখন সেখানকার পাগলদের মধ্যে মজার মজার কথাবার্তা শুরু হয়ে গেলো।
একজন মুসলমান পাগল; যে বারো বছর যাবৎ উর্দু দৈনিক ‘জমিনদার’ পড়ত, তাকে তার এক পাগল বন্ধু জিজ্ঞেস করে, ‘মৌলভি সাহেব, এই পাকিস্তান কী জিনিস, একটু ব্যাখ্যা করে বলুন তো।’ তখন সে খুব ভেবেচিন্তে বলে, ‘হিন্দুস্তানের এমন এক জায়গা, যেখানে ক্ষুর প্রস্তুত হয়।’ উত্তর শুনে তার বন্ধু সন্তুষ্ট মনে চলে যায়। এমনিভাবে এক শিখ পাগল অপর শিখ পাগলকে প্রশ্ন করে, ‘সর্দারজী, আমাদেরকে হিন্দুস্তানে কেন পাঠানো হচ্ছে? আমার তো সেখানকার ভাষা জানা নেই।’ সর্দারজী মুচকি হেসে বলেন, ‘আমি সতেরটা ভাষা জানি, হিন্দুস্তানের ভাষা জানি না। হিন্দুস্তানিরা খুব অহংকারী হয়।’
একদিন এক মুসলমান পাগল গোসল করার সময় এত জোরে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে শ্লোগান দিল যে, মেঝেতে পা পিছলে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। পাগলদের মধ্যে কিছু পাগল এমনও ছিল, যারা প্রকৃত পাগল নয়— এদের অধিকাংশ এমন পাগল ছিল; যাদের অভিভাবকরা তাদের মৃত্যুদণ্ড সাজা থেকে প্রাণে বাঁচানোর জন্য অফিসারদের ঘুষ খাইয়ে পাগলখানায় এনে ভর্তি করিয়েছে। এরা কিছু কথা জানত— কেন দেশ ভাগ হচ্ছে? আর এই পাকিস্তান কী জিনিস? কিন্তু প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে এরাও বেখবর ছিলো। দৈনিক পত্রিকা থেকেও কোন উপর্যুক্ত খবর পাওয়া যেত না। আর পাহারাদাররা তাদের থেকেও মূর্খ ছিলো। তাদের কথাবার্তা থেকেও কিছু উদ্ধার করা সম্ভবপর ছিল না। তারা শুধু এতটুকু জানত, কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ নামে এক ব্যক্তি মুসলমানদের জন্য পৃথক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে— যার নাম পাকিস্তান। কিন্তু সেটা কোথায়? কী কারণে প্রতিষ্ঠা হলো? এসবের তারা কিছুই জানত না। ফলে যাদের কিছু কাণ্ডজ্ঞান অবশিষ্ট ছিল, তারা এই বিভ্রান্তিতে পড়ে যায় যে, তারা এখন পাকিস্তানে না হিন্দুস্তানে বা কোথায় আছে? এক পাগল-হিন্দুস্তান না পাকিস্তান, না পাকিস্তানে, না না.. হিন্দুস্তানে’-এই দ্বিধাদ্বন্ধে পড়ে আরো বেশি পাগল হয়ে পড়ে। ঝাড়ু দিতে দিতে একদিন গাছের মগডালে চড়ে বসে, গোড়ালির উপর ভর করে বসে ঝাড়া দুই ঘণ্টা বক্তৃতা করে। যা পাকিস্তান-হিন্দুস্তানের কোন অমীমাংসিত বিষয়ের উপর ছিলো। পাহারাদার তাকে নীচে নামতে বললে সে আরো উঁচুতে ওঠে। পাহারাদার তাকে ভয় দেখায়, ধমকী দেয়, সে গলা ফাটিয়ে বলতে থাকে, ‘আমি পাকিস্তান বা হিন্দুস্তান কোথাও থাকতে চাই না, আমি এই গাছেই থাকবো।’ কোনভাবেই যখন তাকে নামানো গেল না, তখন তীব্র শীতে টিকতে না পেরে আপনিই নেমে এলো। নীচে নেমে হিন্দু ও শিখ ভাইদের সাথে কোলাকুলি করে কাঁদতে শুরু করে। কেননা, তার মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল এ কথায় যে, সে সবাইকে ছেড়ে হিন্দুস্তানে চলে যাচ্ছে।
একজন মুসলমান এমএইচসি পাস করা রেডিও ইঞ্জিনিয়ার; যে অন্য পাগলদের থেকে একটু ভিন্ন ছিল। বাগানের এক কোণে চুপচাপ একাকী পায়চারী করত, পাগল বিনিময়ের খবর শুনে তার মনে ঝড় ওঠে। তার আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। সে তার সমস্ত কাপড়চোপড় খুলে পাহারাদারের কাছে দিয়ে দিগম্বর হয়ে বাগানে ঘোরাফেরা করতে থাকে। চিনেটের আরেক মোটা মুসলমান পাগল; মুসলিম লীগের সক্রিয় কর্মী ছিল। তার অভ্যাস ছিল, দিনে পনের থেকে ষোলবার গোসল করা। নাম ছিল তার মুহাম্মদ আলী। নিজেকে সে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ নামে পরিচয় করাত। তার দেখাদেখি এক শিখ পাগল নাম পাল্টে হল মাস্টার তারা সিং। অতঃপর উভয়ের মাঝে সংঘর্ষ বাধার আগেই দু’জনকে পৃথক কামরায় নজরবন্দী রাখা হয়।
লাহোরের এক যুবক আইনব্যবসায়ী; যে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে পাগল হয়েছিল, যখন সে শুনতে পায় অমৃতসর হিন্দুস্তানের অংশে পড়েছে, তখন খুবই মর্মাহত হয়। এই শহরের এক হিন্দু মেয়ের সাথে তার প্রেম হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত মেয়েটি তাকে ধোঁকা দেয়। তবু সে মেয়েটিকে ভুলতে পারেনি। সে ভারত-পাকিস্তানের নেতাদের নাম ধরে গালাগাল দেয়, যারা ভারতকে দুই টুকরো করে তাকে তার প্রিয়া থেকে আলাদা করে দিয়েছে। এখন তার প্রিয়তমা হিন্দুস্তানি হয়ে গেছে, আর সে পাকিস্তানিই আছে। পাগল বিনিময়ের কথা ওঠার পর থেকেই কিছু পাগলসতীর্থ এই মজনু যুবককে এই বলে সান্ত্বনা দিয়ে আসছে, ‘সে যেন তার মনকে শক্ত রাখে, আবেগে ভেঙে না পড়ে, তাকে অচিরেই তার প্রিয়ার সান্নিধ্যসঙ্গে পাঠানো হবে।’ কিন্তু সে কিছুতেই লাহোর ছাড়বে না। কেননা তার মনে হচ্ছিল অমৃতসরে আইনব্যবসা তেমন জমবে না।
পাগলাগারদের ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে দুই জন অ্যাঙলো-ইন্ডিয়ান পাগল ছিল। তারা যখন জানতে পারে হিন্দুস্তানকে স্বাধীন করে ইংরেজরা চলে গেছে, তখন তারা দুঃশ্চিন্তিত হয়। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, পাগলখানায় তাদের ভূতভবিষ্যৎ নিয়ে। তাদের মর্যাদা কী হবে? ইউরোপিয়ান ওয়ার্ড আদৌ বহাল থাকবে কিনা? সকালের নাশতায় তারা ব্রেকফার্স্ট পাবে কিনা? নাকি পাউরুটির বদলে ভারতীয় চাপাতি রুটি দেয়া হবে? ইত্যাদি।
পাগলাগারদে এক শিখ পাগল ছিলো। দীর্ঘ পনের বছর যাবৎই সে এখানে আছে। আপনমনেই সারাক্ষণ বকাবকি করে। তার সেসব বকাবকির উদ্দেশ্য-বিধেয় প্রায়ই বোঝা যেত না। সে এই পনের বছরে দিনে বা রাতে কখনোই ঘুমায়নি। পাহারাদারের বর্ণনামতে— দীর্ঘ পনের বছরে সে এক মুহূর্তের জন্যও শোয়নি। বরং কখনো চোখ লেগে আসতে চাইলে দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে থাকত। এভাবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার পা ফুলে গিয়েছিল, গোড়ালিও অস্বাভাবিক মুটিয়ে গেছে। দৈহিক যন্ত্রনা সত্ত্বেও সে শুয়ে বিশ্রাম করত না। হিন্দুস্তান-পাকিস্তান দাঙ্গা, পাগল বিনিময়— কোন কথা উঠলে বরং সে চুপচাপ শুনে যেত। কেউ তার মতামত জানতে চাইলে জওয়াবে বলত, ‘উপর দি গড় গড় অ্যানেক্স দি হে ধিয়ানদি দাল অফ দি পাকিস্তান গভর্নমেন্ট।’ কিছুদিন পর সে তার মতামতে সামান্য পরিবর্তন এনে বলতে থাকে, ‘অফ দি পাকিস্তান গভর্নমেন্ট’ এর জায়গায় ‘টোবাটেক সিং গভর্নমেন্ট।’ সে অন্য পাগলদের জিজ্ঞেস করত, টোবাটেক সিং কোথায়? যেখানে তার ঠিকানা। কারো জানা ছিল না এটা পাকিস্তানে না হিন্দুস্তানে। কেউ সাগ্রহে জানাতে এসে বরং নিজেই এই বিভ্রান্তিতে ফেঁসে যেত— শিয়ালকোট আগে হিন্দুস্তানে তো ছিল জানত, কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে পাকিস্তানে। অনিশ্চিত কী? আজকের লাহোর কাল হিন্দুস্তানের অংশ হয়ে যাবে! কিংবা গোটা হিন্দুস্তানই পাকিস্তানে চলে যাবে! আর এ কথাই বা কে বুকে হাত রেখে বলতে পারবে— হিন্দুস্তান-পাকিস্তান দু’টোই একদিন মানচিত্র থেকেই মুছে যাবে না?
এই শিখ পাগলের মামলা বড় জটিল ছিল। দীর্ঘদিন গোসল না করার ফলে চুল-দাড়ি জড়াজড়ি হয়ে পড়েছিল। এ কারণে তাকে খুব ভয়ংকর দেখাত। কিন্তু শিখ লোক ভদ্র ছিল। পনের বছরে সে কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদে জড়ায়নি। পাগলখানার পুরনো রক্ষীর ধারণামতে-টোবাটেক সিংয়ে তার জমিজমা আছে। স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপনকারী জমিদার ছিল। হঠাৎ একদিন মাথায় গোলমাল বেঁধে যায়। তার আত্মীয়রা তাকে লোহার মোটা মোটা শেকলে বেঁধে পাগলাগারদে নিয়ে আসে। প্রতিমাসে একবার তার পরিবারের লোকেরা তাকে দেখতে আসত। তার কুশলাদি জেনে চলে যেত। কিছুদিন এই নিয়মেই চলেছে তাদের আসা-যাওয়া। যখন পাকিস্তান-হিন্দুস্তানের দাঙ্গা শুরু হয়, তখন থেকে তাদের আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তার নাম বশন সিং। কিন্তু সবাই তাকে ‘টোবাটেক সিং’ নামে চিনত। তার কাছে দিন-রাত-সপ্তাহ-মাসের কোন হিশেব ছিল না। কিংবা এখানে— সৃষ্টিকর্তার অদ্ভুত খেয়ালীপনার— জিন্দানখানায় তার কতগুলি বসন্ত কেটে গেছে, সে খবরও তার ছিল না।
কিন্তু প্রতি মাসে যেদিন তার আত্মীয়স্বজন তাকে দেখতে আসত, সেদিন সে আগেভাগেই টের পেয়ে যেত। পাহারাদার তাকে দর্শনার্থীর খবর পৌঁছানোর আগেই— নিজেই এসে উপস্থিত হত পরিবারের সামনে। পাহারাদারকে বলে রাখত, আজ আমার পরিবার আমাকে দেখতে আসছে। সেদিন— সে খুব ভালোমত শরীরে সাবান ডলে গোসল করত। চুলে তেল দিয়ে মধ্যিখানে সিঁথি কাটত। নিজের ওইসব কাপড়, যেগুলো সে কখনোই পরত না— বের করে পরিধান করত। এভাবে সেজেগুঁজে দর্শনার্থীর সাথে সাক্ষাৎ করতে বের হত। তারা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে চুপ থাকত। আর বিড়বিড় করত— ‘উপর দি গড় গড় অ্যানেক্স দি বে ধিয়ানদি ম্যাঙ্গ দি দাল অফ দি লাটিন।’
তার এক মেয়ে ছিলো। মেয়েটি প্রতিমাসে এক আঙুল করে বাড়তে বাড়তে পনের বছরে টগবগে যৌবনে পদার্পণ করেছিল। বশন সিংয়ের মেয়ের যৌবনপ্রাপ্তি বিষয়ে কোন অভিজ্ঞান ছিল না। মেয়েটি যখন অবুঝ শিশু ছিল, তখনও সে বাবাকে দেখে কাঁদত, এখন যৌবনেও বাবাকে দেখে অঝোর ধারায় কাঁদে। পাকিস্তান-হিন্দুস্তান বিষয়ক আলোচনা উঠলেই বশন সিং অন্য পাগলদের জিজ্ঞেস করত, টোবাটেক সিং কোথায়? কারো কাছে আশানুরূপ কোন জওয়াব না পেয়ে তার অস্থিরতা দিনদিন বাড়ছিলো।
এখন তার পরিবারের আসা-যাওয়া থেমে গেছে। প্রথম প্রথম তো তার আপনা-আপনিই অনুমান হয়ে যেত, কেউ তাকে দেখতে আসছে। কিন্তু এখন তার হৃদয়ের জানলা বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ এলে তাকে খবর করা লাগত। সে এ আশায় বুক বেঁধে থাকত— যারা তাকে দেখতে আসে, তার জন্য ফলমূল, মিঠাই ও নতুন পরিধেয় নিয়ে আসে— তাদের কাছে টোবাটেক সিং কোথায়— এ প্রশ্ন করলে তারা কোন আশানুরূপ উত্তর দিয়ে তার অশান্ত মনকে শান্ত করে দিবে— টোবাটেক সিং পাকিস্তানে বা হিন্দুস্তানে। কেননা, তার বিশ্বাস ছিল-তাকে যারা দেখতে আসে তারা টোবাটেক সিং থেকেই আসে— যেখানে আছে তার জমিজমা। তার পুরনো ঠিকানা।
পাগলাগারদে এক পাগল ছিল; যে নিজেকে ‘খোদা’ বলত। একদিন বশন সিং তাকে জিজ্ঞেস করে, টোবাটেক সিং কোথায়? সে স্বভাবসুলভ অট্রহাসি দিয়ে বলল, কোথাও না। কারণ, আমি এখনো কোন হুকুম দিইনি— তাকে কোথাও স্থির করিনি। বশন সিং বেশ ক’বার এই ‘পাগলখোদা’র কাছে মিনতি জানায়, যেন সে এইসব ঝুটঝামেলা মিটে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু ‘খোদা’ তাকে এই বলে ফিরিয়ে দেয়— সে এরচে-ও জরুরি কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যস্ত আছে। একদিন বশন সিং বিরক্ত হয়ে তাকে ধমক দিয়ে বসে— ‘উপর দি গড় গড় অ্যানেক্স দি বে ধিয়ানদি ম্যাঙ্গ দি দাল অফ দা হে গুরুজী দ্য খালেসা এন্ড দ্য হে গুরুজী কি ফাতাহ..জো বোলে সের নেহালেসত আকল’-পাঞ্জাবি ভাষায় তাকে গালাগাল করতে থাকে। হতে পারে সেগুলোর মর্মার্থ এমনি কিছু— ‘তুমি বেটা হিন্দুর ভগবান! শিখের ভগবান হলে নিশ্চয় আমার কথা শুনতে।’
পাগল বিনিময়ের দিনকয় আগে ‘টোবাটেক সিং’ থেকে বশন সিংয়ের এক মুসলমান বন্ধু তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে। সে আর কখনোই আসেনি। পাহারাদার দর্শনার্থীর কথা বললে বশন সিং সাক্ষাৎ করতে এলো। কিন্তু তাকে এক পলক দেখেই আবার ফেরৎ যেতে উদ্যত হলো। পাহারাদার বলল, এ তোমার সাথেই দেখা করতে এসেছে টোবাটেক সিং। তোমার বন্ধু ফজলউদ্দীন। বশন সিং ফিরে তাকিয়ে ফজলউদ্দীনকে দেখে বিড়বিড় করে— ‘উপর দি গড…’ ফজলউদ্দীন এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলে— ‘আমি অনেক দিন যাবৎ ভাবছিলাম, তোমাকে দেখতে আসব; কিন্তু সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তোমার পরিবার-পরিজন সবাই ভালোভাবেই হিন্দুস্তানে গিয়ে পৌঁছেছে। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ছিল; করেছি। তোমার মেয়ে রুপকোর…’ সে এই পর্যন্ত বলে থামে। হয়তো সামনের কথা বলার জন্যে বড় দম নেয়। বশন সিং বিড়বিড় করে কিছু মনে করার চেষ্টা করে-‘আমার মেয়ে রুপকোর…!’
ফজলউদ্দীন থেমে থেমে বলে— হ্যাঁ..ওইতো… ওইতো সে— ও খুব ভালো আছে। সবার সাথে সেও চলে গিয়েছিল। বশন সিং চুপচাপ। ফজলউদ্দীন দম নিয়ে বলতে শুরু করে— ‘যাবার আগে তারা আমাকে বলে গিয়েছিল, আমি যাতে তোমার খোঁজখবর নিই। শুনছি-তুমিও হিন্দুস্তান যাচ্ছো। ভাই বলবীর সিং ও দোদা সিংকে আমার কথা স্মরণ করিয়ো। বোন আমরত কোরকেও আমার কথা বোলো। ভাই বলবীর সিংকে বোলো, ফজলউদ্দীন সন্তুষ্ট আছে। দু’টো মহিষ ফেলে গিয়েছিল। প্রথম একটার বাচ্চা হয়। পরে দ্বিতীয়টারও বাচ্চা হয়েছিল, কিন্তু ছয়দিন পর বাচ্চাটা মরে যায়। আমার জন্যে তোমার কোন খেদমতের সুযোগ থাকলে বলতে সংকোচ কোরো না। আমাকে সর্বদাই পাশে পাবে। তোমার জন্য কিছু রসোগোল্লা নিয়ে এসেছি।’ বশন সিং মিষ্টির প্যাকেট পাহারাদারের হাতে দিয়ে ফজলউদ্দীনকে জিজ্ঞেস করে, ‘টোবাটেক সিং কোথায়?’ ফজলউদ্দীন বিস্মিত হয়ে বলে, ‘কোথায় হবে? যেখানে ছিল সেখানেই।’ বশন সিং পুনর্বার প্রশ্ন করে-‘পাকিস্তানে না হিন্দুস্তানে?’ ফজলউদ্দীন হকচকিয়ে বলল, ‘হিন্দুস্তানে… না না পাকিস্তানে।’ বশন সিং বিড়বিড় করে এ কথা বলতে বলতে চলে গেল— ‘উপর দি গড অ্যানেক্স দি ধিয়ানদি দি ম্যাঙ্গ দি দাল দি অফ দি পাকিস্তান এন্ড হিন্দুস্তান অফ দি ফুরকটে মে।’
পাগল বিনিময়ের সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। দুই দেশের পাগলদের তালিকা সীমান্তরক্ষীদের হাতে এসে গেছে। তারা একটি দিনও ধার্য করে ফেলেছে।
সেদিন তীব্র শীত পড়লো। লাহোরের পাগলাগারদ থেকে হিন্দু ও শিখ পাগলদের নিয়ে কারাভ্যান পুলিশ প্রহরায় ‘অবিগা’ সীমান্তে পৌঁছুলো। দুই দেশের পাগলাগারদের পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট সীমান্ত চৌকিতে বসে প্রাথমিক কাগজপত্র সম্পাদন করলেন। এরপরই শুরু হলো ঐতিহাসিক মুহূর্তটি— পাকিস্তান-হিন্দুস্তানের মাঝে পাগল বিনিময়। যা প্রায় ফজরের ওয়াক্ত পর্যন্ত চলল। পাগলদের কারাভ্যান থেকে নামিয়ে অন্য দেশের অফিসারের হাতে তুলে দেওয়া সহজ ছিল না। কোন কোন পাগল তো ‘নিচেই নামবে না’ বলে গো ধরে থাকে। যারা স্বেচ্ছায় বের হচ্ছিল তাদেরকে বিষয়টির গুরুত্ব বোঝানোই দুষ্কর হয়ে পড়ে। অনেকে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি শুরু করে দেয়। দিগম্বর পাগলগুলো তো কিছুতেই গায়ে কাপড় তুলবে না। যতই বলপ্রয়োগ করে গায়ে কাপড় দেয়া হয়, কাপড় ফেঁড়ে ফেলতে চায়। কেউ কেউ অব্যক্ত ভাষায় গালাগাল করছে। কেউ গলা ছেড়ে গাইছে গান। কেউ হাতাহাতি করছে, কেউ কাঁদছে, কেউ দাঁত কেলিয়ে হাসছে, সব মিলিয়ে সে এক বিচিত্র দৃশ্য! মেয়ে পাগলদের কথা ভিন্ন।
শীতের প্রকোপ এতটাই তীব্র ছিল যে, দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছিলো। পাগলদের অধিকাংশ এই বিনিময়ের পক্ষপাতী ছিল না। তাদের তো এতটুকু ধারণাও কারো ছিল না যে, তাদের নিজেদের ভূমি থেকে উপড়িয়ে কোথায় না কোথায় ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে? যাদের একটু-আধটু বোধশোধ ছিল; তারা শ্লোগান দিতে থাকে-‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’ বলে। দুতিনবার বড় বড় ধরনের গণ্ডগোল হতে নিয়েও থেমে যায়। কোন কোন মুসলমান ও শিখ পাগল এই শ্লোগান শুনে জোশে এসে যায়।
বশন সিংয়ের পালা চলে এলো। ‘অবিগা’— সীমান্তের অপরপারে সংশ্লিষ্ট অফিসার; যে তার নাম নিবন্ধন বইতে তুলছিল— বশন সিং তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘টোবাটেক সিং পাকিস্তানে না হিন্দুস্তানে?’ অফিসার স্মিথ হেসে বলল, ‘পাকিস্তানে।’ এ জওয়াব শুনে বশন সিং টলায়মান পায়ে তার অন্য সঙ্গীদের সাথে গিয়ে দাঁড়ায়। সে অন্য কোথাও যেতে নারাজ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনি তাকে জোরজবরদস্তি করে সীমান্ত পার করতে চায়, কিন্তু সামনে চলা থেকে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। চিল্লায়ে বলতে থাকে, ‘টোবাটেক সিং এখানে, পাকিস্তানে। আমি টোবাটেক সিং ছেড়ে কোথাও যাব না। উপর দি গড় গড় দি… টোবাটেক সিং হিন্দুস্তান মে চলা গিয়া হে।’
কেউ তাকে শান্ত করার জন্য প্রবোধ দেয়, টোবাটেক সিং হিন্দুস্তানে চলে গেছে। যদি না গিয়ে থাকে, তাহলে অনতিবিলম্বে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু সে কোন কথাই শুনতে রাজী না।
যখন তাকে জবরদস্তিমূলক অপরপারে নিতে থাকে, তখন দুই সীমান্তের মধ্যবর্তী এক জায়গায় ফুলে যাওয়া গোড়ালি গেড়ে গায়ের সর্বশক্তি এক করে দাঁড়িয়ে পড়ে। কারো সাধ্য নেই তাকে এখন তার অবস্থান থেকে এক চুল পরিমাণ নড়াবে! পাগল হলেও বশন সিং ভদ্রলোক ছিলো। এজন্যে রক্ষীরা ধস্তাধস্তি এড়িয়ে তাকে তার জায়গায় রেখে বাদবাকী পাগল বিনিময়ের কাজ এগিয়ে নিলো। সূর্য উঠার কিছু আগে নিরব নিস্তব্ধ বশন সিং আচমকা দিগন্ত ভেদকারী এক চিৎকার দিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অফিসার-সেনাবাহিনি দৌড়ে আসে। যে লোক পনের বছর রাতদিন দুই হাঁটুর উপর ভর করে দাঁড়িয়ে ছিল, সে আজ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে মাটিতে— এদিকে কাঁটাতার ঘেরা হিন্দুস্তানের সীমান্ত, ওদিকে একই কাঁটাতারে ঘেরা পাকিস্তানের সীমান্ত— আর মাঝখানে এক টুকরো ভূমি— যার কোন নাম-পরিচয় নেই— সেখানে টোবাটেক সিং মৃত পড়ে আছে।
মাহদী আব্দুল হালিম অনূদিত